somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দিল্লি মারকাজের সমাধান কোন পথে?

২২ শে জানুয়ারি, ২০১৭ বিকাল ৪:৫৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




দূর ইতিহাসের একটি প্রশ্ন দিয়ে বিষয়টির অবতারণা করা যাক। তা হল, ইসলামি খেলাফতের ইতিহাসে সঙ্কটের সূচনা কবে থেকে? এ নিয়ে নানা মুনির নানা মত। তবে শাহ ওয়ালি উল্লাহ দেহলবির একটি মন্তব্য এই রকম যে, এর সূচনা হজরত উমর রা. থেকে। তাঁর বিশ্লেষণ হল, যদি হজরত উমর রা. শুরা-পদ্ধতির আশ্রয় না নিয়ে খলিফ আবু বকর রা-এর মতো সরাসরি কাউকে মনোনয়ন করতেন, তাহলে সমস্যা তৈরি হওয়ার অবকাশ হতো না। বরং তার গঠিত ছয় সদস্যবিশিষ্ট শুরা-কমিটির মতানৈক্যের পথ ধরেই ইতিহাসে পরবর্তী সকল নেতিবাচক ঘটনা ঘটতে থাকে।

এ হল অতীতের সঙ্কটের মূল চিহ্নিতকরণে জগতবিখ্যাত ধর্মীয় পণ্ডিত শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলবীর মন্তব্য বা সিদ্ধান্ত। কিন্তু আমাদের অলোচ্য বিষয়ে সমস্যা বা সঙ্কটের মূল কোথায়? কীই-বা এর সমাধান? এ নিয়ে এ-ওর দিকে আঙুল তুললেও তা সমাধানের চেষ্টা থেমে নেই। যদিও তা একান্ত চুপিসারে এবং বিশেষ সতর্কতার আশ্রয়ে। এই চেষ্টার একটি অংশ হিসাবেই বর্তমান লেখাটি তৈরির ইচ্ছে জাগে। এ লেখার কোনো কোনো মন্তব্যে কারো মনে আঘাত লাগলেও লাগতে পারে। তাই এ-জন্য পূর্বেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। লেখাটির উদ্দেশ্য, কারো তোষণ বা বিরুদ্ধতা-পোষণ নয়; বরং গভীরে হাত রেখে সমাধানের দিকে এগোনো। তবে এ লেখার সামগ্রিক বিষয়ে বা আংশিক মন্তব্যের প্রতি-মন্তব্য চলতে পারে অধিকতর গ্রহণযোগ্য একটি পাটাতন তৈরির উদ্দেশ্যে। কারণ, ছোট ছোট আলোচনা ও প্রস্তাবনাতেই মুক্তির বড় রকমের পথ উন্মুক্ত হতে পারে। কবির কথায়: “ছোট ছোট বালি কণা, বিন্দু বিন্দু জল; গড়ে তোলে মহাদেশ সাগর অতল।” তাই ছোট ছোট বালি ও বিন্দু বিন্দু জলকে জড়ো হওয়ার অবকাশ দিতে হবে। এগুলোকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিলে তা নভোম-লে ঘুরে বেড়াবে। তবে তা বেশিদিন নয়, বরং মহাকালের বিচারে তা একেবারে সামান্য সময়, এক সময়ে বিশাল বৃষ্টি বা শিলা বৃষ্টি হয়ে তা ভূমিতেই ফিরে আসবে বড় কোনো বিপর্যয়কে সঙ্গে করে। তাই অনুরোধ, স্বার্থান্ধতার ক্ষুব্ধতা নয়, চাই ভবিষ্যৎ-মুখী চিন্তার নিরিখে সাগরসম গভীরতা ও পাহাড়সম দৃঢ়তা।

হজরতজি এনআমুল হাসান রহ-এর ইন্তেকালের পর একক এমারত/ নেতৃত্ব নয়, বরং নির্বাচিত সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত শুরা-কমিটিই বিশ্বব্যাপী প্রচলিত তাবলিগের কার্যক্রম পরিচালনায় নিয়ামকের ভূমিকা পালন করে আসছে। একক নেতৃত্বের শূন্যতায় মাওলানা সাদ সাহেব এমারতের দাবি তুলছেন বলে শোনা যায়। তিনি নেতৃত্বের যোগ্য কি-না, শুরার সিদ্ধান্তের বাইরে তিনি নিজেকে আমির দাবি করতে পারেন কি-না, তা ভাবার বিষয় বৈ কি? তবে মনে হয়, এই সব পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনার সুবাদেই সাদ সাহেব-কর্তৃক প্রদত্ত নানা বক্তব্যের চুলচেরা বিশ্লেষণ শুরু হয়। বোঝা যায়, দীর্ঘদিন থেকেই সুনিপুণভাবে সাদ সাহেবের বক্তব্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। এ-সব বক্তব্যের ন্যায্যতা যাচাইয়ের জন্য ভারত উপমহাদেশের ঐতিহ্যবাহী ইসলাম ধর্মীয় বিদ্যাপীঠ দারুল উলুম দেওবন্দের ফতোয়া বিভাগে পাঠানো হয়। তাবলিগের নানা আচরণ ও বক্তব্য নিয়ে কওমি ওলামা-সমাজে এক ধরনের কানাঘুষা থাকলেও এর আগে এভাবে কারো বক্তব্য ফতোয়ার কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছে কি-না, জানা নেই। কিন্তু এবারে অভাবিত এবং বেশ সুচারুভাবে তা সম্পন্ন হল!

স্বীকার্য, দারুল উলুম দেওবন্দ একটি ঘরানার দাবিদার। ইসলামের ইতিহাস ও বাণী ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে তাদের স্বকীয় অবস্থান থাকাটা বিচিত্র কিছু নয়। আবার অপরাপর ধর্মীয় ঘরানার মতো নিজের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও মতামতকে অবিকল্প ভাবার যে প্রবণতা, তা থেকেও এ মুক্ত নয়। দারুল উলুম দেওবন্দ জন্মলগ্ন থেকেই ইসলাম ধর্মের বাইরের নানা বিষয়ে যেমন নিজের অস্তিত্ব জানান দিয়ে থাকে, ইসলাম ধর্মীয় নানা পথ ও মতের ব্যাপারেও নিজস্ব ধারা অনুসরণ করে থাকে। আর এ নিরিখেই প্রতীয়মান হয় যে, মাওলানা সাদ সাহেবের কতিপয় বক্তব্য যেমন দেওবন্দ-পোষিত চিন্তার বিপরীত, তেমনই কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা এক ধরনের চ্যালেঞ্জ। দেওবন্দের মতো একটি সুপ্রাচীন ধারার প্রতি কেউ যদি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে বসে, তাহলে ক্ষিপ্ত হবার সম্যক অবকাশ বিদ্যমান, অন্তত মানবিক অবস্থান থেকে।

আবার এটাও সত্য যে, তাবলিগের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা ইলিয়াস রহ. ধর্মীয় জ্ঞান-জগতে খুব উঁচু মাপের মানুষ ছিলেন না। এব্যাপারে কেউ প্রত্যয় করে কেউ কিছু না বললেও মৌন সম্মতি দিতে কুণ্ঠিত হবার কথা নয়। ইসলামের প্রথাগত শিক্ষাগ্রহণ করার পর সাধারণ মানুষকে কীভাবে ইসলামের মৌলিক করণীয় বিষয়ে অভ্যস্ত করানো যায়, এনিয়ে তার মনের গভীরে এক রকমের দহন তৈরি হয়। এই দহনের একটি পর্যায়ে বর্তমানে প্রচলিত তাবলিগ জামাতের উদ্ভব ঘটে। কিন্তু তিনি একা পথ চলতে চান নি। নিজ ঘরানার প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞ আলেম-ওলামাদেরকে এবিষয়ে সন্তুষ্ট ও সংশ্লিষট করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যান। ধর্মের নামে নতুন কোনো পদ্ধতির আবিষ্কারে কালে কালে যুগে যুগে অনেক বাধাবিপত্তির মুখোমুখি হওয়ার ইতিাহস বেশ পুরনো। মাওলানা ইলিয়াস রহ. উদ্ভাবিত এ পদ্ধতিটিও এর বাইরে নয়। তবে তিনি নিজ ভাবনা ও কর্মের ব্যাপারে একান্ত নিষ্ঠাবান ও কর্মঠ ছিলেন বলে আলেম-সমাজের নেতিবাচক আচরণে ক্ষুব্ধ হন নি। আরো অধিক ধৈর্য নিয়ে তাদের সম্মতি ও সহায়তা আদায়ে তৎপর হন। এবং তিনি যেহেতু ছিলে আত্মভোলা, স্বার্থহীন মানুষ; তাই নেতৃত্ব নয়, বরং আত্মনিবেদনের মাধ্যমে সহায়তা প্রার্থনা করেন। তার এ নিবেদনই তৎকালীন আলেম-ওলামার সম্মতি ও সহায়তা আদায়করণে বড় রকমের ভূমিকা পালন করে। শুধু তাই নয়, নিজ ভাতিজা ও মেয়ের জামাই মাওলানা জাকারিয়া একজন বিজ্ঞ আলেম এবং নিরলস কলমপেষা স্কলার। তিনি এই কর্মপদ্ধতির পক্ষে কলম ধরেন। সাধারণ জনতার ধর্মবোধ তৈরিতে জাকারিয়া রহ. একে একে নানা গ্রন্থ রচনা করেন। তাবলিগের সাথীদের উদ্দেশ্যে রচিত তার গ্রন্থগুলো যতটা পঠিত, অন্যান্য বিষয়ে রচিত অপর গ্রন্থগুলো ততটা নয়। আর হ্যাঁ, নবোদ্ভাবিত পদ্ধতি হিসাবে তা নিজ ঘরানা ও ভিন্ন ঘরানার কাছে সমালেচনার অন্ত ছিল না। জাকারিয়া রহ. এ জামাতের উপযোগিতা ও বাস্তব কার্যকারিতা দেখে সকল সমালোচনার জবাব দেন বেশ আন্তরিকতার সাথে এবং শরয়ি দালিলিক ভিত্তিসহকারে। ইলিয়াস রহ. এতে উৎসাহ পান। তিনি তখন দেওবন্দ ঘরানার তুখোড় ও মেধাবীদের এতে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করতে থাকেন। আলেম-ওলামাকে গুরুত্বদানের যে নির্দেশ কুরআন-সুন্নায় বিদ্যমান, তার যথাযথ মূল্যায়নে ইলিয়াস রহ.-এর কোনো কসুর ছিল না। এ জন্যই দেওবন্দ-সাহারানপুর সম্মিলিতভাবে এই দাওয়াতি কাজের সহায়তা দিতে থাকে।

ভুলে গেলে চলবে না যে, এটি একটি দাওয়াতি দল মাত্র। এরা দাওয়াত দিয়েই ক্ষান্ত। দাওয়াতের বিষয়ে, বা ইসলামের অপরাপর বিষয়ের পঠন-পাঠনে এদের সামান্যতম আগ্রহ নেই। এমন-কি দাওয়াতি কাজের বাইরে কাউকেই এ ব্যাপারে উৎসাহিত করা হয় না। যারা গণ্ডমূর্খ, কাগজের পাতায় দস্তখত করতে গেলে কলম ভেঙে যায়, পৃষ্ঠা কুঁচকে যায়, শুধু তাই নয়, নিচেকার টেবিল চাপ সামলাতে গিয়ে নাকাল হয়ে পড়ে, তাদের কথা না হয় বাদই দিলাম। যারা মাতৃভাষাসহ একাধিক ভাষায় দক্ষ তাদেরও উৎসাহিত করা হয় না। আরো দুঃখের কথা হল, দাওয়াত ও তাবলিগের সঙ্গে সরাসরি জড়িত, এক চিল্লা-তিন চিল্লা বা জীবন চিল্লার কীর্তিমান সেই কওমি ঘরানার আরবি-উর্দু-ফার্সি-জানা লোকরাও গণ্ডিবদ্ধ পড়াশোনার বাইরে একান্ত নিস্পৃহ! হাজারে-লাখে দু-একজন যারা আছেন, তাদের বক্তব্য শুনে, আল্লাহর কারিশ্মা দেখে চোখ ছানা বড়া হয়ে উঠলেও নিজেরা পাঠের স্বাদ নিতে চান না। বরং সেই সব স্কলাররা পর্যন্ত অধিক পাঠের ব্যাপারে সতর্ক করেন, শঙ্কিত হন! কেন তারা পাঠের ব্যাপারে এতোটা শঙ্কিত, এমনতর প্রশ্নের উত্তরে কেউ কেউ বলেন, “সাহাবাদের জ্ঞান ছিল সীমিত। কিন্তু জানা ও মানার মাঝে কোনো ব্যবধান ছিল না। এজন্যই তাদের সময়ে এত বরকত ছিল। বর্তমানে জ্ঞান আছে, সে পরিমাণে আমল নেই। তাই বরকতও নেই।” জ্ঞানজাগতিক বিস্ফোরণের যুগে তারা কম জ্ঞান নিয়ে বেশি আমল করে অধিক বরকতের ভাগীদার হতে চান! আমার মনে হয়, তারা বিশেষ মেধাবী বা পড়ুয়াদেরও পাঠের প্রতি উদ্বুদ্ধ করতে চান না এই শঙ্কায় যে, তাতে সামান্য হলেও বৌদ্ধিক জাগরণ ঘটতে পারে। জাগরণ মানে কৌতূহল, প্রশ্ন, আরো জানার আগ্রহ। এভাবে ব্যক্তিক জাগরণ ঘটলে জামাতগত শৃঙ্খলায় নানা রকম সমস্যা দেখা দিতে পারে। শঙ্কাটা অমূলক নয়। এ ধরনের শঙ্কা কাটানোর উপায় খোদ ইসলামেই আছে, তা তাদের বোধে কাজ করছে মনে হয় না। তবে এটা সত্য যে, নিস্তরঙ্গ নেতৃত্বে যে নিরাপত্তা আছে, প্রশ্নসঙ্কুল পরিবেশে তা নেই।

তাবলিগ জামাতেরও অবশ্য পাঠ্য আছে। যেমন আছে রাজনৈতিক দল জামাত-শিবিরের নির্ধারিত পাঠ্য। আমাদের দেশের পীর-মাশায়েখবৃন্দের দল ও ভক্তদেরও নির্ধারিত সিলেবাস রয়েছে। কেউ পড়েন ‘আনিসুত্তালিবিন’, কেউ ‘কারামাতে আওলিয়া’, কেউ পড়েন ‘দরুদ ও ওজায়েফ’, ‘চিশতিয়া কাহানি’, ‘কাদেরিয়া বয়ান’ নামের নানা বই। এদের মাঝেও লাখে বা হাজারে কেউ হয়ত ভিন্ন পথে পা রাখেন। তারা আবার এগুলোকে নিজস্ব ধারার ফিল্টারে ছেকে ভক্ত-শ্রোতাদের পরিবেশন করেন। তাই ইসলামের চৌদ্দশত বছরের সুবিশাল স্রোতের গর্জন তাদের কানে পৌঁছয় না। আর এজন্যই তাদের গণ্ডির বাইরে কাউকেই ধর্তব্য বলে গণ্য হয় না। তাবলিগও ঠিক এসব দলের মতোই অন্ধজনদের অসামান্য খোয়াড়। তাবলিগিরা বয়ানে-আচরণে এটা বুঝিয়ে থাকেন যে, এদের বৃত্তের বাইরে যারা আছেন, তারা কেউই ততটা স্বচ্ছ ও তাকওয়াবান নন, যতটা তারা নিজে। দেওবন্দ-ঘরানা এতোদিন সম্মিলিতভাবে এ ধরনের বয়ান ও বক্তব্যের বিপক্ষে দাঁড়ান নি। এবার বক্তব্য আকারে, অন্তত ভার্চুয়াল জগতে তাদের চিন্তাধারা ও অস্তিত্বের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়ায়, অস্বস্তিতে পড়েন। নড়ে-চড়ে বসেন এবং ফতোয়া জারি করেন। খুব সতর্কভাষায় তা জনসমক্ষে প্রকাশও করেন।

তাবলিগের শুরু থেকেই দেওবন্দের সঙ্গে ঘনিষ্ট সম্পর্ক বজায় রাখে। তাই দেওবন্দ হয়ত নীরবে তা সমাধানের চেষ্টা করে। যদিও সে চেষ্টার রূপ-প্রকৃতি আমাদের জানা নেই। আমাদের চোখে পড়ছে দেওবন্দের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ফতোয়সহ নানা বক্তব্য-বিবৃতি। কিন্তু দিল্লি মারকাজের তা নেই। যারা দাওয়াত ও তাবলিগের সঙ্গে জড়িত, তাদের প্রায় সবাই এ ধরনের প্রচার মাধ্যমের প্রতি বিশেষভাবে অনীহ। তাই তাদের মন-মানিসকতা ও চিন্তা-চেতনার সঙ্গে পরিচিত হওয়া যাচ্ছে না। এব্যাপারে তাদের আত্মপক্ষ সমর্থনমূলক বক্তব্যও নেই! উল্টো দিকে, দেওবন্দ ঘরানার, বিশেষত বাংলাদেশি তরুণরা ক্ষোভ ধামাচাপা দিতে গিয়েও ব্যর্থ হচ্ছেন। কেউ কেউ বিষ উগড়ে দিচ্ছেন বায়োবীয় অন্তর্জালে অপরপক্ষের বক্তব্য অনুধাবন করার ন্যূনতম চেষ্টা না করেই। তবে কারো কারো আন্তরিকতা ও সমাধানের আকুলতা মনে আশা জাগায়।

যে সব বিষয়ে দেওবন্দ ভিন্ন মত পোষণ করে, সে সব বিষয়ে সাদ সাহেবের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ আমাদের জানা নেই। এসলাম ধর্মে নানা বিষয়ে একাধিক মতামত রয়েছে। তা কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরস্পর বিরোধী। সাদ সাহেব যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা পেছনের কোনো মুসলিম ধর্মীয় পণ্ডিতের প্রতিধ্বনি বা ছায়াপাত কি-না, বলা যাচ্ছে না। দেওবন্দ নিজ চিন্তাস্রোতের বাইরের কারো ব্যাপারেই ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করে না। তা পোষণ না করুন। কিন্তু কথায় কিন্তু ছিঁড়ে ভিজে না; লাঠিতে অন্ধকার দূর হয় না। তাই মনে হয়, নিজেদের মধ্যেকার এই ভুল বােঝাবুঝির জন্য আইনের আশ্রয়, তথা ফতোয়ার আশ্রয় নেওয়া যুক্তিযুক্ত হয়নি। মহাকালের একটি পর্বে দেওবন্দকে এই ফতোয়ার জন্য নির্ঘাত শরমিন্দা হতে হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।

গ্রাম্য সমাজে একটি কথা প্রচলিত আছে, আদালতে কোনো সমাধান নেই। সমাধান পঞ্চায়েতে অর্থাৎ পারস্পরিক শালিশিতে। এক যুগ, দুই যুগ পার করে, অনেক টাকা-পয়সা, মান সম্মান ব্যয় করে, অগণিত তিক্ততা অর্জন করে, অপরকে নানাভাবে পীড়ন করে শেষপর্যন্ত পঞ্চায়েতেই সমাধান হয়। বলতে দ্বিধা নেই, সে পঞ্চায়েতে দেওবন্দ আপাতত ব্যর্থ। কিন্তু আশার কথা হল, পঞ্চায়েতের সময় কখনোই পার হয়ে যায় না। এর জন্য কোনো সময় নির্ধারিত নেই। তবে ফতোয়া যে ব্যর্থ, তা কিন্তু দেখতেই হচ্ছে। আবার ফতোয়ার কারণে যে তিক্ততার সৃষ্টি হল, এর ঝাঁঝ দীর্ঘদিন রয়ে যাবে।

দেওবন্দ ধারার ফতোয়াকেন্দ্রিক এই ভজঘট পরিস্থিতি এবারেই নয়, অতীতে আরো একাধিকবার হয়েছে। কোনো সমাধান আসে নি। শাখা-প্রশাখা বিস্তারের মাধ্যমে দেওবন্দ যেহেতু সচেষ্ট এবং অবশ্যই সম্প্রসারণশীল, তাই তাদের প্রাধান্য বজায় থাকে সত্যি। যদিও এই প্রাধান্য শুধু উপমহাদেশের নিরিখে মাত্র। যেমন বেরেলি-মওদুদি গোষ্ঠীর ব্যাপারে তাদের নিজস্ব ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ রয়েছে। কিন্তু এ দিয়ে দেওবন্দের কী লাভ হয়েছে? ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে যেহেতু তাদের নিজস্ব ঘরানা রয়েছে, তারা তা দিতে পারেন। কিন্তু দেওয়ার পর ইসলামের আওতাভুক্ত অপরাপর দলগুলোকে দাওয়াতি মানসিকতায় কাছে টানার কোনো নজির আছে কি? জানা নেই। তাহলে দেওবেন্দর উদ্দেশ্য কি বিবাদ-বিভেদ তৈরি করা? তা অবশ্যই নয়; হতে পারে না। কিন্তু ধারাবাহিক কর্মকুশলতায় তার এই ব্যর্থতা কেন? এর উত্তর দেওবন্দকে খুঁজে বের করতে হবে এবং অত্যন্ত নির্মোহভাবে।

অবশ্য দেওবন্দের ভিন্ন পরিচিতিও আছে। ভারতের মাদরাসাতুল ইসলাহ ঘারানার অন্যতম পুরোধা ব্যক্তি মাওলানা হামিদুদ্দিন ফারাহির বিরুদ্ধে মাওলানা আশরাফ আলী থানবি যখন ফতোয়া জারি করেন, তখন মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানি আল্লামা ফারাহির পক্ষে অবস্থান নেন। এনিয়ে তিক্ততা বেশ চরমে পৌঁছে ছিল। থানবির কঠিন ফতোয়া সত্ত্বেও আল্লামা ফারাহিকে নিয়ে জ্ঞানজাগতিক পরিসরে কৌতূহলের সীমা নেই। দেওবন্দ ঘরানার অনেক শিক্ষার্থীই তাকে নিয়ে উচ্চতর পর্যায়ে গবেষণা-রত, দূরের ভূগোলে তথা মধ্যপ্রাচ্যে তিনি তো বেশ সমাদৃত, চমৎকারভাবে গৃহীত! যেমন মাওলানা আহমদ রেজা খান বেরেলি এবং মাওলানা আবুল আলা মওদুদিকে নিয়েও প্রাচ্যে-প্রতীচ্যে নান রকম গবেষণা হচ্ছে এবং হতেই থাকবে।

দেওবন্দের প্রথম ছাত্র এবং পরের প্রধান শিক্ষক, ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনের নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তিত্ব শাইখুল হিন্দ খ্যাত মাওলানা মাহমুদুল হাসান মাল্টা জেল থেকে ফিরে একটি বক্তব্যে বলেছিলেন, "জেলে বসে অনেক চিন্তা করে মুসলিম উম্মাহর পশ্চাদপদতার দুটি কারণই প্রধান মনে হল: (১) কুরআন থেকে দূরে সরে যাওয়া; (২) পারস্পরিক মতবিরোধ!" গণিতের একটি সূত্রও ঠিক এ রকম যে, ভাজক যত বড় হবে, ভাগফল তত ছোট হবে। সামান্য ভুল বোঝাবুঝির কারণে, তথা মাথা ব্যথার কারণে মাথা কেটে ফেলার উদ্যোগ হঠকারিতার শামিল। কিন্তু এ ধরনের হঠকারিতা থেকে দেওবন্দ কখন ফিরে আসবে? বিশেষত দিল্লি মারকাজের ব্যাপারে ভিন্ন কোনো ভূমিকা পালন করবে কি? তবে সবারই কামনা দ্রুত এর সমাধান হোক। সমাধান তাহলে কোন পথে হতে পারে?

(ক) ফতোয়ার মাধ্যমে নয়, হিকমত ও কৌশলের মাধ্যমে সম্ভব হলে সাদ সাহেবকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া। দেওবন্দের শক্তি ও সম্মান অনস্বীকার্য। কিন্তু তা নিজেদের মাঝে ব্যবহারের জন্য নয়। যেহেতু তা নিজেদের মাঝেকার ভুল বোঝাবুঝির বিষয়, তাই কঠোর কোনো অবস্থান না নিয়ে যাদের কৌশলগত বিনীত আচরণে এর সমাধান হতে পারে, তাদেরকে সে পথ অনুসরণ করতে হবে। এবং অবশ্যই কাদা ছোঁড়াছুড়ির সকল পথ পরিহার করা।

(খ) দেওবন্দের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত একটি চিঠিতে দেখা যায়, সাদ সাহেব রুজু করেছেন, অর্থাৎ দাওয়াতি চিন্তা-চেতনার ব্যাপারে তিনি দেওবন্দি চিন্তার অনুসারী। এর বাইরে তিনি পা রাখবেন না। হ্যাঁ, কিছু ছোটখাটো বিষয়ে তিনি ভিন্নমত পোষন করেছেন। কিন্তু মৌলিক বিষয়ে তিনি যদি একমত হন, তাহলে তাকে আমির হিসাবে মানতে সমস্যা কোথায়?

(গ) তিনি তো কোনো দেশের প্রধান নন। একটি জামাতের প্রধান মাত্র। এবারের সকর্তকতায় হয়ত তিনি পরিশীলিত হবেন, আরো সংযত হবেন। এবং তাকে জানিয়ে দেওয়া যে, তাবলিগি বয়ানে যখন কোনো বিচ্যুতির দেখা দেবে, দেওবন্দ সেখানে সংশোধনমূলন বয়ান প্রকাশ করবে। তাহলে তাদের আপত্তিকর বক্তব্য জনসমাজে আসন গেড়ে বসতে পারবে না।

(ঘ) আমিরের ইমারত বিষয়ে মতানৈক্য রেখে বৃহত্তর স্বার্থে তাকে দিয়ে কাজ চালানো যায় কি-না, ইসলামি শরিয়ায় এ-ব্যাপারে আপাতত কোনো নির্দেশনা পাওয়া যায় কি-না, তা খতিয়ে দেখা।

(ঙ) বর্তমানের নিরিখে অ-আলেম তাবলিগি সাথীদের ব্যাপারে যে সব নেতিবাচক মন্তব্য করা হয়েছে, তা থেকে বিরত থাকা। এবং অবশ্যই তাবলিগি কর্মকাণ্ডে বেশি করে মাদরাসার দক্ষ ও যোগ্য শিক্ষক-ছাত্রদের জড়িত করা। যেন সকল রকমের কলুষতা সহজেই এড়ানো যায়।

অবশেষে একটি তাবলিগি কারগুজারি:-
নিজামুদ্দিনের বাংলাওয়ালি বস্তির কাছেই একটি গ্রামে গোঁড়ামি-মূর্খতার কারণে প্রায় সবাই ধর্মহীন-ধর্মবিরোধী উক্তি করে ফেলে। ধর্মসচেতন কতিপয় মাওলানা আবার তখন প্রথাগত নিয়ম অনুসারেই ফতোয়া দিয়ে বসেন যে, তারা সবাই মুরতাদ হয়ে পড়েছে। তওবা না করা পর্যন্ত তাদের সঙ্গে কোনো রকমের সম্পর্ক রাখা যাবে না। এতে গ্রামবাসী ক্ষিপ্ত হয়। আশে-পাশের গ্রামগুলো আলেমদের ফতোয়া মতে সেই গ্রামের মানুষজনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে। তারা তখন তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠে। তারা আলেমদের ব্যাপারে অসহিষ্ণু হয়ে পড়ে। তাহলে সমাধান কি? নিজামুদ্দিনের এই কেন্দ্রের এক দরদি তাবলিগের সাথী ছদ্মবেশে গ্রামে প্রবেশ করেন। তার মুখে কোনো কথা নেই; শুধু 'লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ'। তিনি উন্মাদের মতো গ্রামের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ঘুরতে থাকেন, আর এ বাক্যটি উচ্চারণ করতে থাকেন। তার চারপাশে মানুষ জড়ো হতে থাকে। তিনি তাদের সবাইকে বলেন, পড়ো লা ইলাহা... সবাই সমস্বরে পড়তে থাকেন। তিনি সবার অবচেতনে মুখ থেকে মৌখিক স্বীকৃতি আদায় করে নেন। তখন একজন প্রশ্ন করেন, "আলেমরা বলছেন, আমরা নাকি মুরতাদ-ধর্মত্যাগী হয়ে পড়েছি?" তিনি উত্তরে বলেন, "না, না, না। তা হতে যাবে কেন? আপনারা তো আমার সামনেই কালেমা পড়লেন! আপনারা এবং আমরা সবাই মুসলমান।" এরপর তিনি সমস্ত গ্রামবাসীকে নিয়ে তাওবার আয়োজন করেন। আলেম-সমাজ ও নিজামুদ্দিনের মারকাজে এ সংবাদ পৌঁছালে, তারা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন।

কী চমৎকার সমাধান! কী অসাধারণ প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব! প্রথাগত ফতোয়াকে না মাড়িয়ে, গ্রামবাসীকে না খেপিয়ে পূর্ববৎ পরিস্থিতি তৈরি হল। আজ তো ইরতিদাদ নয়, ইমারতের মতো সামান্য একটি বিষয়ের সমাধানে দেওবন্দ বা নিজামুদ্দিনে হিকমাহপূর্ণ, প্রজ্ঞামণ্ডিত তেমন কোনো পুরুষ কি নেই? এর জবাব ভবিষ্যতের গর্ভে। সে ভবিষ্যত সুদূর-অদূর সবই হতে পারে। আমাদের শুধু প্রতীক্ষা পালা। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সহায় হোন। আমিন।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জানুয়ারি, ২০১৭ বিকাল ৪:৫৩
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসলামের বিধান হতে হলে কোন কথা হাদিসে থাকতেই হবে এটা জরুরী না

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ১০:৫৫



সূরাঃ ৫ মায়িদাহ, ৩ নং আয়াতের অনুবাদ-
৩। তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে মৃত, রক্ত, শূকরমাংস, আল্লাহ ব্যতীত অপরের নামে যবেহকৃত পশু, আর শ্বাসরোধে মৃত জন্তু, প্রহারে মৃত... ...বাকিটুকু পড়ুন

লবণ্যময়ী হাসি দিয়ে ভাইরাল হওয়া পিয়া জান্নাতুল কে নিয়ে কিছু কথা

লিখেছেন সম্রাট সাদ্দাম, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১:৫৪

ব্যারিস্টার সুমনের পেছনে দাঁড়িয়ে কয়েকদিন আগে মুচকি হাসি দিয়ে রাতারাতি ভাইরাল হয়েছিল শোবিজ অঙ্গনে আলোচিত মুখ পিয়া জান্নাতুল। যিনি একাধারে একজন আইনজীবি, অভিনেত্রী, মডেল ও একজন মা।



মুচকি হাসি ভাইরাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

দেশ এগিয়ে যাচ্ছে; ভাবতে ভালই লাগে

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:০৩


বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল নেতিবাচক। একই বছরে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল প্রায় ১ শতাংশ। ১৯৭৩ সালে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রবৃদ্ধি ছিল ৭... ...বাকিটুকু পড়ুন

×