কি অবলীলায় তাদের প্রত্যেকের কথা আমি মনে রেখেছি!
১. ১৯৯৯ সালের প্রথম দিককার ঘটনা। ইন্টামিডিয়েট পরীক্ষা চলছে। ঢাকার বকশি বাজারের একটা কলেজে আমার সিট পড়েছে। ইংরেজি দ্বিতীয় পত্র পরীক্ষা শেষে পলাশী হয়ে বাড়ি ফিরছি। ফুটপাথের পাশে একটা চায়ের দোকান দেখে বসেছি চা খাওয়ার জন্য। খদ্দের বলতে আমি আর সাদা চুল-দাঁড়িওলা এক বয়স্ক লোক। ছোট-খাট ভিষণ রোগা টাইপের এক বুড়ো। কিন্তু আমি বিষ্ময়ের সাথে লক্ষ্য করলাম লোকটার চোখ গুলো ঠিক যেন জ্বল জ্বল করছে। অসম্ভব তীক্ষ্ন এক জোড়া চোখ! মুখটা মৃদু হাসি হাসি। আমাকে অবাক করে দিয়ে তিনি হঠাৎ করেই আমাকে প্রশ্ন করলেন- ‘ কী? পরীক্ষা কেমন হলো?’ চমকে গিয়েছিলাম প্রথমে। কেননা, আমাকে তার চেনার কথা না বা আমি যে পরীক্ষা দিয়ে ফিরছি সেটাও তার জানার কথা না। আমার চমকানো দেখে বুড়ো আরো একটা মজার কথা বলেছিলেন পরিস্কার মনে আছে। তিনি বলেছিলেন,‘ আমি কিন্তু ছেলেধরা না। তোমার হাতে স্কেল আর পকেটে পরীক্ষার প্রশ্নের কোনা বের হয়ে আছে দেখে বুঝলাম তুমি পরীক্ষা দিয়ে আসলে.’.। এরপর লোকটার সাথে আরো কিছুক্ষণ কথা হলো। কথায় কথায় জেনেছিলাম খুলনা অঞ্চলের এক হিন্দু পরিবারের তার জন্ম হলেও তিনি একজন Converted Muslim এবং চিরকুমার। ধর্মান্তরিত হওয়ায় তার পরিবারের সবাই তাকে ছেড়ে চলে গেছে। বেশির ভাগই আর এই দেশে থাকে না, ইন্ডিয়ায় সেটেল্ড। শুধু তিনিই রয়ে গেছেন। সাভার এলাকায় একটা মসজিদে মুয়াজ্জিনের সাথে রূম শেয়ার করে থাকেন। আর এলাকার ছোট ছোট বাচ্চাদের প্রাইভেট পড়ান। তবে তিনি এও বলেছিলেন বেশির ভাগ বাচ্চারা গরীব হওয়ায় তাদের বাবা-মা’রা তেমন টাকা পয়সা দিতে পারে না। তাই তাকে অতি গরীবী হালে দিন পার করতে হয়। আমার মনে আছে লোকটা বলছিল, সংসার পরিজন না থাকলেও তিনি অসুখি নন। কি যেন একটা কবিতার দুই লাইন আওড়ে শুনিয়েছিলেন। ততক্ষণে আমার চা খাওয়া শেষ হয়ে গেছে, আমি বিদায় নিয়ে বাড়ির পথ ধরেছি।
২. নতুন চাকরী পেয়েছি ২০১০ সালে। ওকালতির স্বাধীন পেশা ছেড়ে আসার পর নিজেকে রীতিমতো জেলখানার কয়েদি মনে হচ্ছিল। যাই হোক, যে সময়কার কথা বলছি, তখন ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে আমার পোষ্টিং জয়পুরহাট জেলায় । ২০১১ সালের মাঝামাঝি কোন সময়ে একদিন দুপুরের দিকে সদর থানার পুলিশ একটা মহিলা আর চারটা বাচ্চা কে নিয়ে আসলো। মহিলাটি মাঝ বয়সী, সাথে বড় মেয়েটির বয়স ১৫/১৬ , পরের মেয়েটি ১০/১১, তার পরে আরো একটি মেয়ে ৫/৬ বছরের আর একটা ছোট বাচ্চা ছেলে মহিলার কোলে ছিল- সেটার বয়স ২/৩ হতে পারে। যে পুলিশ তাদের এনেছিল তার চোখ মুখে হন্তদন্ত ভাব। জানা গেল এই মহিলা আর চারটি বাচ্চাকে নিয়ে সদর থানার পুলিশ সারাদিন ব্যাপক ঝামেলার মধ্যে দিয়ে গেছে। খোঁজ নিয়ে আরো জানলাম- তাদের পাওয়া গেছে জয়পুরহাট রেল স্টেশনের কাছে। এবং আরো জেনে অবাক হলাম যে, এরা সবাই নাকি (বাচ্চা গুলো সহ) ট্রেনের নিচে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করতে যাচ্ছিল!! আশপাশের লোকজন ধরে তাদের আটকিয়েছে। আমার চেম্বারে ওদের কে বসিয়ে খুব ধীরে ধীরে জানতে চাইলাম, এমন কাজ তারা কেন করতে যাচ্ছে? বাচ্চা গুলোই বা আত্মহত্যার কি বোঝে? মহিলা খুব বেশি প্রশ্নের উত্তর দেয়নি। তবে বড় মেয়েটিকে বেশ ইন্টেলিজেন্ট মনে হয়েছে। সে খুব শান্ত ভাবে বলেছিল তারা ঢাকার আশকোনা এলাকায় ভাড়া থাকে। বাবা চাকরীর কি এক ঝামেলায় পড়ে নিরুদ্দেশ। মাস ছয়েক বাসা ভাড়া দিতে পারে না। ঘরে টাকা পয়সা সব শেষে। তাদের মা নাকি বলেছে অন্য কোন আশ্রয়ে যাওয়ার চেয়ে মরে যাওয়া ভালো । দুদিন আগে তারা ঢাকা থেকে ট্রেনে উঠে পড়ে। তারপর কয়েকটা স্টেশন ঘুরে জয়পুরহাট নেমেছে। তারা আর বাঁচতে চায় না। বড় মেয়েটা যখন এই কথাগুলো বলছে, তখন তার ইমিডিয়েট ছোটটা নিজে থেকেই বলে ওঠে- ‘আমরা আর ঢাকায় যাব না, আমরা মরে যেতে চাই’। তিন নম্বর মেয়েটার হাতে একটা চিপসের প্যাকেট। সে আনমনে চিপস খেয়ে যাচ্ছে। একদম ছোটটা মায়ের কোলে ঘুমিয়ে।
ওদের এই ধরণের কথাবার্তা শুনে, আমার মনে আছে সেদিন এক ভয়াবহ মানসিক চাপের মধ্যে পড়েছিলাম। বাচ্চাগুলোর দিকে তাকাতেই আমার ‘তাহিতি’র কথা মনে পড়ছিল। একই সাথে মনে হচ্ছিল এই ছোট ছোট বাচ্চারা আত্মহত্যার কি বোঝে? এই মহিলা কি ঠিক কথা বলছে? বাচ্চাদের কেই বা এধরণের কথাবার্তা কিভাবে শেখাবে? আমি তাদের পোষাক-পরিচ্ছদ দেখে অবিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আবার প্রচন্ড মায়া হচ্ছিল ওদের জন্য। এভাবে বিশ্বাস-অবিশ্বাস আর ইমোশনের গ্যাড়াকলে থাকতে থাকতেই পুলিশের সহায়তায় ঢাকায় খোঁজ করা হয়। সেই মহিলার নিকট আত্মীয়ের সন্ধান মেলে এবং তারা তৎক্ষণাৎ ওদের কে নেয়ার জন্য ঢাকা থেকে রওনা দেয়। পরদিন থানা থেকে ওদেরকে সেই আত্মীয়ের সাথে বাড়ি পাঠানো হয়। বাচ্চা গুলো যাবার আগে আমাকে বলেছে দোয়া করতে। আমি অন্তর থেকে ওদের দোয়া করেছি। আমি পাপী মানুষ জানিনা আমার দোয়া কাজে লাগবে বা লেগেছে কি না। তবে যাবার সময় বাচ্চা গুলো হাসি দেখেছি। ওই ছোট ছোট সুন্দর মুখে ‘আত্মহত্যা’র কথা মানায় না।
***********************************************************************
পৃথিবীতে কাটানো আমার বিগত ৩ যুগে এমন অনেকের সাথে জীবনে একবার মাত্র দেখা হয়েছে নেহাত ঘটনাচক্রে। তারা আমার কেউ না, আমিও তাদের কেউ না। তবু তাদের কথা কখনো কখনো মনে হয়, জানতে ইচ্ছা করে তারা কেমন আছে। আজ এই নিশুতি রাতে একলা ঘরে শুয়ে আছি। হঠাৎ করেই ওদের কথা মনে হওয়ায় এতগুলো কথা বলা হল।
কাছের ও দূরের প্রত্যেকটা মানুষ ভালো থাকুক।
শুভরাত্রি।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে আগস্ট, ২০১৭ রাত ১২:৫২