অবেলায় রুমে ফিরে ঘুমিয়ে পড়েছি। মাঝরাতে ঘুম ভাঙল। বিছানা-বালিশ হাতড়িয়ে দেখি সিগারেট নেই একটাও। সিগারেটের কথা মনে পড়তেই রতনের কথা মনে পড়ল। রাস্তার ওপাশের গলিতে উঠেছে কয়েক মাস । সিগারেট লাগত না হয়ত। আবার ঘুমিয়ে পড়লেই হত; কিন্তু ততক্ষণে ফোনের চাবি টিপে দিয়েছি, 'মামা, সিগারেট কিনছ,' স্বভাবসুলভ আবদার করে বসলাম 'কয়েকটা সিগারেট লাগত।' সংকোচ জাগে, আবার মুহূর্ত বাদেই ফিরে আসে মনের লয়, সিগারেট না লাগলেও তা সঙ্গে থাকা ভাল—বিশ্বস্ত সঙ্গী ।
বিশ্ব চরাচরে কোথাও একটা অস্বস্তি তৈরি হয়। নিজেকে অকারণ আর অদ্ভুত ঠেকে। এমন আধোবাধো স্বরে চাইতে গেলাম রতনের কাছে! ওর কাছে তো সিগারেট না-থাকার প্রশ্ন আসে না, প্রতি রাতে প্যাকেট ধরে সিগারেট কেনে সে! না কি উল্টোটাই হলো, সৌজন্যতার খেলাপ কোনো!...
'আসো।' রতন ফোন কেটে দেয়। দু’ মিনিটেই ওর ফ্ল্যাটের দোড়গোড়ায় পৌঁছে যাই। বারান্দার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে একটা সিগারেট বাড়িয়ে দেয় রতন। একটা সিগারেট!—বিস্ময়টুকু গিলে ফেলতে হয়। নিশাচর মানুষ আমরা, বন্ধু'র তো ভালোই জানার কথা, আরও কয়টা সিগারেট লাগবে রাত কাটাতে আমার। সেও তবে বুঝতে চাইছে না আর!
গত কয়েকদিনে দু’একবার মাত্র দেখা হয়েছে, একদম খোঁজ করিনি ওর। বিষণ্ন আনমনা দেখেছি প্রত্যেকবার—নিজেকে অপরাধী লাগে । এজন্যই বোধকরি প্রশ্নটা বেফাঁস বেরিয়ে গেছে—দোস্তো, 'সিগারেট দাও' না বলে বলেছি, 'সিগারেট আছে' । এক হাত ব্যবধানে থেকেও কেউ কাউকে দেখতে পাচ্ছি না আজকাল! আঁচটাও কি তখন আমার কাছে পৌঁছেনি, সিগারেট নাও থাকতে পারে আজ রতনের কাছে!
'একটা?' সাদা-হলুদ শলাকাটাকে নতচোখে দেখি, মৃদু একটা বিস্ময়ধ্বনি বাতাসে ভাসিয়ে দিই, সেটুকুও অনেক চেষ্টার। কোনো কথা না বলে ঘুরে দাঁড়ায় রতন। ভিতর থেকে ম্যাচসহ আরেকটি সিগারেট এনে আলতো করে গুঁজে দেয় আমার হাতে। কেউ কোনো কথা বলি না। ফিরে আসার জন্য পা বাড়াই। অন্ধকারে ঝরে থাকা শুকনো পাতাগুলো বাতাসে ফিসফাস করে ওঠে।
দ্বিতীয় সিগারেটটির সাথে যে প্রশ্নের উদয় হয়েছে তাকে মাথায় নিয়ে হাঁটতে থাকি। ম্যাচ কেন, ম্যাচটিও কেন দিয়ে দিল রতন আমাকে! ওর কাছে বাড়তি ম্যাচ থাকার কথা নয়। একটা ভীষণ মানে হতে পারে এর—সিগারেট নেই আর ওর কাছে। পাঁচ মাসের বড় আমি রতনের চেয়ে, এবং প্রিয় বলেই নয়; ছেলেটি তুখোড়—বরাবরই আমি তার প্রশংসা করে এসেছি। নিজেকে হালকা করে ফেলি। বারান্দার নিচের একটা লতাগাছে কীভাবে যেন জড়িয়ে গিয়েছিল পা—আলতো করে ছাড়িয়ে নিয়ে বেরিয়ে আসি গলির থেকে। অন্ধকারে ঝরে থাকা শুকনো পাতাগুলো বাতাসের সাথে কথা বলার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে।
মন পিছন ফিরতে চেয়েছিল, এখন হনহনিয়ে হাঁটছে পদযুগল। 'একটা সিগারেট খাব আজ বাকি রাতটুকুয়।' আর, কাল সকালে ঘুম ভাঙার আগেই ওর শিয়রের কাছে গুটিকয় সিগার রেখে আসতে চাই । ভাল দু'টো সংকল্প দাঁড় করিয়ে ফেলি। দরজার চাবিতে পাক ঘুরাতে গিয়ে আবার টের পাই, সেরকম হবে না আসলে, ঘুম ভাঙতে আমারই দুপুর হয়ে যেতে পারে। আমার মতো খোর ছেলের সিগারেট নিয়ে কোনো পরিকল্পনা হতে পারে না। কিন্তু ভালবাসার মূল্যটুকু দিতেই হবে! একটি সিগারেটে পাড়ি দিব বাকি রাতটুকু! ঘুমিয়ে হোক, বা জেগেই। দরজার ছিটকিটা ভাল করে লাগিয়ে দিই।
বাঞ্ছাগুলো মলিন, কখনো পূর্ণ হবে না হয়ত ! না হোক! বিষ্যুদবার রাতের এই দ্বিতীয় সিগারেটটি লিঙ্গপরায়ণতায় স্ফূর্তি এনেছে জানলে রতন খুশিই হবে—নির্ভেজাল বলে উঠবে, চিয়ার্স!
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে আগস্ট, ২০১৫ রাত ৯:২৫