somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

MAD LOVE

৩১ শে মে, ২০১৩ রাত ১১:২৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

রাশেদ, তুমি কি ইদানীং আমাকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছ?
হ্যাঁ...
... আমি কি জানতে পারি কেন?
আমার মনে হয় তুমি কারনটা ইতিমধ্যে জান।
আমি তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই।
...নিশাত...
“ওহ হেল।। আবার সেই নিশাত...”
“আই এম স্যরি... কিন্তু আমার আর কিছু বলার নেই।”
রাশেদের কাঁধ ঝুলে পরে। তার কণ্ঠে হাল ছেড়ে দেবার সুর শোনা যায়। কিন্তু রিয়া এত সহজে ছেড়ে দেবার পাত্র নয়। সে ঝাকুনি দিয়ে কপালের উপর থেকে এক গোছা চুল সরিয়ে বলে, “প্রায় তিন বছর কেটে গেছে রাশেদ। এখনো সেই কথা মনে করে...”
“আমার এখনো সব কিছু পরিষ্কার মনে পরে, যেন মাত্র গতকালের ঘটনা...”
“তুমি কথা দিয়েছিলে তুমি ওসব ভুলে যাবে। সব কিছু আবার নতুন করে শুরু করবে। তুমি আর আমি... আমরা দুজন।”
“আমি চেষ্টা করেছি রিয়া। বিশ্বাস কর আমি চেষ্টা করেছি। আমার সর্বশক্তি দিয়ে... তোমার কি মনে হয় আমি ইচ্ছে করে এভাবে বেঁচে আছি?? আমি... আমি রাতে ঘুমাতে পারি না...।”
রাশেদের গলা ভেঙে আসে। রিয়া গভীর মমতায় রাশেদকে জরিয়ে ধরে। রাশেদ শিশুর মত রিয়াকে চেপে ধরে রাখে। তার শরীরটা একটু একটু কেঁপে উঠছে। রাশেদ অসুস্থ, ভীষণ রকম অসুস্থ। রিয়া জানে তার অসুস্থতার কথা। কিন্তু ওর কিছু করার নেই। এই অসুস্থ মানুষটাকে সে ভয়ঙ্কর ভালোবাসে।
**
রাশেদ স্বপ্ন দেখছে।
হাইওয়ে ধরে ফুল স্পিডে গাড়ি চলছে। ড্রাইভিং সিটে বসে আছে নিশাত। জানালার কাঁচ নামানো। হু হু করে বাতাস বইছে। নিশাতের গলায় একটা লাল স্কার্ফ জড়ানো। বাতাসে সেই স্কার্ফ ছটফট করছে। নিশাত হাসছে। কিন্তু হাসির কোন শব্দ হচ্ছে না। নিশাতের হাসির কোন শব্দ নেই কেন?
ঘুম ভেঙে রাশেদ ধড়মড় করে উঠে বসে। ওর হতচকিত ভাবটা কাটতে বেশ সময় নেয়। শরীর ঘামে ভিজে গেছে। কত পরিচিত একটা স্বপ্ন। কতবার এই স্বপ্ন দেখেছে রাশেদ। কিই বা এমন স্বপ্ন এটা? তারা দুই জন পাশাপাশি গাড়ি ছুটিয়ে যাচ্ছে। তবুও এই নির্দোষ স্বপ্নটাই প্রতিবারই ওকে এভাবে কাপিয়ে দিয়ে যায়।
তিন বছর... রিয়া ঠিকই বলেছে...
তিন বছর কেটে গেছে...
নিশাত সুইসাইড করেছে।
কেন কাউকে বলে যায়নি...
তারপর তিন বছর কেটে গেছে।
সত্যি এতদিন পর এখনো তাকে স্বপ্নে দেখার কোন মানে হয় না।
রাশেদ টেবিলে রাখা আলোকিত ডিজিটাল ঘড়ির দিকে তাকায়। রাত সাড়ে তিনটা বাজে। রাশেদ বেডসাইডে টেলিফোনের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। পৃথিবী এখন ঘুমিয়ে আছে। তাতে কিছু এসে যায় না। রিয়াকে সে যখন খুশী ফোন করতে পারে।
***
তোমাকে অনেক ধন্যবাদ ফিরোজ।
ধন্যবাদ কিসের জন্যে?
তোমার কারনেই রাশেদের সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল। ধন্যবাদ তো আবশ্যি তোমার পাওনা।
“আই গেজ ইট ওয়াজ মিন্ট টু বি। গ্লাড আই কুড হেল্প, দো।” ফিরোজ কাঁধ ঝাঁকায়।
“জান, রাশেদ আমাকে প্রপোজ করেছে।” রিয়ার গালটা একটু লাল হয়ে উঠে।
“ওহ, দ্যটস গ্রেট।” ফিরোজ প্রায় লাফিয়ে ওঠে, “এই ঘটনা কখন ঘটল?”
“গতকাল। কি অদ্ভুত ব্যপার জানো। গতকাল আমি ওকে ভীষণ চাপ দিয়েছিলাম আমাদের রিলেশনটার ব্যপারে। ওর মুখ থেকে একটা ফাইনাল ডিসিশন আদায় করতে চাইছিলাম। রাশেদ তখন প্রায় বলেই দিয়েছিল ওর পক্ষে আমাকে বিয়ে করা সম্ভব হবে না। আর তারপর গতকালই রাতে নিজে থেকে এসে বিয়ের প্রস্তাব দিল।”
“বেটার লেট দেন নেভার। তারপর, দিন তারিখ ঠিক করেছ কিছু?”
“ওসব এখনো ঠিক করা হয়নি। তবে আমি বেশি সময় নেব না। যা খেয়ালি মানুষ, দেরি করলে যদি আবার মত বদলে ফেলে।”
“ঠিক বলেছ। শুভ কাজে দেরি করতে নেই।” ফিরোজ তার চেয়ার ছেড়ে উঠে গিয়ে বড় দুই মগে গরম কফি ঢেলে আনে। তারপর একটা মগ রিয়ার হাতে ধরিয়ে দিয়ে অন্যটায় নিজে লম্বা চুমুক দেয়। “আই অ্যাম সো হ্যপি ফর ইউ গাইজ। জাস্ট প্রমিজ মি ওয়ান থিং। নেভার লেট হিম ফিল এলোন।”
“ফিরোজ তুমি জান আমি ওকে কখনো একা হতে দেব না।”
“নিশাতের সব কথা তো তুমি জানই। ওর মৃত্যু যে রাশেদকে কি ভয়ঙ্কর ভাবে এফেক্ট করেছিল, যদি দেখতে। নিজেকে দিনের পর দিন ঘরে আটকে রেখেছে। বাহিরের কারোর সাথে দেখা করত না। কারো সাথে কথা বলত না। এমনকি ভুদিন আমার সাথেও কথা বলেনি। দুনিয়া থেকে একরকম স্বেচ্ছা নির্বাসন নিয়ে ফেলেছিল। ওকে বাঁচিয়ে রাখা নিয়েই আমরা দুশ্চিন্তায় পরে গিয়েছিলাম। সব সময় আতঙ্কে থাকতাম রাশেদ নিজেই সুইসাইড করে কিনা। এই ভয়ঙ্কর অবস্থা চলেছে প্রায় একবছর। আমরা বন্ধুরা সব সময় চেষ্টা করেছি ওকে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে। তবে তুমি না থাকলে এর কিছুই সম্ভব হোত না। নিশাতের চলে যাবার পর তুমিই হচ্ছ রাশেদের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ন ঘটনা। তোমার কারনেই আজ রাশেদ আবার আগের মত হাসতে পারছে। তুমি ওকে নতুন জীবন দিয়েছ।”
“তুমি কিন্তু বেশি বেশি বলছ।” রিয়ার গাল আবার লাল হয়ে উঠছে।
“মোটেই না। আমি রাশেদের ছেলেবেলার বন্ধু। ছোটবেলা থেকে আমরা একসাথে বড় হয়েছি। ওকে আমার চেয়ে ভালো আর কেউ চেনে না।” এটুকু বলে ফিরোজ থেমে যায়। তারপর হেসে ফেলে, “এই কথাটা হয়তো এরপর থেকে আর বলা যাবে না। এখন আমার থেকেও অনেক অনেক বেশি ভালো করে রাশেদকে আরেকজন মানুষ চেনে। সে হচ্ছ তুমি।”
“ওহ।। আর ইউ জেলাস...??” রিয়ার চোখ চকচক করে উঠে।
“ইয়েস আই এম, ফর ইউ এন্ড রাশেদ, বোথ।” ফিরোজ হাসিমুখে বলে।
“নিজেকে মানিয়ে নাও, বুঝলে।” রিয়া ভ্রু নাচিয়ে বলে, “এখন থেকে রাশেদ একা তোমার বেস্ট ফ্রেন্ড নয়। রাশেদের সাথে আমিও এখন সেই লিস্টে আছি।”
“অবশ্যই... চিয়ার্স টু দ্যা হ্যপি কাপল।” ফিরোজ হাতের মগটা উঁচু করে ধরে।
পরের দিন কাউকে কিছু না জানিয়ে রিয়া নিখোঁজ হয়ে যায়। প্রায় এক সপ্তাহ অনেক খুজেও রিয়ার কোন হদিশ পাওয়া যায় না।
***
গভীর রাতে রাশেদের ঘুম ভেঙে যায়।
কেন ঘুম ভেঙে গেল রাশেদ বুঝতে পারছে না। বেড সাইডে আলোকিত ঘড়িটা দেখতে গিয়ে রাশেদ দেখল সে মাথা ঘুড়াতে পারছে না। শুধু মাথা নয়, তার সাড়া শরীর যেন পাথরের মত জমে গেছে। একটা আঙ্গুলও নাড়াবার ক্ষমতা নেই। আতঙ্কে রাশেদ চিৎকার করে উঠল। কিন্তু কোন শব্দ হল না। রাশেদ মুখই খুলতে পারছে না, শব্দ হবে কোথা থেকে। লম্বা শ্বাস নিয়ে রাশেদ নিজেকে সামলে নিতে চেষ্টা করল। সম্ভবত ওকে বোবায় ধরেছে। রাশেদের এই সমস্যাটা আছে। এরকম মাঝে মাঝেই হয়। এবং প্রতিবারই আতঙ্কে রাশেদের হার্ট এট্যাকের উপক্রম হয়। এই জিনিসটার সাথে মানিয়ে নেবার কোন উপায় নেই।
রাশেদ চোখ বন্ধ করে আবার ঘুমিয়ে পড়তে চেষ্টা করে। সাধারণত বোবায় ধরা অবস্থা বেশিক্ষণ স্থায়ি হয় না। পাঁচ দশ মিনিট পরেই কেটে যায়। এই পাচ-দশ মিনিট একটা আধো ঘুম আধো জাগরণের মধ্যে দিয়ে কেটে যায়। রাশেদ মাঝে মাঝে বোবায় ধরা অবস্থাতেই স্বপ্ন দেখে। এই সময়ের স্বপনগুলো কখনোই সুখকর হয় না।
ঘরের বাইরে শব্দ হচ্ছে।
কিসের শব্দ?
রাশেদ কি ঠিক শুনছে?
নাকি স্বপ্ন দেখছে?
রাশেদ বুঝতে পারে না। ববায় ধরা এই সময়টা খুব অদ্ভুত। জাগরন আর অচেতনতার মধ্যে এই সময় পার্থক্য করে খুব কঠিন। রাশেদ অসহায়ের মত বিছানায় ছটফট করতে থাকে, যদিও তার শরীরটা এক চুলও নড়ে না।
শব্দটা বাড়ছে। কে যেন মেঝেতে পা ঘসে ঘসে হাঁটছে।
রাতের সুনসান নীরবতার মাঝে পায়ের শব্দটা স্পষ্ট কানে বাজছে। নাকি হঠাত করে রাশেদের শ্রবন ক্ষমতা বেড়ে গেছে? বোবায় ধরলে কি কানের শক্তি বেড়ে যায়? রাশেদ আগে লক্ষ করেনি।
পায়ের শব্দটা ক্রমেই জোড়ালো হচ্ছে।
ঘস... ঘসসসস।। ঘস...ঘসসসস...
কেউ যেন খুব কষ্টে ক্লান্ত দেহটাকে টেন টেনে এগুচ্ছে।।
রাশেদ ঘামছে। তার বুক শুকিয়ে আসছে। এটা কি স্বপ্ন? নিশ্চয়ই এটা একটা স্বপ্ন। প্লিজ খোদা এটা যেন একটা স্বপ্ন হয়। রাশেদ এক্ষুনি ঘুম থেকে জেগে উঠবে। জেগে উঠে দেখবে সব ঠিক ঠাক আছে, তার মাথার উপরে ফ্যন ঘুরছে। বাসায় আর কেউ নেই। জেগে উঠেই রাশেদ ঠান্ডা এক গ্লাস পানি খাবে।
পায়ের শব্দটা ঠিক ঘরের দরোজার কাছে এসে থেমে যায়।
ঘরের দরোজা লোক করা হয়েছিল তো? রাশেদ মনে করতে পারে না। পায়ের আওয়াজের মালিক দরোজার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে। দরোজার ওপাশ থেকে তার শ্বাস প্রশ্বাসের আওয়াজ আসছে। সে থেমে থেমে লম্বা নিঃশ্বাস ফেলছে। যেন অনেক দূর হেঁটে এসে হাপিয়ে গেছে।
তারপর মৃদু শব্দে দরোজা খুলে যায়।
ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকা দির্ঘ কালো একটি ছায়ামুর্তি সন্তপর্নে ঘরের ভেতর পা ফেলে।
রিয়া!!
ঘরের বাতি নেভানো। বাইরের ঘরে একটা নাইট লাইট জ্বলছে, তারই এক চিলতে আলো খোলা দরোজা দিয়ে শোবার ঘরে প্রবেশ করেছে। এই আলোয় ছায়ামুর্তির চেহারা দেখার উপায় নেই। শুধু তার দেহ কাঠামোটা আবছা ভাবে চোখে পরে। কিন্তু রাশেদ নিশ্চিত এটা রিয়া।
রাশেদের মেরুদণ্ড বেয়ে ভয়ের একটা শীতল স্রোত নেমে যায়। ওর শরীরের প্রতিটি স্নায়ু বলছে এই মুহুর্তে ছুটে পালাতে। কিন্তু মনের নির্দেশ শরীরে পৌচাচ্ছে না। রিয়া রাশেদের শিয়রে এসে দাঁড়িয়েছে। একটা হাত বাড়িয়ে দরোজার দিকে নির্দেশ করছে। রিয়াকে ওকে কোথাও নিয়ে যেতে চাইছে?
অন্ধকার রাস্তায় গাড়ি ছুটছে। ড্রাইভিং সিটে শক্ত করে স্টিয়ারিং ধরে বসে আছে রাশেদ। হেডলাইটের আলোয় যতদুর চোখ যায় কোন জনমানুষের চিহ্ন নেই। পথের দুধারে মোটা মোটা গাছের সাড়ি। বনের মধ্যে এই সড়ু রাস্তা ধরে এত রাতে কোথায় চলেছে রাশেদ? ওর জানা নেই। বিছান ছেড়ে কখন যে গাড়িতে উঠে বসেছে তাও মনে পড়ছে না। ওর পাশের সিটে মুর্তির মত বসে আছে রিয়া। গাড়ির দুলুনির সাথে সাথে রিয়ার শরিরটাও একটু একটু দুলছে। কিন্তু ওর মুখের একটা পেশিও কাপছে না। রাশেদ রিয়ার দিকে তাকাতে পারছে না। ভয় লাগছে। ও কি সত্যি দেখছে? নাকি সবই ওর কল্পনা? নাকি ও এখনো নিজের বিছানায় নিরাপদে ঘুমিয়ে আছে? এসবই একটা বিশ্রি দুস্বপন?
***
কাঠের একটা বাড়ি। উপরে ছাদের জায়গায় বিভার টাইলের চাল। সামনে বড় বাগান।
বাড়িটা রশেদের পরিচিত। রিয়া হাতের ইশারায় তাকে অনুসরণ করতে বলে। কখন যে গাড়ি থেকে নেমে এসেছে রাশেদ বলতে পারবে না। রাশেদের এগুতে মন চায় না। ওর মন বলছে ভয়ঙ্কর একটা কিছু ওর জন্যে ওই বাড়িতে অপেক্ষা করছে। কিন্তু কি এক অদৃশ্য সুতোর টানে নিজের অজান্তেই সে রিয়ার পিছু নেয়। বাগানের মধ্যে দিয়ে কাঁকড় বেছানো পথ মাড়িয়ে ওরা দুইজন দোরগোড়ায় গিয়ে পৌছে। দরোজায় একটা ভারি তালা ঝুলছে। রাশেদ অন্যমনস্ক ভাবে প্যন্টের পকেটে হাত ভরে একটা চাবির গোছা তুলে আনে। এই চাবির গোছা ওর পকেটে কিভাবে আসল?
খুলবে না খুলবে না করেও কোন এক অশরীরীর অমোঘ নির্দেশে তালা খুলে রাশেদ বাড়ির ভেতর প্রবেশ করে।
বাড়ির ভেতরটা একেবারে অন্ধকার নয়। ঘরের মেঝেতে টিমটিম করে একটা হারিক্যান জ্বলছে। স্বল্প আলোয় চোখ মানিয়ে নিতে সময় নেয়। ঘরের ভেতর কিছু এলোমেলো ফার্নিচার, বেশির ভাগই পুরনো। মেঝের কার্পেট ধুলোয় ঢাকা। এই কার্পেট, এই ফার্নিচার, এই পুরনো ধাঁচের ঘর সবই রাশেদের বড় পরিচিত।
রাশেদ মেঝে থেকে হারিক্যেনটা হাতে তুলে নেয়। রিয়া তাকে ইশারায় এগুতে বলে দরোজা ঠেলে পাশের ঘরে অদৃশ্য হয়ে যায়। দুরুদুরু বুকে রশেদ পাশের ঘরে প্রবেশ করে। এই ঘরে চোখে পড়ার মত আসবাব বলতে পুরনো দিনের একটা মস্তবড় পালঙ্ক। পালঙ্কের উপর শুয়ে আছে এক জোড়া নারি ও পুরুষ। রিয়াকে দেখা যাচ্ছে না। রাশেদ সন্ত্রস্ত পায়ে পালঙ্কের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। পুরুষটি মৃত। তার হাত কব্জির কাছে ধারালো কিছু দিয়ে চিরে ফেলা হয়েছে। কবজি থেকে রক্ত ঝরে বিছানার চাদর অনেকটা জায়গা নিয়ে কালো হয়ে গেছে। মেঝেতেও রক্ত জমে আছে। রাশেদ মানুষটিকে একপলক দেখেই চোখ ফিরিয়ে নেয়। রাশেদ জানে ওটা কার মুখ। ওই মুখ রাশেদের বড় পরিচিত। ওই মুখ দেখার সাহস রাশেদের নেই। ওই মুখ রাশেদের নিজের।
পুরনো আমলের পালঙ্কটিতে শুয়ে আছে রাশেদের মৃতদেহ।
সে দুইহাতে রাশেদের মৃতদেহ আকড়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠে। ভাঙা গলায় বারবার বলতে থাকে, “আই এম স্যরি... আই এম সরি...”
পেছন থেকে কেউ এসে শান্ত ভাবে ওর কাঁধে একটা হাত রাখে।
ও পেছনে তাকিয়ে রিয়াকে দেখতে পায়। শুনতে পায় রিয়া তাকে বলছে, “ইটস ওকে... ইটস ওকে... এভ্রি থিং ইজ গোন্না বি অলরাইট”
ও আবার বিছানার দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। বিছানা থেকে মড়া লাশ দুটো অদৃশ্য হয়ে গেছে। শুধু বিছানার সাদা চাদরে বহুদিনের পুরনো রক্ত শুকিয়ে কালো হয়ে আছে। রিয়া জিজ্ঞেস করে, “তোমার সব কিছু মনে পড়েছে?”
“আমার... আমার সব কিছু মনে পড়েছে।”
“তুমি কি জানো তুমি কে?”
“আমি... আমি ফিরোজ।।”

***
“ফ্যসিনেটিং... এবসুল্যুটলি ফ্যসিনেটিং।।” ডক্টর জিয়াউল হক সহাস্যে অভিবাদন জানায়। “তোমাকে অনেক অনেক কনগ্রাচ্যুলেশন রিয়া। তুমি এক রকম যা কে বলে অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখালে। যেই কেস নিয়ে আমি নিজে দুই বছর হিমশিম খেয়ে গেছি,আ জকে তুমি তার সমধান করলে। আর এর থেকে চমৎকার সমাধান আর কি হতে পারত। ওয়ান্ডারফুল এক্সপেরিমেন্ট। আজ শিস্যের কাছে গুরুর পরাজয় ঘটল।”
“থ্যঙ্ক ইউ স্যার। তবে আপনার গাইডেন্স ছাড়া আমি এক কিছুই করতে পারতাম না।” রিয়া মাথা দুলিয়ে বলে।
“তা অবশ্যি ঠিক।” ডক্টর জিয়া হেসে সম্যতি জানায়। “তোমার পেপার তাহলে তৈরি। আমি দেখতে পাচ্ছি আজ থেকে মাসখানেকের মধ্যেই এই পেপার দিয়ে তুমি আমেরিকা ইউরোপের বাঘা বাঘা প্রফেসরদের মাথা খারাপ করে দিতে যাচ্ছ। ওহ, কি একটা হৈ চৈ যে হবে। ভাবতেই আমার ব্লাড প্রেসার বেড়ে যাচ্ছে, হা হা হা”
“কিন্তু আমি কেন যেন খুশী হতে পারছি না। এটাকে আমার আসলে সাকসেস মনে হচ্ছে না। পুরো ব্যপারটাই আসলে এতো স্যড...”
“নাউ কা’মন রিয়া। প্রফেশন্যাল হতে গেলে এমন আরো অনেক স্যড কেস তোমাকে হ্যন্ডেল করতে হবে। ইমোশন্যাল হলে চলবে না। ইউ হ্যভ টু রিমেম্বার ইওর ইন্টারেস্ট ইজ ইওর পেশেন্টস ডিজিস, নট দ্যা পেশেন্ট হিমসেলফ।”
“আসলে আমার নিজের কাছেই এখনো পুরো ব্যপারটা বিশ্বাস হচ্ছে না। ডিসোসিয়েটিভ পার্সোনালিটি সিন্ড্রোমের এত অদ্ভুত নজিড় আর বোধহয় নেই।”
“এমনিতে গোলমেলে মনে হলেও তুমি যদি পুরো ব্যপারটা প্রথম থেকে রিক্যাপ কর তাহলে আর বিষয়টা জটিল মনে হবে না। ফিরোজের আজ যে অবস্থা তার সুচনা প্রায় তিন বছর আগে। তিন বছর আগের এই দিনে ফিরোজের বাল্যকালের বন্ধু রাশেদ আর তার ফিয়ান্সে নিশাতের মৃতদেহ পাওয়া যায় এই সাভারের বাগানবাড়িতে। এই মৃত্যু অস্বাভাবিক হলেও খুনের কোন আলামত না থাকায় পুলিশ এটাকে জোড়া আত্মহত্যা বলে রায় দেয়। এটা পরিষ্কার যে এই মৃত্যুতে সবচে বেশি শকড হয়েছিল রাশেদের বন্ধু ফিরোজ। প্রায় এক বছর সে নিজেকে নিজের ঘরে বন্দি করে রাখে। বাহিরের কারো সাথে কথা বলত না, এমনকি নিজের বাবা মায়ের সাথেও না। নাওয়া খওয়া ঘুম কিছুরই ঠিক ছিল না এই এক বছর। এক বছর পর হঠাত একদিন ফিরোজ তার ঘর থেকে বের হয়ে আসে। আবার স্বাভাবিক জীবন যাত্রা শুরু করে। তার এই পরিবর্তনে ফিরোজের বাবা মা প্রথমে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেল্লেও কিছু দিন পরেই তারা লক্ষ করেন প্রথম দেখায় যতটা মনে হয়েছিল ফিরোজ আসলে অতটা স্বাভাবিক নয়। ফিরোজ নিজের সাথে নিজেই কথা বলে, মাঝে মাঝে বাবা মা’র সাথে কেমন অদ্ভুত আচরণ করে। দিনে দিনে তাদের সন্দেহ ঘনিভুত হয়। ফিরোজের বাবা আমার বন্ধু মানুষ। তার অনুরোধেই আমি ফিরোজকে পরিক্ষা করি। আর তখনি নিশ্চিত হই ফিরোজ ডিসোসিয়েটিভ সিন্ড্রোমে ভুগছে। আমি টানা এক বছর ওর চিকিৎসা করেও ওর অসুখের মুল কারনটা ধরতে পারিনি। তারপর তোমার মাধ্যমেই সব রহস্যের অবসান হল।”
“হুম, কিন্তু আপনি ভাবতে পারেন বন্ধুর প্রতি ঠিক কতটা আকর্সন বা দুর্বলতা থকলে একজন মানুষ বন্ধুকে হারানোর ভয়ে তাকে একেবারে খুনই করে ফেলতে পারে? আর তারপর সেই খুনের অপরাধ বোধ থেকেই হোক অথবা বন্ধুর শূন্যতা পূরণের তাগিদেই হোক নিজের ভেতরে আবার বন্ধুর চরিত্রটিকে জাগিয়ে তুলে। অথচ তেমনটাই ঘটেছে ফিরোজের ক্ষেত্রে। ফিরোজ সারাক্ষন ভয়ে ভয়ে থাকত তার বন্ধুকে অন্য কেউ দখল করে নিচ্ছে। তার বন্ধু তাকে ছেড়ে অন্য কারো কাছে চলে যাচ্ছে। সেই ভয় থেকে সে বন্ধু আর বন্ধুর প্রেমিকা দু’জনকেই খুন করে ফেলল। কিন্তু নিজে এই মৃত্যু সইতে পারল না। এই শক ঢাকা দিতে সে নিজের ভেতরে রাশেদকে জন্ম দিল। নিজেকে রাশেদ ভাবতে শুরু করল। দুই জন বন্ধুর মাঝে আসলেই কি এটা ঘটতে পারে?”
“ফিরোজের বন্ধুত্যকে আসলে কতটা পরিষ্কার বন্ধ্যুত্ব বলা যায় সেটা নিয়ে প্রশ্ন আছে। ওর রিলেশনটা হয়তো ফ্রয়েডিয়ান পারস্পেক্টিভ থেকে আরো ভালো ভাবে ব্যখ্যা করা যায়। যাই হোক, অনেক রাত হল। ফিরোজকে কড়া ঘুমের ওষুধ দেয়া হয়েছে। আগামি কাল আটটার আগে ঘুম ভাঙবে বলে মনে হয় না। তুমিও একটু ঘুমানোর চেষ্টা কর। সকালে উঠেই ঢাকা রওনা দিতে হবে।”
“আজকের এত কিছুর পর আর ঘুম হবে বলে মনে হয় না।” রিয়া ক্লান্ত ভাবে বলে।
“তোমাকে দেখে বুঝা যাচ্ছে ভীষণ ক্লান্ত। একটু না ঘুমালে শরীর খারাপ করবে। তুমি নিজেও বরং একটু ভ্যলিয়াম নিয়ে নাও। স্নায়ুটা শিথিল হোক।”
“আচ্ছা” রিয়া লক্ষি মেয়ের মত মাথা দোলায়।”

***

শেষ রাতের দিকে ফিরোজ হঠাত ঘুম ভেঙে উঠে বসে। এদিক ওদিক তাকিয়ে মনে করার চেষ্টা করে সে এখন কোথায় আছে। ফিরোজের স্মৃতি পরিষ্কার হয় না। তার আবছা ভাবে মনে পড়ছে গভীর রাতে গাড়ি চালিয়ে সে এখানে এসেছে। কিন্তু কেন এসেছে কি কিছুই মনে পড়ছে না। কিছুটা বিভ্রান্ত ভাবে বিছানা থেকে নেমে এলোমেলো পায়ে সে পাশের ঘরে এসে দাঁড়ায়। ঘরে একটা হারিক্যেন জ্বলছে। সোফায় চাদরে শরীর ঢেকে একটা মেয়ে গুটিসুটি মেরে ঘুমাচ্ছে।
কে এই মেয়েটা?
ফিরোজ কাছে গিয়ে টান মেরে তার মুখের উপর থেকে চাদর সরিয়ে দেয়। সাথে সাথে ফিরোজের চোখ ধ্বক করে জ্বলে উঠে।
নিশাত।
এই সেই মেয়ে যে ওর কাছ থেকে রাশেদকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে।
এই মেয়ের সাথে পরিচয় হবার পর থেকেই রাশেদ সম্পুর্ন বদলে গেছে। সিগারেট খায় না, বন্ধুদের আড্ডায় সময় দেয় না। এমনকি ফোন করলেও পাওয়া যায় না। আগের অভ্যেসগুলো সব একে একে পালটে ফেলেছে রাশেদ, সব এই মেয়েকে খুশী করার জন্যে। ফিরোজের জীবন থেকে রাশেদ যেন একেবারে হারিয়েই গেছে। সব এই মেয়েটার দোষ।
ওকে তো বেঁচে থাকতে দেয়া যায় না।
ফিরোজ শান্ত কিন্তু দৃঢ় হাতে রিয়ার গলা চেপে ধরে।

***
পুব আকাশে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। গাড়ি চালাচ্ছে ডক্টর জিয়া। মনের আনন্দে স্টিয়ারিং হুইলে একতু একটু তবলা বাজাচ্ছে সে। অবশেষে সব কিছু ভালোয় ভালোয় শেষ হল।
এই রিসার্চের দাম কোটি টাকা। এই জিনিস যে কতটা মুল্যবান তা বুঝার ক্ষমতা রিয়ার নেই। সবার সব ক্ষমতা থাকে না। এই জিনিসের মর্ম যে বুঝবে না তার কি অধিকার আছে এর সুফল ভোগ করার? ডক্টর জিয়ার সব চেয়ে মেধাবি ছাত্রি রিয়া। তার স্বিকার করতে দ্বিধা নেই রিয়া আসলে ডক্টরের থেকেও বেশি মেধাবি। কিন্তু মেধাবি হলে কি হবে, খুব সহজ জিনিসটা বুঝার ক্ষমতা নেই। ডক্টর জিয়া এত দুর্বল পার্সোন্যালিটির মানুষ নন যে ছাত্রির প্রেমে পড়বেন।
ফিরোজের অসুখটা রিকারিং। মাস দশেক আগে জিয়া নিজেও একবার ব্রেক থ্রু করেছিলেন। কিন্তু ২৪ ঘন্টার আগেই তার অসুখ আবার ফিরে এসেছে। রিয়া অবশ্যি সেটা জানে না। জিয়া সেই সুযোগটাই নিয়েছেন। তিনি অত্যন্ত ক্যল্কুলেটিভ মানুষ। ঝোকের মাথায় তিনি কোন কাজ করেন না। রিয়াকে জেনে শুনেই তিনি এই কেসে অন্তর্ভুক্ত করেছেন।
পাশের সিটে একটা বাধানো নোটবুক শুয়ে আছে। রিয়ার থিসিস পেপার।
সেটার দিকে তাকিয়ে জিয়া মুচকি হাসলেন। ঢাকা আর বেশি দূরে নয়।
৩২টি মন্তব্য ২৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাওরের রাস্তার সেই আলপনা ক্ষতিকর

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৫৯

বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন উপলক্ষে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম আলপনা আঁকা হয়েছে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম হাওরের ‘অলওয়েদার’ রাস্তায়। মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই আলপনার রং পানিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×