তখন বিশ্বজুড়ে সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যান্ড দল বিটলস। আর জর্জ হ্যারিসন ছিলেন বিশ্বের অন্যতম সেরা জনপ্রিয় তারকা। ইতিহাসে তিনি একজন প্রতিভাবান গিটারিস্ট ও শিল্পী হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছেন। তবে বাংলাদেশের মানুষের কাছে হ্যারিসন এক পরম বন্ধুর নাম। যার নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ভালোবাসার অন্য রকম এক কীর্তি।
সময়টা ছিল ১৯৭১। পাকিস্তানি বাহিনীর তাণ্ডবে বিধ্বস্ত গোটা বাঙালি। বাঙালিদের দুরবস্থা ছুঁয়ে গিয়েছিল নানা শ্রেণী-পেশার নানা দেশের মানুষদের। এদেরই একজন ভারতের বিখ্যাত পণ্ডিত রবি শঙ্কর। তিনি তার অবস্থান থেকে বিধ্বস্ত এই জাতির জন্য কিছু করতে চাইলেন। পণ্ডিত রবিশংকর মুক্তিযুদ্ধের প্রতি বিশ্ব জনমত গড়ে তুলতে ও শরণার্থীদের আর্থিক সহায়তা দেওয়ার জন্য বিশ্বখ্যাত ব্যান্ড বিটলেসর শিল্পী জর্জ হ্যারিসনের সঙ্গে একটি কনসার্ট আয়োজনের বিষয়ে আলাপ করেন। হ্যারিসন তার প্রস্তাবটি সাদরে গ্রহণ করেন এবং 'দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ' আয়োজনের জন্য কোমর বেঁধে লেগে পড়লেন। কিন্তু বিষয়টি মোটেও সহজ ছিল না। কারণ দুনিয়া কাঁপানো গানের দল বিটলসের সদস্যদের মধ্যে কোনো বনিবনা ছিল না। কিন্তু এরপরও মানবতার জন্য হ্যারিসন তার দলের সদস্য বন্ধুদের ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনের অনুষ্ঠানে যোগদানের জন্য আমন্ত্রণ জানান। পাঁচ সাপ্তাহের মধ্যে অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়। বিটলসের পল ম্যাকার্টনি কনসার্টে আসার ব্যাপারে সরাসরি অস্বীকৃতি জানান। আরেক কিংবদন্তি জন লেনন অনুষ্ঠানে আসতে রাজি ছিলেন, কিন্তু আদালতে স্ত্রীর সঙ্গে সন্তানের ব্যাপারে আইনি লড়াইয়ের কারণে শেষ পর্যন্ত আসতে পারেননি। আর মিক জ্যাগার তখন ছিলেন দক্ষিণ ফ্রান্সে। ভিসা সংক্রান্ত জটিলতার কারণে তার পক্ষেও আসা সম্ভব হযনি। শেষ পর্যন্ত বিটলসের একমাত্র রিঙ্গো স্টার তাদের সঙ্গে যোগ দেন। সঙ্গে আরও ছিলেন কিংবদন্তি তারকা বব ডিলান, এরিক ক্ল্যাপটন, বিলি প্রিস্টন, হ্যারিসনের নতুন দল ব্যাড ফিঙ্গারের যন্ত্রী দল ও আরও অনেকে। ১৯৭১ এর ১ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ারে আয়োজিত হলো 'কনসার্ট ফর বাংলাদেশ'।
বিটলস ভেঙে যাওয়ার পর এটাই ছিল হ্যারিসনের সরাসরি অংশগ্রহণ করা প্রথম অনুষ্ঠান। এরিক ক্ল্যাপটনও এ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে প্রায় পাঁচ মাস পর কোনো সরাসরি অনুষ্ঠানে গান গাইলেন এবং বব ডিলানও ১৯৬৯ সালের পর প্রথমবারের মতো শ্রোতা-দর্শকদের সামনে আসেন। তাই এই কনসার্ট নিয়ে দর্শকদের মধ্যে বাড়তি উন্মাদনা ছিল। প্রথমে পরিকল্পনা ছিল, একটি কনসার্ট হবে। কিন্তু সে দিন এত বিপুল সাড়া জাগিয়েছিল কনসার্টটি যে পরে অনুষ্ঠানসূচি ঠিক রেখে, একই দিনে আরও একটি অনুষ্ঠান করতে হয়েছিল 'দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ'-এর। মূল অনুষ্ঠানে জর্জ হ্যারিসন শুরুতেই হাজার হাজার শ্রোতাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, 'ভারতীয় সংগীত আমাদের চেয়ে অনেক গভীর।' তারপর পণ্ডিত রবিশংকর ও ওস্তাদ আলী আকবর খান এবং সহশিল্পীদের পরিচয় করিয়ে দেন। কনসার্টটির শুরুতেই পণ্ডিত রবিশংকর এক সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে বলেন, 'প্রথম ভাগে ভারতীয় সংগীত থাকবে। এর জন্য কিছু মনোনিবেশ দরকার। পরে আপনারা প্রিয় শিল্পীদের গান শুনবেন। আমাদের বাদন শুধুই সুর নয়, এতে বাণী আছে। আমরা শিল্পী, রাজনীতিক নই। বাংলাদেশে অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা ঘটছে। বাংলাদেশের পল্লীগীতির সুরের ভিত্তিতে আমরা বাজাব 'বাংলা ধুন'।' তিনি 'বাংলা ধুন' নামের একটি নতুন সুর সৃষ্টি করেছিলেন। সেটি দিয়েই আলী আকবরের সঙ্গে যুগলবন্দিতে কনসার্ট শুরু হয়েছিল। তবলায় ছিলেন ওস্তাদ আল্লা রাখা এবং তানপুরায় ছিলেন কমলা চক্রবর্তী।
দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ-এর বড় আকর্ষণ ছিলেন বব ডিলান ও জর্জ হ্যারিসন। অসাধারণ গিটার বাজিয়েছিলেন এরিক ক্ল্যাপটন। জর্জ হ্যারিসন আটটি গান গেয়েছিলেন। এর একটি ছিল বব ডিলানের সঙ্গে। বব ডিলান গেয়েছিলেন পাঁচটি গান। রিঙ্গো স্টার ও বিলি প্রেস্টন একটি করে গান করেছিলেন। লিওন রাসেল একটি একক এবং ডন প্রেস্টনের সঙ্গে একটি গান করেছিলেন।
এই কনসার্টে জর্জ হ্যারিসনের আন্তরিক ভূমিকা বাংলাদেশি মানুষের কাছে হ্যারিসনকে সত্যিকারের তারকায় পরিণত করেছিল। কনসার্ট ফর বাংলাদেশের সর্বশেষ পরিবেশনা ছিল জর্জ হ্যারিসনের অবিস্মরণীয় গান 'বাংলাদেশ বাংলাদেশ'। ১৯৭১ এর ১ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ারে ওঠা সেই 'বাংলাদেশ-বাংলাদেশ' ধ্বনি সমগ্র বিশ্বজুড়ে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। এই কনসার্ট থেকে সংগৃহীত ২ লাখ ৫০ হাজার ডলার ইউনিসেফের মাধ্যমে বাংলাদেশের বিপন্ন মানুষের জন্য দেওয়া হয়েছিল। এই আয়োজনের ক'দিন পরই ১৯৭১ সালেই এর অডিও সংকলন বের হয়। ১৯৭২ সালে এই অনুষ্ঠানের চলচ্চিত্রও বের হয়। ২০০৫ খ্রিস্টাব্দে ওই চলচ্চিত্রটিকে একটি তথ্যচিত্রসহ নতুনভাবে ডিভিডি আকারে তৈরি করা হয়। এই কনসার্ট এবং তার বিখ্যাত গান 'বাংলাদেশ'-এর জন্য তিনি ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
(সংগৃহীত)
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই ডিসেম্বর, ২০১২ রাত ১:৫১