somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মহান মুক্তিযুদ্ধে বাঙালিদের বিদেশী বন্ধু (ফাদার মারিনো রিগন) পর্ব- ৩

১২ ই ডিসেম্বর, ২০১২ রাত ২:০১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



আমাদের স্বাধীনতা অর্জনে ভূমিকা রেখেছেন দেশ-বিদেশের অসংখ্য মানুষ। দূর প্রান্তে থেকেও সমর্থন জুগিয়েছেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে। ভিনদেশি সহস্র মানুষের কাছে বাঙালি জাতি চিরঋণী। তেমনি একজন মানুষ ফাদার মারিনো রিগন। এখন তাকে ভিনদেশি মানুষ বললে ভুল হবে। বর্তমানে তিনি মনে-প্রাণেই একজন বাঙালি। ষাটের দশক থেকে বাস করছেন প্রিয় বাংলাদেশে। ১৯৭১ সাল। ফাদার রিগন তখন বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার বানিয়ারচর গ্রামের ক্যাথলিক মিশনের প্রধান ধর্মযাজক। ফাদার রিগন পাকিস্তানি সৈন্যদের বর্বরতা, হত্যা-লুণ্ঠন, নারী নির্যাতন, আর হানাদারদের অগ্নিসংযোগে পুড়ে যাওয়া গ্রামের পর গ্রাম নিজ চোখে দেখলেন। মানবতার মূলমন্ত্রে যুদ্ধপীড়িত ও যুদ্ধাহত মানুষের পাশে এসে দাঁড়ালেন তিনি। চিকিৎসাসেবা দেওয়ার জন্য ঢেলে সাজালেন ক্ষুদ্র চিকিৎসাকেন্দ্রটি। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চিকিৎসা দিতে লাগলেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের। শুধু তাই নয়, যুদ্ধপীড়িতদের আশ্রয় ও খাদ্য সংস্থানের ব্যবস্থাও করলেন। ফাদার রিগনের কাছেই চিকিৎসাসেবা পেয়েছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় বৃহত্তম গেরিলা বাহিনীর প্রধান হেমায়েত উদ্দিন। হেমায়েত বাহিনীর প্রধান হেমায়েত উদ্দিন বীরবিক্রম ফাদার রিগন সম্পর্কে বলেন, '১৯৭১ সালের ১৪ জুলাই পাকিস্তানি সৈন্যদের সঙ্গে এক সম্মুখযুদ্ধে আমার মুখমণ্ডলে গুলিবিদ্ধ হয়। শত্রুর বুলেট আমার মুখের বামপাশ দিয়ে ঢুকে চোয়ালের দাঁতসহ ডান দিক দিয়ে বেরিয়ে যায়। জিহ্বার একটি টুকরাও সেই সঙ্গে উড়ে যায়। দলের চিকিৎসকদের কাছে প্রাথমিক চিকিৎসা পাওয়ার পর আমি উন্নত চিকিৎসার জন্য চলে যাই ফাদার রিগনের চিকিৎসাকেন্দ্রে। ফাদার নিজে দাঁড়িয়ে থেকে আমার শরীরে অস্ত্রোপচার করান। সে সময় আমার চিকিৎসা করতে গিয়ে ফাদার নিজের জীবনের যে ঝুঁকি নিয়েছিলেন, তার ঋণ কোনোদিন শোধ হওয়ার নয়। ওই সময় ওপরে ছিল ঈশ্বর, নিচে ফাদার রিগন। হয়তো তার কাছ থেকে চিকিৎসাসেবাটা না পেলে বাঁচতেই পারতাম না। শুধু আমার নয়, তিনি অনেক যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাকে চিকিৎসাসেবা দিয়েছিলেন। তাই ফাদার রিগনও আমাদের মুক্তিযুদ্ধের একজন সহযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের পরম বন্ধু।'

যুদ্ধকালীন তার মিশন থেকে প্রস্তাব আসে, তিনি কিছুদিনের জন্য ছুটি চান কিনা। ফাদার সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন। বাঙালির দুঃসময়ে তিনি তাদের পাশে থাকবেন না, তা তো হয় না। বিপদেই তো প্রকৃত বন্ধুর পরিচয়। তিনি যেন আর ১০ জন দেশপ্রেমী বাঙালির মতোই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। এ যুদ্ধ বাঙালি জাতির মুক্তির যুদ্ধ।

তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় নিয়মিত লিখতেন মুক্তিযুদ্ধের দিনলিপি। ইতালীয় ও ইংরেজি ভাষায় রচিত তার রোজনামচায় ধরা পড়ে স্বাধীনতাযুদ্ধের খণ্ড খণ্ড চিত্র। তার দিনলিপিতে এভাবেই প্রকাশ প্রায় মুক্তিযুদ্ধের নানা ঘটনা। ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১-এর সকালে মুক্তিবাহিনীর একটি লঞ্চ নদীপথে টেকেরহাট থেকে গোপালগঞ্জ যাচ্ছিল। লঞ্চে পতপত করে উড়ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। আমাদের নদীর ঘাটে শত শত লোকের চিৎকারে আকাশ-বাতাস মুখরিত, 'জয় বাংলা! জয় বাংলা!' আমরাও আমাদের লঞ্চের নাম দিলাম 'মুক্ত বাংলা'। বিকাল বেলা ৩০ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল আমাদের সঙ্গে মিলিত হলো। তারা সারিবদ্ধ হয়ে কুচকাওয়াজ, ফাঁকা গুলি করে বিজয়ের আনন্দ প্রকাশ করল। মাঠে শত শত লোক। আমাকে কিছু বলতে বলা হলো। আমি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী কবিতার কয়েকটি লাইন আবৃত্তি করলাম, 'বল বীর, বল উন্নত মম শির' একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রে বানিয়ারচর ধর্মপল্লীতে নতুন করে যাত্রা শুরু করলাম। ফাদার রিগন রচিত মুক্তিযুদ্ধের দিনলিপি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম মূল্যবান ইতিহাস। ২০০৬ সালের ২৮ নভেম্বর মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর আয়োজিত 'স্মারক সংগ্রহ' অনুষ্ঠানে ফাদার রিগন তার লেখা 'মুক্তিযুদ্ধের ডায়েরি', 'মুক্তিযুদ্ধের আলোকচিত্র', মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরকে দান করেন। জাদুঘরের পক্ষে স্মারকগুলো গ্রহণ করেন মুক্তিযুদ্ধের উপপ্রধান সেনাপতি এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) এ কে খন্দকার। মুক্তিযুদ্ধের পরম বন্ধু ফাদার রিগনের জন্ম ১৯২৫ সালে ৫ ফেব্রুয়ারি ইতালির ভেনিসের অদূরে ভিল্লাভেরলা গ্রামে। বাংলাদেশে তার আগমন ১৯৫৩ সালের ৭ জানুয়ারি। বহুমাত্রিক তার পরিচয়। আর ১০ জন ধর্মযাজকের মতো কেবল ধর্মীয় কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত থাকেননি তিনি। নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছেন শিল্প, সংস্কৃতি আর শিক্ষামূলক বহুমাত্রিক কাজে। তার হাতেই ইতালিয়ান ভাষায় রচিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলিসহ প্রায় ৪০টি কাব্যগ্রন্থ, লালন সাঁইয়ের ৩৫০টি গান, জসীম উদ্দীনের নকশি কাঁথার মাঠ, সুজন বাদিয়ার ঘাট, নির্বাচিত কবিতা ছাড়াও এদেশের গুরুত্বপূর্ণ কবিদের অসংখ্য কবিতা। তার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায় দক্ষিণাঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সরকার এদেশের মুক্তিযুদ্ধ, সৃজনশীল ও শিক্ষামূলক কাজে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ প্রদান করেছেন বাংলাদেশের সম্মানসূচক নাগরিকত্ব। মুক্তিযুদ্ধে অনন্য অবদানের জন্য সম্প্রতি তিনি পেয়েছেন রাষ্ট্রীয় পুরস্কার 'মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা'। এছাড়াও দেশ-বিদেশের অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন তিনি। কর্মসূত্রে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে অবশেষে তিনি স্থায়ীভাবে বাস করছেন সুন্দরবন সংলগ্ন মংলা শেলাবুনিয়া গ্রামে। ২০০৩ সাল। ফাদার রিগনের হৃদযন্ত্রে অসুস্থতা ধরা পড়ে। তিনি ভাবলেন, জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে পৌঁছে গেছেন তিনি। উন্নত চিকিৎসার জন্য তার স্বজনরা ইতালিতে যেতে বললেন। কিন্তু ফাদার কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না। তার কথা, যদি মরণ হয়, বাংলার মাটিতেই হবে। প্রিয় বাংলার মাটিতেই চিরনিদ্রায় ঘুমাবেন তিনি। স্বজনদের প্রবল আকুতি-মিনতির পর তিনি রাজি হলেন ইতালি যেতে। তবে শর্ত ছিল, যদি মৃত্যু হয় মরদেহটি বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিতে হবে।
এই হচ্ছে বাংলাদেশপ্রেমী ফাদার রিগনের এদেশের প্রতি গভীর ভালোবাসার এক বাস্তব গল্প।

(লেখাটি সংগৃহীত)
৫টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অণু থ্রিলারঃ পরিচয়

লিখেছেন আমি তুমি আমরা, ০৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৭


ছবিঃ Bing AI এর সাহায্যে প্রস্তুতকৃত

১৯৪৬ কিংবা ১৯৪৭ সাল।
দাবানলের মত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশে।
যে যেভাবে পারছে, নিরাপদ আশ্রয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। একটাই লক্ষ্য সবার-যদি কোনভাবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

পেইন্টেড লেডিস অফ সান ফ্রান্সিসকো - ছবি ব্লগ

লিখেছেন শোভন শামস, ০৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:১৯

"পেইন্টেড লেডিস অফ সান ফ্রান্সিসকো", কিংবা "পোস্টকার্ড রো" বা "সেভেন সিস্টারস" নামে পরিচিত, বাড়িগুলো। এটা সান ফ্রান্সিসকোর আলামো স্কোয়ার, স্টেইনার স্ট্রিটে অবস্থিত রঙিন ভিক্টোরিয়ান বাড়ির একটি সারি। বহু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শিরোনামহীন দুটি গল্প

লিখেছেন সাহাদাত উদরাজী, ০৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৫৫

গল্প ১।
এখন আর দুপুরে দামী হোটেলে খাই না, দাম এবং খাদ্যমানের জন্য। মোটামুটি এক/দেড়শ টাকা প্লাস বয়দের কিছু টিপস (এটা আমার জন্য ফিক্সড হয়েছে ১০টাকা, ঈদ চাদে বেশি হয়,... ...বাকিটুকু পড়ুন

এশিয়ান র‍্যাংকিং এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান !!

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ০৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:২০

যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিক্ষা সাময়িকী 'টাইমস হায়ার এডুকেশন' ২০২৪ সালে এশিয়ার সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা প্রকাশ করেছে। এশিয়ার সেরা ৩০০ তালিকায় নেই দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়।তালিকায় ভারতের ৪০, পাকিস্তানের ১২টি, মালয়েশিয়ার ১১টি বিশ্ববিদ্যালয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজত্ব আল্লাহ দিলে রাষ্ট্রে দ্বীন কায়েম আমাদেরকে করতে হবে কেন?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:০৬



সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ২৬ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৬। বল হে সার্বভৈৗম শক্তির (রাজত্বের) মালিক আল্লাহ! তুমি যাকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব) প্রদান কর এবং যার থেকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব) কেড়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×