দেশের বাম কমিউনিস্ট বা প্রগতিবাজরা নিয়েছেন ভারতের পক্ষে। আজো তারা কাজ করছেন ভারতেরই পক্ষে। বর্তমান আওয়ামী লীগের ভারত তোষণ নীতির মূলে আছেন তারা। বর্তমানে এই প্রগতিবাজরা হয়ে উঠেছেন এক নিখিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা। আর এই বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি হিসেবে তারা রবীন্দ্রনাথকে করে তুলতে চাচ্ছেন বাংলাদেশের মানুষের Culture Hero বা সংস্কৃতি বীর। রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে গড়ে তোলার চেষ্টা হচ্ছে যুক্তিবিহীন অন্ধ ধারণা। রবীন্দ্রনাথের ওপর আরোপ করা হচ্ছে অতিমানবিক গুণাবলি। যার ফলে রবীন্দ্রনাথ যেন হয়ে উঠতে চাচ্ছেন এ দেশের মানুষের জন্য অবতার হিসেবে।
এ দেশের প্রগতিবাজরা প্রমাণ করতে চেষ্টা করছেন যে, রবীন্দ্রনাথ ছিলেন প্রগতিশীল চিন্তার ধারক ও বাহক। রবীন্দ্র ভাবধারা তাই হতে পারে আমাদের চিন্তার প্রসারতা প্রদানে বিশেষ সহায়ক।’ কিন্তু রবীন্দ্র চিন্তা-চেতনা কি সত্যিই প্রগতিশীল ছিল? কী অর্থে তাকে বলতে হবে প্রগতিশীল? কারণ রবীন্দ্র কাব্যে ধ্বনিত হয়েছে হিন্দু পুনরুজ্জীবনবাদী চিন্তা-চেতনা। রবীন্দ্রনাথ তার কবিতায় মানুষকে ফিরতে বলেছেন, বেদ-উপনিষদের যুগে। এর মধ্যে প্রগতিশীল ভাবধারার পরিচয় কোথায়? রবীন্দ্রনাথ বাইরের বিশ্বে ভারতীয় কবি হিসেবে পরিচিত, বাংলাদেশের কবি হিসেবে নন, যদিও তিনি লিখেছেন বাংলা ভাষায়। রবীন্দ্র কাব্যের কোথাও নেই বাংলা ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের কথা; যেমন বাংলা ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের পরিচয় আমরা পেতে পারি মাইকেল মধুসূদন দত্তের সনেটে। কোনো কবিকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উৎস হিসেবে চিহ্নিত করতে হলে মাইকেল মধুসূদনকে করা যেতে পারে; রবীন্দ্রনাথকে নিশ্চয় নয়।
রবীন্দ্রনাথকে বলা হচ্ছে ‘অসাম্প্রদায়িক’। রবীন্দ্রনাথ কতটা অসাম্প্রদায়িক ছিলেন, তা জানি না। রবীন্দ্রনাথের পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার বোলপুরে ২০ বিঘা জমি কিনে সেখানে একটা একতলা বাড়ি বানান। তিনি বাড়িটির নাম দেন- শান্তি নিকেতন। রবীন্দ্রনাথ এখানে ১৯০১ সালে ব্রাহ্মচর্চার আশ্রম এবং একটি আবাসিক বিদ্যালয় স্থাপন করেন। এই বিদ্যালয়ে কোনো মুসলমান ছাত্রের পড়ার অধিকার ছিল না। পরে রবীন্দ্রনাথ এখানে প্রতিষ্ঠা করেন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়। এতে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হয়। তিনি এর জন্য চাঁদা চান ভারতের বিভিন্ন দেশীয় রাজার কাছ থেকে। হায়দরাবাদের নিজাম প্রদান করেন এক লাখ টাকা। এক লাখ টাকা তখন ছিল অনেক টাকা। এরপর রবীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতীতে কিছু মুসলমান ছাত্রের পড়ার ব্যবস্থা করেন। যে ক’জন মুসলিম ছাত্র বিশ্বভারতীতে পড়ার সুযোগ পান, তাদের মধ্যে একজন হলেন সৈয়দ মুজতবা আলী। হায়দরাবাদের নিজাম যদি চাঁদা না দিতেন তবে বিশ্বভারতীতে মুসলমান ছাত্র পড়ার ব্যবস্থা আদৌ হতো বলে মনে হয় না।
আজ তবু রবীন্দ্রনাথকে বলা হচ্ছে আমাদের জাতীয় চেতনার উৎসস্থল হিসেবে। এর আদৌ কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। বাংলার মুসলমান সমাজ রবীন্দ্র চিন্তা-চেতনার দ্বারা কোনোভাবেই প্রভাবিত হয়নি। বাংলাভাষী মুসলমানের মধ্যে সর্বপ্রথম সুন্দর বাংলা গদ্য লিখেছিলেন মীর মশারফ হোসেন (১৮৪৭-১৯১১)। মীর মশারফ হোসেন বাংলা গদ্য লিখতে শিখেন কুষ্টিয়া থেকে প্রকাশিত ‘গ্রামবার্তা’ নামক প্রত্রিকার সম্পাদক কাঙাল হরিনাথের কাছ থেকে। কাঙাল হরিনাথ রবীন্দ্রনাথের পিতার সমালোচনা করেন কৃষক প্রজার ওপর অত্যাচারের কারণে। রবীন্দ্রনাথের পিতা কাঙাল হরিনাথকে খুন করার জন্য গুণ্ডা নিয়োগ করেন। কিন্তু হরিনাথের পক্ষে বিপুল জনসমর্থন থাকায় রবীন্দ্রনাথের পিতার এই উদ্দেশ্য সফল হতে পারেনি। এটা ঠাকুর পরিবারের জন্য হয়ে আছে বিশেষ কলঙ্কজনক ইতিহাস।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম আরম্ভ হয় ১৯২১ সালের জুলাই মাস থেকে। এর কয়েক মাস আগে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার পি জি হার্টগ সাহেবকে নিয়ে আসা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি করে। এই বিশ্ববিদ্যালয় গঠিত হয় কতকটা বিলাতের লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুকরণে। এর চালচলন ছিল বিলাতি। কিন্তু বাংলাভাষী হিন্দুরা সব সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বলতে চেয়েছেন মুসলমান প্রভাবিত বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে। যেটা মোটেও সত্য নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহর ছিল বিশেষ অবদান। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য দান করেছিলেন অনেক জমি। কিন্তু তিনি মারা যান ১৯১৫ সালে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলে পূর্ববাংলার মুসলমান সমাজে একটি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আবির্ভাব হতে থাকে। তাদের প্রভাবে বাংলাভাষী মুসলমান সমাজে আসা সম্ভব হয় একটা বিশেষ মানসিক জাগরণ। বিশ্বভারতীর সাথে সে জাগরণের কিছুমাত্র সম্পর্ক নেই। বিশ্বভারতীর কর্মকাণ্ড আরম্ভ হয় ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্বভারতীর মধ্যে তুলনা করতে গিয়ে ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার মহাশয় লিখেছেন ‘১৯২২ সাল হইতে ১৯৪৭ সালের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্রসমাজ যে কৃতিত্বের পরিচয় দিয়াছেন তাহার সহিত তুলনা করিলে ঐ সময়ের মধ্যে বিশ্বভারতীর কৃতিত্ব এ বিষয়ে নগণ্য বলিলে বিশেষ অত্যুক্তি হইবে না।... কেবল চিত্রকলা ও নৃত্যগীত অনুষ্ঠানকে ইহার ব্যতিক্রম বলা যায়। এই দুই বিষয়ে বিশ্বভারতীর অবদান অনস্বীকার্য।’ (বাংলাদেশের ইতিহাস; চতুর্থ খণ্ড)। কিন্তু আজ আওয়ামী লীগের তথাকথিত প্রগতিবাজরা বোঝাতে চাচ্ছেন রবীন্দ্রনাথের জন্য সৃষ্টি হতে পেরেছে বাংলাভাষী মুসলমান মানসে বিরাট জাগরণ। যেটাকে ঐতিহাসিক সত্য বলে স্বীকার করা যায় না। বাংলাভাষী মুসলমানের জাগরণে বিশ্বভারতী কোনো অবদান রাখেনি; অবদান রেখেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
লেখকঃ এবনে গোলাম সামাদ
সূত্রঃ এই লিঙ্কে জানView this link
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে মে, ২০১২ সকাল ১১:৪০