somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অতি-দীর্ঘ গল্পঃ ফোরটুয়েন্টি'স

০৬ ই জুলাই, ২০১৬ রাত ২:৩৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

গত কয়েকদিনে ফেসবুক-ব্লগ-পত্রিকা-অনলাইন পোর্টাল - সব মিলিয়ে এত এত মানুষের এত এত থিউরি পড়েছি যে - নিজের চিন্তাভাবনাই সব ভুলে যাওয়া শুরু করেছি। এত বড় ঘটনা ঘটলো - ঐটা নিয়ে আমি সত্যি বলতে কিছুই লেখি নাই। না লেখার কারণ - যা বলতে চাই - তা অলরেডি কেউ বলে দিয়েছে। আর, দ্বিতীয় ও বড় কারণটা হল - থিউরি। সবাই ই নিত্যদিন নিত্যনতুন থিউরি বানাচ্ছে। তাই আর আমি কোন থিউরিতে গেলাম না।

যাই হোক - সবাই যখন গোয়েন্দা হওয়ায় ব্যস্ত - তাই আমি আমার তৈরি করা রহস্য উদঘাটনের গল্পই দিচ্ছি। গল্পটা আগেও একবার পোস্ট করেছিলাম। কয়েকদিন রেখে হাইডও করে ফেলেছিলাম। অবশ্য হাইড করা পিছনে বেশ কয়েকটা কারণও ছিল। আরেকবার পোস্ট করার কারণ - বর্তমান পরিস্থিতিতে হালকা কিছুটা সময়ের জন্য মস্তিষ্ককে বিরতি দেওয়া ভাল। তাতে চিন্তাশক্তিই বাড়বে। আর আমাকে বেশ কয়েকজন অনুরোধও করেছিল - গল্পটি হাইড না করে রাখতে। পড়তে আনুমানিক সোয়া এক ঘন্টা থেকে দুই ঘন্টার মত লাগতে পারে। তাই শুরু করার আগে - লম্বা সময় নিয়েই শুরু করা উত্তম। আট-নয়মাস আগের লেখা। ভুল থাকা স্বাভাবিক। পড়ার পর কারো কাছে ভুল ধরা পড়লে - মন্তব্যে জানিয়ে দেওয়ার অনুরোধ রইলো।


যাই হোক... শুরু হোক গল্পটা...





সূচনা

প্রাণীটা লাফিয়ে লাফিয়ে আসছে। উদ্দেশ্য কিছুই না। গায়ে শুধু হাওয়া লাগিয়ে বেড়াচ্ছে। সঙ্গীদের বাকিরাও তার মতই হাওয়া লাগিয়ে বেড়াচ্ছে। কারো কোন ক্ষতি করছে না। তাদেরকেও সবাই এড়িয়ে চলছে। অন্তত তাদেরকে যারা চিনছে – তারা ভালোভাবেই এড়িয়ে যাচ্ছে। আর যারা জানেনা, তাদের কপালে দুর্গতিও আছে। প্রাণী জগতের অন্য প্রাণীরাও তাদের থেকে সাবধানে থাকে। প্রকৃতিগত ভাবে এই প্রাণীগুলোর কিছু ক্ষমতা রয়েছে। আর তারাও যে অন্য প্রাণীদের সাথে বন্ধুত্ব করে সেটাও না। নিজ প্রজাতি ছাড়া অন্য কারো সাথে খুব ভালো খাতিরও জমায় না।

এদের একজন এখন তার সঙ্গীদের থেকে বেশ দূরে রয়েছে। সে ঘুরে বেড়াচ্ছে সমুদ্রতীরবর্তী এলাকায়। জায়গাটা বালিতে পূর্ণ। বালিই তার বেশি ভাল লাগে। লাফানোর পথে কী একটা প্রাণী যেন পড়ে আছে বালির উপর। ওটা আবার নড়ছেও। তারমানে মৃত নয়। তাহলে তার পথ আঁটকে আছে কেন? গেল রেগে!

ক্যাথি ক্রিমসন!
বালিতে শুয়ে থাকা প্রাণীটার নাম। জায়গাটা ক্রোনাল্লা বিচ। সাউথ অস্ট্রেলিয়ার, নিউ সাউথ ওয়েলস-এর রাজধানী সিডনির দক্ষিণ দিকের এলাকাটা। এখানে ঘুরতে এসেছে স্বামী জন ক্রিমসনের সাথে ঘুরতে। হানিমুন না। জন, তার দুই বন্ধুর সাথে ঘুরতে এসেছে।

জন ক্রিমসন, ওয়েন শ, সাদাব রহমান! তিন বন্ধু। অনেকদিন ধরেই চিনে তারা একজন আরেকজনকে। পড়ালেখাও করেছে একই ইউনিভার্সিটি থেকে। পরিচয়টা সেখান থেকেই। গাঢ়ত্বটা বাড়ে, যখন তিনজন মিলে একই অ্যাপার্টমেন্টে রুমমেট হিসেবেও ছিল তারা। অবশ্য প্রফেশনালি সবাই ই এখন আবার আলাদা আলাদা হয়ে গেছে। কয়েক সপ্তাহ ধরে প্ল্যান করে এই উইকেন্ডটা নির্ধারণ করেছে রি-ইউনিয়নের জন্য। ওয়েনও তার স্ত্রী মিসিকে নিয়ে এসেছে। সাধবই এখনও বিয়েটা করেনি। জন থাকেও এই এরিয়াটাতেই। তারই আয়োজন এটা।

ক্যাথি এখন মিসির সাথেই বিচে শুয়ে সান-বাথ নিচ্ছে। আর তিনজন মিলে বিচ ভলিবল খেলছে আরও কয়েকজন অস্ট্রেলিয়ান টিন-অ্যাজারের সাথে।
খেলা শেষ অবশ্য তাদের! ফিরে আসছে।
‘উইকেন্ডটা মনেহয় মারাত্মক কাটবে! আফসোস উইকেন্ডটা মাত্র এই দুই-তিনটা দিনের জন্যই। আরও যদি বড় হত!’ আফসোস করে বললো ওয়েন।
‘ঠিকই বলেছো বন্ধু! আরও কয়েকটা দিন যদি একসাথে থাকা যেত!’ সাদাবও আফসোস করে বললো। আগের দিনগুলো মিস করছে সেও।

কিন্তু কিছুই করার নেই। আফসোস করতে করতেই এগিয়ে চললো তিনজনে মিলে।
প্রথমে কালো-কমলা মিলিত বর্ণের প্রাণীটা দেখলো ওয়েন। প্রাণীটা সম্পর্কে সে জানে। এন্টামোলজিস্ট সে। মেলবোর্নের একটা ইউনিভার্সিটির প্রফেসর! সে তো জানবেই। এগুলো নিয়েই কাজ তার।

‘ক্যাথি! সাবধান! সরে যাও ওখান থেকে।’ প্রাণীটা একদম কাছে এসে পড়েছিল ক্যাথির। তাই সাবধান করা ছাড়া উপায় ছিল না।
‘কেন?’ অবাক হল ক্যাথি। আশেপাশে ভয়ঙ্কর কিছু তো দেখছে না সে, তাহলে সাবধানতার মানে কী!
‘আগে সরে যাও! পরে বলছি! নাহলে তোমাকে মৃত হিসেবে নিয়ে যেতে হবে আমাদের।’ আবারো বললো ওয়েন।
‘কেন!!!’ এবার চারজন একসাথেই অবাক হয়ে বলল। কেউই বুঝতে পারছে না ওয়েনের কথা।

প্রাণীটা একদম কাছে এসে পড়েছে ক্যাথির। দৌড়ে টান দিয়ে তাকে সরালো ওয়েন।
বাকিরা তার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে। চোখে-মুখে কৌতূহল। কী এমন হল যে, ওয়েন এরকম অদ্ভুত আচরণ করছে।
ওয়েনও বুঝতে পেরে বললো, ‘বুঝাচ্ছি! তার আগে বালিতে দেখো!’ একটু আগে ক্যাথি যে জায়গাটায় শুয়ে ছিল সেটার দিকে ইঙ্গিত করলো।

এখনও কেউ ই বুঝেনি। অগত্যা সবাইকে ভাঙ্গিয়েই বলা শুরু করলো ওয়েন।





১...

সকালে ঘুম থেকে উঠার পর থেকেই মেজাজ বিগড়ে আছে আজগর আলীর। জাঁদরেল পুলিশ ইনস্পেক্টর ছিলেন চাকরি জীবনে। বছর দুয়েক হল অবসর নিয়েছেন। মেজাজ বিগড়ে যাওয়ার রোগটা সেই চাকরি জীবন থেকেই। দাগী আসামিদের পিছনে সময় কাঁটাতে কাঁটাতে মেজাজ জিনিসটাকে একদম ভাজা ভাজা বানিয়ে ফেলেছে। চাকরি শেষ, এখন আর পুলিশ অফিসার নয়। কিন্তু মেজাজ খারাপ রোগটা সেঁটেই রয়েছে। তার পরিবার অভ্যস্ত হয়ে গেছে এতে। বরং আজগর আলীর মেজাজ ভালো থাকলেই তারা চিন্তিত হয়ে পড়ে। লোকটা অসুস্থ নয়তো!

তবে আজকের সকালে মেজাজটা খারাপ সম্পূর্ণ অন্য এক কারণে। ফোনে এক মেসেজ এসেছে। ঘুম থেকে উঠে অন্য সবার মত উনার অভ্যাসও মোবাইল চেক করা।
‘Congratulations! You just made our list of painful and surprise dying. You will meet soon with your doom! Just wait. Sorry for keeping you in this waiting time!’
ফাজলামো নাকি!!! কী সব লেখে না লেখে! ‘ফোরটুয়েন্টি কোনখানকার! পাইয়া লই খালি একবার!’ স্বগতোক্তি করলেন আজগর সাহেব।
উনার মেজাজ আরো খারাপ করার জন্যই মেসেজটায় অনেকগুলো ডট দিয়ে নিচে নামটাও লিখে দিয়েছে বার্তাপ্রদানকারীটা। ‘. . . . . . . ---420s’

‘420s’!!!
সহ্যের সীমা অতিক্রম করে ফেলেছে আজগর সাহেবের। মোবাইলটা ঢিল দিয়ে ছুড়ে মারলেন। পাত্তা দিলেন না মেসেজটার। কিন্তু মেজাজ তো গরম হয়ে গেছে। এখন সেটা ভুগতে হচ্ছে তাঁর স্ত্রীকে।
বেচারী! কী আর করবেন! দীর্ঘদিনের অভ্যাস উনারও। আজগর সাহেবের মেজাজ দেখা।

চা দিয়ে ঠান্ডা করলেন আপাতত। তবে আবারো খারাপ হয়ে গেল। কারণ, পত্রিকা হাতে নিয়েছেন এখন। পত্রিকায় আইন-শৃঙ্খলার প্রশংসা করে অনেক লেখা রয়েছে।

****

দুই-তিন দিন পর!
আবারো তার কাছে মেসেজ এসেছে ঐ ‘420s’-এর থেকে।
‘Wait for your doom. A painful death is coming for you. ---420s.’
পরের পাঁচ-ছয়টা দিনও একই মেসেজ আসলো উনার কাছে। সেই ‘420s’ এর কাছ থেকেই।

প্রথম দুই-তিন বার আজগর আলী মেজাজ খারাপ করলেও। পরের দিকে একটু চিন্তিত হলেন। জীবনে অনেক কেসেই কাজ করেছেন। অনেক ধরণের মানুষের সাথেই কাজের অভিজ্ঞতা আছে। অনেক শত্রুও বানিয়েছেন। এরকম হুমকি-ধামকি আসাও নতুন কিছু না। কিন্তু কোন হুমকিতেই হুমকিদাতা তার পরিচয় প্রকাশ করেনি। কাগজে লিখে পোষ্ট করে দিয়েছে। নাহলে মোবাইলে মেসেজ দিলেও ঐ নম্বরটাকে কখনোই খোলা পাওয়া যেত না। কোনরূপ ক্ষতিও হয়নি কোন দিন।

কিন্তু এটা অনেকটা নতুন। প্রায় সাতটা মেসেজ এসেছে উনার কাছে। একই ফোন নম্বর থেকে। নাম্বারটায় তিনি কলও দিয়েছেন। ফোনটা খোলা। কিন্তু কেউ ধরছে না।
আর সবচাইতে অবাক ব্যাপার যেটা, নিজের বা নিজেদের পরিচয়টাও প্রকাশ করে দিচ্ছে।

উনি চাকরীতে থাকার সময় ‘420s’ নামে কোন গ্যাং বা কোন অপরাধীর নামটা শুনেননি। হয়তো পরে তৈরি হয়েছে। কিন্তু পরে তৈরি হলে উনাকে কেন টার্গেট করবে? উনার সাথে কোন সমস্যা থাকার কথা না – ঐ ‘420s’ এর।
ডাটাবেজ-এ ফোন করে খোঁজ নিলেন। এই নামের কোন অপরাধী বা অপরাধী সংস্থার কোন তথ্যই নেই। একদম নতুন কেউ। নতুন কেউ হলে উনার পিছনে লাগবেন কেন? নাকি সত্যিই কোন ৪২০ টাইপের ছেলে তাঁর সাথে মজা করছে?




২...

চোখ মেলার পর কিছু বুঝতে পারছেন না সিরাজ সাহেব। সারা গায়ে চুলকানি হচ্ছে, ঠিক মত শ্বাসও নিতে পারছেন না। হাত দিয়ে শরীরটা বুলিয়ে নিবেন এটাও পারছেন না। হাত দুটো আঁটকে রয়েছে কেন যেন! চোখ জ্বলছে। হুট করে কিভাবে কী হল কিছুই বুঝতে পারছেন না! শরীরের চামড়া চটচটে হয়ে রয়েছে। উঠে একটা গোসল নেওয়া দরকার। কিন্তু কী আশ্চর্য! উঠতেও পারছেন না। চেপে রয়েছেন কেমন করে যেন! আশ্চর্যিত হচ্ছেন শুধু!

****

সিরাজুল ইসলামকে মৃত ঘোষণা করলেন কর্তব্যরত ডাক্তার। অচেতন অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয় সিরাজুল ইসলামকে। ডাক্তারের ধারণা অনেক আগেই মারা গেছেন তিনি। মৃত্যুর কারণটা ধরতে পারেনি ডাক্তারেরা। কোন ধরণের স্ট্রোকের কারণেই মৃত্যু হয়েছে বলে ধারণা করা হল।

সিরাজ সাহেবের ছেলের কাছ থেকে পোস্ট-মর্টেম করার অনুমতি চাইলো ডাক্তাররা। সিফাত, সিরাজ সাহেবের ছেলে সেটার অনুমতি দেয়নি। বয়স হয়েছিল। স্ট্রোক করাটা অস্বাভাবিক ছিল না। আর বাসায় এমন কোন ধরণের আলামতও পাওয়া যায় নি যে এটাকে খুন বলে ধরে নিবে!
স্বাভাবিক মৃত্যুই হয়েছে, এটাই মেনে নিল সিফাত। শুধু একটা আফসোস রয়েছে, ঐ সময়টায় ঘরে কেউ ছিল না। সেও বাইরে, তার মাও বাইরে, বোনটাও কলেজে। ঘরে কেউ থাকলে হয়তো বাঁচানো যেত সিরাজ সাহেবকে।

তবে একটা ব্যাপার নিয়ে একটু দ্বিধাগ্রস্ত সিফাত। তার বাবার বয়স হলেও শরীরে কোন রোগ ছিল না। সাধারণত অতিরিক্ত গরম অথবা চিন্তা এই কারণেই স্ট্রোক করে থাকে মানূষে। এই মুহুর্তে কোন গরম নেই, আর চিন্তায় পড়বেন এমন কোন কারণও ছিল না সিরাজ সাহেবের।
মৃত বাবার লাশটাকে পোস্ট-মর্টেম করতে দেয়নি, কারণ চায়নি কোন কাঁটা-ছেঁড়া করা হোক তার বাবাকে – কিন্তু একটু সন্দেহ রয়েই গেছে।

বাসায় যে ঐ সময় কেউই ছিল না।





৩...

রহমত তার মনের সুখে স্প্রে করে যাচ্ছে। লোকাল ইনসেক্টিসাইড ইরেকশন টিমের একজন এক্সটার্মিনেটর সে। মানে পোকা-মাকড়, কীট-পতঙ্গ এসব নির্মুল করাই তার কাজ। পিঠে একটা পেস্টিসাইডসের সিলিন্ডার বেঁধে হাতমুখ রক্ষা করেই মাঠে নেমে পড়ে ক্ষতিকারক সব কীট-পতঙ্গ ধ্বংস করতে। যাতে করে এরা ফসলের মাঠ বা অন্যান্য কোন জায়গায়ই কোন ক্ষতি করতে না পারে।

আজ এসেছে একটা ধানক্ষেতের কীট তাড়াতে। জমির মালিক খুব চিন্তিত ছিল। লোকাল অফিসটায় জানালো, তার ধানের জমিতে অন্য গোত্রের ক্ষুদ্রাকৃতির প্রাণীরা এসে দখল করে নিচ্ছে। সাথে সব নষ্টও করে দিচ্ছে, সাথে সাথেই পাঠালো রহমতকে। রহমতও খুশি। যত বেশি অ্যাসাইনমেন্ট মাঠে, নির্ধারিত মাইনের বাইরেও আরো কিছু বোনাস পায়। খুশি না হওয়ার তো কারণ নেই। পুরো দুই একর জমি জুড়ে ধান ক্ষেত। একটা অংশে শুধু আক্রমণ করেছে পোকারা। কিন্তু শুধু ঐ অংশে ঔষুধ দিলেই হবে না। তাতে অন্য অংশেও আক্রমণের আশংকাটা থেকেই যাবে। পুরোটা জুড়েই ঔষুধ ছিটিয়ে দিল। তবে, ঔষুধ দিলেই তো শুধু হবে না। পরিমাণমত বুঝে দিতে হবে। নাহলে, পুরো ধানক্ষেত পোকাদের হাত থেকে রক্ষা করতে গিয়ে ঔষুধের কবলে নষ্ট হবে।

এইজন্যই রহমত আলাদা অন্যদের চেয়ে। সে পরিমাণ, অনুপাত এগুলো ঠিকমত বুঝে ব্যবহার করতে পারে। বাকি নির্মূলকারীরা তার থেকেই সব সময় বুঝে যায়।

আপাতত পুরো ধানক্ষেতটাতেই ঔষুধ ছিটানোর কাজ শেষ। এখন ফেরার পথ ধরবে। তবে, যাবার সময় শরীফের দোকান থেকে কিছু ঔষুধ কিনতে হবে। তার স্টকের জিনিস শেষ হওয়ার পথে। লোকাল অফিস তো, সেটাও আবার ব্যক্তিমালিকানায় চলে – তাই সব সরঞ্জামাদি এখনো তাদের ভাণ্ডারে নেই। সব কিছুই কর্মচারীদের আলাদাভাবে সংগ্রহ করে নিতে হয়। অবশ্য খরচটা অফিস থেকেই দিবে। আর শরীফের দোকান থেকেও ঔষুধগুলো আর কাউকে দেওয়া হয় না ওদেরকে ছাড়া। ওর সাথেও আলাদা একটা চুক্তি করেছে। ফলে এইদিক থেকে ইনসেক্টিসাইড ইরেকশন টিম বেশ নির্বঘ্নেই আছে।

‘অ্যা শরীফ! শরীফ!’ হাঁক ছাড়লো রহমত।
‘আর রহমত ভাই নাকি? কিরাম আছো? মেলাদিন দেখাসাক্ষাত নাই।’ রহমত গলার স্বর শুনেই চিনতে পেরেছে। তার সবচেয়ে সেরা খরিদদার। স্বাগত জানালো উষ্ণ গলায়।
‘আরে আছিরে! পুক মাইরা কি আর সংসার চালান যায়!’ দুঃখ করে বলল রহমত। তবে শরীফ জবাব দেওয়ার আগেই সে ই দুঃখ সরিয়ে বলল, ‘যাউকজ্ঞা! তর লগে পরে বমুনে। এহন কাম আছে। আম্রে কিছু বোরিক এসিড দে। স্টক শেষ হইয়া গেছে।’
‘কতানি লাগব? বেশায়া দিমু?’
‘না একটুই দে। বেশি লাগব না। পরে আইসা নিয়া যামু, বৈকালে।’

অল্প কিছু বোরিক এসিড নিয়ে আবার যাত্রা শুরু করলো রহমত। তার বস বলেছিল, কী যেন এক জরুরী কাজ আছে। ঐটা নিয়েই কথা বলবে নাকি!




৪....

আজগর সাহেবের ঘুম নষ্ট হওয়ার পথে। পুলিশ ইন্সেপক্টর হিসেবে অনেককেই সামলাতে হয়েছে, কিন্তু ভয় কোনটাতেই পান নি। কিন্তু এই 420 তাঁকে মারাত্নক ভয় পাইয়ে দিচ্ছে। তিনি নিজেই জানেন না, কেন ভয় পাচ্ছেন ওদেরকে!
420 থেকে মেসেজ আসা এখন কমে গেছে। এখন বেশি বেশি আসে না, সপ্তাহে দুইটা। গতমাসখানেক ধরেই চলছে এটা। নাম্বারও ঐটাই। ফোন দিলে ধরে না। কিন্তু মেসেজে হুমকি-ধামকি কমেনি। মৃত্যুর কথা বলা হয়েছে সবগুলো মেসেজেই। সেটাও ভদ্রভাবে।

কোনভাবেই এগুলোকে ক্রিমিনালিটির সংজ্ঞায় ফেলতে পারছেন না আজগর সাহেব। উনার দীর্ঘ পুলিশ জীবনে কখনোই এরকম কিছুর মুখোমুখি হননি। সন্ত্রাসী হবে সন্ত্রাসীর মত, আচরণ হবে সন্ত্রাসীর মত, সাহসও থাকবে সন্ত্রাসীদের মতই। যত যাই হোক, সন্ত্রাসীরা নিজেদের বাঁচার ব্যবস্থা তো করবে এবং সেটা বুঝাও যাবে। 420 এর এদের সাথে কোন মিলই নেই।
প্রথমেই নাম, 420… নামটাই তো কেমন যেন! খুব একটায় চিন্তার ফেলার মত নাম না। বরং উলটো নিজেদেরকেই খারাপ বানানোর নাম। যে যাই হোক, নিজেকে তো আর 420 বলবে না।
আচরণ একদম ভদ্র। মেসেজ দিচ্ছে ঠিকই মৃত্যুর কথা বলে, কিন্তু কোথাওই হুমকি মনে হয়নি। বরং মনে হয়েছে বহুদিনের পরিচিত বন্ধ্রুর সাথে মজা করছে। সন্ত্রাসীরা এরকম হয় না। তাদের কথাবার্তাই হয় কর্তৃত্বপূর্ণ। কাউকে মারার হুমকি দিলে – ঐ হুমকিতেই মরার দশা হয়। কিন্তু এই 420 এর তো এরকম কোন বাজে সন্ত্রাসীদের মত আচরণই নেই।
ভয় থাকবে একটু। সন্ত্রাসীদের সাহসের এটাই সবচেয়ে বড়গুণ। যত যাই হোক, আমি নিজেকে ফাঁসাবো না। অপরাধীদের প্রথম চিন্তাই থাকে এইটা। কিন্তু আজগর সাহেবকে হুমকি দেওয়া দলটা এরকম না। বরং উলটো নিজেদের নামই জানাচ্ছে যেন! ধরা পড়ার কোন চিন্তা নেই। নাহলে এই আধুনিক প্রযুক্তির যুগে একটা সিমকে ট্র্যাক করা কীই বা এমন কঠিন কাজ। মুহুর্তেই ধরে ফেলা যাবে। তার উপর পুলিশের সাথে ক্ল্যাশে নামলে তো কথাই নেই। সবার আগেই তার জায়গাটা খুঁজে বের করবে পুলিশ। কিন্তু এসব কোন প্ল্যানই নেই তার। বরং চাচ্ছে যেন, সে বা তারা ধরা পড়ুক।

লক্ষণগুলো ভাল লাগছে না আজগর সাহেবের। পুলিশের চাকরী ছাড়লেও এখনো অনেক ইনফরমারই রয়ে গেছে তার। ডিপার্টমেন্টে তার একটা আলাদা পজিশন আছে। সেখানে এক 420 নামের কারো ভয়ে তিনি ন্যুজ্ব হয়ে আছেন সেটা বুঝাতে চাচ্ছেন না। বরং আরো হাসতে পারে সবাই। এত বছরের অর্জন সব 420 এর জন্য এভাবে নষ্ট হোক সেটা চান না। তাই আগেই ইনফরমার দিয়েই জানতে চাচ্ছেন।

ইনফরমারদের কেউ ই তাঁকে সন্তুষ্ট করতে পারলো না। কেউ ই শুনেনি 420 এর কথা। জানেও না এটার সম্পর্কে। খোঁজ খবর তারাও নিল আরো কয়েকজনকে দিয়ে। বলতে গেলে, 420 এর পরিচয় বের করার জন্য মানুষের মেলা বসে গেল – কিন্তু ফল একটাই।

কেউ ই জানে না তাদের সম্পর্কে।

উপায়ান্তর না দেখে ডিপার্টমেন্টেই গেলেন। প্রথমে একটা কমপ্লেন লেখালেন। এখনো জানেন না পুরোপুরি, তাই বেশি ঝামেলায় গেলেন না। ডিউটিতে পুলিশকে সবই খুলে বললেন। ঐ পুলিশও অনেক অবাক। সেও এরকম কিছু শুনেনি। ডাটাবেজ আগেও একবার চেক করা হয়েছিল, আরো একবার হল – কিছুই পাওয়া গেল না।
‘স্যার! খুঁজে পাওয়ার তো কোন উপায়ই দেখছি না!’ বল ঐ পুলিশটা।
‘উপায় একটা আছে। মোবাইল নম্বরটা আছে একটা। ঐটা খোলাও আছে।’ বললেন আজগর আলী।
‘খোলা আছে নিশ্চিন্ত হচ্ছেন কিভাবে স্যার?’ সন্দেহ প্রকাশ করল পুলিশটা। আজগর সাহেবকে বুড়ো পাগল এক অবসরপ্রাপ্ত পুলিশই ভাবছে সে।
‘এই যে কল দিচ্ছি তোমার সামনেই। নিজেই শুনো।’ বলে কল দিলেন আজগর সাহেব। লাউড স্পিকারে কল বাজার বিপ বিপ শব্দটা শোনা যাচ্ছে। একটু পর কেউ ধরলোও, কিন্তু কথা বললো না।
কেঁটে দিয়ে আজগর সাহেব বললেন, ‘এটাকে ট্র্যাক করার ব্যবস্থা করো। দেখো কোথা থেকে আসছে সিগন্যালটা!’

পুলিশ অফিসারটা এখন মাথা কুঁটছে নিজেরই। এটা কেন তার মাথা থেকে আসলো না? আজগর সাহেবের একটা রিপোর্ট হেডঅফিসে গেলে তো আর চাকরিটাই থাকবে না তার। ট্র্যাক করার জন্য নির্দেশ দিল।

****

‘স্যার! লোকেশন পেয়েছি!’ অনেকক্ষণ ধরে ট্র্যাক করেও কোন সিগন্যাল পাচ্ছিল না। সেটা দেখে মেজাজ গরম করে চলে এসেছেন আজগর সাহেব। এসআই এর রুমে বসে রয়েছেন। সেখানেই দৌড়ে আসলো ট্র্যাক করতে থাকা ছেলেটা।
‘কোথায়? কোথায়?’ লাফিয়ে উঠে খুশিতে জিজ্ঞেস করলেন আজগর সাহেব।
‘স্যার! বললে বিশ্বাস করবেন না! নিজেই দেখে যান!’

খুশি মনেই ছেলেটার পিছু পিছু গেলেন আজগর সাহেব। সাথে এস আইটাও। আজগর সাহেব অনেকখুশি। এতদিনে তিনি খুঁজে পাচ্ছেন। এইবার পেলে মেসেজ পাঠানোর ঝালটা ইচ্ছামত উঠাবেন।
কিন্তু কোথায় আছে সেইটা দেখে মুখটা পাংশু হয়ে গেল আজগর সাহেবের! কিন্তু, এটা কী করে সম্ভব?
‘ক্যালিফোর্নিয়া?’ অবাক হয়ে বললেন। ‘কিন্তু নাম্বার তো বাংলাদেশী। আমেরিকা থেকে বাংলাদেশি নাম্বার কী করে ব্যবহার করছে!!!’
তখনই আবার লোকশনটা বদলে গেছে। ‘সাংহাই!’ থেকে সিগন্যাল আসছে এখন। আজগর সাহেব কিছুই বুঝতে পারছেন না। কী করে এটা সম্ভব!





৫....

সকালের মর্ণিং ওয়াকে বের হওয়ার পর থেকে আর কিছুই মনে নেই আনোয়ারুল কবিরের। প্রতিদিনই বের হচ্ছেন হাঁটতে। ডায়াবেটিকটা নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য। কিন্তু আজকে অদ্ভুত একটা ব্যাপার খেয়াল করছিলেন। কেউ একজন তার পিছু নিয়েছিল। মাথা হুডি দিয়ে ঢেকে রাখার কারণে দেখতে পাননি মুখটা। কিন্তু ঐ হুডিওয়ালা লোকটা ছায়ার মতই লেগেছিল তার সাথে। সরেনি একটা বারের জন্যও। প্রথমে ভেবেছিলেন, তেমন কিছুই না। হয়তো তারই মত হাঁটতে বেরিয়েছে। কিন্তু যখন দেখলেন, তিনি বিশ্রাম নিতে বসলে ঐ লোকটাও বিশ্রামে বসে যায়। তিনি উঠলে ঐ লোকও উঠে – তখন কিছুটা চিন্তিত হলেন। সাথে করে ফোন নিয়ে বের হননি। নাহলে তখনি রিপোর্ট করতেন। ঐ লোকের চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে আবার বাসার দিকে রওনা করলেন। তিনি মাথা থেকে ঐ লোকের ঝেড়ে ফেললেও তো ঐ লোক ঝেড়ে ফেলেনি। সে আনোয়ার সাহেবের পিছু পিছুই আসতে শুরু করলো। আনোয়ার সাহেব এটা লক্ষ্য করলেন। দাঁড়ালেন। ঐ লোকটা কাছে আসলে তাকে জিজ্ঞেস করবে, এমন করছে কেন? লোকটা কাছে আসলো ঠিকই। এরপর......

এরপর আনোয়ার সাহেব এখন চোখে অন্ধকার দেখছেন। অন্ধকার না ঠিক, ঝাপসা দেখছেন সব। চোখ কেমন যেন ঘোলাটে হয়ে গেছে। চোখটা প্রচন্ড ভাবে জ্বলছেও। হাত দিয়ে চোখটাকে কচলাতে চাইলেন, কিন্তু হাত আনতে পারলেন না। হাত বাঁধা শক্ত করে। উনি বুঝতে পারছেন উনাকে বসিয়ে রাখা হয়েছে। হাতল ওয়ালা একটা চেয়ার আছে উনার ঘরেই। এটাও বুঝতে পারলেন উনি নিজের ঘরেই আছেন। কিন্তু নিজের ঘরে উনাকে কেন এভাবে বেঁধে রাখবে?

ডাকতে গেলেন উনার স্ত্রীকে। মুখ ‘মমমমম’ ধরণের গোঙানির শব্দ বের হল। কথাও বলতে পারছেন না এখন। মুখও বেঁধে রাখা হয়েছে। যাতে কোন শব্দ না করতে পারেন। কিন্তু কেন? তিনি নিজেও বুঝতে পারছেন না।

ঘরটায় কারো হাঁটার শব্দ শুনতে পেলেন। হাত মুখ বন্ধ করলেও কানটা এখনো খোলাই। ওটা দিয়েই যতটা পারা যায় নিজেকে রক্ষা করতে হবে। শব্দটা উনার দিকেই এগিয়ে আসছে। ভাবলেন, এখনই হয়তো মারধর শুরু করবে। উনি নিজের বাসায় আছেন এটা শুধু উনার একটা ধারণা। সত্যিই আছেন কিনা জানেন না। কোথায় আছেন সেটাও জানেন না। নিজের বাসায় হোক বা অন্য কোথাও উনাকে যে অপহরণ করা হয়েছে সেইটা ভাল ভাবেই বুঝতে পারছেন। অপহরণটা যে টাকার জন্যও করা হয়নি সেটাও জানেন। কারণ, টাকার জন্য করলে উনাকে না করে পরিবারের অন্য কাউকেই করতো। মোটিভ একদম পরিষ্কার। উনাকে মেরে ফেলা হবে। শব্দটা যতই কাছে আসছে, আত্না ততটাই কাঁপছে আনোয়ার সাহেবের। এখনই হামলে পড়বে তার উপর।

শব্দটা একসময় থেমে গেল। বুঝতে পারছেন লোকটা এখন তারপাশেই। আঘাতটা করবে। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে তার শরীরের উপর তরল জাতীয় এক পদার্থ ঢেলে দিল।
আনোয়ার সাহেব হাঁ হয়ে গেল। এটা কী ধরণের মজা!!!
বন্দীর মত করে বেধে রেখে ঢাললো শুধু পানি? এটার জন্যই এতক্ষণ তাকে আঁটকে রেখেছিল? স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন যেন।

****

আনোয়ার সাহেবের মৃতদেহটা চিৎকার করে উঠলেন নাজমা বেগম। সকালে আনোয়ার সাহেবকে জগিং-এ রেখেই তিনি বেরিয়ে গিয়েছিলেন। কয়েক ঘন্টা পরে এসে দেখেন এই অবস্থা।
ডাক্তার ডাকলেন। ডাক্তাররা বললো, কিছুক্ষণ আগেই আনোয়ার সাহেবের মৃত্যু হয়েছে। হার্ট অ্যাটাক বা হার্ট অ্যাটাকের মত কোন কিছুর কারণেই মৃত্যু হয়েছে। আনোয়ার সাহেবের হার্টে সমস্যা ছিল কিনা – এই সম্পর্কে জানা নেই নাজমা বেগমের। হার্ট অ্যাটাক কেন করবে?
ডাক্তাররা পুরো শরীরই পরীক্ষা করে দেখলো। কোন আঘাতের চিহ্ন নেই শরীরে! এটাকে খুন বলা যাচ্ছে না। শ্বাস রোধ করেও মারা হয়নি। এটা খুন হতেই পারে না।

আচমকা আনোয়ার সাহেবের মৃত্যুর পর পুলিশ না ডেকে উপায় ছিল না তার পরিবারের। সুস্থ সবল সকালে জগিং-এ বের হল, দুপুরের মাঝেই মৃত্যু! অনেকটাই অস্বাভাবিক লাগছে তাদের কাছে। পুলিশও এসে তেমন কোন কিছুই করতে পারলো না।

অবশেষে সাধারণ মৃত্যু হিসেবেই মেনে নিল সবাই।

****

ঘটনাটা গোয়েন্দা সংস্থার কাছেও পৌছে যায় খবরটা। তারা প্রথমে খুব একটা পাত্তা দেয় নি। কিন্তু একই রকম তিনটা ঘটনা – কিছুটা পাত্তা তো দিতে হবেই। পরিবার থেকে কারোরই কেউ কিছু রিপোর্ট করেনি।
কিন্তু ডাক্তারদের কাছে একটু আজব লেগেছে। কারণ তিনটা লাশই একই ডাক্তার পরীক্ষা করে দেখেছেন। তিনটা লাশেই একটা ব্যাপার কমন ছিল। শরীরটা চটচটে ছিল কিছুটা। মানুষ মারা গেলে সাধারণত তার চামড়া এরকম হয় না, মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই এরকম হবে না। তার উপর শরীরে লাল লাল দাগও দেখা গেছে। আঘাত করার চিহ্নও না এটা। এলার্জি হলে যে রকম দাগ হওয়ার কথা ঐরকম। কারোরই এলার্জির কোন সমস্যা ছিল না। এটা অদ্ভুত লেগেছে ডাক্তারের কাছে।

গোয়েন্দা বিভাগে এক বন্ধু থাকায় তাকে জানান তিনি। গোয়েন্দা বিভাগের পরিচালক, আমিনুল হক প্রথমে এটাকে তেমন কিছু মনে করেননি। কিন্তু লাল লাল দাগের কথা বলতেই উনার কাছেও কেমন যেন সন্দেহ হল। এটা নিয়ে ভাল করে আলোচনা করার জন্য ডাকলো তরুন গোয়েন্দা ফারহান তানভীর কে।

প্রথমে সবটা শুনে ফারহান কিছু বলল না। কিছুটা ভাবছে। কিছু একটা সমস্যা কোথাও আছে। তিনজন মানুষ হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোক করে মারা যাওয়াটা অদ্ভুত না। অদ্ভুতটা হল, অ্যালার্জির মত দাগের জন্ম হওয়াটা। তিনজনেরই অ্যালার্জি এবং হার্ট অ্যাটাক!!!
এটা অনেক বেশি কাকতালীয়! কেসটায় তদন্ত করার পণ করলো। একটা রহস্য আছেই। সেটা বের করতেই হবে। এগুলোকে সাধারণ মৃত্যু মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে, জোর করে মরে যেতে বাধ্য হয়েছে ভিক্টিমেরা।




৬...

অনেক বছর পর দেশে ফিরলো সাদাব রহমান। একদম ঠিক সংখ্যাটা বললে প্রায় দশ বছর। এতগুলো বছর দেশের বাইরেই ছিল। গ্রাজুয়েশন করেছে অস্ট্রেলিয়ায়। এরপর এখন আছে আমেরিকায় এক ভার্সিটিতে রিসার্চার হিসেবে। তার জীবনটাকে স্বপ্নের মতই বলা যায়। কখনো ভাবেই নি সে এই দেশেই ভাল কিছু করতে পারবে, আর এখন সে দেশে আসলো সম্ভাব্য সব কিছুই অর্জন করে। মেধাবী ছিল আগে থেকেই। সেইটাই তার পথ খুলে দিয়েছে একটু একটু করে। দৈব ক্রমেই পেয়ে গেছে সব কিছু। দেশে এখন তার কেউ ই নেই আত্নীয় স্বজনের। থাকার মাঝে এক চাচাই আছে। সেই চাচাও রক্তের কেউ নন। এই চাচাই তাকে দেশের বাইরে পাঠিয়েছিল পড়ালেখার জন্য।

এই চাচার প্রতি আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবে সাদাব। এই মানুষটা না থাকলে তাকে আজও পড়ে থাকতে হত অনেক নিচেই। দেশে এসেছে শুধু এই চাচাকে দেখার জন্য। কয়েকদিন ধরেই লোকটা অসুস্থ। দেশের বাইরে যাওয়ার পর কয়েকবছর নিয়মিতই যোগাযোগ করতো সাদাব। প্রফেশনাল লাইফে ঢোকার পর থেকে আর যোগাযোগ করাই হয়ে উঠে না। সময়ই বের করতে পারে না। এইবার বলতে গেলে অনেক সময়ই পেয়েছে। বন্ধুদের সাথে রিইউনিয়ন, তারপর দেশে চলে আসা সেটাই প্রমাণ করে। যদিও দেশে সে থাকবে মাত্র তিনদিন। তবুও এই তিনদিনই তার কাছে অনেক সময়। নিজের দেশটাকে তো আবার দেখতে পাচ্ছে। বিদেশে সবই পাওয়া যায়, শুধু নিজের প্রিয় বাংলাদেশটা ছাড়া।

এয়ারপোর্টে ক্লিয়ারেন্সের পর ব্যাগ নিয়ে বের হচ্ছে সাদাব। ডানহাতে একটা স্যুটকেস, বামকাঁধে একটা সাইড ব্যাগ। বাইরে বের হয়ে ট্যাক্সির জন্য অপেক্ষা করছিল। যদিও অপেক্ষার চেয়ে বেশি স্মরণ করছিল গন্তব্যে যাওয়ার রাস্তার কথা। রাস্তাই তো তার স্মরণে নেই। কিভাবে যাবে? ইকবাল চাচাকে ফোন দিয়ে জেনে নিবে? নিজেই সিদ্ধান্তটা বাদ করে দিল। এসেছে তো চমকে দেওয়ার জন্য। একেবারে সামনে গিয়েই হাজির হবে। চমকে যাওয়া চেহারাটা নিজ চোখে দেখতে চায়।

রাস্তাটা কোন রকমে স্মরণ করে নিল। মাথার ভিতর আগের স্মৃতির ম্যাপ ঘেটে কিছুটা অংশ জোড়া লাগিয়েছে। ঐটুকুতেই যাওয়া যাবে। আর ট্যাক্সিতে উঠলে ড্রাইভার তো হেল্প করবেই। এক ট্যাক্সি নিজ থেকেই তার সামনে এসে হাজির হল। ট্যাক্সিটা যাত্রী খুঁজছে। এইজন্যই ঘুরছে শুধু।
‘স্যার কই যাইবেন?’ জিজ্ঞেস করলো ট্যাক্সির চালক। আধাপাঁকা দাঁড়িওয়ালা মোটামুটি বেশ বয়স্কই লোকটা।
‘কলাবাগান!’
‘উঠেন। জ্যাম তো অনেক বেশি। ভাড়াটা একটু বেশি লাগবে।’
‘আচ্ছা, স্যুটকেসটা উঠান আগে ট্যাক্সিতে।’

এই দেশের ভাড়া নিয়ে সাদাবের তেমন জানাশোনা নেই। কিসের বেশি কিসের কম। তার কাছে সবই একই সমান। দশ বছরে তো কত কিছুই পাল্টেছে। ড্রাইভার স্যুট উঠাচ্ছিল। আর সে দাঁড়িয়েই তখনো। রাস্তা স্মরণ করে নিচ্ছে একটু পর পর। মাথার ম্যাপ হ্যাং ধরাচ্ছে, একটু পর পর রিবুট করছে যেন। ঠিক তখনই ড্রাইভারের গলার আওয়াজ শুনতে পেল। ‘স্যার! নিল নিল!’

একটু চমকে গেল প্রথমে। পরে কাঁধের ব্যাগটার জোরে এক টান লাগায় ড্রাইভারের কথা বুঝতে পারলো। ড্রাইভার এটার কথা বলেই সাবধান করেছিল, কিন্তু যা ঘটার সেটা তড়িৎগতিতেই ঘটে গেল। মটর সাইকেলে করে আসা এক যুবক তার কাঁধের ব্যাগ হ্যাচকা টান দিয়ে নিয়ে এখন এই এলাকাই ছেড়ে চলে গেছে। হতভম্ব হয়ে গেছে সাদাব। ইকবাল চাচার কাছে এটার কথা শুনেছিল এতদিন, দেশে পা রাখার পনের-বিশ মিনিটের মাঝেই যে এটা ঘটে যাবে, সেইটা বুঝতেও পারেনি।

****

ট্যাক্সির ভিতরে এখন সাদাব। পিছনের সিটে বসেনি। ড্রাইভারের পাশের সিটটাতেই বসেছে। এটাতেই ভাল লাগছে তার। যদিও কিছুক্ষণ আগের ব্যাগ ছিনতাইয়ের ঘটনায় মন কিছুটা বিষণ্ণ।

‘স্যার কি দেশে অনেকদিন পরে আইলেন?’ জানতে চাইলো ড্রাইভার।
‘হ্যা! যখন দেশ ছাড়লাম, তখন অনেক ছোট ছিলাম। প্রায় দশ বছর আসলাম।’
‘কেমুন লাগতেছে দেশে আইসা?’
‘দেশে আসার পর অনেক বেশি ভাল লাগছে। দেশের বাতাসটা শরীরে পড়তেই অন্য সবকিছুকে নিন্মমানের মনে হচ্ছে।’
‘কোন দেশে ছিলেন স্যার এতদিন?’
‘অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা। দুইটাই। এছাড়া ঘুরতে গিয়েছে আরো বেশ কয়েকটা দেশে। তবে সব থেকে সুন্দর বাংলাদেশই। যত জায়গায়ই যাই, সুন্দরের কথা আসলে সেইখানে বাংলাদেশের কথা মনে হয় সবার আগে।’
‘আরে ধুরু! কি কইন! বাংলাদেশ সুন্দর? বাইরে থাকুইন তো এরলিগাই মনে হইতাছে। আপ্নের সময় থাকলে ঘুইরা দেইখা যাইয়েন – তাইলেই বুঝবেন কিরাম সুন্দর!’

তীব্র শ্লেষ মিশ্রিত স্বরে কথাটা বললো ড্রাইভার। সাদাব বুঝতে পারছে না লোকটা এভাবে কেন বলছে? তার তো ভালই লাগছে। রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা অবশ্য একটু বেশি। তবে চলন্ত গাড়িগুলো একের পর এক পিচঢালা রাস্তায় মসৃণ গতিতে এগুচ্ছে, এটা দেখতে বেশ ভালোই লাগছে। রাস্তায় উজ্জল রং-বেরং এর বিলবোর্ড, বিজ্ঞাপন – আর এখন প্রায় সন্ধ্যা। তাই আলোক বাতিগুলোও জ্বলতে শুরু করেছে। আবছা অন্ধকারে কৃত্রিম আলোয় রঙিন শহরটাকে দেখতে কার না ভাল লাগবে? এটাই ভাবছে সাদাব! অবশ্য প্রতিদিনই একই জায়গায় থাকলে কারই বা ভাল লাগবে। তার যেমন ভাল লাগেনা ক্যালিফোর্ণিয়া এবং সিডনী একটাকেও।
ড্রাইভারের রাগের কারণটা অন্য। এতদিন পর নিজের দেশে একটা মানুষ আসলো, আর তাকেই কিনা ছিনতাইয়ের শিকার বানালো। দোষটা নিজের ঘাড়েই নিচ্ছে। তারই স্যুটকেস তুলতে দেরী হচ্ছিল, এইজন্যই সাদাবকে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল একটু বেশি। সে তাড়াতাড়ি করলে সাদাবের ব্যাগটা নিতে পারতো না।

যদিও সাদাব বারবার তাকে বলেছে তার দোষ নেই। ব্যাগে ইম্পোর্ট্যান্ট কিছু ছিল না। এটা নিয়ে ভাবার দরকার নেই। পাসওয়ার্ড, ভিসা সবই তার কাছেই আছে। এগুলো হারালে বিপদ হত, এগুলো যেহেতু আছে, তাহলে কোন সমস্যা নেই। তবু নিজেকেই দোষ দিচ্ছে ড্রাইভার লোকটা।

প্রায় ঘন্টা দুয়েক লাগলো পৌছাতে। আধাঘন্টার রাস্তা ট্যাক্সিতে করে – জ্যামের কারণে তিনগুণ সময় বেশি নিল। জ্যামে পড়ে থেকে থেকে শেষে সাদাব বিরক্তই হয়ে গেল। শেষমেশ নামতে পেরেই খুশি। ড্রাইভারের প্রথম দিকে আন্তরিকতাও ভাল লাগছিল। কিন্তু ব্যাগ হারানোর কথা বলে বারবার নিজের কাঁধে দোষ নেওয়ার কথা শুনতে শুনতেও বিরক্ত হয়ে গিয়েছিল। ভাড়া মিটিয়ে বিদায় করলো লোকটাকে।
এমনিতেই চিন্তায় আছে ব্যাগটা নিয়ে, যতই গুরুত্বপূর্ণ কিছু নেই বলুক – সে তো জানে ব্যাগের ভিতরে কী ছিল! আর ঐটার দরকারটা কতটুকু!





৭...

মাত্রই তাঁকে শাসানো হল, যেন আসন্ন পৌর নির্বাচনের মেয়র পদে তিনি না দাঁড়ান।
ইসতিয়াক আহমেদ। এলাকার বেশ নামকরা ব্যক্তি। চারিদিকে উনার সুনাম। এলাকার মানুষও তাকে খুবই পছন্দ করে। ন্যায় ও নিষ্ঠার সাথে সবসময় কাজ করেছেন। রাজনীতিবিদদের সাধারণ জনগণ অন্য চোখে দেখে। দরকার লাগলে রাজনীতিবিদদের পিছুই ছাড়েনা, আর দরকার ফুরোলেই গালি-গালাজের মালা পড়ানো হয়। ইসতিয়াক আহমেদ এই দিক দিয়ে একদম আলাদা। উনার সামনে বা আড়ালে – সব জায়গায়ই মানুষ প্রশংসা করে। ওয়ার্ড কমিশনার থাকাকালীনও নিজের সর্বস্ব দিয়ে চেষ্টা করেছেন এলাকার উন্নয়নের। এইভাবেই আস্তে আস্তে উপরে উঠতে উঠতে এখন পৌর মেয়রের জন্য লড়বেন।

প্রতিদ্বন্দী আগের বারের মেয়র দ্বীন ইসলামই। নামে দ্বীন থাকলে কাজে এক ফোটাও দ্বীনের ছিটে নেই লোকটার। কেউ দেখতে পারেনা তাকে। ক্ষমতা ও টাকার জোরেই চলে। টাকাও বাড়িয়েছে মেয়র হয়েই। পৌরসভার পুরো এরিয়া থেকেই সব কাজের আলাদা কমিশন নিতেন লোকটা। মানুষের টাকা মেরে খাওয়ার ওস্তাদ। প্রথমে কৌশল খাটিয়ে নিতেন, কাজ না হলে জোরপূর্বক হুমকি-ধামকি দিয়েই নিতেন। এলাকার মানুষও সহজ-সরল, ভয় দেখানো মাত্রই তার পকেট ভারী করে দিত। এমনকি একটা সামান্য পৌরসভার চারিত্রিক সনদ পত্র নিতে গেলেও তাকে মোটা অঙ্কের টাকা নিতেন। তার দাবী এখানে স্বাক্ষর করে তিনি অনেক মূল্যবান সময় নষ্ট করছেন – এটার মূল্য তো দিতেই হবে। যদিও স্বাক্ষরের স অক্ষরটাও লেখার ক্ষমতা নেই তার। কোনরকমে কলম দিয়ে একটা প্যাচ এঁকেই স্বাক্ষর হিসেবে চালিয়ে পকেট ভরতেন। এরকম করে করেই এখন মহীরূহে পরিণত হয়েছেন।
দ্বীন ইসলাম শুধু পারতেন না এই ইসতিয়াক আহমেদের সাথেই। সমস্যাটা তার সাথেই লেগে থাকতো। ইসতিয়াক আহমেদ সৎ লোক। যেটা দ্বীন ইসলামের জন্য পথের কাঁটা ছিল। দ্বিতীয়ত, ইসতিয়াক আহমেদ যুক্তি সহকারে কথা বলতে পারেন – এর ফলে তার সাথে দুই নম্বরী করা কঠিন। এটা যেমন তাঁর ভাল লাগতো, তেমনি খারাপও লাগতো। তিনি চাইতেন ইসতিয়াক আহমেদের মত যুক্তি সহকারে কথা বলে টাকা খাওয়ার, কিন্তু এতটা ভাল পারতেন না। এই দুটো দিকেই পিছিয়ে আছেন তিনি।

তারপর এলাকায় দ্বীন ইসলামকে কেউই সম্মান করে না। এটা তিনি ভালোই জানেন। কিন্তু তাঁর বিশাল ক্ষমতার সামনে কেউই এইটা প্রকাশ করতে পারে না। কিন্তু ইসতিয়াক আহমেদকে অন্তরের অন্তস্থল থেকে ভালবাসে সবাই।

ইসতিয়াক আহমেদ মেয়র পদে নির্বাচনে দাড়াচ্ছেন শুনেই পিলে চমকে উঠলো দ্বীন ইসলামের। তবে কি তাঁর বিদায়ের ঘন্টা বাজা শুরু হলো? তিনি জানেন, ইসতিয়াক আহমেদের সাথে নির্বাচনে গিয়ে তিনি জিততে পারবেন না। আগেরবার লোকজনকে আবেগীয় ভাব বশীভূত করে জিতেছিলেন। তখন তার সম্পর্কে কেউ এতটা জানতোও না। কিন্তু এতদিনে সবাই জেনে গেছে তার আসল মুখোশ। এমনকি গত বন্যার সময়ও রিলিফের টাকা মেরে নিজের বাড়ি বানিয়েছেন। যুক্তিটা এমন, ‘পানিতে ভাসা যাদের কপালে আছে – তারা ভাসবেই, টাকা দিলে কী করবে ওরা? নৌকা বানাবে? না পানির বালতি কিনে তাতে করে পানি বিক্রি করবে? আমার কপালে ভাল দালানে থাকা লেখা আছে। টাকা দিয়ে আমি দালান বানাবো।’

অকাট্য যুক্তি। এতে শহরের মানুষ ক্ষেপে গেলেও কিছু বলেনি। সময়তো আর বেশি নেইও তার মেয়াদের – পরের বার তাকে আর ভোটই দিবে না ঠিক করে রেখেছে। ইসতিয়াক আহমেদও এইটা জানেন। তিনিও চান না মেয়র হিসেবে দ্বীন ইসলাম থাকুক। অনেক প্রবীণ নেতাদের সাথে তিনি কথা বলেছেন, যেন পরেরবার তারাই দাঁড়ায়। দাঁড়ালেই জিতে যাবে। কিন্তু দ্বীন ইসলামের সাথে সংঘর্ষের ভয়ে কেউ ই আর সাহস দেখাতে পারেনি। দ্বীন ইসলামের নাকি নিজস্ব একদল মাস্তানও আছে। পথের কাঁটা তুলতে ওনার কোন সমস্যাও নেই।
শেষে নিজেই ঘোষণা দিলেন, তিনিই লড়বেন। ভয় তিনি পান না - চান না দ্বীন ইসলামের মত চাঁদাবাজ সন্ত্রাসী ক্ষমতায় থেকে জনগণের আরো অর্থ আত্নসাৎ করুক।

তিনি ঘোষণা দেওয়ার পরের দিনই দ্বীন ইসলাম তার বাড়িতে আসলেন। সারাদিন আন্তরিকভাবে কাটালেন। বুঝালেন, মেয়র থাকা মানে চুলার ভিতরে থাকা। সবসময়ের গরমের ভিতরে সিদ্ধ্ব অবস্থায় আগুনে পুড়ার অপেক্ষায় থাকতে হয়। তিনি আর এই কঠিন কাজ করতে চান না। এরচেয়ে ধান চাষ করা নাকি ভাল। আরো অনেক কিছু।
শেষ ইসতিয়াক আহমেদকে উপদেশ দিলেন, মেয়র হওয়ার মত ভুল না করতে। জীবনটা নাকি ভাজা ভাজা হয়ে যাবে তাতে। ইসতিয়াক সাহেব খুবই ভাল মানুষ, উনার মেয়র হিসেবে কষ্টটা নাকি তিনি দেখতে পারবেন না। সেই সাথে তাঁর সাথে থাকার প্রস্তাবও দিলেন। তাঁর এইসবে অভ্যাস আছে বলে সে ই কষ্টের কাজটা করুক বললেন। ইসতিয়াক সাহেবকে তার হয়ে নির্বাচনে প্রচারণা করার কথাও বললেন। প্রস্তাব করলেন, মেয়র হয়ে আর কতই বা কামাবে – তার চেয়ে বেশি তিনিই দিবেন। যেতে যেতে বারবার, মেয়রের পদ অনেক কষ্টের পদ এইটাও শুনিয়ে গেলেন। ইসতিয়াক আহমেদ শুধু ভেবে দেখবেন বলেই চলে গেলেন।

তারপর আবার এলেন আজকে। এতদিনেও ইসতিয়াক সাহেব তাঁকে ভেবে এখনও কিছুই জানায়নি, উলটো এলাকার লোকদের জড়ো করে নিজের কাজে নেমে গেছেন। মেজাজ একদম গরম হয়ে আছে দ্বীন ইসলামের। এসেই হুমকি দেওয়া শুরু করলেন,
‘ঐ তুই দুইদিনের পোলা আমারে ইলেকশনে হারাইবার চাস? নাকি জান লইয়া ভাগবার চাস?’
‘পালানোর অভ্যাস আমার নেই। কাজ যেইটা শুরু করেছি, সেইটা শেষ করবই। হার-জিত পরের কথা। এখনো আপনি হারেননি। আর মুখের ভাষা ঠিক রেখে কথা বলুন।’ শান্তকণ্ঠে জবাব দিলেন ইসতিয়াক আহমেদ।

এতে মেজাজ আরো বিগড়ে গেল দ্বীন ইসলামের। মারতেই উদ্যত হলেন। ইসতিয়াক সাহেবের শার্টের কলার ধরে শাঁসালেন, ‘ভালা চাস তো সইরা যা! আমারে ক্ষেপাইস না।’
‘আমি নির্বাচনে দাঁড়ালে আপনি ক্ষেপবেন কেন?’ অবাক কণ্ঠে জানতে চাইলেন ইসতিয়াক আহমেদ।
‘এহনো সময় আছে তুই সইরা যা! নাইলে রাস্তাঘাটে লাশ পইড়া থাকবো তোর। মেয়র হইবি না লাশ হইবি?’
‘হুমকি দিচ্ছেন? আপনার এতই ক্ষমতা তাহলে আমাকে সরে দাঁড়ানোর কথা বলছেন কেন? নিজেই কাজ করুন – সবাই পাশেই থাকবে আপনার। আর, আপনারও এখনো সময় আছে – ভালমত আচরণ করতে শিখুন।’
‘ইসতিয়াকের বাচ্চা! তর একদিন কি আমার একদিন আইজকা।’
বলেই মারতে উদ্যত হলেন দ্বীন ইসলাম। তার দলের বাকিরা তাকে ধরে রাখলো দেখে এই যাত্রায় ঐরকম কিছু ঘটেনি। কোন রকমে সবাই মিলে ধরাধরি করে দ্বীন ইসলামকে নিয়ে গেল। ইসতিয়াক আহমেদ তাঁর জায়গা থেকে একটুও নড়েননি। অটুট ছিল, মারতে আসলে আসুক। তিনিও দেখতে চান, লোকটা আর কতটা নিচে নামতে পারে!

****

‘ভাই! মাথা ঠান্ডা হইছে তোমার?’
দ্বীন ইসলামকে জিজ্ঞেস করলো তাঁর ছোট ভাই রফিক। ইসতিয়াক আহমেদের সাথে ঝগড়ার কথাটা শুনেছে সে। ঐ সময় সাথে ছিল না, থাকলে ঐ ঝগড়া হতেই দিত না। কাগজে কলমে মেয়র দ্বীন ইসলাম হলেও, চালায় তো তাঁকে এই রফিকই। সে আড়ালে থেকে বুদ্ধি দিচ্ছে, সেভাবেই চলছে মেয়র বড় ভাই।

‘ক্যামনে ঠান্ডা হইবো? ঐ হারামজাদায় তো ইলেকশনেত্তে সরবো না। আমি হাইরা যামু এইবার!’ মেজাজ এখনো রুক্ষ দ্বীন ইসলামের। খস খস করে কোন রকমে বললেন।
‘ভাই তারে সরায়া দেই রাস্তা থাইকা?’
‘ক্যামনে সরাইবি? তার শইল্লে বা তার পরিবারের কারো শইল্লে একটা টোকা পড়লেই তো আমি হাইরা যামু। এলাকার লোকজন আমারে জীবনেও ভোট দিব না।’
‘হেইডা জানি। তুমি ভাইবো না, একটা ব্যবস্থা করছি। সাপও মরব, লাঠিও ভাঙবো না। জিতবা তুমিই, খালি ইসতিয়াকরে সরায়া দিতে হইবো।’
‘কী প্ল্যান করছস? খুইল্লা ক!’ আগ্রহী হয়ে জানতে চাইলেন দ্বীন ইসলাম।

প্ল্যানটা খুলে বলল রফিক। যেহেতু মেয়র সত্যিকার অর্থে সে ই – তার নিজের চেয়ার রক্ষা করার জন্য মাথা তাকেই খাটাতে হবে। তার মাথামোটা বড়ভাই আবার এইটা কম বুঝে। তবে প্ল্যান শোনার পর হাঁ হয়ে গেলেন দ্বীন ইসলাম।

‘রফিক! এইডা কী প্ল্যান করছস? কাম হইবো তো!’
‘এইডাই একমাত্র উপায় আমগো লাইগা। কাম এইডাতেই হইবো। আমি হেইদিন তোমার লগে তার বাসাত গেলাম না, তখনই দেইক্ষা আইছি। আজকেও এক ফকিরের বেশ এক পোলারে পাঠাইছিলাম। সেও দেইক্ষা আইছে।’
‘কবে কামডা হইবো?’
‘সবুর করো! ঠান্ডা হইবার দেও সব। তুমিও এখন ভালা মাইনশের মত চলো। বেশি বেশি দান করো। মানুষের থেইকা এখন আর কিচ্ছুই নিবানা। খালি দিবা! তাইলেই হইবো।’

দ্বীন ইসলাম তাতে রাজি হলেন। কিছু পেতে হলে, কিছু তো খরচ করতেই হবে। একটু নাহয় খরচ করলেনই, এরপর তো শুধু টাকাই পাবেন। পথের কাঁটা ইসতিয়াক আহমেদ এইবার একদমই থাকবে না। মেয়র তো হতে পারবেই না, ওয়ার্ড কমিশনার হয়েও তাঁর পথে বাগড়া দিতে পারবে না। 





৮...

শায়লা আফরোজ বেশ চিন্তিত স্বামীকে নিয়ে। বেশ কয়েকদিন ধরেই স্বামীর আচরণ কেমন যেন বদলে গেছে। হঠাৎ করে এমন কেন হল বুঝতে পারছেন না। ছেলে-মেয়েদের সাথে এই বিষয়ে কথা বলার জন্য মিটিংই ডেকে বসলেন। উনার স্বামী তখন বাসায় ছিলেন না। গোপন বৈঠক। দুপুরে খাবারের পরে বসলেন তারা।

‘আমার মনে হচ্ছে তোদের বাবার কিছু একটা হয়েছে?’ বৈঠক শুরুই করলেন এটা বলে।
‘কী হয়েছে বাবার?’ নাজমুল আর ঐশি দুইজন একই সাথে চমকে উঠে জিজ্ঞেস করলো।
‘আরে! দেখিস না, ইদানিং খুব ভাল মেজাজে থাকে। সেটার জন্যই ভাবনা হচ্ছে।’ বললেন তিনি।
‘এইটা তো বেশ ভাল। বাবার খারাপ মেজাজে অতীষ্ঠ হয়েও তো কত মিটিং ডেকেছো তুমি। এখন খারাপ মেজাজ না করায় ডাকলা। সমস্যা তো মনে হচ্ছে তোমারই।’ জবাব দিল নাজমুল।

শায়লা বেগম চোখ পাঁকিয়ে তাকালেন ছেলের দিকে। নাজমুল মায়ের এই দৃষ্টি দেখেই কুঁকড়ে গেল। অনেক বড় হয়ে গেছে, নিজেও চাকরি করছে। বলতে গেলে এখন সে ই বাসার অভিভাবক। তবুও তার মায়ের ঐ দৃষ্টিতে সে ভয়ই পেয়ে যায়।
‘থামো তো ভাইয়া! মা কিন্তু ঠিকই বলেছে! আমিও এটা খেয়াল করেছি।’ ঐশি তাড়াতাড়ি করে বলল। এখন এই বিষয়ে কথা বলাই ভাল। নাহলে মায়ের মেজাজ খারাপের জন্য আবার ভাইয়ের সাথে আলাদা বৈঠকে বসা লাগবে।

অদ্ভুত এক পরিবার। মেজাজ খারাপ সবারই। বাবার সবসময়ই, আবার মায়ের আচমকাই। হাসির কথা বললেও মেজাজ খারাপ করে বসে। বিপদে পড়েছে নাজমুল আর ঐশিই। সব সাম্যাবস্থায় রাখতে হয় তাদেরকেই।
‘হুট করে লোকটার মেজাজ এত ঠান্ডা কিভাবে হল?’ আনমনেই বললেন শায়লা বেগম।
‘অসুস্থ নাকি বাবা?’ শঙ্কিত গলায় জানতে চাইলো নাজমুল। বলেছে কৌতুক করেই। এখন ভয় পাচ্ছে মা আবার রেগে যায় কিনা সেটা ভেবে।
‘আসলেই মা! বাবা কি অসুস্থ? অন্য কোন কিছু নিয়ে চিন্তা করছে?’ এইবার জানতে চাইলো ঐশি।
‘জানিনা তো। তোর বাবা কবে কী জানায় আমাকে? সব তো চেপে রাখে। কিন্তু আমার কেন যেন ভয় লাগছে। লোকটার মেজাজ খারাপ দেখেই অভ্যাস। এখন একটানা এতদিন মেজাজ এত ঠাণ্ডা হওয়াটা স্বাভাবিক লাগছে না!’ শায়লা বেগমের গলার স্বর বেশ শঙ্কিত মনে হল।
‘আমি জিজ্ঞেস করবো বাবাকে?’ জানতে চাইলো নাজমুল।
‘না! তুই গেলে মেজাজ আবার একদিনেই এতো খারাপ হবে যে পরে বাসায় থাকাই দায় হয়ে যাবে, তুই চুপচাপ বসে থাক। ঐশি, তুই জিজ্ঞেস করবি তোর বাবাকে।’ বললেন শায়লা বেগম।

ঢোক গিলল ঐশি। বিড়ালের গলায় ঘন্টাটা তাকেই বাঁধতে হচ্ছে। এর চেয়ে মেজাজ ভাল বাবার এইটা নিয়ে চিন্তা না করলেও হত।

****

মোবাইল ট্র্যাক করার পর থেকে এখন পর্যন্ত পুরো পৃথিবীর অর্ধেকের বেশি জায়গা থেকেই সিগন্যাল এসেছে। ঠিক কোথায় আছে, সেইটা বুঝার কোন উপায়ই নেই।
আজগর সাহেব তার জীবনে এত বাজে অবস্থায় পড়েননি। নিজেকে এতটা অসহায় উনার আর কখনোই লাগেনি। প্রথমে ভেবেছিল, নতুন একটা গ্যাং। কিছু উচ্ছন্নে যাওয়া ৪২০ মার্কা পোলাপানেরাই চালায় হয়তো। ধরে ফেলা কোন ব্যাপারই। কিন্তু মোবাইল নম্বর ট্র্যাক করার পর থেকে মনে হচ্ছে, তাকে মেসেজ দিতে থাকা দলটা কোন সাধারণ দল না। বরং এত বছরে মুখোমুখি হওয়া উনার সবচেয়ে কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বী।
প্রচণ্ড বুদ্ধিমান। আজগর সাহেবের জন্য টোপ ফেলে রেখেছে। আর সেই টোপে পা দিয়েই আজগর সাহেব তাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে, আর সেই সুযোগে নিজের কাজটা নিশ্চিন্তে বসে ঠিকই করে নিচ্ছে।

আজগর সাহেব চিন্তিত হয়ে আছেন। 420s কে ৪২০ মার্কা কোন গ্রুপ মনে হচ্ছে না তাঁর কাছে। মেসেজগুলোকেও নিছক মজা করে পাঠানো মেসেজ হচ্ছে না। কিভাবে কী করা যায় বুঝতে পারছেন না। দলটাকে কেউ ই চিনেনা, নেই কোন পুলিশ রেকর্ডও। তাদেরকে ধরার সবচেয়ে সহজ উপায়টাকেও এলোমেলো করে রেখেছে। কোন ভাবেই তাদের কাছে পৌছানোর কোন সুযোগই নেই। এটাকে হেলা করার কোন সুযোগও নেই। যেটাই হোক, এটাকে সমাধান করতেই হবে। কিভাবে করা যায়, ভাবছিলেন।

‘বাবা!’ ডাক শুনে আজগর সাহেবের ভাবনায় ছেদ পড়ল। ডাকের উৎসের দিকে তাকিয়ে দেখেন, তার মেয়ে ঐশি এসে দাঁড়িয়ে আছে দোরগোরায়!
‘কী রে মা! আয় ভিতরে!’ নমনীয় গলায় বললেন তিনি।

ঐশি একটু বিস্মিত। এমন করে বাবার কথা কালে-ভদ্রে শোনা যায়। পরিষ্কারভাবে বললে, তিনি যখন অসুস্থ থাকেন তখনই। কেস নিয়ে চিন্তিত থাকলে তো তখন কথা বলার উপায়ই নেই, মেজাজ তখন গরমের সীমাও ছাড়িয়ে যায়। এখন তো কেস নিয়ে চিন্তারও কিছু নেই, চাকরিই তো নেই। সেজন্যেই এরপর থেকে মাথা গরমও ছিল। স্বাভাবিক ভাবেই কেউ যখন তার প্রিয় কাজটা না করতে পারে, তখন মেজাজটা তিরীক্ষই থাকে। কিন্তু মেজাজ ঠাণ্ডা সে তার বাবার খুবই কম দেখেছে। মায়ের আশংকা সত্যি বলেই মনে হল তার। নিশ্চয়ই বাবার কিছু হয়েছে। নাহলে, এত ঠাণ্ডা থাকার মানুষ তিনি নন। বিস্ময় ভাব কাঁটিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘কেমন আছো তুমি? কয়েকদিন যাবৎ অন্যরকম দেখাচ্ছে তোমাকে?’
‘কইরে? ঠিকই তো আছি! কিছুই হয়নি আমার।’ হেসে হেসে বললেন আজগর সাহেব।
‘মিথ্যে বলো না। তোমাকে আমি চিনি ভাল করেই। কী হয়েছে খুলে বল? নাহলে হাইকোর্টে রিমাণ্ডের আবেদন করবো।’ বাবা যে কিছু একটা লুকাচ্ছে সেটা পরিষ্কার বুঝতে পারলো ঐশি। তাই বাবার পুলিশের মত করেই জানতে চাইলো।
‘পুলিশের মত আচরণ করছিস? বাবাকে রিমাণ্ডে নেওয়ার এত শখ কেন?’ মুচকি হেসে জানতে চাইলেন। চিন্তার ছাপটা সরাতে চাচ্ছেন পুরোপুরি। এসব কথা পরিবারের কাউকেই শুনাতে চান না।
‘পুলিশের মেয়েই তো। সত্যি কথা না বললে, রিমাণ্ডেই নিতে হয়। নাহলে সত্যিটা বের করবো কিভাবে?’ ভারিক্কি গলায় বলল ঐশি।
‘কী বিপদ! আমি তো সত্যিই বলছি। আমার কিছু হয়নি। একদম ঠিকঠাক আছি!’ আবারও হেসে বললেন তিনি। ‘এখন যা তো! চা বানিয়ে আন! অনেকদিন আমাকে চা বানিয়ে খাওয়াস না। আজকে খাব।’ কথা এড়ানোর জন্য বললেন। কারণ বেশিক্ষণ জেরার মুখে পড়লে সত্যি কথাটা বলে দিতে পারেন। এই ভয়ে মেয়েকে আদর করেই তাড়িয়ে দিলেন।

ঐশি প্রথম প্রথম চিন্তিত হলেও, বাবার সাথে কথা বলে এখন তার বাবার কিছুই হয়নি। মা অযথাই চিন্তা করছিল। স্বাভাবিকই আছেন। বরং মেজাজ বেশি খারাপ থাকাটাই অস্বাভাবিক ছিল। যাক এতদিনে, তার বাবা ঠিক হয়েছে। ভেবেই খুশি হল ঐশি। দৌড়ে রান্না ঘরে গেল চা তৈরি করতে। মাকেও বলল চিন্তার কিছুই নেই। সবই ঠিক আছে।

****

গভীর রাত। মোবাইলটা বিপ বিপ করে উঠলো! মেসেজ এসেছে। আজগর সাহেব এমনিতেও ঘুমাতে পারছিলেন না। মেসেজটা দেখে ঘুম একদমই গায়েব হয়ে গেল। শরীরে কাঁপুনিও দিয়ে উঠলো।

‘You think I’m joking? Nope Sir, I’m not joking. You made the list of death, so you will be dead in a few days. But, since you always show your anger to your family, so I give you chance to be a nice man for them. Otherwise, you might regret for this after your death. You don’t have much, so you just have to use it in right way. Your death can wait for a few days. It’s not causes any problem. Today or tomorrow, I’ll kill you. Sorry, my mistake. Today or tomorrow, your will meet with your death.

----- 420s’


মেসেজটায় খুব আক্রমনাত্নক ভাবে কিছু লিখেনি। খুব ভদ্রভাবেও লিখেনি। দুটোর মিশেলে হুমকি স্বরুপ বার্তা দিল। আজগর সাহেব সত্যিই ভয় পেয়ে গেছেন এখন। উনার সম্পর্কে ভাল জানে ঐ লোকটা। মেসেজে ‘আমি আমি’ করছিল। সেই হিসেবে ধরে নিলেন 420s কোন গ্যাং না! একজনই! আসল নামটা লুকিয়ে রেখেছে।
তারমানে কিছুটা ভয়ও পায়। নাহলে আসল নামটাই বলতো। এটা ভেবে আজগর সাহেব বেশ খুশি হলেন। হাজার হোক, ক্রিমিনাল তো – ক্রিমিনালের মতই থাকবে। ভয় যখন পাচ্ছে – তাহলে ধরা পড়ার শঙ্কায়ও আছে।

আবার পরমুহুর্তেই মুখটা পাংশুটে হয়ে গেল আজগর সাহেবের। এমনও তো হতে পারে, এটাও উনাকে একটা টোপ দেখানো হচ্ছে। উনার সম্পর্কে ঐ লোকটা ভাল করেই জানে। পরিবারের মানুষের সাথেও মেজাজ গরম দেখায় এটাও জানে। এটা বাসার বাইরের কারো জানার কথা না। বাসার মানুষ এটা বাইরে বের করে না। তিনি নিজেও বলেন না। তারমানে ঐ বার্তাপ্রদানকারী লোকটা তার আশেপাশেই ঘুরঘুর করে খবর নিচ্ছে। তিনি কিভাবে কিভাবে ভাবেন সেটাও জানে। এই ব্যাপারগুলো অন্যকারো জানার কথা না। এগুলো আজগর সাহেবের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। এটার জন্যই তিনি আজগর আলী। উনাকে যে ভাল ভাবেই বিশ্লেষণ করা হচ্ছে, সেটা ভাল করেই বুঝে গেলেন।
এমন ধূর্ত ক্রিমিনালের কবলে আগে কখনো পড়েননি তিনি। তাকে এতটা ভাবায়ওনি কেউ। একা এই লোকটার মুখোমুখি তিনি হতে পারবেন না। সাহায্য লাগবেই।

সাহায্যের কথা মনে হতেই উনার চোখে ভেসে উঠলো ছোটবেলার বন্ধু সিরাজুল ইসলামের মুখটা। পেশায় সিরাজুল ইসলাম ডাক্তার হলেও আজগর সাহেবকে অনেক কেসেই সাহায্য করেছেন। ফরেনসিক বিভাগের ডাক্তারের সাথে পুলিশের ভাল সম্পর্কই থাকে। আর ফরেনসিক ডাক্তাররা গোয়েন্দা-পুলিশের থেকেও কম যায় না।

রাতেই বেরিয়ে যেতে চাইছিলেন আজগর সাহেব। বাসার অন্য সবাই সন্দেহ করতে পারে দেখে শুয়েই রইলেন। সকালে উঠেই রওনা দিবেন। উনার বিশ্বাস সিরাজ সাহেবের সাথে আলোচনা করলে উপায় একটা পাওয়া যাবেই।





৯...

ফারহান কেসটা নিয়ে এখনো নিশ্চিত না। হার্ট অ্যাটাকে কয়েকজন মারা গেছে – এতে অস্বাভাবিকতার কিছু নেই। একই দিনে পৃথিবীর অনেক মানুষই হার্ট অ্যাটাকে মারা যায়। কিন্তু তার কেন যেন মনে হচ্ছে, এই তিনটা হার্ট-অ্যাটাকে মৃত্যু কিছুটা হলেও অস্বাভাবিক। একই শহরের তিনজন মারা গেল। তিনটি ভিন্ন দিনে। কিন্তু একটা ব্যাপার তিনটা মৃত্যুর ক্ষেত্রেই ছিল মৃত্যুটা হয়েছে সকাল এগারোটা থেকে বারোটার মাঝে। আর, ডাক্তারের কথা অনুযায়ী ঐ তিনটি মৃত্যুর সময়ই মৃত ব্যক্তিটির বাসায় কেউই ছিল না। সবাই ই নাকি এসে দেখেছে অচেতন অবস্থায় পড়ে রয়েছে। ডাক্তারকে দেখানোর পর মৃত ঘোষণা করেছে।

এটা একটু অদ্ভুত লাগছে তানভীরের। বাসায় তো কেউ না কেউ থাকার কথাই। বাসার লোকজন না হোক, কাজের লোক তো থাকবেই। তারাও কি ছিল না? এটা বিশ্বাস হচ্ছে না।

তদন্ত করতে হলে, এই কাজের লোকগুলোকেই এখন আসল যোগসূত্র মনে হচ্ছে। ওদের থেকেই কথা বের করতে হবে, ভেবে নিল ফারহান। সাথে করে ডাক্তার ফায়েজকেও নেওয়ার সিদ্ধ্বান্ত নিল। এই ডাক্তারের সন্দেহের ভিত্তিতেই তদন্ত শুরু হয়েছে। আর হুট করে গোয়েন্দারা তদন্ত শুরুও করতে পারবে না। উপযুক্ত কারণ লাগবে, ডাক্তারের সন্দেহের কথাটা ডাক্তার নিজে বলে শুরু করলেই ভাল হবে।

ডাঃ ফায়েজও বেশ খুশি। গোয়েন্দার সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তদন্তে নামতে পারছেন। তবে এগুলোর থেকে উনার কৌতুহলটা বেশি মৃত্যুগুলো নিয়ে। লাশগুলো দেখে উনি বেশ চমকে গিয়েছিলেন। প্রথম দেখাতেই উনার কাছে মনে হয়েছে সাধারণ মৃত্যু না। কিন্তু বাহ্যিক ভাবে আঘাতের কোন চিহ্ন বা অন্য কিছুও দেখতে পাননি। বিষ দেওয়ার লক্ষণটাও পাননি। শরীরের বর্ণের তেমন কোন পরিবর্তন হয়নি। পুরোটা শরীরেই লাল হয়েছিল। আর সাথে অ্যালার্জির মত লাল লাল দাগ। দেখে মনে হচ্ছিল, কেউ ঐ মানুষগুলোর শরীরে রক্ত আঁটকে রেখেছিল। ওগুলো শরীরের ভিতরেই জমাট বেঁধে আছে। উনার ডাক্তারি জীবনে উনি এমনটা দেখেননি আগে। কোন সন্দেহমূলক কারণ না থাকায় অটোপ্সিতেও নেওয়ার চাপ দিতে পারেননি। তিনটি একই রকম লাশ দেখার পর কৌতুহলটা আরো বাড়ে। এখন লাশ পরীক্ষা করা যাবে না। যদি কোন কিছু থেকেও থাকত, এখন আর পাওয়া যাবে না। ভরসা এখন খুনীকে পাওয়ার উপর। তার থেকেই জেনে নেওয়া যাবে।

প্রথম মৃত্যুটা হয়েছিল আবদুস সালামের। প্রায় মাসখানেক আগে। সেখান থেকেই তদন্ত শুরু করার সিদ্ধান্ত নিল ফারহান।

****

আবদুস সালাম দেশের একজন বিখ্যাত রসায়নবীদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। কাজ করতেন বাইরের দেশেও। বাইরের দেশের ভার্সিটিগুলোতে ক্লাস নিতেন। রিসার্চের জন্যও বাইরের দেশগুলোর সাথে বেশ শক্ত যোগাযোগই ছিল উনার। মৃত্যুর মাস কয়েক আগেই অবসর নিয়েছেন সব কিছু থেকে। অনেক বছর ধরেই দেশ-বিদেশে দৌড়াদৌড়ি করে অনেক ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। ক্লান্তির কারণেই অবসর নেন। অবশ্য অবসর না বলে স্বেচ্ছায় ছুটি বলাই ভাল। কারণ, কিছুদিন পর আবারো সব জায়গায় উনাকে ফিরিয়ে নেওয়া হত।

তানভীর খবরের কাগজে ও টিভি চ্যানেলগুলো আবদুস সালাম সম্পর্কে শুনেছে। ‘হৃদযোগের ক্রিয়া বন্ধ হওয়ায় হারিয়ে গেলেন দেশের অমূল্য সম্পদ’ শিরোনামটাও ভাল করেই মনে আছ। তখন ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি, উনার মৃত্যুটা নিয়ে তদন্ত করা হতে পারে।

আবদুস সালামের বাসাটা ছিমছাম সাজানো। দোতলা বাসা। বাসার সামনের প্রাঙ্গনটাও অনেক বড়। বাগান করা। অবসরের পরই নিশ্চয় বাগানটা করায় হাতে দিয়েছিলেন, আন্দাজ করলো ফারহান। ফুল গাছ গুলো এখনো খুব একটা বেড়ে উঠেনি। অন্যান্যগুলোরও একই অবস্থা। বুঝাই যাচ্ছে, সময় বেশি হয়নি তাদেরকে রোপণ করার পর থেকে। আঙ্গিনার মাঝে ছোট ছোট বাহারী গাছ দেখতে বেশ ভালই দেখাচ্ছে। ভাবাই যায়না একজন বিজ্ঞানীর বাসা এমন হতে পারে। উনার শৌখিনতার পরিচয়টা বাসার ভিতরে ঢুকে আরো ভালভাবে পেল ফারহান। বসার ঘরটা সাজিয়ে রাখা হয়েছে শুধু বই আর বইয়ে। ঘরটা বেশ বড়। মাঝখানে একটা ছোট কাঁচের টেবিল। আর চারদিকেই অনেক গুলো সোফা সাজিয়ে রাখা। আর সোফাগুলোর পেছনের পুরো ঘরটাই গোল করে সাজানো বইয়ের তাক দিয়ে। ভেবেছিল, সবই হয়তো রসায়নের বই হবে। ভাবনায় ভুল ছিল তানভীরের। সালাম সাহেব বিজ্ঞানের মানুষ হতে পারেন ঠিকই, কিন্তু সাহিত্য ও অন্যান্য বিষয়ের প্রতিও ভাল আগ্রহ ছিল উনার। বেশ শিল্পমনা ছিলেন।

সোফায় বসে সালাম সাহেবের স্ত্রীর অপেক্ষাও করছিল, সাথে চোখ বুলিয়ে দেখছিল ঘরটাকেও। ঘরটাকে তার মনে হচ্ছে একধরণের ‘নোলেজ হাউজ’।

জোবাইদা বেগম আসার পর অবশ্য আর এতটা ঘরের দিকে মন দিতে পারেনি। ডাক্তার ফায়েজের পরিচিতই তিনি। ফারহানের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হল। হঠাৎ গোয়েন্দার আগমন শুনে একটু অবাক হলেন।
‘ম্যাডাম! সালাম স্যারের মৃত্যুটা আমার একটূ অবাক লেগেছে। আমি উনার চিকিৎসক ছিলাম দীর্ঘদিন। হার্ট-অ্যাটাক করার মত কোন অসঙ্গতি উনার শরীরে ছিল না। সেটা অবশ্য প্রায় পাঁচ বছর আগের কথা। এরপর তো আপনারা দেশের বাইরেই ছিলেন। ঐসময়কার রিপোর্ট অথবা প্রেসক্রিপশন গুলো দেখা যাবে?’ বললেন ডাক্তার ফায়েজ।
‘খুঁজতে হবে ওগুলো। এখনই লাগবে?’ জানতে চাইলেন জোবাইদা বেগম।
‘এখন হলেই ভাল হয়।’
‘আচ্ছা আমি দেখছি খুঁজে। কিন্তু ঘটনা কী সেটা বলুন তো! গোয়েন্দা, ডাক্তারের রিপোর্ট – আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না!’ বিস্ময় মিশ্রিত গলায় বললেন জোবাইদা বেগম।
‘ম্যাডাম আমরাও ঠিক বুঝতে পারছি না। আমাদের ধারণা স্যারের হার্ট-অ্যাটাক হয়নি। খুন করা হয়েছে। এটা শুধু ধারণা। এখনও নিশ্চিত নই আমরা।’ বোমা ফাটানোর মত করে বললেন ডাক্তার ফায়েজ।

কথাটা শুনে হাঁ হয়ে গেছেন জোবাইদা বেগম। ঠিক মূর্তির মত। নড়তেও ভুলে গিয়েছেন যেন। কাঁপা কাঁপা গলায় জানতে চাইলেন, ‘খুন?’

‘ডাক্তার ফায়েজের কথাটা ঠিক। এটা একটা আশঙ্কা। আমরা নিশ্চিত নই। নিশ্চিত হওয়ার জন্যই আপনার সাহায্য দরকার আমাদের।’ আসার পর এই প্রথম কথা বলল ফারহান।
‘কী ধরণের সাহায্য? আমি করতে রাজি আছি সব কিছুই। কিন্তু কেন আপনাদের মনে হচ্ছে এটা একটা খুন ছিলো?’ বিস্ময়ের ধাক্কাটা এখনো কাঁটেনি জোবাইদা বেগমের। এমন কিছুর আশা তিনি করেননি। সালাম সাহেবের মৃত্যুর প্রায় একমাস হতে চলল। কারো কোন সন্দেহই ছিল না। কিন্তু হুট করে এসব শুনে বিশ্বাস করতে পারছেন না।

‘আপনাকে প্রথম থেকেই বলি। স্যার যেদিন মারা গেলো, তার পরের দুই সপ্তাহেও আরো দুইজন মারা যায়। একই রকম ভাবে। ডাক্তার ফায়েজই সবগুলো লাশকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। লাশগুলো পরীক্ষা করতে গিয়ে উনি অনেকগুলো ব্যাপার কমন পেয়েছেন। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হল – উনি হার্ট-অ্যাটাক বললেও, উনার ধারণা ঐগুলো হার্ট-অ্যাটাক ছিলই না। যদিও সিম্পটমগুলো হার্ট-অ্যাটাকের দিকেই বেশি ঝুঁকছে। তিনজনেরই মৃত্যুর কারণটা একদম অস্বাভাবিক। স্যারের যেমন হার্ট-অ্যাটাক হওয়ার কোন সম্ভাবনা ছিল না, তেমনি বাকিদুইজনেরও একই অবস্থা। এরকম টানা তিন সপ্তাহে একই রকম তিনটা লাশ দেখে অবাক হয়েছেন ডাক্তার ফায়েজ। স্বাভাবিকভাবেই যে কেউ অবাক হবে। কোনভাবেই কোন রোগের সাথে মিলানো যাচ্ছেনা তাদের মৃত্যুটাকে। সে জন্যেই সন্দেহটা জেগেছে। এটা একটা খুন হলে হতেও পারে। সেজন্যেই তদন্তটা করতে হচ্ছে। আপনি তো নিশ্চয়ই চাননা খুনী যদি কেউ থেকেও থাকে, সে বাইরে নিশ্চিন্তভাবে চলুক?’ পুরো কথাটাকেই সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করে দিল ফারহান।
জোবাইদা বেগম শোনার পর প্রথম কয়েকমিনিট কোন কথা বললেন না। মিনিট পাঁচেক পর বললেন, ‘অবশ্যই চাই খুনী থেকে থাকলে ধরা পড়ূক। আমাকে কী রকমের সাহায্য করা লাগবে?’
‘প্রথমে আমাদের নিশ্চিত হতে হবে, উনার ডাক্তারি কাগজপত্র দেখে। ওগুলো দেখার পরই আসলে সামনে এগুনো যাবে।’ বলল ফারহান।

জোবাইদা বেগম উঠে গিয়ে প্রায় মিনিট দশেক পর ফিরে আসলেন এক ফাইল নিয়ে। এখানেই সব রাখা আছে। ফাইলটা নিয়ে দেখা শুরু করলেন ডাক্তার ফায়েজ।

সবগুলো কাগজ পড়া শেষে সন্তুষ্টির শিস দিয়ে উঠলেন ডাক্তার ফায়েজ। ‘স্যারের সবই ঠিক ছিল। ব্লাড প্রেসার, সুগার। হার্টে কোন সমস্যা ছিল না। স্যার ওয়াজ পারফেক্টলী ওকে। হার্টঅ্যাটাকের কোন চান্সই নেই। যদি না অসীম মাত্রার কোন ভয় দেখানো হয়ে থাকে উনাকে।’ খুন হচ্ছে এই সন্দেহটা উনারই। আবদুস সালামের রিপোর্টটা যেন তাঁকে মাত্রই সন্দেহটা প্রমাণে সাহায্য করলো। মিটিমিটি হাসছে ফারহানের দিকে তাকিয়ে। ‘ডিটেক্টিভ, এখন আপনার কাজ! আমারটা আমি সেরে দিয়েছি।’

ফারহানের মনে একটু খটকা। ডাক্তার ফায়েজ প্রথম থেকেই নিশ্চিত ছিল এইগুলো খুন, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই কিভাবে নিশ্চিত হলেন তিনি? একটু সন্দেহ লাগছে তার। তার মনে হচ্ছে, ডাক্তার ফায়েজ আরও অনেক কিছুই জানেন কিন্তু বলছেন না। নয়তো খুনীর সাথে উনার কোন আঁতাত রয়েছে। রহস্যময় কিছু খুনের তদন্তে সাহায্য করলে উনার নামটা আগের থেকে আরো বেশিই ছড়াবে। তবে এই মুহুর্তে ডাক্তার ফায়েজকে নিয়ে চিন্তা করা বন্ধ করে দিল সে। যদি সালাম সাহেব খুনই হয়ে থাকেন, তাহলে সেটার কারণ কী? কারণ ছাড়া তো কেউ কাউকে খুন করবে না।

‘ম্যাডাম আপাত দৃষ্টিতে স্যারের মৃত্যুটা স্বাভাবিক এবং খুন দুটোই মনে হচ্ছে। আপনি এক্সেক্টলি বলুন – ঐদিনের ঘটনাটা। স্যারের লাশটা কখন দেখেছিলেন?’ জোবাইদা বেগমকে জিজ্ঞেস করলো ফারহান।
‘ঐদিন মার্কেটে গিয়েছিলাম। সুপার শপের সাপ্তাহিক লাকি ড্র তে আমার কুপনের নাম্বারটা এসেছিল। এটা জানিয়ে ফোন করেছিল তারা। পুরষ্কার হিসেবে বিশেষ ছাড়ে আমি কিনতে পারবো বলা হয়েছিল। আমি পুরষ্কারটা কাজে লাগিয়ে নাতি-নাতনীদের জন্য শপিং করতে গিয়েছিলাম। ওখান থেকে এসেই দেখি সে বিছানায় পড়ে আছে। তারপরই উনার ঐখানে নিয়ে গেলাম।’ কথার শেষে ডাক্তার ফায়েজকে হাত দিয়ে ইশারা করে দেখালো।
‘সময়টা বলুন। ঠিক কয়টায় গিয়েছিলেন, কয়টায় এসে স্যারকে ঐ অবস্থায় দেখলেন?’
‘উমম। সকাল দশটার দিকে ফোন এসেছিল। সাড়ে দশটার দিকে বেরিয়েছিলাম, যতটুকু মনে পড়ে। ফিরে আসি একটার একটু পর পর। ফেরার পর পরই তাকে ঐ অবস্থায় পেলাম।’ শেষ কথাটা ঠিকভাবে শেষ করতে পারলেন না। গলাটা কেঁপে কেঁপে উঠলো উনার। বারবার মৃত স্বামীর লাশের কথা বলাটা যে কারোর জন্যই অস্বস্তিকর।

ফারহানও সেটা বুঝতে পারছে। যদি খুনই হয়ে থাকে, তাহলে এটা সম্পন্ন করা হয়েছে সাড়ে দশটার পর থেকে দুপুর একটার আগের আড়াই ঘন্টার মাঝেই।
‘ম্যাডাম আপনি যাওয়ার পর বাসায় কে ছিল?’
‘কাজের মেয়েটা ছিল শুধু। আর কেউ না।’
‘আরেকটা প্রশ্ন! আপনি যাওয়ার পর বাসায় কারো আসার কথা ছিল কি?’

প্রায় একমাস আগের কথা। ঠিক মনে করতে পারছেন না। ফারহান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখছে জোবাইদা বেগমকে। সবাইকেই সন্দেহের আওতায় রেখেছে সে। জোবাইদা বেগম মিথ্যা গল্পও তো ফাঁদতে পারেন। তবে ভদ্রমহিলার আচরণে সন্দেহটা আর বেশিক্ষণ থাকলো না। যেভাবে মনে করে বলার চেষ্টা করছেন – তাতে মনে হচ্ছে না মিথ্যা বলবেন। মিথ্যা বলতে হলে বা কারো সাথে আঁতাত থাকলে সে জিজ্ঞেস করার সাথে সাথেই বলে দিতেন।

‘উমম! আসলে সঠিক মনে পড়ছে না। ঐদিন কোন মেহমানের আসার কথা ছিল না। থাকলে আমি মার্কেটে যেতাম না। না, ঐদিন কারও আসার কথা ছিল না।’ অনেকক্ষণ ভেবে চিন্তে তারপরই বললেন তিনি।
‘ভালভাবে মনে করে বলুন! মেহমান না – সাধারণ কারোরই আসার কথা ছিল কিনা? যেমন –দুধওয়ালা, পত্রিকাওয়ালা এদের?’
‘সঠিক মনে নেই। তবে দুধওয়ালা সকালেই এসেছিল। পত্রিকাওয়ালা আমি যাওয়ার আগ পর্যন্ত আসেনি। ঐসময়টায় প্রতিদিন ওর হাতে চা থাকে আর পত্রিকা পড়ে। ঐদিন তাকে আমি পত্রিকা পড়তে দেখিনি। আসেনি তখনো।’ অন্যসব কিছু ভুললেও মৃত্যুর আগে কে কী করছিল আপনজনেরা সেটা সবসময়ই মনে রাখে। জোবাইদা বেগমও মিথ্যা বলছেন না।
‘পত্রিকাওয়ালা কি ঐদিন পরে এসেছিল? পত্রিকা পেয়েছিলেন ঐদিনের?’
‘ঐটার খোঁজ আমি রাখিনি। পত্রিকা পড়া শেষে টেবিলের উপরই থাকে। পরে সেটা রিনা নিয়ে গিয়ে রেখে দেয়। ঐদিন তো পরে আর পত্রিকা নিয়ে ভাবা হয়নি। এসেছিল কিনা সেটা রিনাই ভাল বলতে পারবে।’
‘রিনা কে?’ নতুন নাম উঠায় একটু ভ্রূ কুঁচকে তাকালো ফারহান।
‘বাসার কাজের মেয়ে।’

ঢাকা হল রিনাকে। ফারহান আগে থেকেই বাড়ির কাজের লোকদের প্রায়োরিটি বেশি দিচ্ছিল। কারণ, ঐসময় বাসায় কেউ না থাকলেও কাজের লোকগুলোর অবশ্যই থাকার কথা। মালিকিনরা শপিং-এ যাক বা যেখানেই যাক কাজের লোককে অবশ্যই নিয়ে যাবে না। সে বাসায়ই থাকবে। ঐদিন যদি রহস্যময় কিছু হয়েও থাকে তাহলে সেটা কাজের মেয়েটাই ভাল বলতে পারবে।
রিনা অবশ্য গোয়েন্দার নাম শুনে ঠক ঠক করে কাঁপছে। সে তো গত কয়েকমাস ধরেই কাজ করছে এই বাসায়। কোন অপরাধই তো করেনি, শুধু মাঝে মাঝে একটু দুধ-চিনি লুকিয়ে রাখে নিজের জন্য। সেটার জন্য তার ‘কাকী’ গোয়েন্দা ভাড়া করে নিয়ে আসবে? ভয়ে কুঁকড়ে গেল। মনে মনে প্রতিজ্ঞাও করলো, আজকে এই বিপদ থেকে বাঁচতে পারলে আর কখনো ঐ কাজ করবে না।

‘তুমি রিনা?’ ষোড়শী এক মেয়েকে দেখে অবাকই হল ফারহান। সে ভেবেছিল কাজের মেয়েটা হয়তো আরো বয়স্ক হবে। কিন্তু একে দেখে তো তার বাচ্চা মনে হচ্ছে। এই মেয়েকে কাজেই বা রাখলেন কী করে আবদুস সালাম দম্পতি – সেটা ভেবেও অবাক হচ্ছে।
রিনা কিছু না বলে মাথা দুলিয়ে সায় জানালো। ফারহান বুঝতে পারছে, মেয়েটা ভয় পাচ্ছে। ‘ভয়ের কিছু নেই। তোমাকে শুধু কয়েকটা প্রশ্ন করবো।’
আবারও মাথা ঝাকিয়ে সায় দিল রিনা।
‘এই বাসার মালিক মানে সালাম সাহেব যেদিন মারা গেলেন – সেই দিনের কথা বল শুধু আমাকে!’ শান্তভাবে জিজ্ঞেস করলো ফারহান। ভয় পাওয়াতে চাচ্ছে না মেয়েটাকে আর।
‘হেইদিন তো আমি কাজ করতেছিলাম। মশল্লা বাটতেছিলাম। পরে যখন কাকী আসলো, তখন শুনছি কাকা নাকি অসুস্থ হইয়া পইড়া আছে। পরে ডাক্তার দেখানির পর শুনি, কাকায় মইরা গেছে।’ থেমে থেমে আস্তে আস্তে কথাগুলো বলল রিনা। গ্রাম্য কথার টান স্পষ্ট। কাকা-কাকী সম্ভোষণে ফারহান বুঝতে পারলো, গ্রাম থেকে মেয়েটাকে নিয়ে এসেছেন উনারা। সাহায্য সহযোগীতায় করছে হয়তো।
‘মশলা বাটা ছাড়া আর কিছু করো নি ঐদিন? যেমন – স্যারে চা লাগবে কিনা, অথবা ড্রয়িং রুমটা গোছানো বা ঘর ঝাড়া - এইসব?’
‘ঐদিন ঘর-টর সব আগেই পরিষ্কার কইরা ফেলছিলাম। কাকাও চা চায় নাই, তার রুমেই আছিল – বাইর হইয়া ডাকও দেই নাই। প্রত্যেক দিন মশল্লা বাটুন লাগে দেইখা পুরা সপ্তাহেরটা একদিন কইরা রাখতেছিলাম। রান্ধা ঘরত্তেই আর বাইর হইনাই আমি।’
‘একবারও না? কেউ আসেও নি?’
‘না হেইদিন তো কারো আওনের কথা আছিল না। থাকলে তো কাকী কইতই আমারে। দুধওলাও তো কাকী থাকতেই আইছিল।’ রিনার কথার সাথে জোবাইদা বেগমের কথার মিল পাওয়া গেল। একদিক থেকে জোবাইদা বেগম সাসপেক্টের তালিকা থেকে বের হয়ে গেলেন। ফারহান সামনেই বসা ছিল – গোয়েন্দাও আসার কথা ছিল না, এটা না জেনে আগে থেকেই প্ল্যান করে একই কথা বলা সম্ভব না। কিন্তু একটা খটকা আছে, প্রায় একমাস আগের কথা এই মেয়ে মনে রেখেছে কী করে? বিশেষ করে দুধওয়ালার কথা?
প্রশ্নটা করতে যাবে এমন সময় রিনাই জবাব দিল, ‘হেইদিন কেউ আইলেই ভালা হইতো। আমার আঙ্গুলও ছ্যাচতো না। কাকাও মরতো না। আমি খোঁজ রাখবার পারতাম।’
‘আঙ্গুলে কী হয়েছে?’
‘হলুদ ছ্যাচবার গিয়া আঙ্গুলে ছ্যাচা মারছিলাম।’ প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় বলল রিনা। থেতলানো আঙ্গুলটাও দেখালো ফারহানকে। ডাক্তার ফায়েজও নিশ্চয়তা দিলেন ঘটনা ঐদিনেরই। এক্সরে, ডাক্তার দেখানোর কাজ ঐদিনই ঐ হাসপাতাল থেকেই করা হয়েছিল। রিপোর্ট চাইলে ফারহানকে দেখাতে পারবে। যদি দরকার লাগে।

আবারও ডাক্তার ফায়েজ একধাপ এগিয়েই। গোয়েন্দাদের কাজটা তিনি হালকা বুঝেন বলে মনে হচ্ছে ফারহানের। নাকি এটাও প্ল্যানের অংশ? ফারহান বিভ্রান্তির মাঝে আছে। একটা প্রশ্ন এখনও রিনাকে করা বাকি আছে।
‘তোমার স্মৃতি শক্তি খুব প্রখর। ভাল করে মনে করে দেখো, ঐদিন কী পত্রিকাওয়ালা এসেছিল? ম্যাডাম যাওয়ার পর?’ ফারহান অন্য সব চিন্তা বাদ দিয়ে পত্রিকাওয়ালার পেছনেই লেগেছে। তার কাছে ঐ একটা মানুষকেই সন্দেহজনক লাগছে।
‘নাহ আসেই নাই ঐদিন। আসলে আমারে ডাক দিত। ঐদিন বিল দেওনের কথা আছিল। কাকী আমারে বিলের ট্যাকা দিয়াই বাইরে গেছিল।’

রিনার কথাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আসলে অবশ্যই রিনাকে উঠতে হত বিল দেওয়ার জন্য। এটা তার মনে থাকতোই। ঐদিন যদি পত্রিকাওয়ালা না আসে, তাহলে পত্রিকা থাকারও কথা না। পত্রিকাগুলো কই থাকে রিনাকে দেখিয়ে দিতে বলল।

সব পত্রিকা ঘাটলো ঐ মাসের। আশা করছে যেন, পত্রিকাটা থাকে। তাহলেই বুঝা যাবে – ঐদিন সত্যিই কেউ এসেছিল। অন্তত পত্রিকা দিতে। শুধু বিলের কথাটা জানতো না! এই একটা অজানাই তাকে বিপদে ফেলতে পারে। সব পত্রিকা ঘেটে ফেলল। যেটা আশা করছিলো – সেটা পেলো না। ঐদিনের পত্রিকা সত্যিই নেই। তারমানে ঐটা মিথ্যা না। পত্রিকাওয়ালা আসলেই আসেনি।

তাহলে? ডাক্তার ফায়েজ এত নিশ্চিতভাবে বলছেন খুন কিন্তু কারো আসার পথই নেই এমনকী চিহ্নও নেই।

বাসাটা পরীক্ষা করে দেখলো ফারহান। ঘরের ভেতর ঢুকতে হলে দরজা একটাই। সেটা লাগানো ছিল। কেউ আসলে রিনাই খুলে দিত। তার কথা মতে সে দেয়নি। এছাড়া আবদুস সালামের রুমটায়ও কেউ অন্যকোন ভাবে আসতে পারবে না। জানালায় গ্রিল এবং কোন কিছুতেই কোন খুঁত নেই। মানে ভাঙা বা কাটার কোন চিহ্ন নেই। তাহলে, খুনই যদি হয়ে থাকে – তাহলে খুনী এই পর্যন্ত আসলো কিভাবে? সালাম সাহেব নিজেই ঢুকতে দেননি তো? সেটার সম্ভাবনা খুব কম – কারণ কেউ আসলে সেটা রিনার কানেই আগে যাবে। আর রান্নাঘরটাও একদম সামনা-সামনি অবস্থানে আছে, যেখান থেকে দরজাটা পরিষ্কার দেখা যায়। রিনা যতই ব্যস্ত থাকুক – সামনে তো সে তাকিয়েছেই। তাহলে সে অবশ্যই দেখতো। আর এই মশলা বাটার মাঝেও জোবাইদা বেগম এসে কলিংবেল চাপতেই সে গিয়েই দরজা খুলে দেয়।

নাহ! শুধু শুধু সময় নষ্ট হচ্ছে। ডাক্তার ফায়েজ ভুল কিছু ভাবছেন নয়তো উনার ডাক্তারী বিদ্যা এখনো শেখাই হয়নি। বিরক্ত হল ফারহান। বিদায় নিয়ে বেরোবার উপক্রম করলো।

বাইরের গেটটা দিয়ে বের হবে এমন সময় রিনা দৌড়ে এসে ফারহানকে ডাকলো। ‘স্যার! তখন মনে হয় নাই – এখন মনে হইলো। ঐদিন একবার কলিংবেল বাজছিল – আমি খুইলা দেখি কেউ নাই। আমি কিছুক্ষণ এইদিক-ওইদিক তাকাইয়া কাউরে না দেইখা আবার দরজা লাগায়া মসলা বাটতে গেছিলাম। এরপরেই ছ্যাচনাডা লাগে আঙ্গুলে। আপনেরে আঙ্গুল দেখাইতে গিয়ে মনে হইলো।’

ফারহান যখন ডাক্তার ফায়েজের জ্ঞান নিয়ে গাল দিতে দিতে এগুচ্ছিল – তখনই রিনার এই হুট করে মনে হওয়াটা। মরা রহস্যে প্রাণের যোগান দিল।
কারণ, একমাত্র রান্নাঘরের জানালাতেই কোন গ্রিল, শিক বা কাঁচ লাগানো নেই। শুধু কপাটগুলো আছে। রিনাকে রান্নাঘর থেকে সরাতে পারলে ভিতরে ঢুকাটা খুবই সহজ।






১০...

চা বানাতে গিয়ে চিনি ঢালার সময় কেমন যেন একটা বাজে গন্ধ পেলেন জাহানারা বেগম। অনেকটা পঁচা কাজু বাদামের মত। কাজু বাদাম তো উনার রান্না ঘরে ছিলই না কখনো, পঁচা গন্ধ আসার তো কোন সম্ভাবণাই নেই। হয়তো দোকানেই চিনিটা পঁচা বাদাম যুক্ত পাত্রে রেখেছিল। সেজন্যেই আসছে। এতটা ভাবলেন না। নিজের মত করে চা বানিয়ে নিলেন। শরীরটা হঠাৎ করেই খারাপ হয়ে গেল জাহানারা বেগমের। স্বামীর জন্যই চা বানাতে আসলেও অসম্ভব রকমের মাথা ঘুরানোর কারণে নিজের জন্য এক কাপ তৈরি করে নিলেন। চা বানাতে বানাতে একদম অসুস্থ হয়ে গেলেন। কোন রকমে কাপ দুটো হাতে নিয়ে দুর্বলভাবে রান্নাঘর থেকে বের হয়ে আসলেন।

ইসতিয়াক আহমেদ বসে টেলিভিশন দেখছিলেন। স্ত্রীকে দুর্বলভাবে চায়ের কাপ নিয়ে আসতে দেখে সাহায্য করার জন্য উঠলেন।
‘কি হয়েছে তোমার?’ শঙ্কা পূর্ণ গলায় জিজ্ঞেস করলেন তিনি।
‘আরে কিছুই না। একটু মাথাটা ঘুরছে শুধু।’
‘আর কাজ করতে হবে না এখন। আরাম করে বসে চা খাও!’ বলে নিজেই ধরে ধরে নিয়ে এসে বসালেন। এক কাপ চা স্ত্রীর হাতে দিয়ে, আরেক কাপ নিজে নিয়ে তিনিও বসলেন।

জাহানারা বেগমের শরীরের অবস্থা আরো বাজে অবস্থায় চলে গেছে। শ্বাস নিতেও সমস্যা হচ্ছে এখন। খুব দ্রুত শ্বাস নিচ্ছেন। ইসতিয়াক আহমেদ উদ্বিগ্ন হলেন। ডাক্তার এখন ডাকতেই হবে। চায়ের কাপে এক চুমুক দিয়েই উঠলেন ডাক্তার ডাকার জন্য।

কিন্তু বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারলেন না। তিনিও পড়ে গেলেন। শ্বাস নিতে সমস্যা উনারও হচ্ছে। মাথা ঘোরাচ্ছে, সব কিছু ঝাপসা ঝাপসা দেখছেন। পেটের ভিতরে যা ছিল সব বমি আকারে বের হয়ে আসলো। জাহানারা বেগমও বমি করছেন। প্রায় মিনিট দুইয়েক-এর মাঝে শরীর একদম দুর্বল হয়ে গেল দুইজনেরই। চোখের দৃষ্টি একদম ঘোলাটে। মেঝেতে লুটিয়ে পড়েছেন দুইজনই। শ্বাস দ্রুত নিতে নিতে একটা শ্বাস নেওয়াটা একদমই বন্ধ হয়ে গেল।

একই সাথে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে নিলেন মেয়র পদপ্রার্থী ইসতিয়াক আহমেদ ও তাঁর স্ত্রী জাহানারা বেগম।

****

ঘটনাটা জানাজানি হতে খুব একটা দেরী হল না। মুহুর্তের মাঝেই কয়েকজন ঢুকে ইসতিয়াক আহমেদ ও তার স্ত্রীকে উদ্ধ্বার করতে চাইলো। কিন্তু ভিতরে ঢুকার অল্প সময়ের মাঝেই তারাও অসুস্থ ইসতিয়াক আহমেদের মতই অসুস্থ হয়ে পড়লো। কিছুক্ষণের মাঝে তারাও মৃতদের দলে যোগ দিল।

উৎসাহীদের উৎসাহও কমে গেল। তারা বুঝতে পারছে না কী হচ্ছে এসব। উদ্ধার করতে গিয়ে কয়েকজনকে অনবরত বমি করতে করতে মাটিতে লুটিয়ে পড়তে দেখেছে তারা। ভিতরে কোন একটা সমস্যা অবশ্যই আছে। আর কারো সাহসও হচ্ছে না ভিতরে আগানোর। প্রশাসনকে খবর দেওয়া হল।

প্রশাসনের লোক এসে প্রথমে দুইজন কোনরূপ সতর্কতা অবলম্বন ছাড়াই এগিয়েছিল। একটু ঢুকেই যখন মাথা ঘুরা ও শ্বাসকষ্ট শুরু হল, তারা ফিরে আসলো। অক্সিজেন মাস্ক পড়িয়ে অক্সিজেন দিয়ে তাদেরকে সুস্থ করা হলো। তাদের বর্ণনা অনুযায়ী, বাসার ভিতরে এমন কিছু একটা আছে যেইটা সহজেই শরীরকে খারাপ করে ফেলে। গন্ধটা অনেকটা পঁচা বাদামের মত। প্রথমে মাথা ঘুরানো ও চোখে ঝাপসা দেখা দিয়ে শুরু হয়। তারপর ক্লান্তি শুরু হয়। শ্বাস নিতে সমস্যা হয়। দ্রুত শ্বাস নিচ্ছিল তারা সেইজন্যেই। একমিনিটের মাঝেই এতটা প্রভাব ফেলে দিয়েছিল। বেশি ভিতরে না গিয়ে উলটো দিকে ফিরে আসতে পারায় বাঁচতে পেরেছে। নাহলে তাদেরও যোগ দিতে হত ভিতরের লাশগুলোর সাথে।

ততক্ষণে অবশ্য ভিতর থেকে লাশগুলো বাইরে আনা হয়েছে। আগের দুজনের মত ভুল করেনি, পরের মানুষগুলো। বিষাক্ত গ্যাসের প্রভাব রয়েছে বুঝার পরই, যথাযথ সতর্কতা অবলম্বন করেই ভিতরে প্রবেশ করে তারা।

ইসতিয়াক আহমেদ ও জাহানারা বেগমকে পরিকল্পিতভাবেই খুন করা হয়েছে বলে ধারণা তাদের। এমন বিষাক্ত গ্যাস প্রকৃতি থেকে ছড়ালে পুরো এলাকাতেই প্রভাব ফেলতো। এটা শুধু ইসতিয়াক আহমেদের বাসাতেই ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল তাদেরকে হত্যা করার জন্যই। লাশগুলোকে ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য নিয়ে গেল তারা। বাসাটাকেও জনসাধারণের প্রবেশের জন্য নিষেধ করে দিল। কারণটা প্রথমত, বিষাক্ত গ্যাসের কারণে মানুষের মৃত্যুর সম্ভাবনা আছে। একটা মৃত্যুকূপ এখন বাসাটা। দ্বিতীয়ত, বাসার ভিতরে এমন গ্যাস যে নিয়ে গিয়েছে – সে কোন সূত্র ফেলে যেতে পারে। সাধারণ মানুষের অবাধ প্রবেশ থাকলে – তদন্তে দেরী হওয়ার সম্ভাবণা আছে।

****

ছোট ভাই রফিকের কথার পর থেকেই দ্বীন ইসলাম বেশ বদলে গেছেন। গত দশদিনে আগের সেই অত্যাচারী ও লোভী দ্বীন ইসলামকে পাওয়া যায়নি। বরং শান্ত স্বভাবের দয়ালু একটা মানুষকে দেখা গিয়েছে। এইভাবে চলাটা সবচাইতে কঠিন মনে হচ্ছে দ্বীন ইসলামের নিজের কাছেই। অভিনয় করে যাচ্ছে কোন রকমে। আর ভিতরে ভিতরে রাগে ফুঁসছে ভাইয়ের প্রতি। দশদিন হয়ে গেল, তার প্রধান শত্রু এখনো দিব্যি গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেড়াচ্ছে। তার ভাই তাকে বলেছিল, সব সামলাবে কিন্তু কিছুই তো করছে না। উলটো নিজের গাটের পয়সাই খরচ হচ্ছে। ইসতিয়াক আহমেদকে হারানোর উপায় একটাই। তাকে মেরে ফেলা। এছাড়া যত ভাল ব্যবহারই করুক না কেন জনগণের সাথে, ভোট যে তিনি পাবেন না সেটা ভাল করেই জানেন। এইতো আজকেও এক স্কুলকে অনুদান হিসেবে অনেক টাকা দিয়ে এসেছেন। ভাঙাচোরা ছিল স্কুলটা। ঠিক করাটা একদম জরুরী হয়ে পড়েছিল। সাথে স্কুলের ক্লাসরুমে আসন সংখ্যা ছাত্র-ছাত্রীর তুলনায় অনেক কম। এমন কী স্কুলের আঙ্গিনা ও চারপাশটাও ঝঞ্ঝালপূর্ণ। বর্ষার সময় তো সাপ-খোপেরা স্কুলের ভাঙা দেওয়ালটার ইটের ফাঁকেই বাসা বানিয়ে বসবাস করতে থাকে। ইসতিয়াক আহমেদ বলেছিল, নির্বাচনের পরই স্কুলের জন্য বিশেষ অনুদানের ব্যবস্থা করে দিবে। শুধু স্কুল-ঘর মেরামত করা না, অন্যান্য যাবতীয় সমস্যাগুলোও সরকারীভাবেই ঠিক করে দেওয়া হবে। কিন্তু স্কুল কর্তৃপক্ষের জন্য এতটা সময় অপেক্ষা করা কঠিন ছিল। এই সুযোগে দ্বীন ইসলাম অনুদান দিয়ে স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকা ও ছাত্র-ছাত্রীদের পরিবারদের থেকে ভোট গুলো নিজের করে নিতে চাইলেন। এত বড় অঙ্কের টাকা খরচ করায় এখন জ্বলুনি হচ্ছে দ্বীন ইসলামের। তিনিও জানেন, তিনি যত যাই করেন না কেন – কেউই সেটাকে কোন দাম দিবে না। তার থেকে সব আদায় করে ভোটটা ঠিকই দিবে ইসতিয়াক আহমেদকে।

ওখান থেকে আসার সময় রাস্তায় শুনতে পেলেন ইসতিয়াক আহমেদ আর স্ত্রী নাকি মারা গিয়েছে। তাদেরকে বাঁচাতে গিয়ে আরো তিন-চারজন মানুষও নাকি মরে গেছে। কথাটা শুনে মনে মনে বেশ খুশি হলেন। যাক, শত্রু গেল – এখন তিনিই থাকছেন মেয়র হিসেবে। কিন্তু উপরে উপরে বেশ দুঃখ প্রকাশ করলেন। জানতে চাইলেন, কিভাবে এরকম হল! উত্তর শুনে মেজাজ বিগড়ে গেছে। খুনের সন্দেহ করছে পুলিশ! তারমানে তো তিনিই আছেন বিপদে, খুনের কথাটা সবার জানাজানি হলে – সবাই উনাকেই আগে সন্দেহ করবেন।

তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে গিয়ে রফিককে ডাকলেন। ‘ইসতিয়াকরে খুন করাইছস ভালা কথা – এইডা তো সবাই বুইঝা গেছে। আরো সাবধানে করাইতে পারলি না? এখন তো মানুষে আমারেই সন্দেহ করব।’
‘খুন করাইছি?’ রফিক অবাক হয়ে বলল। ‘কবে খুন হইলো?’
রফিকের প্রশ্নে অবাক হলেন দ্বীন ইসলামও। তার ভাইয়ের তো কথাটা শুনে এভাবে অবাক হওয়ার কথা না। ‘আইজকা সকালে। তুই করাস নাই কামডা?’
‘নাহ!’
‘তাইলে আমারে যে কইলি, প্ল্যান রেডি কইরালছস!’
‘ঐডা তো তোমারে ঠান্ডা করার জন্য কইছিলাম। সত্যি সত্যি তো এমন কিছু ভাবি নাই।’

দ্বীন ইসলাম আবার দুঃশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন। ইসতিয়াক আহমেদকে যদি তার ভাই খুন না করে থাকে, তাহলে করলো কে? আর কারণটাই বা কী ইসতিয়াক আহমেদকে খুন করার।





১১...

আবদুস সালামের বাসায় রহস্যময় কলিংবেল বেজে উঠায় একটা অন্তত রহস্য রয়ে গেছে। উনাকে খুন হয়েছে কথাটাও বলা যাচ্ছে। কিন্তু আনোয়ারুল কবিরের সম্পর্কে সবকিছু শুনে ঘটনাটাকে পুরোপুরিই খুন বলা যায়।

আনোয়ারুল কবির খুব একটা ধনী কেউ ছিলেন না। ছোটখাট এক কেমিস্ট ছিলেন – যতদূর জানা যায়। এছাড়া উনার কাজের সম্পর্কে আর কারোরই কোন ধারণা নেই। উনার পূর্বের কী কাজ ছিল তাদের কাছেও বলা হয়নি। ঢাকায় এসে পুঁজি খাটিয়ে ব্যবসা শুরু করেছিলেন। গার্মেন্টেসের একটা অংশই কিনে ফেলেছিলেন। হঠাৎ করে কিভাবে এতটাকার মালিক হয়ে গার্মেন্টেসের অর্ধমালিকানা পেয়েছিলেন সেইটাও একটা বড় রহস্যই। রহস্যের উদঘাটন কেউ করেওনি। তাদের কারোরই দরকার লাগেনি রহস্য উদঘাটন করার। এখন জানার উপায়ও নেই। আনোয়ার সাহেব মৃত। রহস্যটাকে সাথে করে নিয়েই হারিয়ে গেছেন।

উনার শত্রু থাকাটা বিরল কিছু হবে না। গার্মেন্টেসের মালিক, চাঁদা-টাদা চেয়েছিল হয়তো – দেননি, শত্রুতা হয়েছে। পূর্বের শত্রুতাও থাকতে পারে। যেহেতু উনার অতীতটা রহস্যময়। কিন্তু সেদিনের কথাটা আলাদা। উনি সকালে প্রতিদিনই জগিং-এ যান। ঐদিন নির্ধারিত সময়ের চেয়ে বাসায় ফিরতে একটু দেরী করছিলেন। নাজমা বেগমের একটু সন্দেহ লাগছিল – রাস্তায় কোন বিপদে-টিপদে পড়েছিল কিনা! মৃত্যুর বেশ কয়েকদিন আগে থেকেই নাকি ডায়াবেটিসটা বেশ সমস্যা করছিল। যাক! একটা ক্ষেত্রে অবশ্য ফারহান নিশ্চিত যে, মৃতদের একজনের অন্তত কিছুটা শারিরীক সমস্যা ছিল। হার্ট অ্যাটাক হলে সেটাকে স্বাভাবিকই ধরা যায়।

কিন্তু নাজমা বেগমের পরবর্তী কথাগুলো আর তাকে স্বাভাবিক মৃত্যুর কথাটা মনে আসতে দেয় না। সে এখন নিশ্চিত যে, এগুলো খুনই ছিল। নাজমা বেগমের কথা অনুযায়ী, ঐদিন তিনি আনোয়ার সাহেবের জগিং থেকে ফেরার অপেক্ষাতেই ছিলেন। তখনই নাকি ফোন এসেছিল, সুপার শপের সাপ্তাহিক লাকি ড্র তে উনার কুপনের নাম্বারটা এসেছিল। বিশেষ ছাড়ে দ্রব্যাদি নিতে পারবেন। মেয়েকে নিয়ে সেখানেই চলে যান। বাসায় আর কেউ ছিল না। আনোয়ার সাহেবের কাছে চাবিও ছিল না বাসায় ঢোকার। তিনি মার্কেটে থাকার সময়ও এইটা নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় ছিলেন। বাসায় ঐদিন কাজের লোকদের মাসিক ছুটি দেওয়া হয়েছিল – বাসায়ও কেউ ছিলনা। বাসা থেকে গিয়েছিল সকাল দশটার পর পর। এসেছে একটার দিকে। সময় তিনঘন্টা। আবদুস সালামের ক্ষেত্রে ছিল আড়াই ঘন্টা। এরপর এসে দেখেছেন অচেতন দেহটা। ঐ অবস্থায় আনোয়ার সাহেবকে দেখে নাজমা বেগমের আর অন্য কোন কথা মাথায় আসেনি। সরাসরি ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান। মৃত ঘোষণা করা হয়।

নাজমা বেগম পুলিশের কাছে সকালে আসতে দেরী হওয়ার কথাটা বলেছিলেন। কিন্তু সেটাকে তখন স্বাভাবিক কিছুই লেগেছে। দেরী হওয়াটা কোন সন্দেহ জাগানোর মত কিছু না। বাসায় ঢোকার চাবিটাও ছিল না, কিন্তু লাশ ভিতরে পাওয়া গেছে। এইটা বললে তখন থেকেই পুলিশ তদন্তে নামতে পারতো। পরবর্তীতে উনার মনে হলেও আর পুলিশকে জানাননি।

দুইটা মৃত্যুর ঘটনা একসাথে মিলিয়ে নিল ফারহান। একই সময়, মৃত্যুর ধরণ একই, ডাক্তারের ধারণা হার্টঅ্যাটাক দুই ক্ষেত্রেই, বাসা খালি ছিল পুরোপুরিই। আর সবচাইতে বড় মিল হল, বাসা খালি থাকার কারণটা। সুপার শপের লাকি ড্র!

দুইটা ভিন্ন ও স্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনার ক্ষেত্রে, এতগুলো মিল থাকা অসম্ভব। নিশ্চয়ই একটা যোগসূত্র আছে। অবশ্যই এটা খুন। জোর দিয়েই বলতে পারছে এটা। সিরাজুল ইসলামের বাসায় তদন্ত এখনো বাকি আছে। কেসের কয়েকটা চাবি এখন পাওয়া অত্যন্ত জরুরী। দোয়া করছে যেন সেখানে গিয়ে পেয়েই যায়।

ডাক্তার ফায়েজের সন্দেহটা পুরোপুরিই সঠিক। ডাক্তার ফায়েজের উপর সন্দেহটা বাড়লো ফারহানের। ডাক্তার ফায়েজ সম্পর্কে খোঁজ নিয়েছিল সে। ডাক্তার হিসেবে মোটেই সুবিধার না। সাধারণ রোগ নির্ণয় করতেও উনার বেশির ভাগ সময়ই ভুল হয়। ভুল ঔষুধের কারণে অনেক রোগীকেই মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছিলেন। আবদুস সালামের ব্যক্তিগত ডাক্তার হওয়ার যে দাবি করেছিলেন, সেটাও মিথ্যা। তিনি ছিলেন সালাম সাহেবের ব্যক্তিগত ডাক্তারের সহকারী। তবুও ক্ষমতার জোরে হাসপাতালে টিকেছিলেন। সেই মানুষের পক্ষে এগুলো যে খুন, অস্বাভাবিক মৃত্যু সেটা একদম নিশ্চিত রূপে সন্দেহজনক।

ডাক্তার ফায়েজ এই মৃত্যুগুলো সম্পর্কে কিছু একটা অবশ্যই জানেন। যেইটা বলছেন না। সাসপেক্ট এখন ফারহানের তালিকায় এক নং-এ ডাক্তার ফায়েজেরই নামটা রয়েছে।






১২...


প্রধাণ প্রতিদ্বন্দ্বীই এখন নেই। শুধু নির্বাচন থেকেই না, সরে গেছে দুনিয়া থেকেই। দ্বীন ইসলাম কিছুটা স্বস্তিতে থাকতেই পারতেন। কিন্তু পারছেন না। ভেবেছিলেন, ইসতিয়াক আহমেদকে তিনিই সরাবেন পথ থেকে। তার ভাই রফিকের সাথে কথাও হয়েছিল এমনটাই। কিন্তু এখন শুনছেন, তার ভাই এইটার কিছুই জানে না। তাহলে মারলো কে? কে তাঁর এত বড় বন্ধুটা। তাঁর সবচেয়ে বড় শত্রুকেই পথ থেকে সরিয়ে দিল, আর বিনিময়ে কোন কিছুই নিচ্ছে না? এটা সম্ভব হতে পারেনা। নিজে একজন খারাপ মানসিকতার লোক হওয়ায় তিনি ভাল করেই জানেন, খারাপ মানুষ কখনোই বিনিময়ে কিছু পাওয়া ছাড়া কারো কোন উপকার করতে পারে না। ইসতিয়াক আহমেদকে যে খুন করতে পারে, সে কখনোই ভাল মানুষ হতে পারে না। অবশ্যই সেই লোকটা খারাপ।

ইসতিয়াক আহমেদ যতই তাঁর অনেক বড় প্রতিদ্বন্দ্বী হোক, তিনি জানেন ঐ লোকটা ভাল ছিল। ভাল মানুষের ক্ষতি করতে আরেকটা ভাল মানুষ পিছনে লাগবে না। লাগলে খারাপ কেউই লাগবে। দ্বীন ইসলাম খুবই চিন্তিত এই লোকটা কে হতে পারে? কী তার উদ্দেশ্য?

রাতে ঠিকমত ঘুমাতেও পারছেন না। নির্বাচনের ব্যস্ত সময় বলে স্ত্রীকে এখানে রাখেন নি, পাঠিয়ে দিয়েছেন শ্বশুড়বাড়িতে। প্রায় মধ্যরাত এখন। নিজের রুমে একা একাই এসব ভেবে পায়চারী করছেন। খুনী যদি নিজে থেকে সে দেখা না দেয়, তাহলে বিপদে পড়তে হবে উনাকেই। সবাই উনাকেই ভাববেন উনিই মেয়র হওয়ার জন্য ইসতিয়াক আহমেদকে খুন করেছেন। যেটার কারণে পিছিয়ে যেতে পারে নির্বাচনও। এতে উনার আরেকবার মেয়র হওয়ার কোন সম্ভাবনাও নেই। এরচেয়ে খুনটা উনি নিজে করলেও এতটা চিন্তা করতেন না। খুনের সাথে সাথে অন্যান্য দিকও ঠিকই সামলে নিতেন। যে ই কাজটা করুক, বিপদ থেকে তিনি রেহাই পাচ্ছেন না। জীবনের প্রথমবারের মত রাজনীতিতে এসে ভুল করেছেন চিন্তা করে পস্তাচ্ছেন। সাধারণ মানুষের টাকা-পয়সা মেরে অনেক কিছু কিনতে পারলেও, ক্ষমতাধর হতে পারলেও – ঘুম এবং শান্তি এই দুটোকেই একদম হারিয়ে ফেলেছেন। এখন আর উনার ইচ্ছা করছে না মেয়র পদে থাকারও। যত ঝামেলার মূলে তো এই মেয়রের পদটাই।

অনেকক্ষণ যাবৎ পায়চারী করে ঘুমুবেন বলেই ভাবলেন। গ্লাসে থাকা পানিটা খেয়ে শুয়েছেন মাত্র। অস্থিরতা বেড়ে গেল। এতক্ষণ যেই চোখে ঘুম আসছিল না, সেই চোখেই রাজ্যের ঘুম এসে হাজির হল। ঘরটার মাঝ থেকে কেমন যেন অদ্ভুত রকমের একটা গন্ধ আসছে। পঁচা গন্ধটা কিসের বুঝার জন্য নাক দিয়ে বাতাসটা নিতেই উনার মনে হল ঘরটায় আর থাকতেই পারবেন না। মুহুর্তের মাঝেই ঘরটায় শ্বাস নেওয়ারও পরিস্থিতি রইলো। দুর্বল ভাবে বিছানা থেকে নেমে ঘর থেকে বের হয়ে যেতে চাইলেন। দরজার খুব কাছাকাছি গিয়ে ধুপ করে পড়ে গেলেন। খুব দ্রুত শ্বাস নিচ্ছেন। চেষ্টা করছেন মুক্ত বাতাসটায় যাওয়ার। কিন্তু পড়ার ত্রিশ সেকেন্ডের মাঝেই শ্বাস নেওয়া একেবারেই বন্ধ হয়ে গেল উনার।

****

একটা আতঙ্ক কাজ করছে সবার মাঝে। পরপর দুইদিনে মেয়র পদের জন্য দুইজনই মারা গেল একই ভাবে। এখন আর কোন সন্দেহ নেই দুইজনকেই যে খুন করা হয়েছে। আগের দিন সবাই ভেবেছিল ইসতিয়াক আহমেদের খুনটা দ্বীন ইসলামেরই একটা চাল, নির্বাচনে জয়ের জন্য।

কিন্তু দ্বীন ইসলামের খুন হওয়ার পর এখন নতুন করেই ভাবতে হচ্ছে সবাইকে। দুই প্রতিদ্বন্দ্বীকে একরাতের ব্যবধানেই সরিয়ে ফেলল। ঐ খুনীর উদ্দেশ্যটাই বা কী? দুইটা মানুষকে খুন করাই তো নিশ্চয় উদ্দেশ্য হতে পারে। আরো বড় কোন উদ্দেশ্য আছে।

পুলিশ তদন্ত শুরু করেছে। খুনের ক্ষেত্রে প্রথমেই যাকে সন্দেহ করা হয় সে হল খুন হওয়া ব্যক্তির প্রধান শত্রু। কিন্তু যেই দুইজনের মৃত্যু হয়েছে তাদের দুইজনই ছিল একে-অপরের প্রধান শত্রু। শত্রু শব্দটাও ঠিক না, প্রতিদ্বন্দ্বীই বলা যায়। একজন না থাকলে অন্যজনেরই সুবিধা হত। কিন্তু দুইজনই না থাকলে কার সুবিধা? তৃতীয় কারো নাম এখন পর্যন্ত উঠে আসেনি।

সবকিছুই নির্ভর করছে এখন ফরেনসিক ডাক্তারের রিপোর্টের উপর। মৃত্যুগুলো খুবই অদ্ভুত ভাবে হয়েছে। শুধু তাদের মৃত্যুটাই নয় – ইসতিয়াক আহমেদ দম্পতিকে উদ্ধার করতে গিয়ে শহরের আরো চারজন মানুষও মারা গেছে। উদ্ধারকর্মীদের দুইজনও অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। দ্বীন ইসলামের লাশটা তো পড়েছিল দরজার কাছেই। কেউ তো রাতে নিশ্চয় নিজের বিছানা ছেড়ে দরজার কাছে এসে ঘুমাবে না। কিছু একটা তো অবশ্যই হয়েছিল। দরজার কাছে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি। তাঁকে বের করতে গিয়েও প্রথমে এক পুলিশ কর্মকর্তাও অসুস্থ হয়ে পড়ে। বিষাক্ত কোন অস্ত্র দিয়েই মারা হচ্ছে। অস্ত্রটা এতই বিষাক্ত যে অনেক সময় পর পর্যন্তও এটার রেশ রয়ে গেছে।






১৩...

কেসটা খুবই অদ্ভুত। ফারহান ছাড়া তদন্তে আর কেউ নেইও। ডিপার্টেমেন্টের কেউ জানেনা এরকম একটা কেসের কাজ চলছে। একাকী কাজ করা ফারহানের জন্য কঠিন কিছু না। বরং সে একাকীই কাজ করতে পছন্দ করে। কিন্তু প্রতিটা কেসেই কিছু কিছু সময় একাকী কাজ করাটা কষ্টকর হয়ে যায়। প্রতিটা কেসেই মূল চরিত্রের পাশাপাশি লুকিয়ে থাকা সাহায্যকারী কিছু চরিত্র থাকে। কেসগুলো জটিলও হয় এদের জন্যই।
ডাক্তার ফায়েজ এমনই এক সহকারী চরিত্র। ডাক্তারের পুরোনো ইতিহাস বলে তিনি তার কাজে খুব একটা দক্ষ না। এখনও কিভাবে পেশাগতভাবে টিকে আছেন এটা তার সাথে কাজ করা লোকেরাও জানেনা। অবশ্যই কেউ আছে উনার, যার জন্য এখনও অস্তিত্ব রয়েছে ডাক্তার ফায়েজের।

এই কেসটা মূলত চলছে ডাক্তার ফায়েজের কারণেই। তাঁর সন্দেহেই তদন্ত শুরু হয়েছে। তদন্তের প্রাথমিক দিকে তার সন্দেহটা যে অমূলক না সেটার ধারণাও ইতিমধ্যেই পাওয়া গেছে। ডাক্তার ফায়েজের উপর সন্দেহ হয় এমন কিছুও বের হয়ে আসেনি। কিন্তু উনি যেইটুক ধারণা করেছিলেন, সেটা মিলে যাওয়াটাই অবাক করা ব্যাপার।
তার উপর উনি যদি এটা সন্দেহই করে থাকেন তাহলে আগে কেন লাশগুলো পরীক্ষা করলেন না?
পরিবার অনুমতি দেয়নি – এই যুক্তিটা দেখাতে পারেন। কিন্তু উনি তো ডাক্তার, উনার আগে কেউই লাশগুলোকে লাশ হিসেবে শনাক্ত করেনি। উনি চাইলেই পারতেন নিশ্চিত হওয়ার জন্য পরীক্ষা করে দেখার – কিন্তু উনি তা করেন নি।

মানেটা দাঁড়াচ্ছে উনি নিজেও তখনও বুঝেননি। বুঝেছেন পরে। ঐ মুহুর্তে না বুঝে পরে কিভাবে বুঝলেন সেটা একটা বড়ই প্রশ্নই। সেটাও আবার সময় অনেকটা চলে যাওয়ার পর?

ফারহানের ধারণা কেসটায় ডাক্তার ফায়েজের সাথে আরো একজন জড়িয়ে আছে। যার মাধ্যেমে ডাক্তার ফায়েজ এটা জানতে পেরেছেন। নয়তো ডাক্তার ফায়েজ নিজেই জড়িত। বুঝে থাকলে তা প্রথমটার পরই বুঝার কথা। তাহলে সেটার জন্য তাদের কাছে তখনও আসতেন। তিন-তিনটা ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর কেন আসলেন?

ঐ তিনজনের সাথে ডাক্তার ফায়েজের অতীত ইতিহাসটা জানা একদম জরুরী হয়ে গেছে। সাথে ডাক্তার ফায়েজের বৃত্তান্তও।

তার অধঃস্তন জুনিয়র ডিটেকটিভ অধীতী ডাকলো। মেয়েটার উপর ভরসা আছে ফারহানের। বেশ দ্রুতই উন্নতি করছে। বুদ্ধিমত্তাও বেশ ভাল মেয়েটার। এখনও ডেস্কের ওপাশেই কাজ করছে। মাঠ পর্যায়ে বা ক্রাইম সিনে যাওয়া হয়নি এখনও অধীতীর। এই কেসটা এতটা জটিল ও অনিশ্চিতকর না হলে এবার হয়তো ফারহানের সাথে স্পটে যেতে পারতো। কিন্তু কেসটার এখনকার অবস্থায় তার এইটার সাথে যুক্ত হওয়া নিজের ক্যারিয়ারের জন্যই ক্ষতিকর। ফারহান উতরে যাবে তার ভাল রেপুটেশনের জন্য। কেসটায় অসফল হলেও সে তার জায়গাতেই টিকে থাকবে। ক্ষতিটা হবে তার সহ-গোয়েন্দাদের। সব বুঝে শুনেই ফারহান তার সাথে কাউকেই নেয়নি।

এই মুহুর্তে অবশ্য অধীতীর ডেস্কের কাজটাই দরকার ফারহানের।
‘কী অবস্থা তোমার, অধীতী?’ অধীতী আসার পর সৌজন্যতা স্বরূপ জিজ্ঞেস করলো ফারহান।
‘মন্দের ভাল বলতে পারেন স্যার। সারাদিন একই কাজ করে আর কতই বা ভাল থাকা যায়!’ মন খারাপ করে অনুযোগের সুরে বলল অধীতী।
‘ডেস্কে বসে এখন এই কথা বলছো, মাঠে নামলে তখনও এটাই বলবে। আমাদের কাজটাই এমন।’ হাসলো ফারহান। ‘যেই কাজের জন্য তোমাকে ডেকেছি, ডাক্তার ফায়েজুল ইসলাম সম্পর্কে সমস্ত তথ্য আমার লাগবে রাতের মাঝে।’
‘ওকে স্যার! সন্ধ্যার মাঝেই পেয়ে যাবেন।’ বলে আবার ফিরে গেল অধীতী।

তিনটা লোককে যখন একইভাবে মারা হল, অবশ্যই তাদের মাঝেও একটা না একটা সম্পর্ক আছেই। এখন পর্যন্ত এমন কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি যে তাঁরা একে-অপরকে চিনতেন। কিন্তু না চিনলে একই কায়দায় তাদেরকে মারা হচ্ছেই বা কেন? একটা রহস্য তো আছেই।

অধীতীকে ফোন করলো। ‘আরো তিনটা লোকের সম্পর্কেও একটি ঘাটাঘাটি করতে হবে তোমাকে। কাজটা কিছুটা কমিয়ে দেই। তাদের মাঝে কমন ব্যাপারগুলো পেলেই হবে।’ বলে নাম তিনটা বললো ফারহান।

****

আব্দুস সালাম ও আনোয়ারুল কবিরের বাসায় তদন্তের খাতিয়ে যাওয়া হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই। বাকি আছে সিরাজুল ইসলামের বাসাটা। কোন সন্দেহ নেই – বাকী দুজনের মৃত্যু হওয়াটা যে খুনই। তাই আগে থেকেই কিছু ধারণা করে নিল ফারহান। ঐদিনটাতে সম্ভাব্য কী কী ঘটতে পারে।
নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, বাসাটা খালিই ছিল আগের দুটর মতই। এই সুযোগেই খুনী ঘরে ঢুকে খুন করে যায়। এখন জানার বিষয় এটাই ওইদিন বাসার সবাই যাওয়ার পর ঘরে কে ছিল? কেউ না থাকলে খুনীর বাসার ভিতরে ঢুকে খুন করে যাওয়াটা অসম্ভবই।
সালাম সাহেবের ক্ষেত্রে খুনী বাসার বাসার মত এই বাসাটাতে ঢুকার এমন কোন দ্বিতীয় পথ নেই। সদর দরজাটাই একমাত্র পথ ঢোকার। বাসাটা অবশ্যই ঐদিন ভিতর থেকেই লাগানো ছিল। নাহলে বাইরের দিকটার তালা ভাঙ্গা থাকতো এবং ঐটার জন্য অনেক আগে থেকেই তদন্ত শুধু হয়ে যেত। স্বাভাবিকভাবে ঘটনাটা ঘটানোর জন্য অবশ্যই ভিতরের কারো সাহায্য লাগবে?

এই ভিতরের মানুষটা কে? সিরাজ সাহেব নিজেই না অন্য কেউ?

সিরাজ সাহেব পত্নী সায়মা ইসলাম ও ছেলে-মেয়ে সিফাত-সাবরিনার কাছে জানতে চাইলো ঐদিন কী ঘটেছিল? সেই পুরোনো প্রশ্নটাই। আশা করছে উত্তরটাও পুরোনোই হবে।

‘ঐদিন আমি ইন্টারভিউ দিতে বের হয়েছিলাম। সাবিরনা আর আমি একসাথেই। তাকে কলেজে নামিয়ে দিয়ে আমি যাই। ঐসময় মা বাসায় ছিল। এরপর দুপুরের একটু আগে ফিরে আসি। মা বা সাবরিনা কেউ ই ফিরে আসেনি তখনও। বাবাকে ঐ অবস্থায় আমিই পাই।’ কথার শেষ দিকে গিয়ে মুখটা কালো হয়ে গেল সিফাতের।

সিফাত থামতেই সায়মা ইসলাম বলতে শুরু করলেন, ‘ওরা বের হওয়ার পর আমিও বের হয়ে যাই। এরপর ফিরি তো সিফাতের ফোন পেয়েই।’
‘ঠিক কী কারণে বের হয়েছিলেন? ঐ সকালবেলায় তো সাধারণত গৃহিনীরা বের কম হয়।’ উত্তরটা কী পেতে পারে তা মোটামুটি আগে থেকেই আন্দাজ করে নিয়েছে ফারহান।
‘হ্যা! ঐ সময়টাতে আমিও সচারচর বের হই না। তবে ঐদিন বের হয়েছিলাম সুপার শপ থেকে ফোন আসায়। লাকি ড্রতে ভাগ্যবান ক্রেতা হিসেবে বিশেষ মুল্যছাড়ের অফার দেওয়া হয়েছিল আমাকে।’ উত্তরটা এইটাই হবে, তা জানতো ফারহান।
‘লাকি ড্রতে জিতলে তো আপমি পরেও যেতে পারতেন – তাহলে ঐদিনই কেন?’ প্রশ্নটা আগের দুজনকে করেনি বলে আফসোস করেছে ফারহান। একটা গুরুত্বপূর্ণ সংযোগকে সে হিসাবের বাইরেই রেখেছিল এতক্ষণ।
‘সময়টা ছিল দুপুর একটা পর্যন্তই! ডিসকাউন্টটাও ছিল ৮০% এর মত। তাই দেরী করা হয়নি।’

৮০% ডিসকাউন্ট!!!
এতবড় ডিসকাউন্ট পেলে স্বাভাবিক ভাবেই কেউ অপেক্ষা করবেনা। তড়িঘড়ি করেই যাবে। সবগুলো বাসা খালি করার ফন্দিটা ভালই এঁটেছিল।

‘অবশ্য গিয়েও লাভ হয়নি। ঐদিন কোন ডিসকাউন্ট ছিল না। সময়টাই নষ্ট হয়েছে ওখানে গিয়ে। নাহলে বাসায়ই থাকতাম। তাহলেই আর......’ কথাটা শেষ করতে পারলেন না। ডুকরে কেঁদে উঠলেন।
‘ডিসকাউন্ট ছিল না মানে? আপনাকে তো তারা ফোন দিয়ে এটাই জানিয়েছিল?’ অবাক হল কিছুটা ফারহান।
‘হ্যা জানিয়েছিল! কিন্তু ওদের ঐ ডিসকাউন্ট অফারটা শেষ আরো অনেক আগেই। প্রায় মাস তিনেক আগেই। ওদের ওখান থেকে ঐদিন কিভাবে ফোনটা এসেছিল – এইটা তারাও বুঝতে পারেনি।’ মায়ের হয়ে জবাবটা দিল সাবরিনা।

ব্যাপারটা এখন অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে গেছে। খুনীর কিছু সময়ের দরকার ছিল। সময়টা এভাবেই বের করে নিয়েছে। খুনীর সাথে সাহায্যকারী কেউ ঐ সুপার শপেই আছে। যে জানে লাকি ড্র ও ডিসকাউন্টের ব্যাপারটা। এবং এই মানুষগুলো যে ঐখানে নিয়মিতই যায় সেটাও। খুনীকে ধরতে এখন সুপার শপই প্রধান ভরসা।

সায়মা ইসলামের কান্না থেমেছে। একটু স্বাভাবিক হতেই ফারহান জানতে চাইলো ঐদিন তিনি বেরিয়ে যাবার সময় দরজা বাইরে থেকে লাগিয়ে গিয়েছিলেন কিনা। আর সিরাজ সাহেব তখন কোথায় ছিলেন!
‘ঐদিন যাওয়ার সময় তো ও এই রুমেই বসা ছিল। সংবাদ দেখছিল টিভিতে। বাইরে থাকা তালা দেওয়ার প্রশ্নই নেই। এমনকি আমরা সবাই যদি বাসার বাইরেও থাকি তবুও তালা দেওয়া হয় না বাইরে থেকে। বাসায় কাজের ছেলেটা সবসময়ই থাকে।’

কাজের ছেলে!
এতক্ষণ ধরে ফারহান এখানে এসেছে – এখনও এই তিনজনের বাইরে অন্যকোন মানুষকে দেখেনি। এমনকী বাসায় আরো কেউ আছে সেটার অস্তিত্বও পায়নি।
‘সে এখন কোথায়? ডাকুন তো!’ বললো ফারহান।
‘সে তো বাড়িতে গিয়েছে, আজ চারদিন হল। এসে পড়ার কথা – কিন্তু আসেনি এখনও।’ সিফাত জানালো।

সিফাতের কাছ থেকে আরো জানা গেল, ঐদিন অনেকক্ষণ নক করার পরই নাকি দরজা খুলেছিল ছেলেটা। এতটা সময় সাধারণত নেয় না সে। এটা নিয়ে পরবর্তীতে কথাও ততটা হয়নি – কারণ সিরাজ সাহেব আকস্মিক ভাবে মারা গেলেন – আর ছেলেটাও ঠিক ঐ সময়ই ছুটি নিয়েছে।

ঐদিন খুনীটা এসে নক করার পর ছেলেটাই তাকে ঢুকতে দিয়েছিল। তারপর ছেলেটাকে অচেতন করে খুনী তার কাজ সেরে নেয়। এর জন্যই সিফাত আসার পর দরজা খুলতে বেশি সময় লাগছিল তার।
এমনটাই ঘটেছিল – ধারণা করে নিল ফারহান। কিন্তু তাহলে ছেলেটা ছুটি নেওয়ার নাম করে পালাবে কেন? এটাতো অন্যদেরকে সে জানালেও পারতো! নাকি সেই ছেলেটাই খুনী?

পরতে পরতে রঙ পাল্টাচ্ছে কেসটা!
কয়েকটি সাধারণ মৃত্যুর ঘটনা এখন এক গোলক ধাঁধাঁয় পরিণত হয়েছে।





১৪...

সুপার শপে হানা দিল ফারহান। প্রতিটি মৃত্যুর সাথেই এই নামটি জড়িয়ে আছে। খতিয়ে দেখাটা দরকারই হয়ে পড়েছিল।

এই জায়গাটায় আগে কখনো আসেনি ফারহান। ঢুকেই চমকে গেল। বিশাল জায়গা নিয়ে গড়ে উঠেছে। নামটা সুপার শপ হলেও এটা শুধু পোশাক ও কাপড়ের জন্যই। সকল ধরণের পোশাক এনে জড়ো করা হয়েছে এইখানে। মানুষের ভীড়ও প্রচুর। সকল স্তরের মানুষের জন্যই এখানে পোশাক এনে একত্র করা হয়েছে। স্তর ভিত্তিতে বিশাল দোকানটাকে কয়েকভাগে ভাগ করা হয়েছে। ঐটার ভিতরই গড়ে তোলা হয়েছে আরো ছোট ছোট দোকান। যেন মানুষের খুঁজতে গিয়ে বা কিনতে গিয়ে ঝামেলায় না পড়তে হয়। নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী যাতে কিনতে – ভাগ করার মুল্য উদ্দেশ্যের মাঝে এটাও একটা।
ব্যবসায়িক বুদ্ধিটা বেশ ভাল। ঢুকার পর এটাকে দোকান মনে না হয়ে বস্ত্র মেলাই মনে হবে। সুপার শপ নামটা এমন দোকানগুলোর সাথেই যায়।

ফারহান ঢুকে প্রথমে ঘুরে ঘুরে পুরোটাই দেখল। মুগ্ধ হল এক কথায়। পেশাদারিত্বের খাতিরে তাকে এমন জায়গায় তদন্ত ব্যতীত অন্যকোন সময় আসা হয়না। খোঁজও নেওয়া হয় না খুব একটা। তাই এটার সম্পর্কে আগে তেমন জানা হয়নি তার।

তবে এই দোকানটা এখনও বেশ নতুন। আট-নয় মাস হল চালু করা হয়েছে। ক্রেতা বাড়ানোর জন্য অনেক উপায়ই অবলম্বন করেছে। যেমন – বিশেষ মূল্যহ্রাস, নির্দিষ্ট সংখ্যক টাকার সামগ্রী ক্রয় করলে অপর একটি বিনামূল্যে। তাতে ক্রেতার সংখ্যা বিপুল হারে বেড়েছে। বড় ক্রেতা ও নিয়মিত ক্রেতা বাড়ানোর জন্য তৃতীয় মাস থেকে কুপন ধরিয়ে দিয়েছে। এই কুপনটা নিয়ে এইটুকুউ জানে ফারহান।
ঘুরে ঘুরে যা দেখলো তাতে প্রতি কাপড়ে কাপড়ে কুপনের কোন টিকিট নেই। এটা নিশ্চয়ই অন্য কোন ভাবে দেওয়া হয় – ভাবলো ফারহান। এখানে সে একজন তদন্তকারী হিসেবে আসলেও, রয়েছে সাধারণ ক্রেতার বেশেই। কারণ, সে চায় না তার পরিচয় জানার পর আসল খুনি বা তার সহযোগী গায়েব না হয়ে যায় আবার।

পরিচয় গোপন করায় একটা বড় সমস্যায়ও পড়েছে। কাউকে জিজ্ঞেস করতে পারছেনা। সাধারণ একজন ক্রেতাকে তো আর কেউ ব্যবসায়িক গোপন কথা বলে দিবে না। কাকে দিয়ে কথাগুলো আদায় করা যাবে ভাবছিল।
তার কাজটা কমিয়ে দিল এক সেলসবয়। অনেকক্ষণ ধরেই তাকা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সেলসবয় এসেছে সাহায্য করার জন্য।
‘স্যার কী নিচ্ছেন বলে ঠিক করলেন?’ পিছন থেকে এসে জিজ্ঞেস করলো।

ভাবনার মাঝে ডুবে থাকায় কিছুটা চমকে গেল ফারহান। আকাশী টি-শার্ট পড়া এক যুবককে দেখল। প্রশ্নটা সে ই করেছে। এখানে এরকম আকাশী-টি-শার্ট পড়া দোকানের লোগো সম্বলিত আরো বেশ কয়েকজনকেই সে দেখেছে। পরিচয়টা বুঝতে অসুবিধা হল না। নামটাও টি-শার্টের উপর লেখা আছে প্রত্যেকেরই। এই ছেলেটার নাম মোর্শেদ।
‘এখনও কিছু ঠিক করতে পারছি না।’ এটা সত্য কথাই বলল ফারহান। তবে প্রয়োজনীয় কথাগুলো জানার জন্য মিথ্যার আশ্রয় নিতেই হবে। ‘আচ্ছা শুনেছি – এইখানে নাকি কুপনের লাকি ড্র তে ৮০% মুল্যছাড় দেওয়া হয়?’
‘না স্যার! আগে দেওয়া হত – এই অফারটি এখন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।’ হাসিমুখে জানালো মোর্শেদ।
‘কিন্তু আমাকে তো বলা হয়েছে, আজকের ড্রতে আমার কুপনের নম্বরটা এসেছে। ফোন দিয়ে বলেছিল।’ প্রায় জেদের মত করে বলল ফারহান।
‘স্যার ফোনটা ভুল করে দেওয়া হয়েছে নিশ্চয়। আমাদের এই অফারটি আরো কয়েকমাস আগেই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।’
‘কে বলে বন্ধ? এইতো আগের সপ্তাহেও একজন নিয়ে গেল।’

একদিক থেকে ফারহান জেদ করছেই – আরেকদিকে ঐ সেলসবয়ও হাসিমুখে ফারহানের কথা প্রত্যাখান করেই যাচ্ছে। কেউই হার মানছে না। ফারহান ইচ্ছে করেই গলার জোর বাড়িয়ে দিয়েছে যাতে করে হাঙ্গামার জের ধরে তার সাথে আলাদাভাবে কথা বলার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়।
সেইভাবেই হল। প্রথমে তাকে কাউন্টারে নিয়ে যাওয়া হল। সেখানেও বাকবিতণ্ডা চলল। একসময় ম্যানেজারকেও আসতে হল। সব শুনে ফারহানকে ঐখান থেকে সরে এসে তার সাথে আলাদাভাবে কথা বলার জন্য বললো।

ম্যানেজারের কক্ষে আসার পর নিজের পরিচয় ও ব্যাজ দেখালো ফারহান।
‘একটা তদন্তের স্বার্থে আসতে হয়েছে। বাইরে চেঁচামেচির জন্য দুঃখিত।’ বললো ফারহান। ম্যানেজার থঁ হয়ে গেছে। তদন্ত করতে কোন গোয়েন্দা একটা পোশাকের দোকানে আসবে – এমন কিছু ভাবেওনি কখনো। গুছিয়ে নিলেন নিজেকে কিছুটা।
‘নাহ! ঠিক আছে। সমস্যা নেই। বলুন, তদন্তে কী সাহায্য করতে পারি?’ সামলে নিয়ে বললেন ম্যানেজার।
‘আপনাদের কুপন লাকি ড্র সিস্টেমটা সম্পর্কে জানতে চাচ্ছিলাম। একটা কেসের সাথে এই ব্যাপারটা অনেকবারই এসেছে।’ বললো ফারহান।

ম্যানেজার আমতা আমতা করছেন – বলবে কিনা সেটা নিয়ে। হাজার হোক, ব্যবসায়িক ব্যাপার। একজন বাইরের লোককে বলাটা কেমন যেন লাগছে। যতই গোয়েন্দা হোক। কিন্তু গোয়েন্দার থেকে লুকিয়ে তাদের চোখে সন্দেহভাজন হওয়ারও কোন ইচ্ছে নেই তাঁর।
‘এটা আসলে ক্রেতা বাড়ানোর জন্য একটা উপায়। খোলার পর কয়েকমাস ক্রেতাদের সাড়া দেওয়াটা আশা জাগানিয়া ছিল। পরে সেটাকে আরো বাড়ানোর জন্য একটা প্যাকেজ ধরিয়ে দেওয়া হয়। প্যাকেজটি ছিল যারা একবারে বারো হাজার বা তার উপরে টাকার পন্য ক্রয় করবে তাদেরকে একটি করে কুপন দেওয়া হবে। পরের মাস থেকে তাদের মাঝে ড্র করে প্রতিসপ্তাহে দুইজন করে ভাগ্যবান ক্রেতা বাছাই করা হবে। ভাগ্যবান ক্রেতা ৮০% ছাড়ে ঐদিন সামগ্রী নিতে পারবে।
এতে আমাদেরও তেমন ক্ষতি হচ্ছেনা। কারণ, বারো হাজার টাকার ঐ প্যাকেজটা সামর্থ্যবান অনেকেই গ্রহণ করছিল। সাথে ব্যবসাও ভালই যাচ্ছিল। সেখান থেকে দুইজনকে এতটা ছাড় দেওয়াটা সমস্যার ছিল না।
এটা চালু ছিল প্রায় তিনমাস। পরবর্তীতে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কারণ রাখলেও ক্ষতি। যাদের সামর্থ্য কম তাদের সাথে অন্যায় হয়ে যাচ্ছিল এক প্রকার। তবে এটা ঝামেলা এখনও রয়েই গেছে।
অফারটি শেষ হওয়ার পরও কয়েকজনকে বলা হয় যে, তাদেরকে এই বিশেষ ছাড়টি দেওয়া হবে। প্রথমবার মেনে নেওয়া হয়েছিল এটা। পরবর্তীতে আরো দুইবার এমন হলেও আমরা ছাড়টা দিয়ে পারেনি। দুইবারই অবশ্য এটা নিয়ে বেশ ঝামেলা হয়েছে। লজ্জায়ও পড়তে হয়েছে আমাদের।
ভুলটা আমাদেরই ছিল, তাদের দেখানো সব যুক্তিপ্রমাণও ঠিক ছিল – কিন্তু এরকম ভুল হতে থাকলে ব্যবসা লাটে উঠতে সময় লাগবে না।
আপনার ক্ষেত্রেও মনে এরকম কিছু ঘটেছে। এই নিয়ে গত একমাসে চারটা। আপনি চাইলে অবশ্য আপনার জন্য এই অফারটি আবার কিছু সময়ের চালু করা যেতে পারে।’

একদমে কথাগুলো বলে থামলেন ম্যানেজার। এতক্ষণ চুপ করে শুনছিলো সব ফারহান। শেষ কথাটা শুনে মনে পড়লো, তার পরিচয় দিলেও ফোন আসার মিথ্যেটা এখনও ভাঙ্গানো হয়নি। ‘আরে নাহ! আমাকে ফোন দেওয়া হয়নি। এরকম কয়েকটা রিপোর্ট আমরা আগেও পেয়েছি। সেটার জন্যই মিথ্যেটা বলতে হয়েছে। জানি তাতে আপনার সাথে দেখা পাওয়াটাও খুব একটা অসুবিধা হবে না।’
‘সেটা তো স্যার সরাসরি দেখা করতে চাইলেও হত না।’ গোয়েন্দা উনার সাথে দেখা পাওয়ার জন্য এমন নাটক করবে!!! এইটা মানতে পারছেন না ম্যানেজার।
‘তাতে সমস্যা ছিল কিছু। আসল উদ্দেশ্যটাই তখন নষ্ট হয়ে যেত।’ বললো ফারহান। কিন্তু তার মাথায় ঘুরছে অন্য ব্যাপার। ‘প্রতি সপ্তাহে দুইজনকে বাছাই করে কী দুইদিনে আসতে বলা হতো না একই দিনে?’
‘একদিনেই। তাতে আমাদের হিসাব রাখতে সুবিধা। ডিসকাউন্টের যেসব বিক্রি করা হচ্ছে – সেটার হিসাবটা একদিনেই সেরে ফেলাটা সুবিধাজনক ছিল আমাদের জন্য।’
‘তাহলে তো, ভুল করে হলে – তিনজন নয় ছয়জনকে এটার কথা জানানো হয়েছিল। তিনজন এসেছে, বাকি তিনজন আসেনি। এমন কি ঘটেছে আগেও যে, ডিসকাউন্ট পেয়েও কেউ আসেনি?’
‘না! এটা কখনো ঘটেনি। নিজে না আসলেও অন্য কাউকে না কাউকে ঠিকই পাঠিয়েছে।’
‘তাহলে ঐ তিনজন কোথায়? তারা আসলো না কেন? জানানো হলে তো ছয়জনকেই জানানোর কথা। কেউ যদি অন্য কাউকেও পাঠিয়ে থাকে তাহলে সেও তো আসবে। কিন্তু তাদের তো কোন অস্তিত্ব নেই। প্রতি সপ্তাহ থেকেই একজন করে আসবে না এটাও অদ্ভুত ঘটনা।’ কথাগুলো বলার পরই বুঝতে পারলো ম্যানেজার এটার কোন উত্তর দিতে পারবে না। ‘এই ড্রয়ের কাজটা ও জানানোর কাজটা কাদের ছিল?’
‘ড্র করে বাছাইটা করতাম আমি। জানানো হত কাউন্টারে ফোন থেকে। সমস্ত ডাটার কপি কাউন্টারে আছে। শুধু কুপনের সিরিয়াল নং টা জানালেই কাউন্টারে যে থাকে সে ই জানিয়ে দিত।’
‘তারমানে বলতে চাচ্ছেন – এই তথ্যগুলো সবার হাতেই রয়েছে? যে কেউই এইগুলো জানতে পারবে? এটার জন্য তো আপনাকে অ্যারেস্ট করা যায় – কারণ এই তথ্যগুলো সুবিধা নিয়ে বেশ কিছু মানুষের ক্ষতি সাধিত হয়েছে।’ কঠিন মুখে বললো ফারহান।
‘না স্যার! সবার হাতে যাওয়ার উপায় নেই। কাউন্টারে কম্পিউটারের পাসওয়ার্ড প্রটেক্টেড। এবং এটা প্রতিদিন বদল করা হয়। যে কোন ফাইল ওপেন করতে গেলেও পাসওয়ার্ডটা এন্টার করাতে হবে। তিনটা শিফটে তিনজন থাকে। এদের বাইরে আর কারও এক্সেস নেই।’
শুনে কিছু সন্তুষ্ট হল ফারহান। নিরাপত্তা ব্যবস্থা অনেক ভাল মানের। ‘ভুলটা যে করেছে তার বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে?’
‘কোন ব্যবস্থাই আসলে নেওয়া হয়নি। নেওয়া যায়নি ভালভাবে বললে।’ নিরাসক্তভঙ্গিতে জানালেন ম্যানেজার।
‘কেন?’ একই সাথে রাগ ও বিস্ময় দুটোই প্রকাশ পেল ফারহানের।
‘ভুলটা আসলে তিনবার করেছে তিনজন। তিনজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলে আমূল পরিবর্তন করতে হবে সবকিছু।’

এটায় সত্যিই কিছুটা চমকালো ফারহান। খুনী যে এত চতুরতার সাথে প্ল্যান সাজাবে সেটা ভাবতেও পারেনি। বুদ্ধির তারিফ করে নিল মনে মনে।
কিন্তু একটা খটকা আছে। খুনীর কথা কেউই জানতে পারেনি আগে – এতদূর তদন্ত এগুবে সেটারও নিশ্চয়তা ছিল না। ছিল না তদন্ত হওয়ার নিশ্চয়তাও। এতদূর আগানোর পিছনের মূল কারণ ভাগ্যের সহায়। কেসটা শুরুর পর থেকে এটা তেমন একটা জটিল বা অন্ধকারে হাতড়ানোর মত কিছু ঘটেনি। অল্পতেই খুনীর অস্তিত্ব টের পাওয়া গেছে।
সেইখানে এতগুলো মানুষকে তার প্ল্যানে শামিল করা মানে – প্ল্যানটা সবাইকেই জানিয়ে দেওয়া। শুধু তাদেরকে সূত্র দিয়ে যাচ্ছে যারা।

ব্যাপারটাকে অনেকটা এমন লাগছে যে – সে খাবার ফেলে রেখে গেছে – যদি পিঁপড়ার দল টের পায় তাহলে হামলে পড়বে। আর টের না পেলে – কোন সমস্যাই নেই। খাবার তো খাবারের জায়গাতেই রাখা আছে। আর সেও নিরাপদ দূরত্বেই।

****

কাউন্টারে বসা ঐ তিনজনকে ডাকলো ফারহান।
তাদের মাঝে ভয় পাবার কোন নমুনা পাওয়া গেল না। জিজ্ঞেস করাতে কেউ মিথ্যেও বললো না। সবাই ই বলল, তাদেরকে ফোন করে বলে হয়েছিল কাজটা করতে। তিনজনকে তিনটি নাম্বার বলে দিয়েছে – ঐগুলোতে ফোন করার জন্য।
প্রথমে তারা মানা করলেও, এটাতে তেমন কোন ক্ষতি হবে না – সাথে টাকাও পাচ্ছে বড় অঙ্কের – তাই রাজি হয়ে যায়। টাকার অর্ধেকও তাদের রাজী হওয়ার আগেই দেওয়া হয়। তাই মানার করাটা কঠিনই ছিল তাদের জন্য।
শুধু একটা ফোন করে লক্ষ লক্ষ্য টাকা পেলে কে কতক্ষণই বা ন্যায়বান থাকতে পারবে?
ওদেরকে দিয়ে ফাঁদটা পাতিয়ে খুনী তার কাজটা করে নিয়েছে।

ফারহান আশা করেনি এত তাড়াতাড়ি তারা ভুলটা স্বীকার করে ফেলবে। বিশেষ করে, ভুল করে ফোন গুলো করার পর তারা এই কথাটি জানায়নি। বরং এখন জানিয়ে তাকে ঠান্ডা করতে চাচ্ছে বলেই মনে হল।
এটা জানতে চাইলে তিনজনে একই জবাব দিয়েছে – যেই লোক তাদেরকে ফোনগুলো করার জন্য বলেছে – সে ই জানিয়ে দিয়েছে কোন গোয়েন্দা যদি এই ফোন করাটা নিয়ে জেরা করে তাহলে তাকে সত্যিটাই জানিয়ে দিতে।

খুনী যে একটা খেলায় মেতে উঠেছে, সেটা বুঝতে আর কোন সন্দেহ নেই ফারহানের।

প্রথম থেকে ঘটনাগুলো ভেবে নিচ্ছে, ডাক্তার ফায়েজ আসলেন তিন খুনের সন্দেহ নিয়ে। কিছু ব্যাপারে তিনটি লাশে মিল খুঁজে পাওয়ায় তদন্ত শুরু হল। আব্দুস সালাম সাহেবের বাসা থেকে একটা তথ্যই বের হয়ে আসলো, একবার কলিংবেল বেজেছিল কিন্তু দরজায় কাউকেউ পায়নি কাজের মেয়েটা। সেই সুযোগে ঘরে ঢোকার একটা সম্ভাবনা ছিল।

আনোয়ার সাহেবের বাসায় কিভাবে ঢুকেছিল সেটা এখনও পরিষ্কার না। কিন্তু সালাম সাহেবের ঘটনার মতো মৃত্যুর ধরণটি ছাড়াও মিল ছিল ছিল সুপার শপের কুপনের ব্যাপারটা।

তৃতীয়টায় সিরাজ সাহেবের ক্ষেত্রে, এইগুলো তো ছিলই – সাথে ছিল কাজের ছেলের হুট করে ছুটি নেওয়াটা এবং ঐদিন ছেলেটার দরজা খুলতে দেরী করাটা। খুন সেই কাজের ছেলেটা করেনি, কিন্তু তার সাহায্য নিয়েছে খুনী। এটাতে ধরা পড়ার সম্ভাবনা ছিল – কিন্তু সুপার শপ নিয়েও একটা ধাঁধাঁ সাজিয়েছে। যেটাতে তাকে ধরাটা মনে হচ্ছে খুবই সোজা – কিন্তু সে ঠিকই নিরাপদেই আছে। শুধু ঘোল খাওয়াচ্ছে।

প্রতিটা জায়গায়ই সে সূত্র রেখে যাচ্ছে যেন তাকে খুঁজে বের করা হয়। কিন্তু থাকছে আড়ালেই। কারণ তাকে শনাক্ত করার মত এখনও এমন কোন চিহ্ন পাওয়া যায়নি। শুধু পাওয়া গেছে সে জড়িয়ে আছে – এটার প্রমাণ।

এখন পর্যন্ত এত কিছু জানার পরও একটা দিক রয়ে গেছে আড়ালেই। কেন করছে সে এসব? কোন উদ্দেশ্য তো অবশ্যই আছে। কী সেটা?
দৈবভাবে বেছে তো কাউকেই মারছে বলে মনে হয় না – কিন্তু যাদের খুন হয়েছে তাদের একে-অপরের সাথে কোন সম্পর্কের আলামতও পাওয়া যায়নি।

এই জটিল সমীকরণ মিলিয়ে খুনীকে বের করার শর্ত একটাই। ভিক্টিমদের সম্পর্কটা জানা। তাহলেই খুনী কে হতে পারে সে সম্পর্কে জানা যাবে।

তবে তার চেয়েও বড় প্রশ্ন, খুন কি এই তিনটাতেই শেষ? নাকি খুনির তালিকায় রয়েছে আরো কেউ?





১৫...

অধীতীর দেওয়া রিপোর্টগুলো দেখছে। সময়ের একটুও হেরফের হয়নি, যথাসময়েই দিয়েছে। মেয়েটার দক্ষতা নিয়ে ফারহানের সন্দেহ আগেও ছিল না, এখন তো আরোই নেই। তাড়াতাড়ি ফিল্ডে নামিয়ে দিতে পারলেই খুশি সে। তার সহযোগী হবার যোগ্য মেয়েটা।
এখন পর্যন্ত কোন স্থায়ী সহযোগী নিয়ে কাজ করেনি ফারহান। একেকবার একেকজন। কারো কাজই পছন্দ হয় না ফারহানের। কেউ ই কাজের প্রতি ততটা নিষ্ঠ নয়। আর ফারহানের সাথে কাজ করা মানেই মাথার খেলা দেখানোর সুযোগ। দুঃখের হলেও সত্য যে কেউ ই পারেনি ফারহানকে সন্তুষ্ট করতে।
যেমন – কোন সময় তথ্য সংগ্রহের কথা বললে – ফারহানের পছন্দ সেই তথ্যগুলো কাগজে পড়া। কারণ, মুখে বলতে গেলে অনেক সময়ই কিছু কথা বলা হয় না। মানবিক অভ্যাসের কারণেই ভুলে যায়। তাতে কেসগুলো সমাধান করতেও বেগ পেতে হয়। কিন্তু তার কোন সহযোগীই সেই কাজটা করতে পারেনি। অজুহাত সময়ের অভাব। যে কয়জন দিয়েছে তারাও খুব ভালভাবে দেয়নি। বরং মুখে বললে, তারা ঐ কাগজের চেয়ে ভাল বলতে পারতো।

এইদিক থেকে অধীতী বলা যায় সন্তুষ্টই করতে পেরেছে। গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলো আলাদাভাবে মার্ক করে দিয়েছে। সেই সাথে গুছিয়ে দিয়েছে লেখা তথ্যগুলো। যাতে পড়তে গেলে বিরক্তি ভাবটা না আসে।

ফারহানকে অবশ্য কেসটার শুরুতে বলা হয়েছিল অধীতীকে সাথে রাখতে। কিন্তু গোয়েন্দা বিভাগের পরিচালকের কথাটা মানেনি ফারহান। তার পিছনে অবশ্য কারণ আছে যুক্তিযুক্ত। গোয়েন্দা বিভাগের পরিচালকের এই সুপারিশের প্রেক্ষিতে সে বলেছিল,’স্যার! অন্য কেস হলে সাথে রাখতে কোন সমস্যা ছিল না। কিন্তু এই কেসটায় কাউকে যুক্ত করতে চাচ্ছি না।’
‘কেন?’
‘কেসটা খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ লাগছে না আমার কাছে। যতদূর মনে হচ্ছে, ডাক্তার কিছুটা বাড়িয়েও বলেছে। এটা সত্যিই আমাদের মাথা ঘামানোর বিষয় কিনা সেটাও মনে হচ্ছে না। মৃত্যুগুলো স্বাভাবিক। এই মুহুর্তে কাউকে নিলে হয়তো দেখা যাবে, কোন রহস্যই নেই। সেই কারণে তার কাজের প্রতি আগ্রহটা কমতেও পারে। আবার, এক ক্ষেত্রে কেসটায় সফল হওয়ার চান্সও কম – যদি কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘতেও – এতদিন পরে কোন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা ছাড়া শুধু কথার উপর ভিত্তি করে সলভ করাও যাবে না। এতে তদন্তকারী দলটারই মানহানী হওয়ার সম্ভাবনা আছে। জেনেশুনে কাউকে নিয়ে আগুনে ঝাঁপ দিয়ে তার ক্যারিয়ার নষ্ট করতে ইচ্ছা হচ্ছে না।’ সেই সময় বলেছিলো ফারহান।
‘কথা ঠিকই বলেছো। কেসটা খুব সাধারণ বা অসাধারণ কোনটাই মনে হচ্ছে না আমার। সন্দেহ যেহেতু একজনের হয়েছে – সেটা ভাঙতে পারলেই যথেষ্ট। আর তুমি তো অল্প রহস্য থাকলেও সেটাকে ঠিকই খুঁজে বের করতে পারো। তাই তো কেসটা তোমাকেই দিয়েছি।’ হেসে বলেছিলেন গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান।
‘স্যার একটা অনুরোধ! কেসটা যেন মিডিয়া কাভারেজ না পায় সেক্ষেত্রে একটু খেয়াল রাখতে হবে। মানে এইটা আপাতত গোপন রাখতে হবে। কোন কারণে এই কেসটা সমাধান না ওরা আমাদেরকে ছিড়-ছিবড়ে খাবে। তখন মুখ দেখানোই কঠিন হয়ে যাবে। এইটা গোপন থাকাই ভাল হবে।’

সেজন্যেই যোগ্যতা থাকার পরও অধীতীকে এই কেসে ঢুকানো যাচ্ছে না। তবে তথ্য জানাতে গিয়ে অল্প হল ঢুকে পড়েছে।

ডাক্তার ফায়েজকে নিয়ে আগ্রহ জাগানিয়া এমন কোন তথ্য নেই। বয়স আঁটত্রিশের কোঁটায়। ডাক্তারী বলতে শুধু এম.বি.বি.এস. ডিগ্রিটাই আছে। এরপর আর কিছুই করেননি। বাবা ছিলেন এক পৌরসভার মেয়র। রাজনৈতিক পরিবারের ছেলে। উন্নতি হওয়ার প্রধান কারণ এটাই। ঐ প্রভাব খাটিয়েই এতদূর আসতে পেরেছেন। আসলে তেমন একটা যোগ্যতা নেই। প্রভাবশালী না হলে হয়তো পড়ে থাকতেন আরো নীচেই। সরকারী একটা হাসপাতালে চিকিৎসক হিসেবে ঢুকতে গেলে কিছু প্রথাগত কাজ অবশ্যই করতে হয়ে। সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে এইটা একটা বাঁধা হলেও ডাক্তার ফায়েজদের মত লোকের জন্য সেটা কঠিন কিছুই নয়।
এছাড়া উনাকে নিয়ে আর তেমন কোন আকর্ষণীয় তথ্যই নেই।

পড়ার সময় ফারহানের মাথায় পুরোনো প্রশ্নটাই বারবার জাগছিলো। ইউনিট যদি উনার কাজে এতটাই অদক্ষ হয়ে থাকেন – তাহলে ঐ লাশগুলো দেখেকিভাবে বুঝলেন যে ঐগুলো খুন! উনার সম্পর্কে কোন তথ্যই তো উনার এই দক্ষতার পক্ষে কথা বলছে না। হঠাৎ করেই এই দক্ষতা পেয়ে গেলেন! বিশ্বাস করতে কষ্টই হচ্ছিলো ফারহানের।
তবুও বিশ্বাস করে নিতে হল। কারণ, এই অদক্ষতা ও প্রভাব খাটিয়ে উপরে উঠা ছাড়া উনার বিরুদ্ধে এমন কোন তথ্য আর নেই। রেকর্ডও একদম পরিষ্কার। হতে পারে প্রথমবারের মত ভালভাবে লাশগুলো নিয়ে ভেবেছেন। এটার জন্যই হয়তো সন্দেহ জেগেছে।
এই এক সন্দেহের জন্য উনার উপর সন্দেহ আসাটা তেমন একটা কাজেও দিচ্ছে না।

ডাক্তার ফায়েজের ঐ রিপোর্টটায় উনার বিভিন্ন সময়ের কিছু ছবি সাঁটানো আছে। এটা কেন দিয়েছে অধীতী নিজেও জানে না। হয়তো প্রমোশন পাওয়ার জন্য বসকে খুশি করতেই। এটা ভেবে হালকা হাসলো ফারহান।

একটা ছবিতে গিয়ে চোখটা আঁটকে গেল ফারহানের।
ডাক্তার ফায়েজের বাবা খুন হয়েছিলেন। ছবিটা সেই সময়কার। এমনিতে ছবিটা দেখলে তেমন কিছু মনে হবে না, ষোল বছরের বয়সী এক ছেলে বাবার জন্য কাঁদছে আর তাকে কয়েকজন স্বান্তনা দিচ্ছে। এটা স্বাভাবিক। কিন্তু ছবির মাঝে তাদের থেকে একটু দূরেই দাঁড়িয়ে থাকা অপর লোকটির চেহারা তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো।

ছবির লোকটাকে পরিচিত লাগছে তার। গত কয়েকদিনে বেশ কয়েকবারই এই লোকটির ছবি দেখতে হয়েছে তাকে। এত বছর আগের ছবিতে চিনতে অসুবিধা হলেও ফারহানের চিনতে কোন অসুবিধাই হল না।

সেই লোকের ছবিই, যার সম্পর্কে আগের কোন কথাই কেউ জানেনা। রূপকথার গল্পের কোন চরিত্রের মত হুট করেই যিনি আত্নপ্রকাশ করেন।
আনোয়ারুল কবির!

****

যার ভরসা পাওয়ার জন্য ছুটে এলেন – এসে শুনলেন সেই মানুষটি গত হয়েছেন বেশ কদিন আগেই। আজগর আলী খানের মত দুঃখী এই মুহুর্তে পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি খুঁজ পাওয়া যাবে না। উনার সবচেয়ে বড় দুঃখটা একই শহরে থেকেও সবচাইতে কাছে বন্ধুটিকে শেষবার দেখতে না পারাটা।
সিরাজুল ইসলাম উনার ছোট কালের বন্ধু। একই গ্রামে বেড়ে উঠেছেন। একই সাথে সময় কাঁটিয়েছেন কত – তার হিসাব নেই। পড়ালেখাও একই সাথে। চাকরীতে প্রবেশও একই সাথে। এমন কী দুই বন্ধু মিলে বেশির ভাগ সময়ই চাকরী করেছেনও একই জায়গাতে। পেশায় সিরাজ সাহেব ডাক্তার আর তিনি পুলিশ। দুই ভুবনের বাসিন্দা হয়েও কাছেই ছিলেন সবসময়।
গত কয়েকমাস কোন খবর নেননি বন্ধুর। আসলে অবসর জীবনটায় এতটা মুষড়ে পড়েছিলেন যে, কোন কিছুর কথাই মনেছিল না উনার। গালি দিলেন নিজেকেই।

সিরাক সাহেবের পরিবারকেও এর মাঝেই এক চোট কথা শুনিয়ে দিলেন। তাঁকে কেন জানানো হল না তখন!
সিফাত এতবার ক্ষমা চ্যেও কোন লাভ হল না। আজগর সাহেবের মেজাজের কথা তাদেরও জানা আছে। আর তারাও এমন এক কাজ করেছে যে, মেজাজ দেখানোটা অযৌক্তিকও লাগছে না। কোন ফাঁকে যে উনার কথা ভুলে গেছে সবাই স্মরণই করতে পারেনি। সময়টাও আকস্মিকভাব এসেছিল। পুরোপুরিই অনাকাঙ্খিত ভাব। ঐ সময় মনে না আসাটাই স্বাভাবিক।
তবে গোয়েন্দাদের তদন্ত শুরুর পর জানানো কথা যে ভুলে গেছে সেটা মনে হয়েছিল সিফাতের। কারণ, পুলিশ বলত একদম কাছের এই একজনই তাদের। যদি কেউ খুন করেই থাকে – তাহলে তাকে খুঁজে বের করার জন্য তাদের ভরসাও এই লোকটিই। বন্ধুর জন্য সবই করতে পারেন তিনি। কিন্তু তখন না জানিয়ে পরে ঐভাব জানালে যে, উনি প্রচন্ড কষ্ট পাবেন সেটাও জানতো। তাই জানায়নি।

আজগর সাহেব প্রথমে বাচ্চাদের মত হাউমাউ কেঁদে, মেজাজ খারাপকরে অনেক কথা বলার পর ঠান্ডা হলেন।
‘কিভাবে কী হইছিল? সিরাজের হইছিল কী?’ জানতে চাইলেন।
‘ডাক্তার তো বলে হার্ট অ্যাটাক। কিন্তু......’ বলে শেষ করতে পারলো না।
‘হার্ট অ্যাটাক! সিরাজের? অসম্ভব। বাঘ একটা সিরাজ! সে হার্ট অ্যাটাক করতেই পারে না।’ কঠিন মুখে বললেন আজগর সাহেব।
‘হ্যা! আমরাও এইটা বিশ্বাস করতে পারিনি। পরে গোয়েন্দার তদন্ত শুরু হওয়ার পর বুঝা গিয়েছে।’
‘গোয়েন্দা পর্যন্ত জানে – আর আমি জানি না!’ আবারো রেগে গেলেন আজগর সাহেব।

সিফাত কিছু না বলে চুপ করে আছে। আবার কী বললে ক্ষেপে যান আজগর সাহেব, এই ভয়ে চুপই আছে। তখন সামলে নিল সিফাতের মা। ‘গোয়েন্দাকে আমরা জানাইনি, আজগর ভাই! আরো দুইটা একই রকম ঘটনা ঘটেছে। সবগুলো মিলিয়েই গোয়েন্দার সন্দেহ হয়। সেভাবেই তারা জানে।’

কিছুটা ঠান্ডা হলেন আজগর সাহেব। সব জানতে চাইলন। খুলে বলা হলো সব। সব শুনে বুঝে গেলেন ঘটনাটা পরিকল্পিত। খুব ঠান্ডা মাথায় কাজটা করা হয়েছে। কিন্তু কিভাবে মারলো সেটা শুনে বিচলিতই হলেন। খুন যদি করা হয়েই থাকে অবশ্যই চিহ্ন থাকবে কোন, উপসর্গ থাকবে। এসব কিছু না থাকা মানে খুনি খুব জেনেশুনেই নিজের চিহ্ন মুছে কাজটা করেছে। যার জন্য সব না জানলে এবং না ঘাটলে বুঝা যাবে না এইটা খুন।

মুহুর্তেই মনে পড়ে গেল 420s এর মেসেজের কথা। যেটার জন্য সমাধান চাইতে বন্ধুর কাছে এসেছিলেন – সেই বন্ধুও একই মেসেজ পায়নি তো? ‘ভয়ংকর মৃত্যু’ ‘ভয়ংকর মৃত্যু’র কথা বলা আছে মেসেজে। এটা তারই এক নমুনা না তো?
সব শোনার পর আজগর সাহেবের এর থেকে বেশি ভয়ংকর মৃত্য কিছু হতে পারে বলে মনে হচ্ছে না। নাহলে ইস্পাত কঠিন মানুষকে হার্ট অ্যাটাক করিয়ে মারাটা এত সহজ নয়।

‘সিরাজের মোবাইলটা কোথায়? ঐটা দাও তাড়াতাড়ি।’ সিফাতকে বললেন তিনি।
মোবাইল্টা বন্ধ করে রেখে দিয়েছিল সিফাত। তার বাবার রুমেই রেখে দিয়েছিল। আজগর সাহেব চাইতেই দিতে দেরী হল না। কিন্তু হুট করেই মোবাইল চাওয়াতে একটু অবাকও হয়েছে সে। মোবাইলটা এনে দিল আজগর সাহেবকে।

মোবাইলটা হাতে নিয়েই চালু করলেন। তারপর প্রথমেই মেসেজে ঢুকলেন। যদি ডিলেট না করে থাকে তাহলে এখনও থাকার কথা আগের মেসেজগুলো। বেশি ঘাটতে হলো না। পেয়ে গেলেন ঘাতককে। ঘাতক আর কেউ না। সেই 420 – ই। উনাকে যে মেসেজগুলো দেওয়া সেগুলো সিরাজ সাহেবকেও দেওয়া হয়েছে। উনার মতই এগুলোকে কারো কাছেই বলেন নি। হয়তো পাত্তাই দেন নি।
দুর্বল ভঙ্গিতে সোফার উপর হেলে পড়লেন আজগর সাহেব। উনার পরিণতিও যে এটাই ঘটতে যাচ্ছে বুঝতে দেরী হল না। তবে বাঁচার আশা আছে এখনো। খুনিকে ধরারও।

‘আরো কয়েকটা এক রকম ঘটনা ঘটেছে শুনলাম। আর কে কে মারা গেছে এইভাবে?’ জানতে চাইলেন।
‘একজন আব্দুস সালাম। আরেকজন... মনে নেই নামটা ভাল করে, মনে হয় আনোয়ার কবির না কী যেন!’ জানালো সিফাত।

জানার পর চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে পড়ার উপক্রম হল আজগর সাহেবের। এত অবাক উনাকে কখনো দেখা যায়নি।





১৬...

পুরো রিপোর্টটি পড়ে শিস দিয়ে উঠলো ফারহান।
ঐতিনজনের মাঝে আনোয়ারুল কবিরের শুধু ছবি ছাড়া আর কিছুই পায়নি নতুন। যা আছে সবই এখনকার কথা। অতীত এখনো আড়ালেই। ভালভাবেই নিজেকে লুকিয়েছিলেন তিনি – ভাবলো ফারহান। শুধু একটা ছবি কোন ফাঁকে রয়ে গিয়েছিল হয়তো।

তাদের তিনজনের মাঝে সম্পর্কও খুঁজে পাওয়া যায়নি কোন। তবে একটা সংযোগ পাওয়া গেছে।

সিরাজুল ইসলাম ও আব্দুস সালাম দুইজনই কর্মজীবনে ছিলেন ঐ পৌরসভাটাতেই যেটার মেয়র ছিলেন ডাক্তার ফায়েজের বাবা। শুধু এইটুকুই না – দুইজনই ঐ জায়গাটা ছাড়েনও একই সময়ে।
ডাক্তার ফায়েজের বাবা যেই বছর খুন হয়েছিলেন – সেই বছরই।

সবগুলো তথ্যই কোন না কোন ভাবে ডাক্তার ফায়েজের সাথে সম্পর্কযুক্ত। ডাক্তার ফায়েজ খুবই গুরুত্বপূর্ণ এক ব্যক্তি এই কেসে। রহস্যের জটও মনেহয় কিছুটা ছাড়ানো শুরু করেছে।
সবগুলো মানুষই হয়তো জড়িত ডাক্তার ফায়েজের বাবার খুনের সাথে। হয়তো এইজন্যই মানুষগুলো খুন হচ্ছে। কে জানে হয়তো ডাক্তার ফায়েজই খুনী। প্রতিশোধ নিচ্ছে বাবার খুনের। ধাঁধাঁর মাধ্যমে কেসটাকে রেখে চাচ্ছেন বাবার খুনের ঘটনাটাকে সামনে আনতে। এইজন্যই লাশগুলো এতটা আত্নবিশ্বাসী ছিলেন।

ডাক্তার ফায়েজের সাথে কথা বলা দরকার – অনুভব করলো ফারহান। ফোন দিল সে। সন্দেহ করছে এইটা বলবে না, বলবে কেসটা নিয়ে কিছু কথা আছে – লাশগুলোর সম্পর্কে আরো কিছু জানতে চায়।

পেল না ফোনে। বাসায় ফোন দিল, নেই। হাসপাতালে, নেই। হঠাৎ করেই যেন উধাও হয়ে গেলেন ডাক্তার ফায়েজ!






১৭...

‘এইটা তো একটা পিঁপড়া মাত্র!’ হতভম্ব হয়ে গেছে ওয়েনের কান্ডে ক্যাথি। ‘এইটা এমনই বা কী ক্ষতি করে ফেলত?’

বাকীরাও একই কথা ভাবছে। একটা পিঁপটা দেখে এত সতর্কতার কী দরকার! বড়জোর কামড় দিলে একটু জ্বলতই হয় তো। সবার আগে থেকেই ধারণা ছিল ওয়েন একটু পাগল ধরণের। এন্টামোলজিস্টরা একটু এরকমই হয়। কিন্তু তাই বলে আজ যা করলো সেইটা একটু বেশি রকমের পাগলামীই মনে হল বাকীদের।

সবার মনে কথাই বুঝতে পারছে ওয়েন। তাকে নিয়ে অন্যদের ধারণা সম্পর্কেও সে অবগত। কিন্তু সে যে ক্যাথির জীবন বাঁচিয়েছে এইটাই বুঝতে পারেনি কেউ। বুঝব কিভাবে! এই ক্ষুদ্র পিঁপড়া নিয়ে তো কারো কোন ধারণাই নেই। ধারণা থাকলে, সবাই ই তার মত সাবধান হয়ে যেত।

‘শুনো বন্ধুরা! এইটা হতে পারে একটা পিঁপড়া। কিন্তু এইটার আকৃতিটা কি দেখেছো?’ ওয়েন বললো।

অন্যরাও এখন মাথা দোলালো। হ্যা! এই পিঁপড়াটা আকৃতিতে সাধারণ পিঁপড়ার দশগুণের বেশি বড়। দেখতেও একটু অন্যরকম। কালো-কমলা মিশেল রং-এর। শরীরটা কালো, মাথার দিকটা কমল। হুলগুলোও কালোর উপর কমলা প্রলেপের মত। হুলগুলো বেশ বড়ও।

‘এই পিঁপড়াটা হল প্রাণীজগতের সবচাইতে বিষাক্ত প্রাণীদের একটি। একটা কামড় যদি দিত পারে তাহলে মারা যাওয়ার জন্য চার মিনিট সময়ই যথেষ্ট। বেশি হলে বিশ মিনিটের মাঝে তুমি অবশ্যই মৃত থাকতে।’ ক্যাথির দিকে তাকিয়ে বললো ওয়েন। ক্যাথি হাঁ করে রয়েছে। থরথর করে কাঁপছে। অন্যরাও একটু চমকে গেল। একটা পিঁপড়ার কামড়ে মৃত্যু হতে পারে – এমন কিছু জানা ছিল না কারোরই।

‘পিঁপড়াদের মাঝে এটা হল বড় পিঁপড়া জাতের একটি। যদিও সবচেয়ে বড় পিঁপড়া হল বুলডগ অ্যান্ট। এটার নাম জ্যাক জাম্পার অ্যান্ট। মিরমেইসা গণের পিঁপড়া। পিঁপড়াদের মাঝে সবচাইতে ক্ষেপা প্রজাতি এরা। আকৃতিতে এরা বেশি হলে ১২-১৪ মিলিমিটার হয়। ক্যাথির দিকে যেটি এগিয়ে আসছিল – সেটি একটি কর্মী পিঁপড়া। রাণী পিঁপড়া আরো বড় হয়। প্রায় ১৬ মিলিমিটারের মত।
এরা বালি ও পাথুরে মাটিতেই থাকে। এদের পাওয়াও যায় শুধু আমাদের এই সাউথ অস্ট্রেলিয়াতেই। যদিও আমার জানা ছিল না এই বীচে এদের বসবাস আছে। হয়তো নতুন কলোনি গড়েছে। এরা দিনেই কাজ করে। রাতে বিশ্রাম নেয়। খোলা জায়গায়ই এদের বেশি পছন্দ। এইজন্যই তো বীচের মাঝে এসে পড়েছে।
তো যা বলছিলাম, এটার হুলে যে বিষটা বা এসিডটা রয়েছে এটা মানুষের জন্য ক্ষতিকারক। একধরনের অ্যালার্জিক প্রভাবের সৃষ্টি করে। অনেক মানুষেরই অ্যালার্জির কারণ এই পিঁপড়াটাই। অ্যালার্জিক প্রভাবটার ফলেই অ্যানাফিলেটিক রিয়েকশনের শিকার হয় মানুষ। অ্যানাফিল্টিক মানে হল প্রতিরক্ষাহীনতা। এটা এতটাই ভয়ানক যে মুহুর্তেই কাউকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে পারে। এটার সিম্পটমগুলো হল – অ্যালার্জির ফলে শরীরের অঙ্গ ফুলে যাবে, লাল লাল দাগের সৃষ্টি হবে, খিচুনী বাড়বে, শ্বাসনালী মনে হবে আঁটকে যাচ্ছে, রক্ত চাপ কমে যাবে। যেটার জন্য একটা মানুষকে মরতে বিশ মিনিটের বেশি লাগবে।
এই পিঁপড়াগুলো খুবই ক্ষেপাটা স্বভাবের। নিজেদের বাইরে কাউকেই সহ্য করতে পারেনা। তাদের চলার পথে কোন বাঁধা পড়লে হুঁল ফুটিয়ে শেষ করে দিতেই দ্বিধা করেনা। এইটা তোমার দিকে এগুচ্ছিলো এই কারণেই।’ ক্যাথির দিকে তাকিয়ে বলল।

‘তার চলার পথে রয়েছিলে তুমি। ভাগ্যিস দেখেছিলাম – নাহলে তো গিয়েছিলে আজকে জমের বাড়ি।’ হেসে বলল ওয়েন। তার দিকে কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকালো জন।
‘কিন্তু ধরো যদি কামড় দিতই, তাহলে? ক্যাথিকে নাহয় তুমি বাঁচালে জানো দেখে – যারা না জানে তারা কী করবে? সবাই ই কি মরবে নাকি কামড় দিলেই?’ জানতে চাইলো সাদাব।
‘না! বাঁচানোর একটা উপায়। একটা প্রতিষেধক আছে। ঐটা ব্যবহার মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করা যাবে। সাউদার্ন অস্ট্রেলিয়ার সব স্বাস্থ্যকেন্দ্রেই এপিনেফ্রিন বা এড্রেনালাইন তো রয়েছেই। বিপদটা তো এইদিকেই বেশি ঘটে থাকে।’

ওয়েনের কথা শুনে সাদাব ভাবনার দেশে চলে গেল। আরো কিছু প্রশ্ন রয়েছে তার।
‘আচ্ছা ওয়েন! এই পিঁপড়াগুলোকে যদি কৃত্রিমভাবে বালি ও পাথুরে মাটির মাঝে রাখা হয় তাহলে কি বাঁচবে না?’ জানতে চাইলো সাদাব।
‘বাঁচবে। তবে বেশিদিন না। যেহেতু দিনের আলোতেই এরা থাকতে পছন্দ করে – তাই কৃত্রিম ভাবে রাখা যাবে না দিনের আলো ছাড়া। এদের গড় আয়ুই তো কম। একবছরের মত। প্রতিকূল পরিবেশে বেশি টিকবে না। আরেকটা বিপদও রয়েছে – নিজেদের পরিবেশের বাইরে গেলে এরা আরো বেশি বিপদজ্জনক হয়ে উঠে।’

এইটুকুই যথেষ্ট। অতিরিক্ত হিংস্রতাই তার দরকার। অনেকদিন ধরেই এমন ক্ষুদে খুনীর অপেক্ষায় ছিল সে। এখন পেয়ে গেছে। পরিকল্পনা সাজানো আছে – শুধু বাকি ছিল এটারই। এখন পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করতে খুব একটা সমস্যা হবে না।
উইকএন্ডের রি-ইউনিয়ন সাদাবের জন্য ঐখানেই শেষ। প্রস্তুতি এখন দেশে ফেরার। বহুবছর ধরে অপেক্ষা করছে দেশে যাওয়ার, কাজটা শেষ করার।

এখন সময়টা সেই কাজটাই সম্পন্ন করার।






১৮...

ইসতিয়াক আহমেদ ও দ্বীন ইসলামের লাশগুলো পোস্টমর্টেমের দায়িত্ব পান ডাক্তার সিরাজুল ইসলাম। জেলা সদর হাসপাতালের সিনিয়র ডাক্তার তিনি। ফরেনসিক জ্ঞানটাই বেশি। লাশ কাঁটা-ছেড়ার কাজটা উনারই।
জেলা পুলিশ প্রধান তার বন্ধু আজগর আলী খান। আর আজগর আলীর কেসের সাথে যুক্ত মেডিক্যালের কাজগুলো তিনি উপস্থিত তিনিই করে থাকেন। আর এরকম দুই মেয়র হত্যার মত হাই-প্রোফাইল কেসের জন্য কেউই রিস্ক নিতে চায় না। যত ভাল লোকদের সম্ভব দায়িত্ব দেওয়া হয়।

যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই কেসের অপরাধীকে খুঁজে বের করার নির্দেশনা রয়েছে উপর থেকে। কয়েকদিন পরেই নির্বাচন। এর আগে এরকম ঘটনাটা অনাকাঙ্খিত ব্যাপার। হত্যাকারীক অতিশীঘ্রই ধরতে না পারলে জনসাধারণে মাঝে বিরাজমান আতঙ্কটা থেকেই যাবে। এতে নির্বাচনটাও পিছিয়ে যাবে। এখনও যে কয়দিন সময় আছে – তার আগে কেসটা সলভ করতে পারলে সময়মতই নির্বাচনটা অনুষ্ঠিত হতে পারবে।

সিরাজুল ইসলাম যেটা আশা করছিলেন – লাশ পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর সেটাই প্রমাণিত হল এতক্ষণ পর্যন্ত যতগুলো কথা শুনেছিলেন – তাতে ধারণা ছিল অতি বিষাক্ত কোন গ্যাসের কারণে এমনটা হয়েছে। যেটাতে মৃত্যু ঘটার জন্য চোখের পলক ফেলার সময়টাই যথেষ্ট।

ইসতিয়াক আহমেদের লাশ পরীক্ষা করে যেটা পেলেন – ইসতিয়াক আহমেদ গ্যাসটা শুধু বায়ুমন্ডল থেকে শুঁকেই গ্রহণ করেননি, উনাকে এটা গলাধঃকরণও করানো হয়েছে। উনার স্ত্রীকেও একইভাবে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে হয়েছে। শুধি তাঁদের পেটেই বিষের নমুন পাওয়া গেছে। কতটা নির্দয়ের মত মারা হয়েছে তাঁদেরকে – ভেবে শিউরে উঠলেন ডাক্তার। এমনিতেই বাতাসের সাথে গ্যাসটা নাক দিয়ে ঢুকে শ্বাস আঁটকে দিয়েছিল – সাথে পেটের ভিতরেও গ্যাসটা ছড়িয়ে পড়ে সব অচল করে দিয়েছিল। পেটে কিভাবে গেল সেটা বুঝাটা কঠিন কিছু না। তাদের লাশের পাশেই চায়ের কাপ ছিল। সেটা দিয়েই বিষটি পেটে প্রবেশ করেছে। চায়ের কাপে কিভাবে আসলো সেটাও একটা বড় প্রশ্ন। কেউ এটা কাপের ভিতর রাখতে গেলে নিজেও মারা পড়তে পারে। এটাকে চায়ের মধ্যে মেশানোর সবচেয়ে বড় সুযোগ চা-পাতা ও চিনির মাধ্যমে।
চা-টা পরীক্ষা করে দেখলেন। চায়ের সাথে যেটা মেশানো হয়েছে – সেটা চিনিনা। এক প্রকারের লবণ। অল্প পরিমাণ পানিতেই এইটা দ্রবীভূত হয় – সাথে সৃষ্টি করে বসবাস অযোগ্য এক পরিবেশ। আর সেখানে চিনির পরিমাণে এটাকে পানিতে মিশিতে খাওয়াটা?
আর ভাবতে পারলেন না তিনি। অত্যন্ত হিংস্রভাবে মারা হয়েছে তাদেরকে। দ্বীন ইসলামের লাশের পোস্টমর্টেমটা করা বাকী।

সেটা থেকেও ব্যতিক্রম কিছু পাওয়ার আশা করছেন না তিনি।

****

সায়ানাইড গ্যাস!
খুনগুলো করার জন্য এই অস্ত্রটাই ব্যবহার করা হয়েছে। ইসতিয়াক আহমেদ ও তাঁর স্ত্রীকে মারা হয়েছে সায়ানাইডের জলীয় দ্রবণ খাইয়ে। এটা এতটাই বিষাক্ত যে, এটা দিয়ে একজনকে মারতে চাইলেও সাথে আরো কয়েকজনকে নিমিষেই গুড়িয়ে দেওয়া যায়।
কারণটা হল, আক্রান্ত ব্যক্তি এটার প্রভাবের ফলে বমি করবে। বমি থেকে গ্যাসটা ব্যাপনের মাধ্যমে বাতাসে ছড়িয়ে বাতাসকে বিষাক্ত করে তুলে। যার জন্যই তাঁদেরকে উদ্ধার করতে যাওয়া আরো কয়েকজন মানুষও মারা গেছে।

দ্বীন ইসলামকেও এভাবেই মারা হয়েছে। উনার পাকস্থলীতে সায়ানাইড ছিল – এমন কোন ট্রেস পাওয়া যায় নি। উনার ঘরটাতেই ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল গ্যাসটা। কাজটা অত্যন্ত বিপদজ্জনক ছিল খুনির জন্যও। একটু অসতর্ক হলে তাকেও এই বিষাক্ত গ্যাসের শিকার হতে হত।

রিপোর্টটায় আরো বলা আছে, সায়ানাইডের লবণ চায়ের সাথে ব্যবহার করে ইসতিয়াক আহমেদকে মারা হয়েছে। রান্নাঘরেই ঐটা থাকার কথা – চিনির কৌটাতে। চায়ের মাঝে চিনি হিসাবে এটাই মিশিয়েছিলেন জাহানারা বেগম। বেচারীর এই সম্পর্কে কোন ধারণাই ছিল না। নিজ হাতে বিষকে টেনে নিয়ে মৃত্যুকে স্বাগতম জানালেন।
কিন্তু চিনির জায়গায় রান্নাঘরে এটা যাওয়ার তো উপায় নেই। কেউ তো ঘরের ভিতর নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার জন্য বিষ রাখবে না। ঐটা হেঁটে হেঁটেও তো আর যায়নি। কেউ নিয়ে গেছে সাথে করে।

খুনী যে ই হোক – সে চায়নি এভাবে এটাকে খুনের ঘটনা প্রমাণ করতে। তার সায়ানাইডের লবণের সম্পর্কে জানাশোনা থাকলেও ঐটার এতটা ক্ষতিকারক প্রভাবের কথা জানা নেই হয়তো। এটা জানলে অন্য কোন ব্যবস্থাই নিত। এজন্যই দ্বীন ইসলামকে মারতে আর এই রকম দিকে যায় নি। সরাসরিই গ্যাসটা দিয়ে একজনকেই সরিয়েছে।

কারণটা এখনো ধোঁয়াশাতেই রয়েছে। দুই মেয়র পদপ্রার্থীকে সরিয়ে দেওয়ার মত কাজ করতে পারে স্বার্থান্বেষী তৃতীয় কোন ব্যক্তি। কিন্তু সে এতটা ভুল করতো না। একজনকে মেরে আরেকজনকে ফাঁসিয়ে দিত আর নিজে থাকতো নিরাপদে।
তাহলে কে? দুইজনেরই কমন শত্রুও তো নেই।

রান্নাঘর থেকে ঐ চিনির কৌটাটা আনার জন্য লোক পাঠালেন।
লবণটার মালিককে সে সম্পর্কে উনি অবগত আছেন। উনাকে ডেকে পাঠালেন।

****

কয়েকদিন আগের কথা।

সকালে পুলিশে স্টেশনে এসে মাত্রই একটা ফাইল হাতে নিলেন আজগর আলী খান। গতকাল থেকে বেশ কয়েকটি কেস ফাইল করা হয়েছে। বেশির ভাগই জমি-জমা সংক্রান্ত।
সেই সময়ই এক ভদ্রলোক হাজির হলেন। ভদ্রলোক বললেও দেখতে লোকটাকে পাগলের মতই লাগছে। স্যুট পড়ে এসেছেন কিন্তু পায়ে স্যান্ডেল, চুল এলেমেলো, এমনকি মুখটায় সকালের নাস্তার দাগটাও রয়ে গেছে।

এসেই আজগর আলীর খোঁজ করলেন। একটা কেস ফাইল করবেন। তাঁর যেন কী হারিয়ে গেছে। হারিয়ে গেছে বলাটা ভুল হবে – উনার ভাষ্যমতে এগুলোকে চুরি করা হয়েছে।

‘বলেন কী চুরি হইছে আপনার?’ থানায় আসার পরই টেবিলে চা এসে গেছে। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতেই জিজ্ঞাস করলেন।
‘লবণ!’ অল্প কথাতেই যেন রহস্য বাড়াতে চাচ্ছেন – এমন ভাবে বললেন ভদ্রলোক।

লবণ চুরি যাওয়াতে কেস করতে আসে কেউ! ভেবে পেলেন না আজগর আলী। লোকটাকে আসলেই পাগল মনে হচ্ছে উনার। লোকটাক চেনেন আগে থেকেই। কেমেস্ট্রির প্রফেসর আব্দুস সালাম। কিছুটা পাগলের মতই বলেই গুজব রয়েছে। আজগর আলী অবশ্য আগে কখনও উনার পাগলামী দেখেননি। আজ লবণ চুরি যাওয়ার কেস করতে এসেছেন পরে মজা নেওয়ার সুযোগটা হাতছাড়া করতে চাইলেন না।

‘কাজের মহিলা-টহিলা নিছে হয়তো। আরেক প্যাকেট কিনে ফেলেন – কেস করার কী আছে এতে?’ হেসে হেসে বললেন আজগর আলী খান।

আব্দুস সালাম অবশ্য হাসিতে যোগ দিতে পারলেন না। উনার সম্পর্কে অন্যান্যদের ধারণা সম্পর্কে তিনি অবগত আছেন। এই পুলিশ অফিসারও যে তাদের বাইরের কেউ না সেটাও বুঝতে পারলেন।

‘যেই লবণটা হারিয়েছে সেটা সাধারণ কোন লবণ না। অত্যন্ত বিষাক্ত জিনিস ওটা। ভুল লোকের হাতে গেলে অনেক কিছুই করতে পারে ঐটা দিয়ে।’ গম্ভীর গলায় বললেন সালাম সাহেব।
‘বিষাক্ত মানে?’ একটু অবাক হলেন আজগর আলী।
‘হ্যা! বিষাক্ত! লবণটা পটাশিয়াম সায়ানাইডের। সায়ানাইড অত্যন্ত বিষাক্ত গ্যাস। সবাচাইতে বেশি বিষাক্ত এই পটাশিয়াম সায়ানাইড। ঐটাকে তরল কিছুর সাথে মিশালে বিক্রিয়া করে ব্যাপন প্রক্রিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে বাতাসে। তখন সেই জায়গায় মানুষ থাকলে সাথে সাথে মারা যাবে নয়তো অসুস্থ হয়ে পড়বে। আমি একটা রিসার্চের জন্য এইটা আনিয়েছিলাম। সকালে উঠে দেখি সব আছে শুধু এটাই নেই।’
‘হয়তো অন্য কোথাও রেখেছেন। ভাল করে খুঁজে দেখেন। শুধু এই লবণটাই বা কে চুরী করতে যাবে?’
‘না অন্যকোথাও রাখিনি। এটা সাবধানেই রেখেছিলাম। এত বিষাক্ত কেমিক্যাল আমি অনিরাপদে রাখব না। এইটা চুরি করলে সাধারণ কেউ চুরি করবে না, যে করবে সে কোন উদ্দেশ্য নিয়েই করবে।’

****

সালাম সাহেবের রিপোর্ট করার পরদিনই ইসতিয়াক আহমেদ খুন হয় ঐ লবণ দিয়ে। তারপর ঐ রাতেই দ্বীন ইসলাম। আবারো সেই সায়ানাইড দিয়েই।
কার কাজ বুঝার উপায় নেই। সালাম সাহেবকে আনা হয়েছে এই কারণেই। এরকম ঘটনা ঘটাতে পারলে এক উনার অথবা উনার কোন সহযোগীর দ্বারাই সম্ভব। কারণ, পটাশিয়াম সায়ানাইডের কথা জানলে তা একমাত্র জানার কথা তাদেরই। কিন্তু সন্দেহটা ওদের উপর পড়েছে না কারণ ঘটনার দিন কেউ ই ইসতিয়াক আহমেদের বাসার আশেপাশেও ছিল না। তাঁর সহকর্মী তখন শহরেই ছিল না। সালাম সাহেব ছিলেন ক্লাসে।
সব মিলিয়ে সালাম সাহেব নিরাপদেই আছে। হতে পারে উনি কাউকে দিয়ে করিয়েছেন। কিন্তু এরকম করার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। ইসতিয়াক আহমেদ বা দ্বীন ইসলাম দুইজনের কারো সাথেই উনার কখনো কথাই হয়নি। কোন শত্রুতা আছে বলেও শোনা যায়নি।

তবে সায়ানাইড সম্পর্কে উনার থেকে ভাল এখানে অন্য কেউই জানেনা। তদন্তের স্বার্থেই সাথে রাখা হল উনাকে। একদিক থেকে উনার উপর চোখ রাখাও হবে। আরেকদিকে সাহায্যও পাওয়া যাবে। তদন্ত করতে গিয়ে কেমিক্যালের বিরূপ প্রভাবটা থেকে রক্ষাও পাওয়া যাবে।
পুলিশ বাহিনীর বেশির ভাগেরই এটার সম্পর্কে কোন ধারণা নেই। সে জন্যেই তো ইসতিয়াক আহমেদের লাশ বের করতে গিয়ে প্রথমে দুইজন পুলিশ নিজেরাই মরতে বসেছিল।

জাহানারা বেগমের রান্নাঘর থেকে চিনির কৌটাটা আনতে লোক পাঠালেও – ভয়ে কেউ ই যেতে পারেনি ঐ মৃত্যুপুরীতে। অগ্যতা সালাম সাহেবকে নিয়ে তাঁকেই যেতে হল। সালাম সাহেবকে সাথে রাখার সিদ্ধান্তটা যে ভুল না সেটার প্রমাণও দিলেন সালাম সাহেব নিজেই। তিনি না থাকলে আজগর আলীও এতক্ষণে মৃতদের দল ভারী করতেন।

যে ঘরটাতে ইসতিয়াক আহমেদ মারা গিয়েছেন সেটা ছিল বাইরের ঘরটাই। গ্যাসের প্রভাব এখনও দূর হয়নি সেখান থেকে। এখনও বিপদ রয়ে গেছে। আজগর সাহেব প্রথমে ঢুকতে গেলে তাঁকে বাঁধা দেন সালাম সাহেব। মুখে মাস্ক পড়ে যাওয়ার কথা বলেন। কারণ, সায়ানাইডের প্রভাব কোন বদ্ধ জায়গায় থাকলে সেটা সহজে দূর হয় না। এই তিন-চারদিনেও হয়নি।
প্রথমে রান্নাঘর থেকে লবণটা উদ্ধার করা হল। এটাই পটাশিয়াম সায়ানাইড কিনা সেটা পরীক্ষা ছাড়া বুঝার উপায় নেই। চিনির সাথে মিশে রয়েছে। তবে অটোপ্সি রিপোর্টে যেহেতু এসেছে তার মানে এটাই। কিন্তু এটা এখানে কিভাবে আসলো সেইটা বুঝতে পারছেন না। এভাবে মিশাতে গিয়ে খুনী নিজেও মরতে পারতো।

আজগর আলীকে এটা জানালেন। তারমানে খুনী এইটা মিশানোর জন্য বেশি সময় পায়নি। সকাল থেকে মৃত্যু হওয়ার আগ পর্যন্ত সময়টাতেই সে এইটা করেছে। আগে থেকে মিশালে আরো আগেই মারা পড়তেন ইসতিয়াক আহমেদ ও তাঁর পরিবার। কারণ, চা তো খাওয়া হবেই। চিনির ব্যবহারও লাগবে অন্য কোন কাজে।
ঐদিন ঐ সময়টার ভিতরে ইসতিয়াক আহমেদের বাসায় কারা কারা এসেছিল সেটা জানলেই পাওয়া যাবে খুনীকে। কিন্তু সেইটা একমাত্র জানতো তাঁরাই। তারমানে খুনী এখনো নিরাপদেই রয়েছে। তাকে সনাক্তকরার কোন উপায়ও নেই।
আরও কিছুক্ষণ বাসার অন্যান্য জায়গা ঘুরে ফিরে খুঁজে দেখলেন। কাজে লাগার মত কিছুই পাওয়া গেল না।

****

দ্বীন ইসলামকে খুনটা করা হয়েছে বাতাসে সায়ানাইড গ্যাসটা ছেড়ে দিয়েই। কিন্তু গ্যাসটাকে একদম গ্যাস হিসেবে নয় – তরল আকারে ঘরে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ঘরের মেঝেতে লবণাক্ত পানির ফোঁটা পাওয়া গেছে। ঠিক পানির ফোঁটা না – পানি শুকিয়ে যাওয়ায় শুধু দানা দানা লবণই পড়ে থাকতে দেখা গেছে।

পরীক্ষা করে সেটাকে নিশ্চিত করেছেন সালাম সাহেব। ডাক্তারও সিরাজও লাশগুলো পরীক্ষা করে এটাই পেয়েছিলেন।
আজগর আলীর সাথে এই কেসে ডাক্তার সিরাজ থাকবেনই – সেটা জানা কথা – সাথে সালাম সাহেবকে পেয়ে ভালই হয়েছে। কিন্তু খুনী কে? এইটা এখন পর্যন্ত খুঁজে বের করতে পারেননি তাঁরা।
‘সালাম সাহেব! খুনী কী রকম হতে পারে বলে মনে হচ্ছে?’ যদিও কাজটা তাঁরই, কিন্তু সালাম সাহেবের কিছু কাজে উনার প্রতি শ্রদ্ধাটাও বেড়ে গেছে। দ্বীন ইসলামের বাড়ির মেঝেতে লবণটা তিনি দেখলেও সেটাকে গণ্য করেননি। সালাম সাহেবের কাছে সেটাকে অন্যরকম মনে হয়েছিল। পরে তো উনার ধারণাই ঠিক হল।

‘দেখুন আজগর সাহেব! আমি কোন গোয়েন্দা না। আমার ধারণা সঠিক নাও হতে পারে। তবে একটা কথা বলতে পারি – খুনী পানি ছিটানোর স্প্রেয়ারের মালিক। লিকুইড পটাশিয়াম সায়ানাইডটা সে স্প্রেয়ার দিয়ি ছিটিয়েছে। এর ফলেই লবণের ফোঁটাগুলো একই পরিমাণের ছিল। কম-বেশ হয়নি। হাতে ছিটালে এতটা নিখুঁতভাবে ছিটানো সম্ভব না। পরিমাণটা কম-বেশ হত। আর এটা ছিটানোর জন্য কোন কিছুর সাহায্য লাগবেই – হাতে ছিটালে নিজের প্রাণের ঝুঁকিও আছে। পানি ছিটানোর যন্ত্রটাই এই কাজটা ভাল করতে পারবে।’ সালাম সাহেব বেশ ভেবেছেন এই বিষয়টা নিয়ে বলা যায়। বিজ্ঞানের মানুষ তো – ভাবনাটা উনার মাঝে এমনিতেও একটু ভাল ভাবেই কাজ করে।
‘খুনী হয়তো একটা স্প্রেয়ার কিনে নিয়েছে। এইটা থেকে কেমন করে খুনী শনাক্ত করা যাবে?’ ভ্রুক্ষেপ করলেন ডাক্তার সিরাজ।
‘হ্যা সেইটা নিতে পারে। কিন্তু ইসলাম সাহেবের বাসায় যাওয়ার রাস্তাটাতে বেশ কয়েকটা চায়ের দোকান রয়েছে। সেগুলো সারারাতই খোলা থাকে। কাউকে স্প্রেয়ার হাতে নিয়ে এত রাতে ঐদিকে যেতে দেখলে অবশ্যই তাকে জিজ্ঞেস করানোর জন্য থামাবে। এতে খুনী অনেক মানুষের নজরেই পড়ে যাবে। অপরিচিত মানুষকে ঐদিকে যাওয়ার পরের সকালেই তাদের মেয়র খুন! এতে খুনী ধরা পড়ার সম্ভবনাও অনেক বেশি। এই রিস্ক কোন খুনী নিবে বলে মনে হয় না। এটা এমন কেউ করেছে যার হাতে স্প্রেয়ার দেখলে কেউই সন্দেহ করবে না, এমন কী আঁটকাবেও না। পরবর্তীতে অতটা মনেও রাখবে না।’
‘এমন কে থাকতে পারে?’ জানতে চাইলেন না ঠিক, নিজেও ভাবছেন এমনভাবেই বললেন ডাক্তার সিরাজ।
‘অনেক লোকই হতে পারে। তবে সবচাইতে কমন যেই লোকটি – সে হল ইনসেক্টকিলার বা এক্সটার্মিনেটর। কেমিক্যাল সম্পর্কে হালকা জ্ঞান তাদেরও থাকে।’ বললেন আব্দুস সালাম।

সালাম সাহেব স্প্রেয়ারের কথা বলার পর পরই একটু ভাবনায় পেয়ে বসেছিল আজগর আলীকে। চোখে ভাসছিল, ইসতিয়াক আহমেদের রান্নাঘরের পাশের বারান্দায় সারিবদ্ধ হয়ে মরে থাকা লাল পিঁপড়ার দলটাকে। এগুলোকে এতটা গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়নি তখন।
কিন্তু পিঁপড়াগুলো নিজে থেকে এভাবে মরতে পারে না – যদি না তাদের উপর কোন ঔষুধ প্রয়োগ না করা হয়। ঔষধটা যদি ইসতিয়াক আহমেদ বা তার স্ত্রী ছিটাতেন – তাহলে অবশ্যই পিঁপড়াগুলো পরিষ্কার করে ফেলতেন। এখনো ঐভাবেই থাকা মানে খুব বেশি আগে ঐগুলোর উপর ঔষুধ ছিটানো হয় নি – আর এগুলো সরানোর মত সময়ও পাননি জাহানারা বেগম। তার আগেই মারা গেলেন তাঁরা দুজনই। তাহলে বাইরে থেকেই কেউ এসে পিঁপড়াগুলোর উপর ঔষুধ ছিটিয়ে দিয়ে গেছে।

‘সালাম সাহেব! আপনি তো কেসটাকেই সলভ করে দিলেন।’ হাসতে হাসতে বললেন আজগর আলী। ‘এইটা ইনসেক্ট কিলারেরই কাজ! খালি পার্থক্য ইনসেক্টের জায়গায় হিউম্যান কিল করে ফেলেছে এইবার।’

****

পোকা –মাকড় দমনের জন্য লোকাল একটি প্রতিষ্ঠান আছে। প্রতিষ্ঠান না বলে বলা ভাল এরকম একটা দল আছে। স্থানীয় এক কৃষিবীদ নিজ উদ্যোগ ও অর্থায়নে এটি শুরু করেছেন। চারা-গাছ, বীজ, ফসলের জমি – এসবকে পোকা-মাকড়ের হাত থেকে রক্ষা করার জন্যই তিনি এটি চালু করেছেন। এটার ফলে কিছু মানুষের কর্মসংস্থানও হচ্ছে আবার সাথে অনেকের জমির ফসলও রক্ষা পাচ্ছে। সাথে তাঁর ছোট ভাইটাকেও বেকার বসে থাকতে হচ্ছেনা। অন্তত চাকরী পাওয়ার আগে কয়েকটাদিন এটার সাথে থেকে সময়টাকে ভাল কাজে ব্যয় করতে পারছে।
অবশ্য সেই কৃষিবীদ এখন তাঁর ভাইয়ের উপর হতাশই। দুই বছর হয়ে গেল – এখনও ঐখানেই পড়ে আছে। চাকরী খোঁজার কোন ইচ্ছাও নেই তার মাঝে।
উনার ভাই ই দলটাকে তদারক করে। তিনি শুধু টাকা দেন। প্রথমে পুলিশ উনার সাথেই যোগাযোগ করেন। পরে তিনি তাঁর ভাইয়ের কথা বলে দেন।

ভাই এবং পুলিশ দুইজনের কাছ থেকেই থানা থেকে তলব করা হয়েছে শুনে কিছুটা অবাক হয় আনোয়ার। তাকে কেন পুলিশ ডাকবে সেটাই বুঝতে পারছে না। কোন রকমে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে থানায় হাজির হল।

‘আপনি আনোয়ারুল কবির?’ থানায় যাওয়ার পর তাকে দেখে জানতে চাইলেন আজগর আলী।
‘জ্বি! কিন্তু আমাকে এখানে কেন ডাকা হল সেটা বুঝতে পারছি না।’
‘ইনসেক্টিসাইড ইরেকশন টিমটা তো আপনার নির্দেশেই চলে?’
‘হ্যা!’
‘ইসতিয়াক আহমেদ ও দ্বীন ইসলামের খুনের কথা তো শুনেছেন? এই দুটো খুনের সাথে পুলিশের সন্দেহ আপনার টিমেরই কেউ জড়িত। আমরা সরাসরি আপনার কাছে যেতে পারতাম, কিন্তু আমাদের দেখলে খুনী সাবধান হয়ে যেতে পারে। তাই আপনাকে এখানে আসতে বলেছি।’

ফ্যাল ফ্যাল করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো আনোয়ার। কিছুই মাথায় ঢুকছে না। গরীব কয়েকটা মানুষের দুই দুইজনকে খুন করার সাহস আছে বলে তার মনে হচ্ছে না। আবার, তার উপর যাদের খুন হয়েছে তারা দুজনই রাজনীতির সাথে জড়িত।
‘কে জড়িত?’
‘সেটা জানার জন্যই আপনাকে ডেকেছি।’
‘দেখুন, আমার মনে হয় আপনাদের কোথাও কোন ভুল হচ্ছে। আমার কোন লোকজনই এরকম কাজ করবে বলে মনে হয় না। ওরা সবাই দিন আনে দিন খায় ধরণের মানুষ।’
‘আমি বলিনি আমরা নিশ্চিত। এটা একটা সন্দেহ মাত্র।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে! এখন বলুন আমি আপনাকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি?’
‘ইসতিয়াক আহমেদ যেদিন খুন হলেন, সেদিন কি আপনার টিমের কেউ উনার বাসায় গিয়েছিল?’
‘হ্যা! রহমত গিয়েছিল ঐদিন।’
‘ঠিক কী কারণে? উনিই পাঠাতে বলেছিলেন কাউকে না রহমত নিজে থেকেই যাওয়ার কথাটা বলেছিল? মনে করে বলুন!’

এই জায়গায় এসে একটু থমকে যায় আনোয়ার। ঐদিন তো তার কাছে ইসতিয়াক আহমেদ কোন লোক পাঠানোর জন্য বলেনি। রহমতই বলেছিল যাবে। ঐখানে নাকি তাকে যাওয়ার জন্য বলে দিয়েছিল। রহমত তার অতি বিশ্বস্ত লোক। তাই তার কাছ থেকে আর কিছু না জেনেই অনুমতি দিয়েছিল। এখন তো মনে হচ্ছে পুলিশের কথাই ঠিক।

উত্তর পাচ্ছেন না দেখে একটু গলা চড়িয়েই আবার প্রশ্নটা করলেন। উত্তর পেলে। ঠিক যা আশা করেছিলেন তাই।
রহমতের সাথে খুন হওয়া দুইজনের কোন শত্রুতা আছে কিনা জানতে চাইলেন। উত্তরটা জেনে সন্তুষ্ট হলেন।

কেস পুরোপুরি সলভড এখন।

****

রহমতের সাথে দ্বীন ইসলামের সম্পর্ক খারাপ অনেক বছর আগে থেকেই। অনেক বছর আগে রহমত এতটা দরিদ্র ছিল না। বেশ ভাল জমিজমা ছিল তার। বেশ স্বাচ্ছন্দেই ছিল তখন।
দ্বীন ইসলাম তার সরলতার সুযোগ নিয়ে জমিগুলো আত্নসাৎ করে নেয়। পথে বসে যায় রহমত। শুধু ভিটে-মাটিটাই রয়ে যায়। ঐদিকে দ্বীন ইসলাম কুট-কৌশল খাটিয়ে সকল জমির দলিলও বদলে ফেলে। এতে করে রহমতের আর কোন সুযোগই ছিল না জমিগুলো ফিরে পাওয়ার। হাল ছেড়ে দেয়।
কিন্তু দ্বীন ইসলামের প্রতি প্রচন্ড ঘৃণা ছিল তার। দুই চোখে দেখতে পারতো না লোকটাকে।

ইসতিয়াক আহমেদের সাথে শত্রুতা ছিল না। তবে এইটুকু জানা গেছে, একবার রহমতকে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছিলেন তিনি। অপরাধ কী ছিল সেটা জানা যায় নি। তবে এরজন্য সপ্তাহখানেক কারাভোগ করতে হয়েছিল রহমতকে। অনেকেই বলে চুরি করে ধরা পড়েছিল। সেজন্যেই পুলিশে দেওয়া হয় তাকে। চুরিটা করেছিল – তার এক বছর বয়সী মেয়েটা অসুস্থ ছিল - তাকে ডাক্তার দেখানোর জন্য। উলটো সাতদিন সাতদিন কারাভোগ করার কারণে মেয়েটা মারা যায়।

খুন করার জন্য এরচেয়ে বড় কারণ থাকতে পারেনা। দুটো লোককেই ঘৃণা করতো সে। একজন তাকে সর্বহারা করেছে – আরেকজন কন্যাহারা। রহমতের বিশ্বাস ছিল, সে জেলে না থাকলে মেয়েটাকে হত না।

ঐদিকে চিনির কৌটার মুখেও রহমতের আঙ্গুলের ছাপ পাওয়া গেছে। তার স্প্রিংলার বা স্প্রেয়ারটাতেও সায়ানাইডের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। সমস্ত প্রমাণই রহমতের বিরুদ্ধে। খুনী যে সে ই সেইটা বুঝতে দেরী হল না।

ধরতেও বেগ পেতে হয়নি। রহমতের মাঝে পালিয়ে যাওয়ার কোন তাগিদও ছিল না। এলাকাতেই হাওয়া লাগিয়ে ঘুরছিল। হয়তো ভবেছিল তাকে কখনও ধরতেও পারবে না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর বাঁচতে পারেনি।





১৯...

এতদিন ধরে ফারহান যে সম্পর্কটার খোঁজে ছিল – সেটা আজগর সাহেবের কাছ থেকে পেয়ে গেছে। কেসটা সলভ করতে আর খুব বেশি দেরী হবে না।

রাতে অধীতীর দেওয়া রিপোর্টগুলো পড়তে পড়তে বাসায় আর যাওয়া হয়নি। অফিসের চেয়ারে হেলান দিয়েই ঘুমিয়ে যায়। সকালে চোখে দেখে সিফাত তাকে ডাকছে। তার সাথে ছিলেন আজগর সাহেবও।
তারপর কেসটা নিয়ে কথা বলতে বলতেই পূর্বের কথা শোনান আজগর সাহেব। তা থেকেই সম্পর্কটা বেরিয়ে আসে। দুই মেয়র খুনের হাই প্রোফাইল কেস ছিল বলেই মনে আছে এটা উনার।
তারপর নিজের পাওয়া 420s এর উদ্ভট মেসেজগুলোও দেখালেন ফারহানকে। সিরাজুল ইসলামকেও যে একই ধরণের মেসেজ পাঠানো হয়েছে সেটাও জানালেন। বাকী দুইজনকেও যে একই ধরনে পাঠানো হয়েছে সেটা সম্পর্কে ধারণাটাও জানালেন।

সবশুনে ফারহান এসবের সাথে ডাক্তার ফায়েজের সম্পর্কটা মিলাতে পারছে না। উনার বাবার খুনের তদন্তকারী ও সেইটার সাহায্যকারীদেরই বা উনি কেন খুন করতে যাবেন। কোন যুক্তিই খাটছে না।
ডাক্তার ফায়েজ হঠাৎ করেই উধাও হয়ে যাওয়ায় ফারহানের ধারণা খুন গুলো ডাক্তার ফায়েজেরই করা।

আব্দুস সালামের কাছ থেকে খুন করার অস্ত্রটা মানে লবণটা চুরি যায়। উনার কাছে না থাকলে হয়তো রহমত খুনগুলো করতে পারতো না ঐটা ব্যবহার করে। সেই ক্ষেত্রে আব্দুস সালামের প্রতি ডাক্তার ফায়েজের ক্ষোভটা মানা যায়। আর যেহেতু সালাম সাহেবের ব্যক্তিগত চিকিৎসকও উনিই ছিলেন – সেই হিসেবে উনি ধীরে ধীরেই পরিকল্পনা করে খুনটা করেছেন। মানা গেল।
আনোয়ারুল কবিরের ক্ষেত্রেও একটা যুক্তি খাটানো যায়। আনোয়ার কবির না থাকলে রহমত এত সহজে গ্যাসটা ছড়িয়ে দেওয়ার উপকরণ পেত না। আর কেমিক্যাল সম্পর্কে ধারণাও পেত না। কারণ, রহমতকে এগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জ্ঞানটা দিয়েছেন আনোয়ার সাহেবই। এই দিক থেকেও ডাক্তার ফায়েজের ব্যাপারটা মানা যায়।
এই দুই ব্যক্তি পরোক্ষভাবে উনার বাবার খুনের জন্য দায়ী বলা যায়।
কিন্তু সিরাজুল ইসলামের প্রতি ক্ষোভ থাকার কারণটা কী? তা৬র বাবার খুনের সাথা তো সিরাজুল ইসলামের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ কোন সম্পর্কই ছিল না। আর আজগর আলী খানকেও এরকম মেসেজ দিয়ে হুমকীই বা কোন ক্ষোভে দিচ্ছে?

ফারহান এইটুকু বুঝে গেছে – হত্যাকান্ডগুলো ঘটার পিছনে জড়িয়ে আছে বাইশ বছর আগে ঘটা ঘটনাটাই। দুইটা পরিবার ধ্বংস হয়েছিল সেদিন। ক্ষোভ জন্মে থাকলে তাদেরই কারোর জন্মাবে। সেইক্ষেত্রে সন্দেহের তালিকায় এখন ডাক্তার ফায়েজের সাথে আরেকটি নামও উঠে আসছে। ডাক্তার ফায়েজের থেকেও ক্ষোভের পরিমাণটা তার আরও বেশি থাকার কথা। কারণ, বাবা-মা দুইজনকেই হারিয়েছিল সে।
ইসতিয়াক আহমেদের ছেলে!

‘ইসতিয়াক আহমেদের ছেলে ছিল একটা বলেছিলেন। তার সম্পর্কে আরো কিছু বলুন!’ বললো ফারহান।
‘ছেলেটার সম্পর্কে তেমন কিছু জানিনা। তার বাবার মৃত্যুর পর তো কোন খোঁজই পাইনি। তবে যদ্দুর শুনেছি তার বাবার এক বন্ধু তাকে নিয়ে গিয়েছিল।’ জানালেন আজগর আলী খান।
‘ঐ লোকটার সম্পর্কে কতটুক জানেন?’
‘তেমন কিছুই না। নামটা মনে আছে শুধু। ইসতিয়াক আহমেদের মৃত্যুর পর আরো কিছু সমস্যা হয়েছিল সম্পদ নিয়ে। তখন এসেছিলেন তিনি। ভাল লোক। ইকবাল হাসান নাম। কলাবাগান না কোন জায়গায় থাকে যেন বলেছিল।’

আজগর আলী খান এসে কেসটাকে আলোর পথ দেখানো শুরু করেছেন বলে মনে হল। যদিও উনি হুমকীস্বরূপ মেসেজগুলোতে শঙ্কিত। ফারহান তাঁকে আস্বাস্ত করলো, উনার কিছুই হবে না। সার্বক্ষণিক নিরাপত্তার জন্য সে তো সাথে থাকবেই – আর এই কেসটার সাথে এই হুমকির সম্পর্ক থেকে থাকলে, হুমকী দাতা ও খুনী একই ব্যক্তি।

খুব শীঘ্রই ধরা পড়তে যাচ্ছে সে।

****

ইকবাল হাসানের সাথে কথা বলে চমক জাগানিয়া তথ্যই জানতে পারলো তারা। ইসতিয়াক আহমেদের ছেলে সাদাব আহমেদ বহু বছর পর কয়েকদিন আগেই দেশে এসেছিল। আব্দুস সালামের মৃত্যুর ঠিক দুইদিন আগে।
আসার পর থেকেই এক ব্যাগ হারানো নিয়ে খুব মন খারাপ করেছিল। দেশে আসতেই ছিনতাইয়ের শিকার হল ভেবে যতদিন রয়েছিল – ততদিন মন খারাপ করেই ছিল।

ইকবাল হাসান ব্যাগটায় কী ছিল সে সম্পর্কে জানতে চাইলে সাদাব বলেছিল, ‘বাবার খুনটার পিছনে শুধু একজনই না, একটা চক্র ছিল। একজনকে ধরে থামিয়ে দেওয়া হয়েছে চক্রটাকে। কোন প্রমাণও পাওয়া যায়নি বলে তারা আরামেই থেকেছে এতগুলো বছর। প্রমাণগুলো সংগ্রহ করেছিলাম আমি। ঐ ব্যাগটাতে ছিল সব। ভেবেছিলাম বাবা-মাকে ন্যায় বিচার দিতে পারবো কিন্তু হল না।’

অল্প কয়দিন থেকেই চলে যায়। কিন্তু এই কয়েকদিনের মাঝেই ঐ কেসের সাথে জড়িত একজনের খুন হল। তারমানে ঐ ব্যাগটা হারায়নি – ছিনতাইয়ের মত করে ঘটনা সাজিয়ে তুলে দিয়ে গেছে অন্য কারো কাছে।
এই খুনগুলোর পিছনে সাদাবের হাত রয়েছে বললে – ভুল হবে না।
কিন্তু কার কাছে দিয়ে গেছে সেগুলো? দেশের বাইরে থাকে, দেশে কারো সাথে পরিচয়ও নেই – হঠাৎ করে এই বন্ধুটা আসলো কোথা থেকে।

যদি কেউ থেকেও থাকে – তাহলে সেও ঐ ঘটনাটারই কেউ একজন।
ঘুরেফিরে একটা নামই আসছে। আজগর আলী খানও নিশ্চিত।

ডাক্তার ফায়েজ!

২০...

আজগর সাহেবকে নিয়ে আবারো ঢুঁ মারলো আব্দুস সালামের বাসায়। দুইটা কাজ মূলত।
একটা মোবাইলের মেসেজ চেক করা, দুই ঐ বাসাত কাজের মেয়ে রিনা আরো কিছু জানে বলে সন্দেহ হচ্ছে ফারহানের। মূলত সুপার শপে কাউন্টারে বসা লোকদের নিয়ে নাটকটা করানোর পরই এই সন্দেহ। রিনাকে দিয়েও এই রকম নাটক সাজানো অসম্ভব না।

জোবাইদা বেগম ফারহানকে দেখে খুশি হলেন। আগেরবার আসার পর ফারহানের কথা শুনে উনারও মনে হয়েছে সালামা সাহেবকে খুনই করা হয়েছে। খুনীকে ধরার কোন খবর এখনও না পাওয়ায় একটু মুষড়ে পড়েছিলেন। গোয়েন্দাদেরকে আবার আসতে দেখে বুঝে ফেলেছেন খুনী হয়তো ধরা পড়ে গেছে নয়তো ধরা পড়ার পথে।

‘তদন্তে কী খবর ডিটেকটিভ?’ জিজ্ঞেস করলেন তিনি।
‘সফল হওয়ার পথে।’ হাসিমুখে জানালো ফারহান। ‘ম্যাডাম, কিছু মনে না করলে স্যারের ফোনটা কি দেওয়া যাবে?’ ভণিতা করে সময় নষ্ট না করে কাজের কথা বললো।
কারণ খুনী যে ই হোক – সে দ্রুতই হাতের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। বিশেষ করে তার সাথে আজগর আলী খান যোগ দেওয়ার পর থেকেই। কারণ, এরপর থেকেই 420s এর নম্বরটায় ফোন করে আজগর আলী বন্ধ পেয়েছন। যেটা ঠিক ফারহানের সাথে কথা বলার আগ মুহুর্ত পর্যন্ত চালু ছিল।

মোবাইলটা পেয়ে প্রথমেই মেসেজগুলো দেখলো। হ্যা! সেই মেসেজগুলো সালাম সাহেবকেও দেওয়া হয়েছে। কোন সন্দেওই নেই কাজগুলো একই খুনীর করা। এগুলো যে খুন – সেটা সম্পর্কে আর কোন খটকাও নেই।
‘ম্যাডাম! আপনার কাজের মেয়েটাকে ডাকবেন?’ বললো ফারহান।
‘হ্যা অবশ্যই। কিন্তু কেন বলুন তো? ও তো সব বলেই দিয়েছে।’ কিছুটা অবাকও হলেন জোবাইদা বেগম।
‘হ্যা বলে দিয়েছে। তবুও নিশ্চিত হবার জন্য কিছু প্রশ্নের উত্তর জানা দরকার!’

রিনা আসার পর তাকে বসতে বললো। কিন্তু মেয়েটা কিছুতেই বসবে না। ভয়ে কাঁপছে। তার কাঁপুনিতেই বুঝা গেল – সে আরো কিছু জানে। রিনাকে ধমক দিয়েই বসানো হল। কাজটা করলেন আজগর সাহেব।

‘সত্যি করে বলো...............’ কথাটা শেষও করতে পারলো না ফারহান।
তার আগেই রিনা বলা শুরু করে দিয়েছে, ‘আমি কিছু জানিনা।’ অতিরিক্ত ভয় পেলে যা হয় আর কী! রিনার ক্ষেত্রেও সেটাই ঘটেছে। এরপর আর লুকাতে পারলো না। সত্যটাই বলল।

সালাম সাহেবের খুন হওয়ার আগের দিন রিনাকে একজন কিছু টাকা দিয়ে বলে, পরদিন সালাম সাহেবের সাথে দেখা করতে আসবে সেই লোক – যখন জোবাইদা বেগম বাইরে চলে যাবে। দেখা করাটা জরুরী। কিন্তু কাউকে এটার কথা বলা যাবে না। গোয়েন্দাও আসতে পারে তাকেও বলা যাবে না। বেশি জোরাজুরি করলে এটা বলতে হবে যে, সে কাজ করার সময় একবার কলিং বেল বেজেছিল, কিন্তু কাউকে দেখেনি দরজা খুলে।
এরজন্য রিনাকে দশ হাজার টাকাও দেওয়া হবে বলা হয়।

কিন্তু রিনা হালকা ভুল করে ফেলে। সে ভেবেছিল তাকে এইগুলোই বলতে হবে। সে গোয়েন্দাদের প্রথমে এটা বলেনি শুনলে যদি আবার তাকে টাকা না দেয়? এইটা ভেবেই সে দৌড়ে গিয়ে বলেছিল ফারহানকে। যার কারণেই কেসটায় আগাতে পেরেছে। তবে এরপরও রিনাকে টাকা দেওয়া হয়। খুনীর কাছে এটাকে ভুল মনে হয়নি। বরং পারলে চোর-পুলিশ খেলাটা খেলে মেয়র খুনের ঘটনাটা সামনে আসতে দেরী হবে না ভেবে খুশিই হয়েছিল।

‘ভুল করে ফেলেছো। আচ্ছা যাক! লোকটা দেখতে কেমন ছিল?’ জানতে চাইলো ফারহান।
‘মুখ ঢাকা আছিলো। খালি চোখ দুইডা খোলা আছিলো। চেহারা দেখবার পারি নাই।’ রিনা জানালো।

ফারহান মোবাইল বের করে দুটো ছবি দেখালো। একটা সাদাবের, আরেকটা ডাক্তার ফায়েজের। সাদাবেরটা প্রথমেই না করে দিল। ডাক্তার ফায়েজের ছবি দেখে কিছুটা দ্বিধায় পড়তে দেখা গেল রিনাকে। কিছুই বলতে পারলো না। শুধু জানালো, ‘মুখের উপর থেইকা একবার কাপড় সইরা গেছিলো। তখন দেখছিলাম হালকা। খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি আছে! ভালা কইরা দেখার আগেই আবার ডাইকা ফালছিলো। পরেরদিন বাসায় আসা সময়ও মুখ ঢাইকা আইছিল।’

ডাক্তার ফায়েজের ছবিটা দেখে দ্বিধায় পড়ার কারণটাও স্পষ্ট হল। কারণ, ডাক্তার ফায়েজের গালেও খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি রয়েছে।

****

আনোয়ারুল কবিরকেও যে মেসেজগুলো পাঠানো হবে সেটা নিয়ে কোন সন্দেহ ছিল না আজগর আলীর। তবুও নিশ্চিত হওয়ার জন্য খতিয়ে দেখলো। হ্যা! আনোয়ার সাহেবকেও একই মেসেজগুলো পাঠানো হয়েছে। একই নম্বর থেকে।

চারজনকেই একই মেসেজ, একই নম্বর থেকে, সবগুলোই মৃত্যুর হুমকি দিয়ে। ফারহানের অবাক লাগছে আজগর আলী ছাড়া এই মেসেজগুলো নিয়ে কেউ ভাবেনি কেন? একটা কারণ হতে পারে, মেসেজের শেষের 420s লেখাটাই এগুলোকে নিয়ে ভাবত দেয়নি। মজা ভেবে কেউ চিন্তা করেনি এটা নিয়ে।

আরেকটা কারণ হিসেবে বলা যায়, সবাইকে এতটা সময়ও দেওয়া হয়নি। মেসেজগুলো দেওয়া শুরু হয়েছে আব্দুস সালামের মৃত্যুর আগে থেকে। একই সময় থেকেই সবাইকে দেওয়া হচ্ছে। খুব একটা সিরিয়াস হওয়ার আগেই সবাইকে মেরে ফেলা হয়েছে।
তাহলে আজগর আলীকে এতটা সময়ই বা দেওয়া কেন? তারউপর উনি পুলিশ অফিসারও ছিলেন। ধরা খাওয়ার সম্ভাবনা প্রচুর, উনাকেই সবার আগে মারা উচিৎ ছিল খুনীর।
তাহলে দেরী কেন?
নাকি আজগর আলী খানের সাথে ঐ ঘটনা ছাড়াও আরো কোন কারণে ক্ষোভ আছে?

সবই জানা যেত সাদাবের কাছের তথ্যগুলো পেলে। কিন্তু সেটাও এখন অতীত!
আনোয়ার সাহেবের খুনটা এখনও ঘোলাটে। কারণ, আনোয়ার সাহেব বাসার বাইরে ছিলেন এবং দরজায় বাইরে থেকে তালাও দেওয়া ছিল। চাবি নিয়ে বের হননি। এমনকী, চাবির জন্য বাসার অন্য কাউকে ফোন করে আসতেও বলেননি। তাহলে উনার লাশটা কিভাবে উনার কক্ষে উনার বিছানায় চলে গেল?
এমন তো না যে মৃত্যুর পর দেয়াল ভেদ করে নিজেই হেঁটে হেঁটে গিয়ে শুয়ে পড়েছেন। অবশ্যই খুনী কোন একটা উপায় অবলম্বন করেছে।

দুইজনে মিলে তালাটা পরীক্ষা করে দেখলো। তালাটা ভাঙ্গা না – কারণ নাজমা বেগম তালা ভাঙ্গা পাওয়ার কোন কথা বলেননি। কিন্তু তালাটায় কিছু সমস্যা ছিল। মেরামতের চিহ্ন পাওয়া গেল। এটা কোন গুরুত্বপূর্ণ সূত্র হতে পারে বলে মনে হল না। তবুও জিজ্ঞেস করলো, ‘তালাটায় কি কোন সমস্যা ছিল? মেরামত করা হয়েছে বলে মনে হল!’
মাথা ঝাঁকালেন নাজমা বেগম। ‘হ্যা একবার নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। আঁটকে গিয়েছিল। তখন মেরামত করা হয়।’
‘কবে সেটা মনে আছে কি? আনোয়ার সাহেবের মৃত্যুর আগে না পরে?’
‘আগে।’
‘কতদিন আগে?’ ফারহানের প্রশ্নটা একটু আশ্চর্য হলেন বলে মনে নাজমা বেগমকে। ভ্রুঁ-কুঁচকে মনে করার চেষ্টা করলেন।
‘ঠিক কতদিন মনে নেই – এক-দেড় সপ্তাহ আগে হবে মনে হয়।’

ঘটনাটা ঐদিন কিভাবে ঘটেছিল সেটা পরিষ্কার হয়ে গেল ফারহানের কাছে। খুনীর কাছে চাবিই ছিল বাসার ভিতরে ঢোকার। তালাটা আঁটকানোর কাজও নিশ্চয় তারই। তারপর তালার মিস্ত্রি সেজে এসে চাবির ছাপটাও নিয়ে গেছে। পানির মত পরিষ্কার এখন।
তাদের জন্য কাজটা আরো সহজ করে দিলেন নাজমা বেগম। প্রথমে না বুঝলেও পরে বুঝতে পেরেছেন। তালা কে ঠিক করেছিল মন রাখাটা কঠিন না, কারণ তালা ঠিক করা লোকটা উনাদের বাসাত সামনেই বসে। স্বাভাবিকভাবেই, ঠিক করার জন্য তাকেই ডাকা হয় এইসব ক্ষেত্রে।
নাজমা বেগমকে এটা জানানোর জন্য ধন্যবাদ দিয়ে বেরিয়ে পড়ল দুজন।

তালা ঠিক করা লোকটাকে খুঁজে পেতে সমস্যা হল না। আনোয়ার সাহেবের বাসার সামনের রাস্তার উলটো পাশেই বসে লোকটা। তাকে গিয়ে ধরতেই, স্বীকার করলো তালাটা ঠিক করতে সে ই গিয়েছিল। তবে চাবির ছাপ আনার কথা অস্বীকার করলো। আজগর আলী একটু চাপ প্রয়োগ করতেই হরহর করে বলে দিল। তাকে চাবির ছাপ আনার জন্য বলা হয়েছিল। এরজন্য তাকে টাকাও দিয়েছে।
কথাটা গোপন করে রাখতে না বললেও, সে গোপন রেখেছ – কারণ এটা জানাজানি হলে তারই বিপদ। এই গোপনে চাবি বানিয়ে বিক্রি করাটা অন্যায় সেইটা সেও জানে।

কে ছিল ঐ লোকটা জানতে চাওয়া হলে বললো, অন্ধকার ছিল তাই চেহারা পরিষ্কার দেখতে পারেনি। চাবি বানাতেই ব্যস্ত ছিল। আর অঈ লোকটা মুখ ঢেকে রেখেছিলো। তবে অল্প আলোতে এইটুক দেখেছিল খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি আছে।
লোকটা কে তা বুঝতে তাদের এক মুহুর্তও দেরী হল না। সবগুলো ঘটনার সাথেই তার অস্তিত্ব আছেই কোন না কোন ভাবে।







২১...

সিরাজ সাহেবের বাসার কাজের ছেলেটি ফিরে আসেনি। তবে না আসলেও যে একই চুক্তি করা হয়েছিল সেটা বুঝতে কারোরই কোন অসুবিধা হওয়ার কথা না। ডাক্তার ফায়েজের কোন খোঁজ এখনো পাওয়া যায়নি। ভালভাবেই লুকিয়েছেন তিনি।
চারজনকেই যেই নম্বরটা থেকে মেসেজ করা হয়েছিল সেটাও বন্ধ আছে। যদিও আগের বার ট্র্যাক করার সময় আজগর আলী যে সিগনালের লাফালাফি দেখেছিল সেটাও মনে আছে।
সুপার শপের লোকগুলোকে ফোন করা হয়েছিল আরেকটা নং থেকে।

তিনটা নম্বরই একই লোকের কিনা তা জানা যাবে এই নম্বরগুলোর লোকেশনটা জানলেই। ট্র্যাক করে লোকেশন জানানোর জন্য বললো।

খুনী বেশ চালাকিকতার পরিচয় দিয়েছে। সূত্রগুলো সামনে রেখে গিয়েও তাদেরকে উলটো পথে পাঠাতে চেয়েছে। সবসময় সে একজনই ছিল – কিন্তু দেখিয়েছে একটা গ্রুপ কাজ করেছে। বিভ্রান্তিটা বেশি করে লাগাতে পেরেছে 420s শব্দটা দিয়ে। যেন মনে করা হয় কোন গুপ্ত সঙ্ঘই এটা। এটাকে সবাই খোঁজার চেষ্টা করবে আর সে তার কাজ চালিয়ে যাবে।

কেসটাকে নিয়ে একদম প্রথম থেকে ভাবছিলো ফারহান। সেই মেয়রখুনের ঘটনাগুলো থেকেই। ঘটনার সাথে প্রতিটা মানুষের সম্পর্কে খোঁজ পাওয়া গেলেও খোঁজ পাওয়া যায়নি রহমতের পরিবার সম্পর্কে। এইটুকু জানতে পেরেছে রহমতের মেয়েটা তখনই মারা গিয়েছিল। মেয়ের জন্মের সময় তার স্ত্রীও।
কিন্তু এরপরও রহমত কাজ করে গেছে। যদি তার কোন পরিবার না ই থেকে থাকে তাহলে তো রহমতে কষ্ট করে উপার্জন করার কোন দরকার হয় না। নিজের জন্য কিছু একটা করলেই হতো তার। অবশ্যই কেউ তো ছিল – যার জন্য ইনসেক্ট কিলারের কাজটা নিয়েছিল!
এইক্ষেত্রে এসে তার মনে হচ্ছে – ডাক্তার ফায়েজ যদি জড়িত থেকেও থাকেন – তাহলে অবশ্যই উনার কারো সাহায্য লেগেছে।

আজগর সাহেবকে জিজ্ঞেস করেও কিছু জানতে পারলো না। উনিও রহমতের পরিবারের অন্য কারো দেখা পাননি।

কিছু একটা অসঙ্গতি লাগছে ফারহানের!

বেশিক্ষণ ভাবতে পারলো না। ট্র্যাক করার পর তিন নম্বরই এক জায়গায় আছে জানা গেল। গাজীপুরের একটা অংশ।
বুঝতে দেরী হল না ফারহানের ঠিক কোথায় খুঁজতে হবে। আজগর আলীকে নিয়ে বের হয়ে গেল দ্রুতই।





উপসংহার

ঠিক কতক্ষণ অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল খেয়াল নেই ফারহানের। চোখ মেলে দেখে তাকে উদ্ধ্বার করার জন্য গোয়েন্দা বিভাগের পরিচালক নিজেই দলবল নিয়ে হাজির হয়েছেন। ঐ লোকেশনটার জন্যই তাকে খুঁজে পাওয়া গেছে। সে নিজেও বলে এসেছিল – যদি সে ফিরতে দেরী করে তাহলে ফোর্স নিয়ে যেতে।
পাশের চেয়ারটায় পড়ে আছে আজগর আলী খান। মৃত!

‘ফারহান! আর ইউ অলরাইট মাই বয়?’ তার জ্ঞান ফিরেছে দেখে জিজ্ঞেস করলেন গোয়েন্দা বিভাগের পরিচালক।
‘মে বি স্যার!’ উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললো ফারহান।
‘এই জায়গাটা খুঁজে পেলে কী করে?’
‘লোকেশন জানার পরই বুঝেছি। এই বাড়িটা ডাক্তার ফায়েজের। কয়েকদিন আগেই কিনেছেন। কথায় কথায় একদিন আমাকে বলেছিলেন।’
‘উনাকে তো দেখা যাচ্ছে না। এখানে আসার পর কী হয়েছে? খুনটা করেছে কে?’ আজগর সাহেবের লাশটা দেখিয়ে জানতে চাইলেন।
‘খুব সম্ভবত ডাক্তার ফায়েজই। এখানে আসার পর উনাকে দেখি চেয়ারটায় বসেছিল। উনার দিকে এগুতেই পিছন থেকে কে যেন আঘাত করে। এরপর তো এই যে এখনই জ্ঞান ফিরলো।’
‘খুনগুলো কি ডাক্তার ফায়েজেরই করা? কিন্তু কেন?’
‘খুব সম্ভবত তিনিই। তবে উনাকে কেউ একজন সাহায্য করেছে। তিনি উনার বাবার খুনের প্রতিশোধ নিচ্ছেন মনে হল। আজগর সাহেবের থেকেও এই তথ্যই পেয়েছি।’ বলে মেয়রখুনের ঘটনার সবটাই বললো।

‘স্যরি স্যার! কেসটা ভালমত শেষ করতে পারলাম না। আপনার কথাই ঠিক ছিল। আগে থেকে কাউকে সাথে রাখলে কাজটা সহজ হত। এইভাবে খুনীও পালাতে পারতো না।’
‘তুমি না থাকলে তো এই রহস্যেরই সমাধান হত না। ডাক্তার ফায়েজকে খুঁজে পেতে সমস্যা হবে না আর। তুমি চমৎকার কাজ দেখিয়েছো। এখন বিশ্রাম দরকার তোমার!’

গোয়েন্দা বিভাগের পরিচালকের শেষ কথাটার সাথে একমত হল ফারহান।
আসলেই অনেক কাজ করেছে সে, এখন একটু বিশ্রাম দরকার তার।





ফ্ল্যাশব্যাক...



ইসতিয়াক আহমেদ ও দ্বীন ইসলামের খুন

ভাইকে ঠিকই স্বান্তনা দিয়ে এসেছে প্ল্যান রেডি করা আছে, কিন্তু সত্যিকার অর্থে কোন প্ল্যানই নেই তার। ভাইয়ের রাজনীতি সে চালালেও এটা অনেকেই জানেনা। এই ফাঁকেই সে গড়ে তুলেছে তার টাকার পাহাড়। সম্পর্ক গড়ে উঠেছে অনেক মানুষের সাথে। যাদের সম্পর্কে তার ভাই দ্বীন ইসলামের কোন ধারণাই নেই। তার ভাইকে সে নিজেও পছন্দ করে না। কিন্তু টাকার সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে তার ভাইয়ের মেয়র হওয়ার কোন বিকল্প নেই।
এইদিক থেকে তার ভাইয়ের মাথা ব্যথা ইসতিয়াক আহমেদ তারও মাথা ব্যথার কারণ। ইসতিয়াক আহমেদকে নির্বাচনে ভোটাভোটিতে হারানো যাবে না। সে ভাল করেই জানে। এলাকার মানুষ তাকেই নির্বাচন করবে। কারণ তার ভাইয়ের আচরণে জনগণ সন্তুষ্ট নয়। এই জন্যই তার ভাইকে তার পছন্দ না। একটু ভেবে-চিন্তে চললেই এসব কোন সমস্যা হত না। কিন্তু তার ভাই তো আর কিছুর ধার ধারেনি।
এখন কিছু করতে হলে তারই করতে হবে। ইসতিয়াক আহমেদকে খুন করে ফেললেই যে সমাধান হবে সেটাও না। তাতে সন্দেহটা তাদের উপরই আসবে। কিন্তু খুন করা ছাড়া আর কোন উপায়ও মাথায় আসছে না। কারণ, লোকটার সম্পর্কে তেমন কোন খারাপ কথা সে শুনেনি। তাকে জনগণের সামনে খারাপ বানানোটাও এত সহজ হবে না। ঐদিকে প্রার্থী প্রত্যাহার করার সময় সীমাও শেষ হয়ে আসছে। কিছু করতে হলে এর মাঝেই করতে হবে।

জুয়ার আসরে বসেও তাই চিন্তিত রইলো ঐটা ভেবেই। এইটা নজর এড়ালো না বাকীদের। বাকীদের মাঝে একজন ছিল আজগর আলী খান। পুলিশ হিসেবে রেকর্ড উনার ভাল – সাথে দুর্নীতির হিসাবেও রেকর্ডটা খারাপ না। যেখানেই যাবেন সেখানেই দুর্নীতিগ্রস্ত প্রভাবশালীদের উনার ভাল সম্পর্ক গড়ে উঠবেই। রফিকের সাথেও এইভাবেই গড়ে উঠেছে। আর উনার সাথে অবধারিত ভাবেই ছিলেন সিরাজুল ইসলাম সাহেব।
চতুর্থ সঙ্গীটি ছিল আনোয়ারুল কবির। দিনে অনেক ভাল মানুষ তিনি। কিন্তু রাতের অন্ধকার বাড়লেই আসল রূপটা বেড়িয়ে আসে উনার। বড় ভাইয়ের টাকার অভাব নেই। তাই চাকরীর দিকে যাওয়ার কোন ইচ্ছাই তাঁর নেই। বড় ভাইয়ের থেকে টাকাও পেতেন বড় অঙ্কের – কীট-পতঙ্গ মারার জন্য ঔষুধ কেনার অজুহাতে। চাকরীতে গেলে তো আর এটা পাওয়া যেত না। এত টাকা শুধু একটু বসে বসেই পেলে আর কার চাকরীর দরকার পড়ে! সেই টাকা দিয়েই রাতে বসতেন জুয়ার আসরে।

‘রফিক সাহেবকে চিন্তিত মনে হচ্ছে?’ জিজ্ঞেস করলেন আজগর আলী।
‘হরে ভাই! চিন্তায় আছি।’
‘কী নিয়ে বলা যাবে?’ জানতে চাইলেন সিরাজ সাহেব।

খারাপ মানুষেরা কাউকেই বিশ্বাস করে না বলে একটা প্রবাদ আছে। কিন্তু খারাপ মানুষেরা আবার তার মতই খারাপ মানুষকে মাঝে মাঝে বিশ্বাস করেও। রফিকেরও বাকীদের উপর যথেষ্ট বিশ্বাসই আছে। অনেকদিন ধরেই জুয়া খেলেন একসাথে। সব কথা খুলে বলল তাঁদেরকে।

সবশুনে আজগর আলী বললেন, ‘ফেলে দিন। বাকীটা আমি সামলায়া নিতেছি।’
‘আপনি তো আছেন ভরসাই। কিন্তু সমস্যা হইলো, ইসতিয়াকরে ফালাইলে সন্দেহটা সরাসরি ভাইয়ের উপরেই পড়ব। পুলিশি কেইসে যেইটাই হউক – মানুষ তো ভাববো কাজটা ভাইয়েরই। তাইলে তো সমস্যা।’ চিন্তিত কণ্ঠে বলল রফিক।
‘হ! সেইডা ঠিক। পাবলিকরে বুঝানো কঠিন।’ রফিকের কথায় সায় জানালেন আজগর আলী।

‘রফিক ভাই, একটা কাজ করেন। দুইজনকেই সরায়া দেন।’ এতক্ষণ চুপচাপ কার্ডগুলো দেখছিল আর বাকীদের কথা শুনছিলো আনোয়ার।
তার কথায় একটু অবাক হল অন্য তিনজনই। রফিক তো রেগেই গেল। ‘ধুর মিয়া! কী কও এইসব? আমার নিজের ভাইরে মারমু ক্যান?’

আজগর আলী খান একটূ ভাবলেন আনোয়ারের কথাটা। ‘আনোয়ার কিন্তু ভুল কিছু বলে নাই।’
‘পুলিশ সাব! আপনেও একই কথা কইতেছেন?’ রফিক আরো রেগে গেল।
‘ঠান্ডা হন ভাই আগে। আপনার কিন্তু আপনার ভাইয়ের প্রতি অতটা দরদ নাই। আপনার দরদটা হইলো গদি। বলতে গেলে টাকার দিকে। এখন ভাবেন, ইসতিয়াক সাহেব থাকলে আপনার এইদিকটা নিয়ে সমস্যাই। আবার উনাকে সরাইতে গেলেও সমস্যা। আমরা যতই সামলাই সমস্যা আপনাদেরই হবে।
এখন ভাবেন ভাই, দুই প্রতিদ্বন্দীই যদি একই সময়ে খুন হয় তাহলে কে কাকে সন্দেহটা করবে?
দুইজনই তো শেষ। সন্দেহ করার কেউ নাই। সেই সুযোগে আপনি দাঁড়ায়া যান ইলেকশনে। পাবলিক সিম্প্যাথিতে জিইতাও যাইবেন। এখন অন্য কেউ দাঁড়াইতেছে না, আপনাদের ভয়ে – আর ইসতিয়াক সাহবের সাথে টিকতে পারবে না ভেবে।
কিন্তু দুইজন সরে যাওয়ার পর অন্যরা ঠিকই লড়তে চাইবে। তখন আপনি দাঁড়াইলে – ভোটগুলো আপনিই পাবেন। কারণ, আপনাকে কিন্তু এলাকার সবাই ই ভাল হিসেবেই জানে।’

একটানা বলে গেলেন আজগর আলী।
‘কথা কিন্তু আজগর ভুল বলে নাই রফিক সাহেব।’ বললেন সিরাজ সাহেব। ‘তার কথায় যুক্তি আছে। আপনি তো বলেছেনই আপনার দরকার শুধু মেয়রের চেয়ারটা। সেইখানে যে ই বসুক – সমস্যা নেই। আপনার ভাইয়ের জায়গায় আপনি ঐখানে থাকলে আপনি আরো ভাল ভাবে সব সামলাতে পারবেন। আমার মনে হয়, আপনার আজগর আর আনোয়ারের কথাটাই ভাবা উচিৎ।’

একটু ভাবলো রফিক। কথাগুলো ভুল বলেনি তারা। এইজন্যই তো উনারা তার বন্ধুগোত্রের মানুষ। কিন্তু একজনকে মারুক আর দুইজনকেই – মারবে কিভাবে? যেই উপায়গুলো মাথায় আসছে তাতে একটা না একটা সময় ফাঁসতে হবে তাকেই। সে সেইটা চাচ্ছে না। গুলি করে বা চাকু মেরে খুন করাটা খুব একটা আলাদা কোন উপায় না। আর এতে কাউকে ফাঁসানোও যাবে না – প্রয়োজনীয় যুক্তির অভাবে।
‘কথা ভুল কন নাই আপনারা। কিন্তু কাজটা করা কেমনে?’ কোন উপায় পাওয়ার আশায় প্রশ্নটা করলো রফিক।
‘আরে ভাই! খুন করা কোন ব্যাপার নাকি? একজনরে পাঠাইয়া দিলেই তো হয়।’ বললো আনোয়ার।
‘একজনকে পাঠাইলে তো হবেই – কিন্তু এমন কাউকে পাওয়া সম্ভব না। পাইলেও তাকে কাজ করার পর পালায়াই থাকা লাগবে। যদি ধরাও খাওয়াই, তাইলে আবার সব কথা বইলা দিবে। এইটা তো রিস্ক। কাজটা তো অন্য কাউকে জানাইলে যেইটা চাইতেছি সেইটা হইবো না।’ চিন্তিত হয়ে বলল রফিক।
‘রফিক ভাইয়ের কথাটা ভুল না। আমরা নাহয় জড়িতে থাকলেও, আমাদেরকে সন্দেহ করবে না কেউ। আমরাও পার পাইয়া যাইতে পারব। কিন্তু এর মাঝে অন্য কাউকে এইসব জানানো হলে – পরে সত্যিটা ফাঁস হওয়ার সম্ভাবনাও বেশি।’ রফিকের কথার সাথে একমত হল আজগর আলী।
‘আচ্ছা! একটা কাজ করা যায়। সাধারণভাবেই এই কাজটা করানো যাবে। তাতে কারো সন্দেহও হবে না। কারো ধরা পড়ার সুযোগও থাকবে না।’ বললেন আজগর আলী।
‘কিভাবে?’ একই সাথে জানতে চাইলো তিনজন।
‘ঐদিন সালাম সাহেব একটা বিষের কথা বলছিলো না?’

সালাম সাহেব মানে আব্দুস সালাম, তাদের সাথে মাঝে মাঝেই বসে আড্ডা দেওয়ার সাথে জুয়া ও নেশায় মত্ত হয়। সবসময় থাকতে পারেন না কাজের জন্য। মাঝে মাঝে কাজ করতে গিয়ে হাঁপিয়ে পড়লে উনার নেশা করার বাজে একটা অভ্যাস রয়েছে। সেই সুবাদেই পরিচয় হয়েছে রফিকের সাথে। প্রফেসর মানুষ! যে কাউকে তো আর বলতে পারেন না – তাই খুঁজে খুঁজে রফিককে বের করেছেন। সাথে সাথে পরিচিত হয়েছেন অন্যান্যদের সাথেও।
তাদের মাঝে সম্পর্কটা গড়ে উঠেছে এইভাবেই। আনোয়ারুল কবির আর রফিক আগে থেকেই একে-অপরকে চিনতো। তারপর রফিকের সাথে পুলিশ অফিসার আজগর সাহেবের পরিচয় হয় এক নেশাখোরকে ধরতে গিয়েই। টাকার গন্ধ পেয়ে আজগর আলী রফিকের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তোলেন। আস্তে আস্তে আজগর আলীর সাথে সিরাজুল ইসলামও তাদের সাথে পরিচিত হন।
রফিকও এতে খুশি। কারণ, সবাই বুদ্ধিমান মানুষ। অনেকদিন ধরেই তাকে বিভিন্ন কাজে বুদ্ধি দিয়ে সাহায্য করছেন। তাই তাদের সাথের সু-সম্পর্কটা সে ভাঙতেও চায় না।

দুইদিন আগেই সালাম সাহেব কী যেন একটা পরীক্ষার জন্য একটা কেমিক্যাল আনিয়েছেন বলেছিলেন। অত্যন্ত বিষাক্ত নাকি! কাউকে খুন করতে হলে – এটা ব্যবহার করলে ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনা কম।
‘হুম! সায়ানাইড। কিন্তু ঐটা দিয়েই কিভাবে কাজ হবে?’ উত্তরের সাথে সাথে একটা প্রশ্নও রেখে দিলেন সিরাজ সাহেব।
‘হ্যা! আমারও একই প্রশ্ন সায়ানাইড দিয়ে কিভাবে কাজটা হবে?’ পিছন থেকে প্রশ্নটা করলেন সালাম সাহেব। মাত্রই এসে হাজির হয়েছেন।

ঐটা দিয়ে আসলেই কিভাবে কাজ হবে? বলার পর এখন নিজেও বোকা হয়ে গেছেন আজগর আলী। এতটা ভেবে বলেন নি তিনি। এইটা দিয়ে মারতে হলেও খুনীকে কন্ট্রাক্ট দিতে হবে। তাতে আবার সেই আগের সমস্যাটাই ফিরে এসেছে।
সমস্যাটা রফিকের নিজের। কিন্তু তাতে অন্যদেরকেও মাথা ঘামাতে দেখে খুশিই হল সে। এত বুদ্ধিমান মানুষকে তো সে সাথে রেখেছে এই কারণেই। নিজের সমস্যাটা সে কত তাড়াতাড়ি তাদের উপর ছড়িয়ে দিতে পারলো।

হঠাৎ করে বলে উঠলো আনোয়ার, ‘ইসতিয়াক ভাইয়ের সাথে কয়েকদিন আগে দেখা হইছিল আমার। বলল, বাসায় নাকি পিঁপড়া বেশি বাড়ছে। ঐগুলোরে মারার জন্য একজনকে পাঠাইয়া দিতে। এইটা কি কোন কাজে আসবে?’
‘এইতো পাওয়া গেছে।’ বলে উঠলেন আজগর আলী। হঠাৎ করে বোকা হয়ে যাওয়ায় ভাবছিলেন কী করা যায়। আনোয়ারের কথাটা যেন প্রাণ ফিরালো উনার। ‘ঐ পিঁপড়া মারার তালেই কাউরে পাঠায়া, তার সাথে পিঁপড়ার বিষের বদলে সায়ানাইড দিয়া দিলেই তো কাজ হয়া যাইবো। কেউ টেরও পাইবো না। আর তাকে ধরতেও সমস্যা হইবো না। কোন রকমে একটু ঘাটাঘাটি কইরা তাকে ধরলেই কাহিনী শেষ!’
‘নাহ শেষ না। সমস্যা এখানেও আছে।’ বললেন সালাম সাহেব।

হঠাৎ করে জ্বলে উঠা বুদ্ধির বাতিটা আবার ধপ করেই নিভে গেল আজগর সাহেবের। উনার ধারণা মতে উনি যা বলছেন ঠিকই আছে – কোন সমস্যা নেই। কিন্তু কিভাবে কিভাবে যেন সমস্যা বেরই হয়ে আসছে।
‘সায়ানাইড অত্যন্ত বিষাক্ত গ্যাস। এটা পিঁপড়া মারা জন্য না। এইটা একটা এক ধরণের হিস্টোটক্সিক হিপোক্সিয়া তৈরি করে যা কোষগুলোকে অক্সিজেন ব্যবহার করতে ব্যাহত করে। আর সাইটোক্রোম সি অক্সিডেজ উৎপন্ন করে। যেটার জন্য যেই পরিবেশে সায়ানাইড থাকে সেখানে মানুষের থাকাটা অসম্ভব হয়ে পড়ে। এইটার সংস্পর্শে আসলেই হিপোক্সিয়ার জন্য শ্বাসকষ্ট তৈরি হবে। এবং আস্তে আস্তে কিছু সময়ের মাঝেই মৃত্যু।
এইটা পিঁপড়া মারার জন্য ব্যবহার করতে গেলে ঐ বাসার মানুষ মুহুর্তের মাঝেই এইটার ক্ষতিক্রর প্রভাবে পড়বে। সাথে সাথেই হেলে পড়বে মৃত্যুর দিকে। এতে করে কাজ হলেও – যে পিঁপড়াগুলো মারতে যাবে তার কাছে অস্বাভাবিক লাগবে। এমন কী একটু অসাবধান হলে সেও মারা পড়বে।
যতদূর শুনলাম, ইসতিয়াক আহমেদকে মারলে দ্বীন ভাইয়ের উপর সরাসরি সন্দেহ আসবে। তারমানে ঐ সময় যাকে পাঠানো হবে তাকে বাঁচিয়ে রাখা জরুরী। দুটো খুন এক সময়ে করা যাবে না। করতে হবে ভিন্ন সময়ে। সেই জন্য বাঁচিয়ে রাখতে হবে।
আর এতে আরেকটা সমস্যাও আছে। সে যদি বেঁচেও যায় – তাকে ফাঁসানোর উপায় থাকবে না। তখন সে সরাসরি আনোয়ারের কথাই বলে দিবে। তারপর আস্তে আস্তে আমাদের কাছে আসতে সময় লাগবে না।’
ব্যাখ্যা করে বললেন সালাম সাহেব অসুবিধাগুলোর কথা।
‘তাহলে করার উপায়টা কী?’ মরিয়া হয়ে জিজ্ঞেস করলো রফিক।
‘সায়ানাইড দিয়ে মারতে চাওয়াটা খারাপ বুদ্ধি না। আজগর সাহেব ইউনিক একটা উপায়ই বের করেছেন।’ আজগর সাহেবের দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতেই বললেন। ‘আর আনোয়ারকে ইসতিয়াক সাহেবের বলা কথাটা মেঘ না চাইতেই বৃষ্টির মত। আনোয়ারের লোককে টোপ হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। কিন্তু টোপটাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।
সায়ানাইড দিয়ে মৃত্যুটা যেন তাদের হয় সেই টোপ হওয়া ব্যক্তিটি বের হয়ে আসার পর। এখন বাকীটা আপনাদের উপর।’

সবাই ভাবছে কিভাবে কাজটা করা যাবে। আনোয়ার বললো, ‘আচ্ছা! আমি কাজটা করাইতেছি। তয় রফিক ভাই! আমার দিকটা খেয়াল রাখা লাগবে কিন্তু একটু। আপনার লাইগা আমার বিশ্বস্ত লোকটারেই টোপ বানাইতেছি।’
জবাবে হাসলো রফিক। ‘কারে টোপটা বানাইবা? আর কাজটাই করবা কেমনে?’
‘রহমত থাকতে আর কেডা? একবার ইসতিয়াক ভাইয়ের লাইগা রহমতের জেলের ভাত খাইতে হইছিল। প্রায়ই ঐটার কথা বলে। তারে টোপ বানাইলে পরে কাহিনী বানাইতে মিছা কিছু ভাবা লাগবো না। আর দ্বীন ভাইয়ের সাথে তো তার সমস্যা অনেক আগেরই।’
সবাই রাজি হল এতে। দ্বীন ইসলামকে মারার জন্য একটা প্ল্যান করা হল। সেইটা দেখবে রফিক নিজেই। তার থেকে বড় সুযোগ কারো নেই। আগে ইসতিয়াক আহমেদকে সরানোর পর একই অস্ত্র দিয়ে দ্বীন ইসলামকে খুন করলে কাজটা একই লোকের মনে করাটা খুব একটা কঠিন হবে না।

সব ঠিক হয়ে যাওয়ার পর আজগর আলী বললেন, ‘সালাম সাহেব! আপনার তো তাহলে একটু থানায় আসা লাগে কালকে।’
শুনে ভয়ই পেয়ে গেলেন একটু আব্দুস সালাম। পুলিশের উপর উনার বিশ্বাস কম। কখন কী করে বসতে পারে সেই ধারণা পাওয়া যায় না। হুট করেই থানায় কেন যেতে বলবে, এতক্ষণ প্ল্যান করার অপরাধে আবার উনাকে ফাঁসিয়ে দিবে না তো। ‘কেন ভাই? কোন অপরাধ করলাম নাকী?’
‘আরে নাহ! লবণ হারাইয়া গেছে এমন একটা কমপ্লেন করবেন। তাইলেই হইবো। তাতে একটা জোর পাওয়া যাইবো।’
‘আমাকে এসবে টানছেন কেন? জানাজানি হলে তো পরে আমার বিপদ।’ অনীহা দেখালেন সালাম সাহেব।
‘সায়ানাইড আপনার কাছেই ছিল সেইটা জানতেও কিন্তু দেরী হবে না। খুনের পর এইটা জানাজানি হইলে আপনাকেও কিন্তু খুনী মনে করা হইতে পারে। তখন আমার কিছুই করার থাকবে না। এরচেয়ে আগেই হারায়া গেছে এমন একটা কমপ্লেন করা থাকলে আপনিও বাঁইচা যাইতেছেন। আনোয়াররে বাঁচাইলেন – আপনার বাঁচা লাগবো না? বুঝছেন ব্যাপারটা?’ ব্যাখ্যাটা দিলেন আজগর আলী।
‘অহ! তাই বলেন! আমি তো ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম। আসেন গেম শুরু করি এখন।’ হাসতে হাসতে বললেন সালাম সাহেব। এই প্রথম পুলিশের উপর একটু ভরসা পেলেন তিনি।

খেলায় মত্ত থাকলেও – রফিকের মাথায় চিন্তা ঘুরছে। ভাইকে কিভাবে সায়ানাইড দিয়ে সরাবে? এত বিষাক্ত পদার্থ – তারও তো মৃত্যু হতে পারে এতে।

একমাস পর

আবারো ঐ জুয়ার আসরে। এতদিনে সব ঝামেলা মিটে গেছে। দুই মেয়র পদ-প্রার্থী সরে গেছে পথ থেকে। রফিক বিনা প্রতিদ্বন্দীতাতেই মেয়র নির্বাচিত। কারণ অন্য কেউ আর লড়ার আগ্রহ দেখায়নি। এলাকার মানুষের অনুভূতি মিশ্র। কেউকেউ স্বাগত জানিয়েছে, আবার কেউকেউ মেনে নিতে পারেনি দ্বীন ইসলামের ভাই বলে। তবে দুই আগের দুইজনের খুনের সমস্ত ঘটনাই এখন অতীত এলাকাবাসীর কাছে। ঘটনাটা এমনভাবেই সাজানো হয়েছিল – রহমত ধরা পড়ার পর থেকেই খল চরিত্রে পরিণত হয়ে যায়।

আজগর আলীও বেশ ফুরফুরে মেজাজেই আছেন। কারণ, সব ঠিক থাকলেও – রহমতের মুখ থেকে স্বীকারোক্তি না বের হলে আবার ভেজালে পড়তে হত। টানা একটা মাসের মত রিমান্ডে বেধড়ক পিটিয়ে রহমতের কাছ থেকে স্বীকারোক্তি আদায় করতে পেরেছেন। সব মিলিয়ে এখন আর কোন সমস্যা কেউ করতে পারবে না। কোর্টে গিয়ে এই স্বীকারোক্তিটা করলেই কেস একদম খতম।
তবে কেসের অনেক ঘটনাই এখনো তাদেরই অনেকে জানে না। ইসতিয়াক আহমেদকে খুন করার দায়িত্ব ছিল আনোয়ারের, আর দ্বীন ইসলামকে রফিকের। কিভাবে মেরেছে সেটা নিয়ে কথা হয়নি তাদের। তবে সিরাজুল ইসলাম পোস্টমর্টেম করতে গিয়ে অনেক কিছুই আদায় করতে পেরেছেন। রিপোর্টে প্রকাশ করেননি।

‘আচ্ছা আনোয়ার! চিনির কৌটাতে তোমার হাতের ছাপ আসলো কিভাবে? আমি তো রহমতের বলে চালিয়ে দিলাম – কিন্তু তুমি কখন উপস্থিত হলে সেখানে? সায়ানাইড একেবারে খাইয়ে দেওয়াটা বড়ই অমানবিক কাজ করেছো।’ বললেন সিরাজ সাহেব।
‘রহমতের সাথে ঐদিন আমিও গিয়েছিলাম সেইখানে। ইসতিয়াক ভাইয়ের সাথে দেখা করার ভান করে। আর নিজ থেকে তদারকী করবো সেই অজুহাতে। এর ফাঁকেই চিনির কৌটাতে সায়ানাইডের লবণটা মিশিয়ে দেই। এর থেকে ভাল কিছু মাথায় আসেনি। কারণ চা তো খাবেই তারা। সেই রিস্কটাই নিলাম। অমানবিক হইলে আর কী করার আছে কন?’ হাসতে হাসতে বলল আনোয়ার।
‘বুদ্ধিটা ভালই ছিল। রহমতও বেঁচে থাকলো, কাজটাও তার উপর দিয়েই চালিয়ে দেওয়ার অজুহাতটাও রয়ে গেল।’ তিনিও হাসছেন।
‘নাহ! আনোয়ার অসাধারণ দেখিয়েছো। বুদ্ধিটা বেশ।’ সালাম সাহেবও প্রশংসা করলেন।
‘যাই কন! বুদ্ধিটা কিন্তু আমার ছিল সায়ানাইড দিয়ে মারাটা। এখন আমার কোন কৃতিত্বই নাই।’ কৃত্রিম মন খারাপের ভান করলেন আজগর আলী।

সবাই হাসলো। রফিকের বুদ্ধিটাও খারাপ ছিল না। রিপোর্টে সিরাজ সাহেব একটা কথা লুকিয়েছিলেন। দ্বীন ইসলামকেও সায়ানাইড পান করিয়েই হত্যা করে হয়েছিল। রিপোর্টে শুধু বাতাস থেকে গ্যাসের কারণেই মৃত্যুর কথাটা লিখেছিলেন। পানির সাথে সায়ানাইড মিশানোর বুদ্ধিটা ছিল সালাম সাহেবের। রাতে ঘুমানোর আগে দ্বীন ইসলামের পানি খাওয়ার অভ্যাসটাকেই কাজে লাগিয়েছেন তিনি। আর ঘরে লবণের যে ছিঁটাগুলো ছিল – এগুলো রফিকের করা। গোয়েন্দা আসলে কিছু প্রমাণ দেখাতে হবে রহমতের বিরুদ্ধে – তাই লবণই ছিটিয়ে রাখেন। সেটাই গিয়ে সংগ্রহ করেন আজগর আলী আর সালাম সাহেব।

সবকিছুই একদম ঠিকঠাক মত করা হয়েছে। একটু ভুলও হয়নি। এটাই বড় দিক। অবশ্য এতগুলো মাথা একসাথে কাজ করলে ভুলের সম্ভাবণা কম। যদিও রহমত একবার বলেছিল আনোয়ারের কথা – কিন্তু আজগর আলীর মারের তীব্রতায় সেটা আর মনে থাকেনি তারও।
সবাই ই খুশি। তখনই ঘটলো অঘটনটা। চাওয়ালা ছেলেটা চা ফেলে দিয়েছে আজগর আলীর গায়ে। রেগে মেগে বলে উঠলেন, ‘ফোর টুয়েন্টি কোনহানকার! চোক্ষে দেখস না নাকি! যা এইখান থেইকা!’

****

চা-ওয়ালা ছেলেটা রহমতের। বাবাই একমাত্র অবলম্বন ছিল তার। এখন বাবা জেল-হাজতে – কোন টাকা পয়সাও জমানো নেই। সাথে তার বাবার করা কাজের জন্য তাকে এখন প্রায়ই মানুষের নানান কথা শুনতে হয়। সেই সাথে স্কুলের পড়ালেখাও আছে। সবকিছু চালানোর জন্য রাতের বেলা চায়ের দোকানে কাজ নিয়েছে। যেন অন্তত দুই-একটা ভাত জুটে তার পেটে।
প্রথম দিনই তাকে চা দিয়ে পাঠানো হয় – রফিকের আড্ডায় নিয়ে যাওয়ার জন্য। রাতে ঐখানে বসে তারা। কখন কখন পাঠানো লাগবে সেইটা আগে থেকেই বলে যায়। চাওয়ালা নিজ দায়িত্বে ঐখানে পাঠিয়ে দেয়।

ছেলেটা যখন চা নিয়ে ঐখানে হাজির তখন শুনতে পায় ওদের কথা। কিভাবে তাদের স্বার্থ হাসিল করার জন্য তার বাবাকে ফাঁসানো হয়েছে সেইটা শুনে চোখে পানি চলে আসে। তাদের কথা পুরোটাই শুনে পিছনে দাঁড়িয়ে। তাদের কোন নজরও ছিল না তার দিকে।
চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে দেখে ঐগুলো দিয়ে আসলো। ‘সব কিছুর প্ল্যান আমার করা’ – আজগর আলীর এই কথাটা শুনে তার উপর রাগ লাগছিল তার। তাই ইচ্ছা করেই চা টা ফেলে দেয় উনার শরীরে।
তারপর অনেকক্ষণ গালিগালাজ শুনলো। তাকে ওদের কেউই চিনতে পারেনি। সে ভেবেছিল চিনে ফেলবে। চিনতে পারেনি দেখেই সেইটাকে কাজে লাগানোর চিন্তাটা আসলো তার।

তার বাবা যাকে মেরেছে – সেই ইসতিয়াক আহমেদের ছেলে সাদাব তার খুব কাছের বন্ধু। হয়তো দুইজনের পরিবার দুই রকম। কিন্তু পড়ালেখায় সাদাব তার সাথে পারেনা। এইভাবেই বন্ধুত্বটা হয়ে যায়। তাদের বাবাদের মাঝে কিছু কিছু ঝামেলা হলেও তাদের কোন সমস্যা হয়নি কখনো। কিন্তু তার বাবা যখন তার বন্ধুর বাবাকেই মেরে ফেলল – এরপর আসলে সে আর দেখাই করেনি সাদাবের সাথে।
এখন সত্যটা জানার পর দ্রুতই গেল সাদাবকে জানাতে।

বর্তমান সময়

সাদাবও তখন বিপদে ছিল। সেও জানতো তার বাবাকে রহমত খুন করেনি। করেছে অন্যকেউ। রহমতকে ফাঁসানো হচ্ছে। আবার নতুন এক সমস্যার উদয় হয়েছিল সাথে। তার বাবার সকল সম্পত্তিই নাকি অবৈধ। সেগুলো বাজেয়াপ্ত করা হবে। সমস্ত দলিলও তৈরি করা। কোনভাবেই এই মিথ্যাটাকে মিথ্যা প্রমাণ করা যাচ্ছিল না। তখন সে কই থাকবে জানতো না। অন্য কিছুই ভাবতে শুরু করেছিল।
অবশ্য তাকে সেই যাত্রায় বাঁচিয়ে দেয় তার বাবার বন্ধু ইকবাল হাসান। তিনিই তার দেখভাল করার সিদ্ধান্ত নেন।

সে চলে আসার আগের রাতে হঠাৎ রহমতের ছেলে দৌড়ে আসে। তার বন্ধুই। ঐ ঘটনার পর থেকে তাদের দেখা ঐ একবারই। তার কাছ থেকেই সাদাব জানতে পারে সকল সত্যি কথা। তখনই চেয়েছিল ঐটা ফাঁস করতে।
তাকে আঁটকেছিল তার বন্ধুই। বলেছিল, ‘দোস্ত! এখনও সময় আসেনি। এইগুলো আমরা বললে কেউই মেনে নিবে না। বরং আমাদেরই সমস্যা বাড়বে। তারচেয়ে অপেক্ষা করি। একটা সময় আসবেই। শাস্তিটা তারা পাবেই। ভাবিস না! অপেক্ষা কর।’

ওয়েনের কাছে পিঁপড়ার কথাটা শোনার পর বুঝলো সময়টা এসে গেছে। দ্রুতই জানালো দেশে থাকা তার বন্ধুকে। ঐদিক থেকে শুনলো সেও সব গুছিয়ে ফেলেছে। এই পিঁপড়াকেই অস্ত্র হিসেবে কাজে লাগাবে তারা।
সাদাব বেশ ভাল একটা রিস্ক নিল পিঁপড়া সংগ্রহ করতে গিয়ে। কারণ তাতে তারও পিঁপড়ার বিষে পরপারে যাওয়ার সুযোগ ছিল। কোন রকমে গ্লাভস পড়ে কয়েকটা পিঁপড়া সংগ্রহ করে একটি কাঁচের পাত্রে রাখে। যেটায় আগে থেকেই পিঁপড়াদের থাকার উপযোগী করে বালি ও পাথর রেখে দিয়েছিল। পিঁপড়াগুলো ঢুকিয়ে মুখটা বন্ধ করে দেয়। মুখের ঢাকনাটায় অনেকগুলো ছিদ্র করা ছিলো। আর পিঁপড়াগুলোর ঐ ছিদ্র দিয়ে বের না হয়ে যাওয়ার জন্য দুর্বেধ্য তারে নেটও লাগিয়ে রেখেছিল। সাথে সাউথ অস্ট্রেলিয়ার দিনের হিসাব অনুযায়ী লাইট সেন্সরও লাগানো ছিল কাঁচের পাত্রটায়। যেন পিঁপড়াগুলো কোন ভাবেই প্রতিকূল পরিবেশে গিয়েও না মরে।

দেশে আসার সময় এয়ারপোর্টে সিকিউরিটি তাকে আঁটকায় এইটার জন্য। কিন্তু পার পেয়ে যায়, আরেক এন্টামোলজিস্টের জন্য নিয়ে যাচ্ছে, তার এসিস্ট্যান্ট এই কথা বলে।

দেশে এসে ট্যাক্সি নিতে পারতো আগেই। কিন্তু অপেক্ষায় ছিল আরেকটা কাজের। ব্যাগের অস্ত্রটা তার বন্ধুর হাতে তুলে দেওয়ার জন্য। স্বাভাবিকভাবে দিতে গেলে সন্দেহে পড়তে পারে – সেই জন্যই ছিনতাইয়ের নাটক। ছিনতাইটা ইচ্ছা করেই করা হয়েছিল। তাতে করে সে সন্দেহের আওতা থেকে বেঁচে যায়।

এরপর বাকি কাজটা তার বন্ধুই সেরে নিয়েছে। ঠিক যেইভাবে বলেছিল আগে, সেইভাবেই শাস্তিটা পেতে হয়েছে সবাইকে।





উপসংহারের আগে...

গাজীপুরে যখন ঐ বাড়িটায় তারা পৌছুলো, তখনও আজগর আলী খানের মাথায় ঢুকছিলো না, ফারহান কিভাবে এতটা নিশ্চিত হয়েছে যে এখানেই আসতে হবে!
পুরোটা রাস্তাই তিনি ভেবেছেন এইটা নিয়ে। এতদিন উনার মাথায় আসেনি যে, এই কেসটাতে ফারহান ছাড়া আর কেউ নেই। কেন নেই বুঝতে পারছেন না। তার উপর সবসময়ই ডাক্তার ফায়েজকে সামনে রাখাটাও উনার একটু কেমন যেন লেগেছে। মনে হয়েছে, ডাক্তার ফায়েজকে সবসময়ই ফাঁসানোর তালে রয়েছে। আরো একটা ব্যাপারে বড় ধরণের খটকা লাগছে উনার। ফারহানের মত ঝানু গোয়েন্দা – যে কিনা মৃত একটা রহস্যকেও সজীব করে ফেলেছে – সে আগে মোবাইলগুলো চেক করেনি। এটা কেমন যেন খাপ খাচ্ছে না সবকিছুর সাথে।

তবে কী...???

আর ভাবতে পারলেন না তিনি। কয়েকদিনে সন্দেহের মাঝে থাকতে থাকতে সবকিছুতেই সন্দেহ করার বাতিক চলে এসেছে। জায়গাটা এত তাড়াতাড়ি খুঁজে বের করাটা অসম্ভবও নয়, এই কেসের অনেক কিছুই তিনি জানেন না। হয়তো বাড়িটার কথা ফারহান জানতো আগে থেকেই। তাই খুব তাড়াতাড়িই বের করতে পেরেছে। মোবাইলগুলোর ব্যাপারেও হয়তো খুব একটা পাত্তা দেয়নি আগে। স্বাভাবিক ভাবেই, বিনা রহস্যের মৃত্যুতে মোবাইল ঘাটাটাও খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। আর দ্রুতই ঘটে গেছে সব। উনি আসলে হয়তো মোবাইল গুলোর দিকে নজর যেতই। উনি এসে কাজটা সহজ করে দিলেন আরো।

বাসাটা খালিই। কেউ থাকে বলে মনে হচ্ছে না। ঢোকার পর একট ব্যাগ দেখতে পেলেন। ফারহান ব্যাগটা খুঁজে তেমন কিছুই পায়নি। শুধু একটা কাগজ পেয়েছে। ব্যাগটার মালিক কে সেটাতেই বুঝা যায়। পন্য ক্রয় করার রশিদ ঐটা। উপরে নাম লেখা – সাদাব রহমান।
ফারহান যেভাবে যেভাবে বলেছিল সেভাবেই মিলে যাচ্ছেসব। উনার কাছে এই ব্যাপারটা এতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। সাদাব আহমেদ শুধুই সময়ের মাঝে পড়ে গিয়েছিল বলেই ধারণা করেছিলেন। ফারহানের উপর ভক্তিটাও তাই বেড়ে গেল। একটু আগে তাকে সন্দেহ করছিলেন বলে লজ্জা পেলেন।

একটা ঘরের লাইট জ্বালানো ছিল। ফারহান তার পিস্তলটা বের করে নিল। দরজা লাগানো ছিল। এক ধাক্কায় দরজাটা খুলে ভিতরে ঢুকলো তারা। ডাক্তার ফায়েজ তখন চোখ লাল করে একটা চেয়ারে বসেছিলেন। ফারহান তাঁর দিকে পিস্তলটা তাক করেই রেখেছিল। কিন্তু আজগর আলীর কাছে ব্যাপারটা কেমন যেন লাগছিল। ডাক্তার ফায়েজকে বেশ দুর্বল দেখাচ্ছিল। এই দুর্বল লোকটিকে খুনী মনে হল না তাঁর।

ভাবতে ভাবতে হঠাৎই দেখলেন ফারহানের পিস্তলের নলটা তার দিকে ঘুরে গেছে।

‘ডিটেকটিভ! এটার মানে কী?’ অবাক হয়ে জানতে চাইলেন।
‘কথা না বলে ঐ চেয়ারটায় বসে পড়ুন।’ ঘরে থাকা আরেকটি খালি চেয়ারের দিকে ইঙ্গিত করলো ফারহান।

আজগর আলী খান হতভম্ব হয়ে আছেন। কিছুই বুঝতে পারছেন না। ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন। মুখের উপর এক ঘুষি পড়ায় বাস্তবে ফিরলেন। এক ঘুষির ধাক্কা সামলাতে না সামলাতেই আরো কয়েকটি ঘুষি পড়লো মুখের উপর। রক্ত ঝড়ছে নাক বেয়ে। নেতিয়ে পড়েছেন। তাঁকে চেয়ারে টেনে নিয়ে বসালো ফারহান। তারপর বাঁধলো দড়ি দিয়ে। মুখ আঁটকে দিল টেপ মেরে। ঐদিকে আরেক চেয়ারে এখনো নেতিয়ে পড়ে আছেন ডাক্তার ফায়েজ। চোখের বিষ্ময়ের ভাবটি এখনো কাঁটেনি আজগর আলী খানের। আজকের আগে এতটা অবাকও তিনি কখনো হননি।

উনার অবাক হওয়া দৃষ্টিটা চোখ এড়ালো না ফারহানের। মুচকি হাসলো সে।
‘আপনি খুবই অবাক হয়েছেন দেখা যাচ্ছে। কৌতুহল মেটাই আপনার।
দ্বীন ইসলাম ও ইসতিয়াক আহমেদের খুনের জন্য যার সাজা হল তার কিন্তু কোন দোষই ছিল না। তাঁকে ফাঁসিয়ে ছিলেন আপনারাই। সত্যিকারের খুনিও আপনারাই। শুধু শুধুই একটা নিরীহ লোককে ফাঁসিয়ে দিলেন – নিজেদের স্বার্থের জন্য।’

বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছেন আজগর আলী খান।
‘ভাবছেন আমি কিভাবে জানলাম? আপনাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, রহমতের পরিবারের কেউ আছে কিনা! আপনি বলেছেন নেই। কিন্তু আপনার জানার একটি ভুল আছে। রহমতের একটি ছেলে ছিল। সে তার বাবার সাথে দেখা করার জন্য অনেক চেষ্টাও করেছে। কিন্তু কখনোই তাকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। আপনার মনে আছে, তখন আপনারা একটা জায়গায় প্রতিরাতেই জুয়া খেলতেন। সেখানে একরাতে আপনার শরীরের উপর চা ফেলে দিয়েছিল এক ছেলে। আপনারা তখন রহমতকে নিয়েই কথা বলছিলেন। মেজাজ খারাপ করে সেই ছেলেটিকে 420 বলে গালি দিয়েছিলেন। সেই ছেলেটি ছিল রহমতের ছেলে। তার বাবাকে কিভাবে ফাঁসানো হয়েছে সেটা শুনে ছেলেটি আর স্থির থাকতে পারেনি। আপনার উপর রাগটাও বেশি হচ্ছিল তার। তাই ফেলে দিয়েছিল চা টা!’

আজগর আলী কথা বলতে পারছেন না মুখ আঁটকানো থাকায়। কিন্তু ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন ফারহানের দিকে।
‘আপনাদেরকে মেসেজ দেওয়া 420 ব্যক্তিটি আর চা ফেলে দেওয়া রহমতের 420 ছেলেটি একই মানুষ! ভেবেছিলাম, আপনি সহজেই বুঝতে পারবেন। কিন্তু পারেননি আর কী করার!’ বলে হাসলো ফারহান। ‘ভাবছেন এসব আমি কী করে জানলাম? কারণ, সেই 420 টি আমিই।’

আজগর আলী খান ছাড়া পাওয়ার জন্য ছটফট করছেন। সেটা দেখে আবারো হাসলো ফারহান। তারপর আর কথা না বলে, একটি কাঁচের পাত্র নিয়ে আসলো। ভিতরে পাথুরে বালি। সেই বালিতে পিল পিল করে ঘুরে বেড়াচ্ছে কয়েকটি পিঁপড়া।
আজগর আলী খান পিঁপড়াগুলো দেখে অবাক হলেন। এত বড় বড় পিঁপড়া তিনি কখনো দেখেননি। ফারহান সন্তর্পণে তিন-চারটি পিঁপড়া ছেড়ে দিল উনার শরীরে। এরপর যা করার পিঁপড়াই করলো।

দুর্বল ভঙ্গিতেই দৃশ্যটা দেখলেন ডাক্তার ফায়েজ। দেখলেন মুহুর্তের মাঝেই পিঁপড়ার কামড়ে মারা গেল এক জলজ্যান্ত মানুষ। সবগুলো খুন এইভাবেই করা হয়েছে – তাই তিনি ধরতে পারেননি মৃত্যুর আসল কারণ। পিঁপড়ার কামড়ে মানুষ মরে এই ধারণাও ছিল না উনার।

ডাক্তার ফায়েজের অবাক হওয়া দৃষ্টিটার দিকে তাকালো ফারহান। ভাবছে, ডাক্তার ফায়েজ কোন অপরাধই করেনি। কিন্তু তাঁকেও শাস্তি পেতে হচ্ছে। যেমনটা পেতে হয়েছিল তার বাবাকে। মাঝে মাঝে কিছু মানুষ অযথাই শাস্তি পায়, পেতে হয়। কিছুই করার নেই এতে। 





পরিশিষ্ট


গোয়েন্দা হওয়ার কারণে ফারহানের সবাইকে খুঁজে পাওয়াটা কঠিন ছিল না। বিশেষ করে তাদের পদবীগুলোই তাকে খুঁজে পেতে সাহায্য করেছে।
একমাত্র সমস্যা ছিল আনোয়ারুল কবিরকে খুঁজে বের করাটা। খুনগুলো হওয়ার পর রফিকের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণে টাকা পেয়েছিল সবাই। তাদের মাঝে আনোয়ারুল কবির তার টাকাটাকে কাজে লাগিয়ে সবার থেকে দূরেই সরে যান। পরিচয়ও পুরোটা বদলে ফেলেন। শুধু নামটা ছাড়া।
এই নামটা ধরেই তাকে খুঁজে পেয়েছে ফারহান। তবে তাকে খুঁজে পাওয়ার জন্যই সময়টা বেশি লেগেছে।

তারপর আস্তে আস্তে ঘটনা সাজিয়েছে। সবগুলো পরিবারের মাঝেই একটা কমন দিক পেয়েছিল। সেটা হল সুপারশপ। তাই সেটাকে কাজে লাগানোর জন্য সুযোগ খুঁজছিল। সাদাবের কাছ থেকে অদ্ভুত ধরণের আনট্রেসেবল অস্ত্রটা পাওয়ার পর আর দেরী করেনি। কাজে লাগিয়েছে ঐসবকে।
শুধু আজগর আলী খান ছাড়া বাকী সবার জন্য একই প্ল্যান ছিল। সেই ছোট থেকেই আজগর আলীর উপর একটা ক্ষোভ রয়েছে ফারহানের। সেই জন্যই একটা আলাদা প্ল্যান করতে হয়েছিল।

আর এর সাথে অন্যান্য ঘটনাগুলো সাজিয়েছে শুধু তদন্ত করার জন্য। যেন এইগুলো নিয়ে কাজ করার ভান করা যায়। এইটাতে কারো না কারো অস্বাভাবিক লাগতেই পারে – তখন তদন্ত হলে কিছু তো সূত্র দিতে হবে। ঠিক তার বাবার সাথে যা হয়েছিল – সেটারই পুনরাবৃত্তি করলো। শুধু তারা প্রভাব খাটিয়েছিল – সে খাটিয়েছে মাথা।

ডাক্তার ফায়েজ প্ল্যানটাতে হঠাৎ করেই এসে গিয়েছিল। সবগুলো লাশ তার কাছেই যাবে – এটা কাকতালীয় ছিল খুব। সাথে দ্বীন ইসলামের ছেলেও তিনি এটাও জানা ছিল না। সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার হল – সে যে কয়জনের সাথে এইটার জন্য আলাদা ভাবে টাকা দিয়ে ঠিক করেছিল, তখন অনেকদিন শেভ না করায় খোঁচা খোঁচা দাড়ি রয়ে গিয়েছিল। ডাক্তার ফায়েজের সাথে এই দিকটা ভাল ভাবেই মিলে গিয়েছিল। সবকিছু ডাক্তার ফায়েজের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়াটা খুব একটা কঠিন ছিল না। কাকতাল হোক আর যাই হোক – এতে করে কাজটা অনেক সহজ হয়ে যায়।
তাঁকে একবার ফোন করে লাশগুলোর মৃত্যুর রহস্যগুলো বলে দেয় সে ই। ফারহানই তাকে এটার কথা গোয়েন্দাদেরকে জানানোর কথা বলে। জানে এইটার জন্য তাকেই ডাকা হবে। আত্নবিশ্বাস একটু অতিরিক্তই ছিল। কিন্তু কাজে লেগে গেছে।

আজগর আলী খান ছিলেন তার শেষ শিকার। শিকারটা করেই স্কাইপেতে কল করলো তার বন্ধু সাদাবকে।
‘দোস্ত! জব ডান!’ হেসে জানালো।
‘তাতো বুঝলাম! কিন্তু ইকবাল চাচাকে জেরা করার তো কথা ছিল না। আমার নামটাও জড়ানোর কথা ছিলনা।’ একটু ভীত শোনালো সাদাবের কন্ঠটা।
‘ভাবিস না। ঐটার কথা জানতো শুধু একজনই। সেটার কথা উঠবে না। তুই নিরাপদেই আছিস।’ আশ্বাস দিল ফারহান।
‘আর ডাক্তার ফায়েজ! ঐ লোকটা কোন ঝামেলা করবে না তো?’
‘ডাক্তার ফায়েজ তো ছিল সাপোর্টিং এক্টর। তাদের গুরুত্ব তো শুধু কাহিনী বাড়ানোর জন্য। এছাড়া তারা অপ্রয়োজনীয়। আছেন তিনি কোনরকম।’

এরপর আরো কিছু কথা বলে কথা শেষ করলো তারা। এতদিনে শান্তি পেল ফারহান। একটা পাথরের মত চাপ অনুভব করছিলো সবসময়। এখন সেই চাপটা দূর হয়েছে।



----- সমাপ্ত -----

লেখার চিন্তা করার তারিখঃ ২৭ অক্টোবর, ২০১৫
লেখা শুরুর তারিখঃ ২২ নভেম্বর, ২০১৫ (মাঝে শুধু গল্প সাজানোর কাজই করেছি)
লেখা শেষের তারিখঃ ২৮ নভেম্বর, ২০১৫।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে অক্টোবর, ২০১৭ সন্ধ্যা ৬:২৫
২০টি মন্তব্য ২০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিসিএস-পরীক্ষার হলে দেরিঃ পক্ষ বনাম বিপক্ষ

লিখেছেন BM Khalid Hasan, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



বর্তমানের হট টপিক হলো, “১ মিনিট দেরি করে বিসিএস পরীক্ষার হলে ঢুকতে না পেরে পরীক্ষার্থীর স্বপ্ন ভঙ্গ।” প্রচন্ড কান্নারত অবস্থায় তাদের ছবি ও ভিডিও দেখা যাচ্ছে। কারণ সারাজীবন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:২৮




আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না। আমাদের দেশে মানুষ জন্ম নেয়ার সাথেই একটি গাছ লাগানো উচিৎ । আর... ...বাকিটুকু পড়ুন

মানবতার কাজে বিশ্বাসে বড় ধাক্কা মিল্টন সমাদ্দার

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:১৭


মানুষ মানুষের জন্যে, যুগে যুগে মানুষ মাজুর হয়েছে, মানুষই পাশে দাঁড়িয়েছে। অনেকে কাজের ব্যস্ততায় এবং নিজের সময়ের সীমাবদ্ধতায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারে না। তখন তারা সাহায্যের হাত বাড়ান আর্থিক ভাবে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিসিএস দিতে না পেরে রাস্তায় গড়াগড়ি যুবকের

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৫৫

আমাদের দেশে সরকারি চাকরি কে বেশ সম্মান দেওয়া হয়। আমি যদি কোটি টাকার মালিক হলেও সুন্দরী মেয়ের বাপ আমাকে জামাই হিসেবে মেনে নিবে না। কিন্তু সেই বাপ আবার ২০... ...বাকিটুকু পড়ুন

×