১ম পর্ব
রাত পৌনে বারোটা। রাস্তায় গাড়িঘোড়ার ভিড় এই সময় প্রায় নেই বললেই চলে। স্ট্রিট ল্যম্পের মরচে পড়া আলোয় রাজপথটাকে কেমন নিঃসঙ্গ মনে হচ্ছে। সেই নিঃসঙ্গতা ঘুচাতেই যেন রাজপথের বুক চিরে হুশ করে ছুটে গেল একটা মাইক্রোবাস। বাসটির সামনের একটা হেডলাইট জ্বলছে, অপর হেডলাইটটি দুই ব্লক আগে একটা তীক্ষ্ণ মোড় পার হবার সময় একটা মেইল বক্সের সাথে ঘষা খেয়ে গুড়ো হয়ে গেছে। রাতের অন্ধকারে মাইক্রোবাসটিকে মনে হচ্ছে নরক থেকে উঠে আসা এক চোখা দানবের মত। বাসের ড্রাইভিং সিটে ড্যশবোর্ডের উপর ঝুঁকে বসে আছে রানা। দুই হাতে খামচে ধরে আছে স্টিয়ারিং হুইল। রানার ডান কাঁধের কাছে লাল একটা বৃত্ত ক্রমেই একটু একটু করে বড় হচ্ছে। বৃত্তের কেন্দ্রটিতে একটা ছোট্ট 9mm বুলেট তার জায়গা করে নিয়েছে প্রায় বিশ মিনিট আগে। ব্যথায় চোখে ঝাপসা দেখছে রানা। গাড়ির নাক সোজা রাখতে হিমশিম খাচ্ছে। পেছনে শুনা যাচ্ছে তীক্ষ্ণ সাইরেনের শব্দ... হুই।। হুই ।। হুই।। হুই।। ঝাপসা চোখে একবার রিয়ারভিউ মিররটা দেখে নিল রানা। দুইজোড়া লাল সবুজ আলোর বিরতিহীন ঝলকানি চোখে পড়ল। কে জানে পেছনে হয়তো আরো আছে।
রানার পেছনের সিটে গাঁ এলিয়ে বসে আছে সোর্ড অভ আহকামের লিডার টাইগার রমিজ। গুলি লেগেছে তার গায়েও। জখম রানার মত অতটা গুরুতর না হলেও ব্যথা কম নয়। মানুষটা একটু পর পর জ্ঞান হারাচ্ছে, আবার ঝাকুনি দিয়ে জ্ঞান ফিরে পাচ্ছে। গাড়ির মেঝেতে রানা আর রমিজের রক্তে একাকার হয়ে গেছে। মাইক্রোবাসের ড্যাশবোর্ডে একটা পুলিশ স্ক্যানার আশেপাশে পুলিশের ওয়্যারলেস চ্যনেলগুলো ধরা পড়ছে। একের পর এক আদেশ নির্দেশের তুবড়ি ছুটছে সেখানে। স্ক্যনারে কান রেখে আশেপাশে পুলিশের গতিবিধি আন্দাজ করে গাড়ি চালাচ্ছে রানা। তবে শেষ দশ মিনিট আর সেদিকে মনোযোগ দিতে পারেনি, স্ক্যানারের কথাগুলো কেমনযেন প্রলম্বিত খসখসে কাশির শব্দের মত মনে হচ্ছে। ব্যথায় রানার ইন্দ্রিয়গুলো যেন একে একে অকেজো হয়ে পড়ছে।
বোধ হয় সে কারনেই রাস্তার সামনে বিশাল বড় পুলিশ ব্যরিকেডটা রানার চোখে পড়ল না। রাস্তার উপর লোহার বার ফেলে ব্যরিকেড দেয়া হয়েছে। ব্যরিকেডের ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে দুইটি পুলিশ ভ্যান আর গোটা দশেক কালো পোশাকের র্যাব, তাদের হাতের সবকটি পিস্তল আর শটগান তাক করা অন্ধের মত ছুটে আসা মাইক্রোবাসটির দিকে। অবশেষে ব্যথার জাল কাটিয়ে রানার অবশ মস্তিষ্ক যখন সামনের পুলিশ ব্যরিকেডের মর্মার্থ উদ্ধার করতে পারল ততক্ষনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। ব্যরিকেড থেকে বাসটা আর দশ হাত দূরে।
রানা এক্সিলেটরে পা দাবিয়ে দিল। অদ্ভুত এক হাসি ফুটে উঠেছে ওর ঠোঁটে, যেন কিছুতেই আর কিছু এসে যায় না।
চারদিন আগে !!
ধানমন্ডি লেক। সোহেলের নির্দেশনা মত ধানমন্ডি লেকে এসেছে রানা। সময়টা বিকেলের মাঝামাঝি। ছুটির দিন হওয়ায় প্রচুর ভিড় আজকে এখানে। তার উপর চলছে মৌসুমি মাছ ধরা উতসব। তাই আজকে মানুষ অনেক বেশি। লেকের পাড় ধরে একটু পরে পরেই এক সিরিয়াল দিয়ে বাশের তৈরি অনেক গুলা অস্থায়ী ডেক থেকে চলছে ছিপ দিয়ে মাছ ধরার প্রতিযোগিতা। তাই দেখছে ভিড় করে দাঁড়ানো অনেক মানুষ। লেকের অন্য এক পাশে ঘের দিয়ে করা হয় মাছ চাষ। তাই পুরো লেকে মাছের অবাধ দেখা পাওয়া যায়। এবং এই কারনে সচরাচর যেটা হয়- ছিপ ফেলে অনেকক্ষন বসে থাকা লাগে, সেটা লেকে লাগছে না। টোপ দিয় ছিপ ফেললেই মাছ পাওয়া যাচ্ছে। ভিড়ের মধ্যে দিয়ে রানাকে হাটিয়ে নিয়ে ধানমন্ডির ৭ নম্বরের রাস্তার কাছা কাছি নিয়ে আসল। এই রকম প্রানচ্ছল কোলাহোল বেশ অনেক দিন পর দেখছে রানা। তাই খুব উপভোগ করছে সে এই ভিড়। লেকের পুব পাড়ে ডান দিক থেকে গুনে গুনে তিন নম্বর বেঞ্চের দিকে এগিয়ে গেল রানা। ওখানে আগে থেকেই পাশে একটা ছোট ব্রিফকেস নিয়ে আরেক লোক বসে ছিল।পরিপাটি করে আচরানো চুলগুলো নেমে এসেছে ঘাড় পর্যন্ত। বয়স খুব বেশি হলে রানার চেয়ে ৩-৪ বছরের বড় হবে। পরে আছে আকাশী রঙের শার্ট আর কালো প্যান্ট। সাথে মিল রেখে চামড়ার জুতো। সোজা হেঁটে গিয়ে মানুষটার পাশে বসে পড়ল রানা।
“চমৎকার আবহাওয়া আজকে।” মানুষটি বলে উঠল।
“হুম, রানা মাথা দোলাল, “এবং চমৎকার ভিড়”
“আপনি ভিড় পছন্দ করেন না?”
“নট ফর বিজনেস মিটিং। আমাদের এখানে দেখা করতে বলা হল কেন?”
“আমার কোন ধারণা নেই। মে বি দ্যে লাইক দ্যা ভিউ। ”
“হোয়াট ডু ইউ গট ফর মি ডক্টর?”
মানুষটি পায়ের পাশে রাখা একটা মঝারি আকারের ব্রিফকেস তুলে নিয়ে রানার দিকে এগিয়ে দিল। ব্রিফকেসটা কোলের উপর রেখে ভেতরটা এক পলক দেখে নিল রানা। নিজের অজান্তেই একটা ভ্রু উঁচু হয়ে গেল ওর। “Samsung S2… রিয়েলি?? বাজারে এখন S4 পাওয়া যাচ্ছে।”
“স্টাইল নয় এখানে functionality আসল। সিগন্যাল ট্রাকার, স্ক্র্যাম্বলার, ডিবাগার... সাথে একটা ম্যানুয়েল দেয়া আছে,ওটা পড়লেই সব বুঝতে পারবেন। আর আমি তো আছিই।”
“এসবের আসলেই কি কোন দরকার আছে?”
“বিশ্বাস করুন মাঠে নেমে ওই ওয়ালথারের চেয়ে এই সেলফোনটাই অনেক বেশি বার আপনার জীবন বাঁচাবে। এসপিওনাজ জগত প্রতি মুহুর্তে বদলে যাচ্ছে মিস্টার রানা। এখন সব কিছু ডিজিটাইজড, সব কিছু বাইনারি ভাষায় লেখা। ইন্টেলিজেন্স এখন কম্পিউটারের উপর নির্ভরশিল। এজেন্টের স্থান এখন আর মাঠে নয়, তার জায়গা এখন ডেস্কে কম্পিউটারের সামনে। স্পাইং এখন একটা একঘেয়ে পেশা।”
“আপনি ইতিমধ্যে একঘেয়েমিতে ভুগছেন?? আপনার বয়েস আসলে কত বলুন তো?”
“আপনি আর আমি একই বয়েসি মিস্টার রানা। তবে মিলিটারিদের সাথে আমার উঠাবসা অনেক দিনের। আমি প্রথম যখন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সার্ভার হ্যাক করেছিলাম আমার বয়েস তখন উনিশ।”
“আপনি তো ভয়ঙ্কর লোক।”
“আপনিও ভয়ঙ্কর লোক মিস্টার রানা। ভয়ঙ্কর না হলে কেউ এই দুনিয়ায় প্রবেশ করতে পারে না।”
“আপনার সাথে কথা বলে ভালো লাগল ডক্টর...”
“কবির চৌধুরি... আমারও আপনার সাথে পরিচিত হয়ে ভালো লাগল মিস্টার রানা।”
রানা এবং কবির চৌধুরি হ্যন্ডশেক করল।
***
Intelligence is all about patient.
রাহাত খান বলেছিলেন কথাটা। আজ থেকে দুই রাত আগে, ঢাকার ডিজিএফআই হেড কোয়ার্টারে, যখন তিনি রানার পার্ফরম্যান্স ইভ্যালুয়েট করছিলেন। নতুন কোন কথা নয়। আগেও বহুজনের মুখ থেকে শুনেছে রানা। এবং এই মুহুর্তে সে লম্বা ধৈর্যের পরিক্ষা দিতে বসেছে।
রানা বসে আছে চিটাগাং নিউ মার্কেটের সামনের রাস্তায় একটা ভাড়া করা কনভার্টিবলে। সন্ধ্যা থেকে বসে আছে এইখানে। সময় দেয়া হয়েছে তাকে রাত ৮টা। তবু আগে আগেই এসেছে রানা। সে আসে পাশে ভালো করে দেখে একটা ভালো স্পটে গাড়ীটা পার্ক করে গাড়ীর ভিতরে বসে আছে। ভাবখানা এমন যেন কারো জন্য অপেক্ষা করে আছে। আসলে তার নজর হচ্ছে মার্কেটের গেটের পাশের একটা দোকানের দিকে। এই দোকানের পাশে একটা ফাকা যায়গামত আছে। রাস্তা দিয়ে হেটে যেতে কারো চোখ ওইখানে পড়ে না, যদি না সে আগে থেকে জানে যে ওইখানে এইরকম একটা ফাকা যায়গা আছে। ঐ যায়গাতে রানার জন্য কেউ একজন ব্যাগ রেখে যাবে।
আগের দিন কবির চৌধুরির সাথে দেখা করেই, রানা সারভেইলেন্স কেস নিয়ে উঠে পরে চিটাগাংগামী একটা বাসে। রানা চিটাগাং পৌঁছেছে আজ সকাল সাতটায়। উঠেছে হোটেল “অবকাশ” এ। খুবই সস্তা হোটেল, নিউ মার্কেট থেকে এক কিলোমিটার দক্ষিণে ঘিঞ্জি একটা এলাকায়। সারাক্ষন প্রচুর মানুষ হোটেলে আসছে যাচ্ছে, নানা পেশার নিম্ন থেকে মধ্যম আয়ের মানুষ। এদের মধ্যে সহজেই মিশে যাওয়া যায়, সহজে চট করে কারো চোখে পড়ার ভয় থাকে না। অতয়েব যেকোন বেআইনি কাজের জন্যে অবস্থান করতে হলে এই হোটেল আদর্শ। এসব দিক বিচার করেই এই হোটেলকে নির্বাচন করা হয়েছে।
সবকিছু আগের থেকেই ঠিক করে রাখা আছে। হোটেলে চেক ইন করেই রানা কেসটা খুলে দেখল কি কি আছে। সেলফোন, ল্যাপটপ, ছোট কিছু বাগ, ক্যামেরা ছারাও অস্ত্র হিসাবে ছিল সার্ভিস গান, ওয়ালথার পিপিকে। গুলির এক্সট্রা ২টা ক্লিপ, সাইলেন্সার, টেজার আর কিছু ছোট গ্যাস বোমা। সেলফোন আর ল্যাপটপের সাথে পাওয়া গেল ব্যাবহার করার ইন্সট্রাকশনস। সেখানে লেখা ছিল, ফোন আর ল্যাপটপ দুটোই ইমরান ক্লিফোর্ডের ফোন আর ল্যাপটপের ক্লোন। তবে বাড়তি সুবিধা হিসাবে ফোনটাকে ব্যাবহার করা যাবে অন্য যে কোন ফোন ক্লোন করতে, এবং সেই ফোনে আড়িপাতা থেকে শুরু করে সেটাকে ট্র্যাকও করা যাবে। আর ল্যাপটপটা হচ্ছে একটা বোম্ব, সি ফোর বিস্ফোরক দিয়ে ল্যাপটপটাকে লাইনআপ দেয়া হয়েছে, সময় সুযোগ মত প্রয়োজন পরলে ব্যাবহার করার জন্য। রানা প্রথমেই ওয়ালথার পিপিকে টাকে খুলে পরিষ্কার করে চেক করল যেন প্রয়োজনের সময় ওর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা না করে। SWADS এর ট্রেইনিং এর সময় রানার ট্রেইনারের বলা কথা সবসময় মেনে চলে রানা- কখনোই একটি অপরিচিত অস্ত্রকে বিশ্বাস করবে না। তাই সবসময়ই রানা নতুন কোন অস্ত্র পেলে আগে তা চেক করে দেখে ফায়ার করবে কিনা ঠিক মত। তবে তা অবশ্যই ব্ল্যাঙ্ক শট ফায়ার করে। Walther PPK পিস্তলটি প্রথম ডিজাইন করা হয় ১৯৩১ সালে। PPK হচ্ছে Polizeipistole Kriminalmodell বা Police Pistol Detective Model এর সংক্ষিপ্ত রূপ। রানার পিস্তলটার ওজন মাত্র ৭০০ গ্রাম। এই অস্ত্রটি সহজেই পোশাকের আড়ালে লুকিয়ে রাখা যায় তাই সাদা পোশাকের পুলিশ বা কোভার্ট অপারেটরদের এটি খুবই প্রিয় অস্ত্র। ওয়ালথারের একটা সমস্যা এর ম্যগাজিন ক্যপাসিটি, মাত্র ৮টা বুলেট ধারন করতে পারে। ডিজিএফআই এজেন্টদের স্ট্যান্ডার্ড ইস্যু এই অস্ত্র। কবির চৌধুরি অস্ত্রে বিশেষ কিছু মডিফিকেশন যোগ করেছে। এর একটি হচ্ছে এর প্রজেক্টাইল এনহেন্সমেন্ট। এটা দিয়ে রিমোট কন্ট্রোল চার্জ, বাগ, হোমিং ডিভাইস, ইলেক্ট্রিক্যাল স্টানার সহ বিভিন্ন প্রজেক্টাইল ফায়ার করা যায়।
অস্ত্র চেক করা শেষ হতেই কেসের উপরের খাপে রাখা মিশন ডোশিয়েটা খুলে পড়ল রানা। সেখানে মিশনে রানার চিটাগাং এ অবস্থানের কারন এবং করনীয় উল্লেখ করা ছিল। ডোশিয়েটা পড়ে তা এরপরে ছিরে টয়লেটে ফ্ল্যাশ করে দিল রানা।
চিটাগাং এ রানা কোথায় উঠবে সেটা সোর্ড অভ আহকামের জানার কথা নয়। তবে চিটাগাঙে পৌছে তাদেরকে কনফার্মেশন পাঠাতে হবে। ল্যপটপ চালু করে একটা পুর্ব নির্ধারিত ই-মেইল এড্রেসে একটা এনক্রিপ্টেড মেইল পাঠিয়ে দিল রানা। ল্যপটপটা কবির চৌধুরির দেয়া, তার ভাষ্যমতে এটা আসল ইমরান ক্লিফোর্ডের ল্যপটপের ক্লোন। সোর্ড অভ আহকামের ই-মেইল এড্রেস আর কনফার্মেশন ম্যসেজ ইমরানের ল্যপটপ থেকেই পাওয়া গেছে। ই-মেইলটা এঙ্ক্রিপ্টেড, কি যে লেখা তার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারল না রানা, তবে ওর বুঝার দরকারও নেই। এই ই-মেইল পেলে সোর্ড অভ আহকাম বুঝতে পারবে ইমরান জায়গা মত পৌছে গেছে। কবির অবশ্য ই-মেইল এড্রেসটা ট্রেস করতে পারেনি। এটা নাকি একটা ক্যমিলিয়ন এড্রেস। দেশের বাইরে বেশ কয়েকটা সিকিউরড সার্ভার থেকে রিরাউটেড হয়ে গেছে এড্রেসটা। ট্রেস করা অসম্ভব। কবির চৌধুরির মত মানুষ যদি বলে অসম্ভব তার মানে আসলেই অসম্ভব। বুঝাই যাচ্ছে সোর্ড অভ আহকামের অতি উচ্চ পর্যায়ের টেকনিক্যাল সাপোর্ট আছে। কথা হচ্ছে লোকাল একটা টেরোরিস্ট গ্রুপের এত হাই লেভেলের টেক স্পেশালিস্ট থাকার কথা নয়। এর থেকেই আরো নিশ্চিত হয়া যায় যে SOA এর পেছনে বিদেশী কোন শক্তিশালী চক্রের হাত আছে।
ই-মেইল পাঠানোর পর বেশিক্ষণ ঘণ্টা দুয়েক অপেক্ষা করতে হল। রানার ল্যপটপ যখন আবার গুঞ্জন করে উঠল ও তখন মাত্র ঠাণ্ডা পানিতে গোসল করে গরম এক কাপ চা খাচ্ছে (শাওয়ার নেয়ার ইচ্ছে ছিল, ব্যবস্থা নেই)।ল্যপটপ জানান দিচ্ছে সোর্ড অভ আহকামের মেইলের উত্তর এসেছে।
মেইলটা খুলতেই ঝিক করে উঠল রানার চোখ।
বিংগো!!
ইমরান ক্লিফোর্ড আর সোর্ড অভ আহকাম দুই পক্ষই যথেষ্ট সাবধানী, এবং ভীষণ রকম প্রফেশন্যাল। তারা তাদের কাজ খুব ভালোই বুঝে, কিভাবে করতে হবে সেটাও জানে। প্রথম থেকেই দুই পক্ষ খুবই সাবধান ছিল যাতে কখনোই এক পক্ষের সাথে আরেক পক্ষের কখনো সরাসরি কোন দেখা সাক্ষাৎ বা যোগাযোগ না হয়। দুই পক্ষের মধ্যে সকল যোগাযোগ হয়েছে ইন্টারনেটে সিকিউরড লাইনে, তথ্য আদান প্রদান এমনকি টাকার হাত বদলও হয়েছে অনলাইনে। ইমরান বা SOA দুই পক্ষের কেউই ওপর জন সম্পর্কে তেমন কিছু জানে না। তারা একে অপরের পরিচয় সনাক্ত করার জন্যে ব্যবহার করেছে এঙ্ক্রিপ্টেড কোড। এই পদ্ধতিতে যদি কোন এক পক্ষ ধরা পরে যায় বা বিশ্বাস ঘাতকতা করে তবে তারা ওপর পক্ষ সম্পর্কে পুলিশকে তেমন কিছুই জানাতে পারবে না। দুই পক্ষের পরিচয়ই এতে করে
নিরাপদ থাকবে।
কিন্তু ইমরানের জন্যে এই পদ্ধতি বেশ কার্যকর হলেও রানার তো এতে পোশাবে না। তাকে যে করে হোক SOA’এর ভেতরে ঢুকতে হবে। কিন্তু SOA’এর কোন সদস্যের সাথে যদি মুখোমুখি দেখাই না হয় তবে তাদের দলে ঢুকবে কি করে? এই সমস্যারই একটা সম্ভাব্য সমাধান দিতে পারে এই ই-মেইল। ইমরান বাংলাদেশে এসেছে প্রায় পরিষ্কার হাতে। সাথে একটা 9mm পিস্তল ছাড়া আর কিছুই ছিল না। এটা নিশ্চিত যে একটা সামান্য পিস্তল দিয়ে সে নিশ্চয়ই হাই র্যঙ্কিং গভর্মেন্ট অফিসিয়ালকে হত্যা করার পরিকল্পনা করছে না। তার পরিকল্পনার মধ্যে অবশ্যই শক্তিশালী বিস্ফোরক অথবা লংরেঞ্জ শ্যুটিং অন্তর্ভুক্ত থাকবে, বিশেষ করে ইমরান যখন ডেমোলিশন এক্সপার্ট তখন বিস্ফোরক ব্যবহার করার সম্ভাবনাই বেশি। এতে করে পুরো ব্যপারটাকে একটা র্যানডম এক্সিডেন্ট হিসেবে দেখানো যায়। বুলেট অলওয়েজ লিভস এ ট্রেস। কিন্তু কথা হচ্ছে ইমরান সাথে করে কোন অস্ত্র বা বিস্ফোরক দ্রব্য আনেনি। অর্থাৎ তাকে নিশচয়ই বাংলাদেশের ভেতর থেকে কেউ অস্ত্র সরবরাহ করবে। বাংলাদেশে ইমরানের নিজস্ব কোন কন্টাক্ট থাকাত কথা নয়। তাই সোহেল ধারণা করেছিল তাকে অস্ত্র সরবরাহ করবে SOA দেখা যাচ্ছে সোহেলের ধারনাই ঠিক। সোর্ড অভ আহকামের প্রতিত্ত্যুরে একটা জায়গার কো-অর্ডিনেট দেয়া আছে (SOA সরাসরি ঠিকানা না বলে স্থানের কো-অর্ডিনেট দিচ্ছে!! বিদেশী শক্তি নিশ্চিত!!) বলা আছে এই কো-অর্ডিনেট থেকে তার জন্যে রাখা প্যকেজটা তুলে নিতে হবে। রানা তার Samsung S3 তে কো অর্ডিনেটগুলো প্রবেশ করিয়ে জায়গাটা বের করে ফেলল। তারপর স্পিড ডায়ালে সোহেলের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করল।
“সোহেল কো-অর্ডিনেটটা দেখতে পাচ্ছেন?”
“হুম, এই লোকগুলো আসলেই প্রফেশন্যাল। এই লেভেলের এক্সপার্টিজ দেশের অন্যকোন টেরোরিস্ট দলের মধ্যে দেখা যায় না।”
“খুব সম্ভবত এই লোকেশনে তারা আগে থেকেই প্যকেজটা ফেলে গেছে।
আগে থেকে কোন আলামত বের করা সম্ভব?”
“আমি দেখছি। তবে মনে হয় না কোন সুবিধা হবে।”
“তার মানে আজকে রাতেই আমাদের একমাত্র সুযোগ।”
“তাই তো মনে হচ্ছে।”
“আমাদের টাইম উইন্ডো তো খুবই ছোট। এত অল্প সময়ে কি কিছু করা যাবে?”
“জানি না। কবির তো বলছে ও পারবে। বাকিটা ভাগ্যের হাতে।”
“লোকেশনটা সম্পর্কে বলুন।”
“আশে পাশে উঁচু বাড়িঘর তেমন নেই। এইটা আমদের জন্যে আশার কথা। অতয়েব প্যকেজের উপর নজর রাখার জন্যে কেউ যদি থাকে তবে তাকে অবশ্যই প্যকেজের কাছাকাছিই থাকতে হবে। আমার অনুমান প্যকেজের পঞ্চাশ ফিট রেডিয়াসের মধ্যেই কেউ থাকবে। গুগল আর্থে দেখতে পাচ্ছি জায়গাটা একটা গলির মধ্যে। এতে আমরা আমাদের অব্জারভেশন এরিয়া আরো ছট করে আনতে পারব।”
“ওয়্যারলেস এক্টিভিটি...?”
“অনুমান করা কঠিন।”
“হুম।। এখন কবিরের দেয়া খেলনাগুলো ঠিকঠাক মত কাজ করলেই হয়।”
“সেই সাথে ভাগ্যের সহায়তা।”
“আমি ভাগ্যে বিশ্বাস করি না।”
“রানা, যে কোন মিশনের সফলতা মাত্র ৫০% নির্ভর করে দক্ষতা-অভিজ্ঞতার উপর। বাকি ৫০% সব সময় ভাগ্যের উপর নির্ভরশিল।”
……
৮টা বাজে। হাই তুলে আড়মোড়া ভাঙলো রানা। সময় হয়ে গেছে।
পুরো জায়গাটা গড়ি নিয়ে কয়েক বার চক্কর মেরে দেখেছে রানা। সন্দেহ জনক কাউকে সনাক্ত করতে পারেনি। এখন কাজ শুরু করতে হবে। রানা কানের ব্লু-টুথ মডিউলটা স্পর্শ করে বলল, “MR9 Go”
ওপাশ থেকে সোহেলের উত্তর ভেসে এল “SK7 Go”
আরেকটা চ্যনেলে কবির চৌধুরি বলল, “KX11 Go”
সেলফোন হাতে নিয়ে গাড়ি থেকে বের হয়ে এল রানা। ই-মেইলের জিপিএস কো-অর্ডিনেটের দেখানো পথে এগিয়ে চলল। সেলফনের স্ক্যানার এপস চালু আছে। ব্যগটা খুঁজে পাওয়া গেল গলির ভেতরে একটা তালাবদ্ধ লকারের ভেতর। লকারে একটা নাম্বার লক বসানো ছিল, লকের পাস কি রানাকে ইমেইলের সাথেই দেয়া হয়েছে। লকারের ভেতরে একটা বড় ড্যফল ব্যগ পাওয়া গেল, বেশ ভারি। কি আছে এর ভেতর, বাজুকা!!??
রানা চাপা গলায় বলল, “SK7 ইউ পিকিং আপ সামথিং”
“নাথিং... ইউ গো অন।।”
রানা সহজ ভাবে ব্যগটা কাঁধে ঝুলিয়ে গাড়ির দিকে চলল। পকেটের S3 এর স্ক্যানার এপস তখনো কাজ করে যাচ্ছে। ব্যগটা গাড়িতে ফেলে রানা আবার জিজ্ঞেস করল, “kX11... anything??”
“nothing yet” কবিরের জবাব।
“এই জিনিসের রেঞ্জ যেন কত বলেছিলেন?”
“২০ মিটার রেডিয়াস।।”
“ধুর... এই খেলনা দিয়ে কাউকে খুঁজে পাবার সম্ভাবনা হাজারে এক। আর সোহেল আমাকে এইটা কেমন হোটেলে বুক করছে? শাওয়ারটাও ঠিক মত কাজ করে না।”
“তোমার শাওয়ারের দরকারটা কি। দেখে তো মনে হয় না তুমি কখনো গোসল কর।”
“জেমস বন্ড কিন্তু ফাইভ স্টার হোটেল ছাড়া স্টেক আউটে যায় না।”
“too bad you are not James Bond” সোহেল মাঝখান থেকে খোঁচা মারল।
“কেন না? আমাদের দুজনেরই ওয়ালথার পিপিকে আছে”
“তা আছে, কিন্তু তোমার অস্ত্রটা তো বন্ডের সমান নয়।”
“ওয়েট আ মিনিট। তুমি কখন আমার অস্ত্রের মাপ নিলে?”
“quit… I think I got something..” কবির বলে উঠল।
“সত্যি!” রানা দ্রুত এদিক ওদিক তাকাল। ওর চোখে সন্দেহজনক কিছু ধরা পড়ল না।
“I think you can leave now. We got what we looking for” সোহেলের কন্ঠ শুনা গেল।
“Are you sure?”
“Positive”
রানা খুশী মনে গাড়ি স্টার্ট দিল। কবির চৌধুরি ছেলেটা আসলেও কাজের। সেই সাথে সোহেলের ইন্ট্যুশনেরও প্রশংসা করতে হয়। প্ল্যন্টা আসলে সোহেলের মাথা থেকেই এসেছে। সোহেল একটা ছোট্ট জুয়া খেলেছে। ও ধারণা করেছিল প্যকেজের ড্রপজোনের আশে পাশে নিশ্চয়ই SOA’র একজন ইনফর্মার থাকবে। এমন একটা জায়গা থেকে যে কেউ এসে ব্যগটা তুলে নিতে পারে, বাংলাদেশের কথা তো আর বলা যায় না। তাই সেই ইনফর্মারের কাজ হবে কে ব্যগটা তুলে নেয় সেদিকে লক্ষ রাখা। এই ইনফর্মার খুব হাই প্রোফাইল কেউ হবে না অবশ্যই। সাধারণ ফুটসোলজার, হয়তো সে জানেও না ব্যগের ভেতর কি আছে। কিন্তু সে যার কাছে রিপোর্ট করবে সেই ব্যক্তিটি নিশ্চয়ই হবে দলের কোন গুরুত্বপুর্ন সদস্য। সোহেল বাজি ধরেছিল রানাকে ব্যগতা তুলে নিতে দেখা মাত্র ইনফর্মার তার সুপারভাইজারকে ফোনে অথবা ম্যসেজ দিয়ে জানাবে। ব্যগটা ছিল একটা চিপা গলির ভেতর, এবং আশেপাশে কোন উঁচু বিল্ডিংও নেই। তাই ব্যগের উপর নজর রাখতে হলে ইনফর্মারকে অবশ্যই গলির আশেপাশে বিশ পচিশ মিটার রেডিয়াসের মধ্যেই থাকতে হবে। কবির চৌধুরির দেয়া কাস্টমাইজড Samsun S3 এর স্ক্যনার এপসের কাজ হচ্ছে আশে পাশে বিশ মিটার রেডিয়াসের সকল একটিভ ওয়্যারলেস এক্টিভিটি ট্রেস করা। গাড়িতে যেতে যেতে কবির জানালো রানার ট্রেসার মোট তিনটা ফোন কল আর দুইটা sms পিক করতে পেরেছে। কবির ইতিমধ্যেই প্রতিটা ফোনের মালিকের প্রোফাইল ঘেটে দেখেছে। একটা ম্যসেজের মধ্যে শুধু লেখা ছিল DONE. সোহেলের ধারণা এইটাই ইনফর্মারের ম্যসেজ। ইনফর্মার লোকটার রেপশিটও তাই বলে,ছাত্রবয়েস থেকেই সন্ত্রাসি কর্মকান্ডের সাথে জড়িত। দুইবার গ্রেফতার হয়েছে। একবার জেল খেটেছে ছয়মাস। তবে এই লোক SOA’র সদস্যা নয়, ছিচকা অপরাধি। ম্যসেজটা যেই নম্বরে পাঠানো হয়েছে তার সম্পর্কে NSI ডাটাবেজে কোন তথ্য নেই। বুঝাই যাচ্ছে এইটাই আসল ব্যক্তি। কবির সেলফোনের নেটয়ার্কের মাধ্যমে ওই লোককে ফলো করে যাচ্ছে। কবিরের কম্পিউটার বলছে লোকটা এখন আছে জিইসি মোড়ে।
আধ ঘন্টা পরে রানা হোটেলে ফিরে এল। ভারি ড্যফল ব্যগটা কাঁধ থেকে নামিয়ে জিপার খুলতেই এক মুহুর্তের জন্যে ওর চোখ স্থির হয়ে গেল। ব্যগের ভেতর একটা স্টিলের কেসিং, সাইজ দেখেই বুঝা যায় ভেতরে কি। কেসিং এর ভেতরে দশ টুকরো হয়ে শুয়ে আছে একটা M24 বোল্ট একশ্যন স্নাইপার রাইফেল। ইউএস আর্মি এই জিনিস ব্যবহার করে। কত বড় শক্তি কাজ করছে সোর্ড অভ আহকামের পেছনে!!!
***
পরের সারাটা দিন রানার কেটে গেল সেই ম্যেসেজ গ্রহনাকারিকে অনুসরণ করে। লোকটার নাম রাজ্জাক আলি। দেখে ছাপোষা মানুষ বলেই মনে হয়। দর্জির দোকানের ম্যনেজার। সারাদিন নিরাপদ দুরুত্বে থেকে লোকটার উওর নজর রাখল রানা, তার দোকানে কে কে যায়, কার কার সাথে সে কথা বলে তার তালিকা করল। সন্দেহজনক কিছুই চোখে পড়ল না। লোকটা এতোই নিরিহ যে এক সময় রানার মনে হত থাকল সোহেল কি ভুলই করল কিনা।।
সুর্য ডোবার পর রানা সিদ্ধান্ত নিল এভাবে হবে না। রাজ্জাক আলির বাসা সার্চ করতে হবে। রাজ্জাকের বাসা ব্যঙ্ক কলোনিতে। দোতালা একটা বাড়ির উপরের তলায় একটা রুম নিয়ে সে থাকে। বাড়িতে সে একাই থাকে বুঝা যায়। সদোর দরজায় তালা ঝুলানো। লক পিক রানার সাথেই ছিল। না, মিলিটারির ট্রেনিং এ লক পিকের কোর্স করানো হয় না। এই জিনিসটা রানা নিজের শখে শিখেছে। বারো বছর বয়েস থেকে সে চুলের ক্লিপ বা ছোট্ট স্ক্রু ড্রাইভার দিয়ে খুচিয়ে প্রায় সব ধরনের দেশি তালা খুলে ফেলতে পারে। রাজ্জাকের দরোজার তালাটা ভারি, সুইডিশ তালা। খুলতে রানার ত্রিশ সেকেন্ড লাগল।
ঘরের ভেতরটা অগোছাল ব্যচেলর মানুষের ঘর যেমন হয়। খাটের উপর কিছু বইপত্র ছড়ানো ছীটানো আছে। সবগুলোই ধর্ম বিষয়ক বই, এতে অবশ্য কিছুই প্রমান হয় না। আলনায় ঝুলছে কিছু পুরানো শার্ট প্যন্ট। সবগুলোর পকেট হাতড়ে দেখল রানা। বিশেষ কিছু নেই। ঘরের একমাত্র টেবিলে একটা ড্রয়ার। ভেতরে হাবিজাবি জিনিস। দরোজা খুলে বাথরুমে ঢুকল রানা। এত্ত ছোট্ট একটা বাথরুম, একটা মানুষ কোনমতে দাড়াতে পারে। সেখানে গোসল আর টয়লেট দুটোই করতে হবে। পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে মাথা উঁচু করে উঁকি দিল বাথরুমের ভেন্টিলেটরে।
বিংগো...
ভেন্টিলেটরের ফাকে শুয়ে আছে রুমাল দিয়ে জড়ানো একটা ছোট্ট কালো রিভলভার।
দ্রুত সেলফোন বের করে চট করে কয়েকটা স্ন্যাপ তুলে ফেলল রানা। তারপর ঘরের ভেতর ফিরে এসে বিভিন্ন এঙ্গেল থেকে রুমের বেশকিছু স্যানপ তুলল। কাজ প্রায় শেষ। টেবিলের উপরে সস্তা একটা ফ্রেমে একটা মেয়ের ছবির উপর রানার চোখ আটকে গেল। কার ছবি এটা? প্রেমিকা? ছোট বোন?? সিড়িতে পায়ের আওয়াজ শুনা গেল। ঘরের মালিক ফিরে এসেছে। প্রস্থানের সময় হয়ে গেছে।
***
কলোনীর শেষ মাথার এক বাড়ীর নিচ তলার এক পাশের ঘরে থাকে রাজিয়া আর তার মা। রাজিয়া একটা বাচ্চাদের স্কুলে শিক্ষকতা করে। এনজিও থেকে স্কুলটা চালানো হয়, দুঃস্থ শিশুদের জন্য স্কুল। এই জন্য খুব বেশি বেতন দেয়া হয় না এই স্কুলের শিক্ষকদের। বেশ কিছু শিক্ষক তো ভলান্টিয়ারি হিসাবে আসে। তাদের হিসাবে সিভি ভারি করার জন্য, অন্য কোন ভালো স্কুল অথবা কলেজে পরে বড় কোন শিক্ষক পদে চলে যেতে পারবে। রাজিয়ার সেই সুযোগ নেই। রাজিয়ার শিক্ষাগত যোগ্যতা খুব বেশি না। বাবা বছর পাঁচেক আগে এক্সিডেন্টে মারা গেছে। তিনি রেলওয়েতে ছোট একটা চাকরি করতেন। মৃত্যুর পর বাবার পেনশনের টাকা আর উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। মা অসুস্থ, বছরের বেশির ভাগ সময় তার কাটে হাসপাতালে। বড় ভাই যেটা ছিল সেও বছর দুই ধরে পুরা নিরুদ্দেশ। বাধ্য হয়েই কলেজ পাশের পর রাজিয়াকে জিবিকার সন্ধানে নামতে হয়েছে। অথচ ও ভালো ছাত্রি ছিল।
রাতের ভাত বসিয়ে মায়ের পাশে একটু বসে পুরানো স্মৃতি রোমান্থন করছিল রাজিয়া। এই সময় দরজায় কড়া নারার শব্দ হল। রাত প্রায় ৯টা বাজে। একটু ভয় পেয়ে গেল রাজিয়া। সে দেখতে খুব একটা খারাপ না। মাঝে মধ্যেই বিয়ের প্রস্তাম আসে। কিন্তু তার বিয়ে হয়ে গেলে তার মাকে কে দেখবে, এই চিন্তায় কখনোই সে কোথাও মত দেয়নি। আর এই এলাকায় অনেক দিন ধরে আছে দেখে, এলাকার মানুষজনও বেশ পরিচিত হয়ে গেছে। কখনোই এখানে সমস্যা হয়নি এর আগে। কিন্তু আজকে মনে হচ্ছে কিছু একটা হয়েছে। কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না রাজিয়া। ওদিকে দরজায় কড়া নেরেই যাচ্ছে। ভয়ে ভয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল রাজিয়া। দরজার এপাশ থেকে কম্পিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে উঠল রাজিয়া,
কে ??
আমরা পুলিশ, দরজাটা খুলুন।
পুলিশ শুনে রাজিয়ার আত্মা পুরাই উড়ে গেল। হাত-পা জমে গেছে একদম। দুনিয়া যেন দুলে উঠছে তার। প্রচন্ড ভাবে কাপা হাতে কোন মতে দরজার সিটকিনিটা খুলে দিল সে। দিয়ে দরজাটা একটু ফাকা করে খুলে ধরতেই, ও পাশ থেকে একটা হাস্যজ্জল মুখ দেখা গেল। মুখে অভয় দেয়ার হাসি ফুটিয়ে যুবক বলে উঠল, "সি আই ডি থেকে এসেছি আমরা, আমি সোহেল আহমেদ। আপনার ভাই, রাজ্জাক আলির বেপারে কিছু কথা বলতে এসেছি। ভিতরে এসে বসা যাবে ?? "
***
রানা দাঁড়িয়ে আছে জিইসি মোড়ের একটা পাঁচ তালা ভবনের চতুর্থ তলার কার্নিশে। এটা একটা পাঁচ মিশালি কমার্শিয়াল ভবন। এর একেক তলায় একেক বিজনেসের অফিস, তার মধ্যে ফোন ফ্যক্স থেকে শুরু করে ইম্পোর্ট এক্সপোর্টের অফিস ইত্যাদি সবই আছে। সারা দিন প্রচুর মানুষের আনাগোনা এখানে। অবশ্য এখন ভবনটা প্রায় নির্জনই বলা চলে। রাত আটটার পর অফিসগুলো একে একে বন্ধ হয়ে যায়। রাত দশটার পর ভদ্রলোক প্রায় কেউই থাকে না আর। তখন একদল মাদকাসক্ত বিল্ডিঙের গ্যরেজে আড্ডা বসায়। ভবনের সিকিউরিটি গার্ডও যোগ দেয় তাদের সাথে। উপরের তলাগুলো একরকম অরক্ষিতই থাকে। তবে রানার জানা মতে কোন কোন রাতে মাদকাসক্তরা ছাড়াও আরেকটি দল আসে এখানে, তাদের মিটিং বসে চতুর্থ তলার একটা বিশেষ অফিসে। রানা এই মুহুর্তে সেই বিশেষ অফিসটির বাইরে জানালার কার্নিশে দাঁড়িয়ে আছে। ঘড়ির কাটা নির্দেশ করছে সময় রাত এগারোটা। রানা এখানে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে প্রায় আধাঘন্টা হয়ে গেল। পা দুটো একটু একটু ব্যথা করছে। তবে সমস্যা নেই। প্রয়োজনে রানা এভাবে ৩৬ ঘন্টা শরীরের একটা মাসলও না নাড়িয়ে সোজা দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে।
সাধারণ আইন শৃঙ্খলা বাহিনি থেকে ইন্টেলিজেন্সের কাজের পদ্ধতি সম্পুর্ন আলাদা। যেখানে লোকাল পুলিশ বা র্যাব হয়তো সরাসরি রাজ্জাককে তুলে এনে থানায় ভালো একটা প্যদানি দিতে সেখানে সোহেল ভিন্ন পথ ধরল। রাজ্জাক আলির পরিবারকে খুঁজে পেতে মোটেই বেগ পেতে হয়নি সোহেলের। একটু খোঁজ নিতেই জানা গেল অভাবি ফ্যমিলি, একমাত্র কর্মক্ষম ব্যক্তিটি রাজ্জাকের ছোট বোন রাজিয়া। ফ্যমিলির সাথে রাজ্জাকের যোগাযোগ নেই বছরখানেক। কিন্তু তার টেবিলের উপরে রাখা ছবিই প্রমান করে পরিবারে ছোট বোনটির প্রতিই তার টান সব থেকে বেশি। অতয়েব রাজ্জাককে হাত করার মোক্ষম টোপ হচ্ছে তার বোন রাজিয়া। এরপরে যা হল তা টেক্সটবুক ইন্টেলিজেন্স। রাজিয়াকে হাত করতে তেমন সমস্যা হল না। প্রথমে তাকে তার ভাইয়ের বর্তমান কর্মকান্ড সম্পর্কে ধারণা দেয়া হল। সেই সাথে এই সকল কাজের পরিনতি ব্যখ্যা করে রাজিয়ার কাছে সাহায্য চাওয়া হল। এতে কাজ হল না (সাধারণত হয় না) এবার সোহেল দুই নম্বর টোপ ফেলল। রাজিয়ার মা অসুস্থ, হাসপাতালে অনেক বিল জমে আছে। সোহেল চাইলে মা’য়ের ফ্রি চিকিৎসা করিয়ে দিতে পারে। রাজিয়ার বাবার পেনশনের টাকা আটকে আছে। সোহেল চাইলে সেই টাকা এক মুহুর্তে উদ্ধার করে দিতে পারে, শুধু একটা ফোন কলের অপেক্ষা। বিনিময়ে রাজিয়াকে শুধু তার ভাইয়ের সাথে দেখা করে কিছু প্রশ্নের জবাব এনে দিতে হবে। রাজিয়া যদি তার ভাইকে সাহায্য করতে রাজি করাতে পারে তাহলে সোহেল নিশ্চয়তা দিচ্ছে রাজ্জাকের তেমন কোন বড় সাজা হবে না। কিন্তু রাজ্জাক যদি এমনিতে র্যবের হাতে ধরা পরে তাহলে হয়তো ক্রস ফায়ারেই মারা যাবে, অথবা বিচার পর্যন্ত বেঁচে থাকলেও বিশ বছরের জেল নিশ্চিত। এবার মেয়ে বস মানলো। অবশ্য এতে কাজ না হলে সোহেলের কাছে আরো ওষুধ রেডি ছিল। রাজিয়াকে স্কুলের চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হত, রাজিয়া এখন যেই বাড়িতে থাকে সেটা ওর দাদার কাছ থেকে পাওয়া। সেই বাড়ির কাগজপত্রে ঝমেলা বের হত, তাদের পরিবারকে রাস্তায় উচ্ছেদ করা হত। ইন্টেলিজেন্সের কাজের ধারাই এরকম। তাদের যখন কারো কাছ থেকে সাহায্য প্রয়োজন হয় তখন সেই ব্যক্তির সাহায্য না করে কোন উপায় থাকে না। প্রথমে তাকে সাধারণ ভাবে বুঝানো হয়, তাতে কাজ না হলে লোভ দেখানো হয়, তাতেও কাজ না হলে হুমকি দেয়া হয়। কিন্তু সবচেয়ে ভয়ের ব্যপার হচ্ছে ইন্টেলিজেন্স প্রায় কখনোই বেআইনি ভাবে ঘুষের লোভ দেখায় না বা বেআইনি হুমকি দেয় না। রাজিয়ার বাবার পেনশন তাদের ন্যায্য পাওনা, এটা কোন ঘুষ না। আর রাজিয়াদের বাড়ির কাগজপত্রে আসলেই ঘাপলা আছে। তাদেরকে উচ্ছেদ করা হলে আইন মেনেই করা হবে। সব মানুষই জেনে হোক বা না জেনে হোক কোন না কন বেআইনি কাজের সাথে জড়িত। ইন্টেলিজেন্স সেই বিষয়গুলোই খুঁজে বের করে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে।
রাজিয়াকে নিয়ে অবশ্য অতটা বাড়াবাড়ি পর্যায়ে যেতে হয়নি। বোনকে দিয়ে রাজ্জাকের সাথে যোগাযোগ করা হয়েছে। অনেক চেষ্টার পর রাজিয়া অবশেষে ভাইকে সোহেলের সাথে কথা বলতে রাজি করাতে পেরেছে। রাজ্জাকের মুখ থেকেই বের হয়ে এসেছে আজকের এই মিটিং এর কথা। জিইসি মোড়ের এই মার্কেট ভবনের একটা বিশেষ ভবনে প্রতি মাসে সোর্ড অভ আহকামের মিটিং বসে। সেই মিটিং এ মাঝে মাঝে তাদের লিডার টাইগার রমিজও যোগ দেয়। রাজ্জাকের দেয়া তথ্য অনুযায়ি রানা এখন অপেক্ষা করছে অফিসের জানালার পাশে। তার উপর নির্দেশ মিটিঙে কি আলোচনা হয় পুরোটা রেকর্ড করা। মিটিং এ আর যারা থাকে সম্ভব হলে তাদের স্ন্যাপ তুলা।
রানার পড়নে কালো কমব্যট স্যুট। অফিসের উপরে সবগুলো বাতি নেভানো। তাছাড়া রাস্তা থেকে ভবনের এইদিকটা সহজে চোখে পরে না। কার্নিশের উপরে দেয়ালে গাঁ মিশিয়ে থাকা রানাকে তাই রাতের অন্ধকার থেকে আলাদা করার উপায় নেই। তারপরেও বাড়তি সতর্কতা হিসেবে নিচে রাস্তার কাছাকাছি স্ট্রিটল্যম্প দুটো ফাটিয়ে এসেছে রানা। ঠিক সাড়ে এগারোটায় একে একে চারটে মাইক্রোবাস এসে থামল ভবনের সামনে। মাইক্রোবাস থেকে নেমে আসা মানুসগুলো ছড়িয়ে পড়ল ভবনের বিভিন্ন তালায়। তাদের মাঝে লিডার আছে কিনা অবশ্য বুঝা গেল না। অফিসের বাতি জলে উঠল। ওপাশে একাধিক মানুষের অস্পষ্ট কথাবার্তা শুনা যাচ্ছে। মিটিং শুরু হয়েছে। রানা বেল্টের পাউচ থেকে কবিরের দেয়া মাল্টি পারপাস S2 এন্ড্রয়েডটা বের করল। ফোনটাকে চাইলে হাইড্রোফোন হিসেবে ব্যবহার করা যায়। জাস্ট ফোনের স্ক্রিন জানালার কাচে চেপে ধরলেই হল। কাচের গায়ে ফোনটা স্পর্শ করতেই রানা তার কানের ব্লু-টুথ মডিউলে কথাবার্তার আওয়াজগুলো বহুগুণে বেড়ে গেল। কিন্তু কন্ঠস্বর গুলো পরিষ্কার হচ্ছে না। এক দুইটা শব্দ ছাড়া রানা কিছুই বুঝতে পারছে না। ঢাকায় বসে কবির চৌধুরি আর সোহেল আহমেদও আলোচনা শুনছে। তবে তাদের কাছে অডিও ক্লারিফায়ার আছে। রানা মিটিঙের কথাবার্তা বুঝতে না পারলেও সোহেলের সমস্যা হচ্ছে না।
মিটিং চলল প্রায় দেড় ঘন্টা পর্যন্ত। তারপর একসময় মনে হল আলোচনা গুঁটিয়ে আনা হচ্ছে। এই সময় রানার ইয়ারপিস গুঞ্জন করে উঠল। সোহেলের জরুরি কন্ঠের নির্দেশ ভেসে এল, “রানা ইন বাউন্ড প্যন্থার স্ট্রাইক ইন ফাইভ মিনিটস। ইউ হ্যাভ থ্রি মিনিটস টু ক্লিয়ার দ্যা এরিয়া”
রানা ভ্রু কুচকে ফেলল। প্যান্থার স্ট্রাইক মানে র্যাবের রেইডিং পার্টি আসছে। কিন্তু র্যাবকে খবর দিল কে? এটা তো সাধারণ একটা রিকন মিশন ছিল। হস্টাইল টেক ওভারের তো কথা নয়!! রানা চাপা গলায় গর্জে উঠল, “হোয়াট ডু ইউ মিন প্যান্থার স্ট্রাইক?? তাদেরকে খবর দিল কে?”
“ব্যখ্যা করার সময় নেই। তোমার মিশন শেষ হয়েছে। তোমাকে জলদি সরে পরতে হবে। ভবনে তোমার উপস্থিতি এই মুহুর্তে সবকিছু আরো জটিল করে তুলবে।”
“কি বলছ আমার মিশন শেষ মানে? মিটিং এ কি আলোচনা হল? র্যাবকে কেন ডাকা হচ্ছে?”
“রানা... ইউ আর টু ইভ্যাকুয়েট দিস বিল্ডিং নাউ। ইটস এন অর্ডার”
“ফাক ইওর অর্ডার। আমি জানতে চাই মিটিঙে কি এমন তথ্য বের হয়ে
এসেছে যার জন্যে এমন তাড়াহুড়ো করে র্যাবকে ডাকা হল? মিটিঙে কি টাইগার রমিজ যোগ দিয়েছিল?”
“আমি শিওর নই”
“ইয়েস অর নো?”
“......ইয়েস”
ব্যাস, রানার এইটুকুই জানা দরকার ছিল। রানা লক্ষ করল কালো বেশ কিছু ভ্যান এসে দাড়িয়েছে ভবনের সামনে। কালো আর্মার আর আটোমেটিক রাইফেল হাতে প্রায় জনা পঞ্চাশ র্যাব নিঃশব্দে বাড়িটা ঘিরে ফেলছে। রানাকে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। রানা মনঃস্থির করতে আরো পাঁচ সেকেন্ড নিল। তারপর কান থেকে ইয়ারপিস খুলে এনে ছুড়ে ফেলল অন্ধকারে।
প্রচণ্ড শব্দে ভবনের মুল দরোজা ভেঙে পড়ল। র্যব ঢুকে পড়েছে বিল্ডিঙের ভেতর। পটাপট বেশ কিছু গ্যস শেল বিস্ফোরিত হল। চোখ ঝাঝালো সাদা ধোঁয়ায় ভরে গেল বিল্ডিং। জবাবে SOA’পক্ষ থেকে টানা কয়েক রাউন্ড গুলি ছোরা হল (রানার ধারণা AK 47) র্যাবও পাল্টা গুলি ছুঁড়ল। র্যবের সদস্যদের কি কিল অর্দার দিয়েই পাঠানো হয়েছে? এমন নির্বিচারে গুলি করছে কেন ওরা? দেখে মনে হচ্ছে কাউকে জীবিত ধরার ইচ্ছে নেই র্যবের।
অফিসের ভেতর থেকে হাইউকাউ হুটোপুটির আওয়াজ পাওয়া গেল। বুঝা যাচ্ছে অফিস খালি করে সবাই বেড়িয়ে যাচ্ছে। SOA’র সদস্যরা লিডারের প্রতি মারাত্মক ভাবে অনুগত। নিজের জীবন থাকতে তারা লিডারের গায়ে একটা আচড় পরটে দেবে না। এই ভয়ঙ্কর আনুগত্যের কারনেই দলটা এতদূর এসেছে।
রানা লম্বা নিঃশ্বাস নিল। তারপর সেলফোনের একটা বিশেষ বাটন চাপল। ভবনের গায়ে চড়ার আগে রানা এই ব্লকের ইলেকট্রিক ট্রান্সমিটারটা খুঁজে বের করেছে। তারপর সেটার গায়ে ছোট্ট একটা রিমোট কন্ট্রোল এক্সপ্লোসিভ বসিয়ে এসেছে। কঠিন কিছু নয়, রানার কাস্টমাইজড ওয়ালথারের গায়ে প্রজেক্টাইল এনহেন্সমেন্ট বসানো যায়। জাস্ট বিদ্যুতের পোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে সুযোগ বুঝে একটা গুলি করেছে ট্রান্সমিটারের গায়ে। রানা সেলফোনের বোতাম চাপতেই ভয়ঙ্কর শব্দ করে ট্রান্সমিটার বিস্ফোরিত হল। সাথে সাথে ব্লকের সবগুলো বৈদ্যুতিক বাতি দপ করে নিভে গেল, পুরো ব্লক ঢেকে গেল নিকষ অন্ধকারে। কাঁচ ভেঙে জানালা খুলে ঘরে প্রবেশ করল রানা। অফিসের ভেতর ঘুটঘুটে অন্ধকার। রানা কপালে বসানো মাল্টিভিউ গগলসটা টেনে নামালো চোখের উপর। এটা একটা থার্ড জেনারেশন আলফা ডুয়্যাল টিউব গগলস। থারমাল ভিশন আর নাইট ভিশন দুই মোডেই কাজ করে। কবির চৌধুরির আরেক উপহার। নাইট ভিশন অন করতেই এক লাফে ঘরের সব অন্ধকার দূর হয়ে গেল। নষ্ট করার সময় নেই। র্যবের হাতে মারা পড়ার আগেই টাইগার রমিজকে খুঁজে বের করতে হবে। রানার হাতে উঠে এল ওয়ালথার, যদিও একান্ত দরকার ছাড়া ওটা ব্যবহার করার কোন ইচ্ছেই রানার নেই। দরোজা ঠেলে করিডোরে বের হয়ে এল রানা।
SOA’সদস্যরা অন্ধকারে দিশেহারার মত ছুটোছুটি করছে। সিড়িতে ডজন খানেক বুটের শব্দ পাওয়া গেল। র্যাব চলে এসেছে। SOA’ এর পাচজনের একটা দল সিড়িতে একেবারে তাদের মুখোমুখি হয়ে গেল। মেশিনগানের প্রলম্বিত গর্জন আর মানুষের কণ্ঠের তীক্ষ্ণ আর্তনাদে বাতাস ভারি হয়ে উঠল। তারপর সিড়ি থেকে গোটা দুই মোটা আলোর রশ্মি উঁকি দিল। র্যবের বাহিনি পৌছে গেছে। ভারি হেলমেট, গগলস আর আর্মর পড়া র্যাব সদস্যদের দেখতে মনে হচ্ছে সায়ন্স ফিকশনের পাতা থেকে উঠে আসা সাইবর্গদের মত। প্রতিটি ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে র্যবের একজন লাথি দিয়ে দরোজা খুলে ফেলছে আরেকজন টর্চের আলো ফেলে ভেতরটা চেক করছে। বুঝাই যায় ওরা লিডারকে খুঁজছে। একটা দরজা খুলতেই ভেতর থেকে ভারি রাইফেলের গুলির শব্দ ভেসে এল। একজন র্যব সদস্য বুক চেপে ছিটকে এসে দেয়ালের গায়ে আছড়ে পড়ল। বাকিরা দ্রুত দরোজার দুই পাশে পজিশন নিল। একজন পিন খুলে ভেতরে একটা গ্যস বম্ব ছুড়ে ফেলল। চাপা শব্দ করে সাদা ধোঁয়ার একটা মেঘে ডুবে গেল ঘরটা। একটু পর ঘর থেকে অন্ধের মত টলতে টলতে বের হয়ে এল একটা মানুষ। ঘর থেকে বের হয়ে তিন পা এগুতেই র্যবের মেশিনগানের প্রায় একডজন গুলি তাকে ঝাঁঝরা করে দিল। মানুষটার শরীর মেঝে স্পর্শ করার আগেই প্রান হারিয়েছে।
রানা চট করে করিডোরের পাশের একটা ঘরে লুকিয়ে পড়ল। কয়েক সেকেন্ড পরেই বুটের আওয়াজ এসে থামল দরোজার সামনে। সজোড় লাত্থিতে দরোজা খুলে হা হয়ে গেল। ঘরের ভেতরের অন্ধকার চিরে দিল মোটা দুটো আলোক রশ্মি। আলোক রশ্মি দুটো ঘরের ভেতর মিনিটখানেক ঘুরে বেরালো, ভেওরে কেউ নেই নিশ্চিত হয়ে র্যবের সদস্য দুজন এগিয়ে গেল পাশের ঘরটির দিকে।
রানা তখন ঘরের কোনায় মেঝে থেকে ছয় ফুট উপরে শূন্যে ঝুলছে। রানার দুই পা দেহের দুই পাশে পার্ফেক্ট স্প্লিট করে দুইপাশের দেয়ালের গায়ে চেপে বসে থেকে রানার শরীরকে শূন্যে সাপোর্ট দিচ্ছে। র্যাব ঘরটা সার্চ করলেও অন্ধকারের কারণে ছাদের দিকে তাদের দৃষ্টি যায়নি। র্যাব চলে যেতেই দেয়াল থেকে পা সরিয়ে এনে ধুপ করে মাটিতে নেমে এল রানা। পকেট থেকে একটা চিকন কর্ড ক্যম বের করে দরজার নিচ দিয়ে ওপাশে পাঠিয়ে দিল কর্ডটাকে। কর্ডের ওপর মাথায় বসানো ক্যমেরা দরোজার অপাশের ছবি তুলে পাথিয়ে দিচ্ছে রানার এন্ড্রয়েডের পর্দায়। রানা আরো দুই মিনিট সময় দিল র্যাবগুলোকে যথেষ্ট দুরুত্বে সরে যাবার জন্যে। তারপর দরোজা খুলে বাইরে বের হয়ে এল। করিডোরের এক কোন ঝাঁঝরা হয়া লাশটা পরে আছে। রানা লাশটার মুখতা ভালো করে দেখল। নাহ, টাইগার রমিজের লাশ নয়। লাশটা ডিঙ্গিয়ে সামনে পা বাড়ালো রানা।
লিডার কে খুঁজে পাওয়া গেল তৃতীয় তলার বাথরুমে। পায়ে গুলি লেগেছে। তারপায়ের কাছে পরে আছে SOA’আরেক জন সদস্য। গুলি লেগেছে তার গায়েও। লোকটার বুক থেকে রক্তের লহর বইছে। দুই হাতে একটা সাবমেশিনগান চেপে ধরে রীতিমত হেচকি তুলছে মানুষটা। তার পেছনে সময় নষ্ট করল না রানা। লিডারের হাত চেপে ধরে বলল, আসুন আমার সাথে।
রানাকে দেখেই রমিজ প্রথমে আহত কমরেডের মেশিনগান তুলে নিয়ে গুলি করতে উদ্যত হল। রানা চট করে মেশিনগানটা কেড়ে নিল রমিজের কাছ থেকে। তারপর রমিজের হাত মুচড়ে দেয়ালের সাথে চেপে ধরে বলল, “আমি আপনাকে সাহায্য করছি। যদি বাচতে চান তাহলে আসুন আমার সাথে।”
র্যবের আরেকটা দল এগিয়ে আসছে বাথরুমের দিকে। রমিজ বুঝতে পারল রানাকে বিশ্বাস করা না গেলেও এই মুহুর্তে রানাই তার সবচে বড় সহায়। রমিজ মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানাল। রমিজ আর রানা এসে দাঁড়াল বাথরুমের দরোজার পাশে। বাথরুমের বাইরে র্যবের কয়জন দাঁড়িয়ে আছে বুঝা যাচ্ছে না, পাঁচ জনের কম তো নয়ি। এই দরজাই বাথরুম থেকে বের হবার একমাত্র পথ। রানা তার বেল্টের পাউচ থেকে একটা ফ্ল্যশব্যং গ্রেনেড বের করল। পিন খুলে গ্রেনেডটা দরোজার ওপাশে গড়িয়ে দিয়েই রানা দুই হাতে রমিজের চোখ চেপে ধরল, নিজেও শক্ত করে চোখ বুজল। চাপা শব্দ করে বিস্ফোরিত হল ফ্ল্যাশব্যং। যেন এক সাথে কয়েক লাখ মোমবাতি দপ করে জলে উঠল। তীব্র সাদা আলোর ঝলকানিতে সাময়িক অন্ধ হয়ে গেল র্যব সদস্যরা। বিদ্যুৎ বেগে বাথরুম থেকে বের হয়ে এল রানা। র্যবের উপর আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের কোন ইচ্ছে ওর নেই। ফ্লাশব্যং গ্রেনেডে শুধু প্রচন্ড আলোর ঝলকানি হয় শুধু, স্থায়ি কোন শারীরিক ক্ষতি হবার তেমন সম্ভাবনা নেই। র্যাবের সদস্যরা মিনিট পনেরোর জন্যে অচল হয়ে গেছে। কিন্তু গ্রেনেডের শব্দ অবশ্যই অন্যান্য ফ্লোর থেকে শুনা গেছে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে বাকিরা এখানে চলে আসবে। রানা চট করে রমিজকে জাপটে ধরল। লোকটা ঠিক মত হাঁটতে পারছে না। উরুতে গুলি লেগেছে। রানার কাঁধে ভর দিয়ে খুড়িয়ে খড়িয়ে এগুচ্ছে। পেছনে রক্তের মোটা দাগ ফেলে আসছে ওরা। যে কেউ সহজেই ট্রেস করতে পারবে। তবে এখন আর অত কিছু চিন্তা করার সময় নেই।
পালানোর পথ ঠিক না করে রানা কখনো শ্ত্রুর গুহায় ঢুকে না। সোয়াডসের প্রথম ট্রেনিং, অলয়েজ হ্যভ এ এস্কেপ রুট প্ল্যানড। চার তলার কার্নিশ থেকে রানা একটা ফিশিং লাইন ঝুলিয়ে রেখে এসেছে। মার্কেটটা থেকে বিশ গজ দূরে রানার মাইক্রোবাসটা অপেক্ষা করছে। কিন্তু আগে রানাকে এখান থেকে সরে পড়তে হবে।
র্যাব চলে এসেছে। পেছনে তাদের বুটের আওয়াজ শুনা যাচ্ছে। দৌড়ে করিডোরের শেষ প্রান্তে জানালার কাছে গিয়ে থামল রানা। রমিজ ইতিমধ্যে হাপাচ্ছে। জানালার বাইরে ফিশিং লাইনটা ঝুলছে। হাত বাড়িয়ে লাইনটা ধরে রানা নিজের বেল্ট বাকলে আটকে নিল। তারপর রমিজকে বলল ওর কাঁধে চড়তে। রমিজের ভেতর তখন আর তেমন ইচ্ছে শক্তি অবশিষ্ট নেই। রানা যা বলল সেই মতই কাজ করল রমিজ। হারামজাদার ওজন মনে হয় ২০০ কেজি। এক হাতে ফিশিং লাইনটা জড়িয়ে ধরে জানালা দিয়ে লাফ দিল রানা। স্যাত করে দুইজন নেমে এল মাটিতে।
ভবনের বাইরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পজিশন নিয়ে আছে বেশ কিছু র্যাব। অন্ধকারের সুযোগে তাদের চোখ বাঁচিয়ে গজ বিশেক দূরে দাড় করানো মাইক্রোবাসের কাছে পৌছে গেল ওরা। প্যসেঞ্জার সাইডের স্লাইড ডোর সরিয়ে রমিজকে সিটে বসাতে যাবে এমনি সম্য পেছন একটা কণ্ঠ ভেসে এল, “হ্যন্ডস আপ। খবর্দার কেউ এক চুল নড়বে না।”
রানা ধিরে ধিরে পেছনে ফিরে তাকালো। পেছনে একা একজন র্যাব তাদের দিকে পিস্তল তাক করে আছে। রানা ঘাড় ফেরাতেই সে কাঁপা গলায় চিৎকার করে উঠল, “বললাম না কেউ নড়বে না। হাত মাথার উপর জলদি।”
রানা বুঝতে পারল র্যাব সদস্যটি নিজেও যথেষ্ট নার্ভাস। তার বয়েস কম, সম্ভবত সে ফোর্সে নতুন। হয়তো এটাই ওর প্রথম রেইড। সদস্যটি কাঁধের কাছে রেডিও খামচে ধরে বলল, “কলিং আলফা 210.. আই হ্যাভ দ্যা টার্গেট অন গান পয়েন্ট। রিকোয়েস্টিং ব্যাক আপ।” তাড়াহুড়া করতে গিয়ে ওর কথা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।
এই সময় রমিজ ভুলটা করল। র্যাবের সদস্যটি রেডিও নিয়ে ব্যস্ত সেই সুযোগে সে হাতের সাব মেশিনগান তাক করল ওর দিকে। র্যাবটি চোখের কোনা দিয়ে রমিজের মুভমেন্ট দেখে ফেলল। যত নার্ভাসই হোক একজন আহত মানুষের চেয়ে একজন ট্রেইন্ড র্যাব অফিসারের রিফ্লেক্স অনেক ভালোই হবার কথা। র্যাবটি রেডিও ছেড়ে সাথে সাথে গুলি করল রমিজকে। রানা নিজেও অটো রিফ্লেক্স থেকে কাজ করল। ঝাঁপিয়ে পরে বুলেট লাইন থেকে সরিয়ে দিল রমিজকে। থ্যাক করে একটা শব্দ হল। ছোট্ট বুলেটটা এফোঁড় ওফোঁড় করে দিয়েছে রানার কাঁধ।
এর পরের মুহুর্তটি যেন হঠাত করে লম্বা হয়ে গেল, যেন স্বাভাবিক সময় ছেড়ে এক স্লো-মোশানের জগতে প্রবেশ করেছে রানা। র্যাবটি আবার নিশানা তাক করেছে রমিজের দিকে। রমিজও মেশিন গান তাক করেছে র্যাবের দিকে। ট্রিগারে চেপে বসছে রমিজের আঙুল। এবার আর ভুল করবে না রমিজ। তার হাতের সাব মেশিনগান স্থির তাকিয়ে আছে র্যাবের বুকে। ট্রিগার টেনে দিলে ওর মৃত্যু নিশ্চিত। রানা কোমড় থেকে ওয়ালথার টেনে বের করল। তারপর ফায়ার করল র্যাবের পা লক্ষ করে। গুলি খেয়ে মাটিতে হুমড়ি খেয়ে পড়ল সে। পর মুহুর্তে ফায়ার করল রমিজ। কিন্তু তার ছোড়া গুলি ইঞ্চিখানেকের ব্যবধানে র্যাবের মাথার উপর দিয়ে চলে গেল।
হাচড়ে পাচড়ে মাইক্রোর ড্রাইভিং সিটে উঠে বসল রানা। গুলির শব্দ সবার কানে পৌছে গেছে। সবাই দল বেঁধে ছুটে আসছে। রানা ইগনিশনে চাবি ঢুকায়। ডান হাতটা প্রায় অকেজো। এই অবশ্তায় গাড়ি চালানো প্রায় অসম্ভব। কিন্তু সেই অসম্ভবকেই সম্ভব করতে হবে। পেছনের সিটে রমিজ বেহুশ হয়ে পরে আছে। বেঁচে বের হতে হলে রানাকে পারতেই হবে।
মৃদু কাশি দিয়ে চালু হয়ে গেল গাড়ির ইঞ্জিন। হুশ করে বের হয়ে গেল রানার মাইক্রো। পেছনে ছুটে আসছে বোধ চিটাগাং শহরের সব পুলিশ।
***
পোর্ট কলোনী !!
বর্তমান সময়ে !!
একটা ঘোরের মধ্যে আছে রানা। আসে পাশে বেশ অনেক মানুষের কথার শব্দ পাচ্ছে সে, কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছে না। তার চার পাশে ঘন কুয়াশা। কুয়াশার ওপাশে অনেক মানুষের ছায়া হাটা চলা করছে। কিন্তু কারো দেহ অবয়ব পরিষ্কার হচ্ছে না। ঘোরের মধেই সে দেখল, তার বাবা তাকে ডেকে বলছেন- উঠ, চল একটু ঘুরে আসি। কুয়াশার ওপাশ থেকে বাবা হাত বাড়িয়ে আছে, রানা ব্যকুল হয়ে এগিয়ে যেতে চায়। কিন্তু ওর দুই পায়ে কেউ যেন দুই মন ওজনের পাথর বেঁধে দিয়েছে। কিছুতেই সে বাবা বাড়ানো হাতের নাগাল পাচ্ছে না। আপ্রাণ চেষ্টায় সে বাবার হাত স্পর্শ করতে পারল... কিন্তু কোথায় বাবা? বাবার যায়গায় চলে দাঁড়িয়ে আছেন রাহাত খান। কাচাপাকা ভুরুর নিচে চোখদুটো রাঙিয়ে বলে উঠলেন, কাজের সময় এত ঘুম কিসের হ্যাঁ ?? অলস ছোকড়া। বুড়োর ঝারি খেয়েই রানার শরীরটা একটু ঝাকি খেয়ে গেল। রানার ঘোরটাও কেটে গেল। দেখল সে একটা সিঙ্গেল বিছানায় শুয়ে আছে, ছোট একটা ঘরে। একটা বিছানা আর অন্য পাশে একটা টেবিল আর একটা চেয়ার ছাড়া আর কিছু নাই এই ঘরে আর। মাথার উপরে জ্বলছে একটা হলুদ আলোর বাল্ব, আর আস্তে আস্তে ঘুরছে সিলিং থেকে ঝুলা একটা ফ্যান। কোথায় আছে সেটা বুঝতে না পারলেও, কিভাবে এইখানে এল তা মনে পড়ছে এখন রানার। গুলি খেয়েছিল সে লিডারকে বাচাতে গিয়ে। বেশ অনেকটা রক্ত হারিয়ে পরে অজ্ঞান হয়ে যায়। বাম কাধটা এজন্য পুরো অবশ হয়ে আছে রানার। ডান হাত দিয়ে পুরো ব্যান্ডেজ করা যায়গাটা হাতড়িয়ে বুঝতে পারল রানা, গুলি কাধ ফুটো করে বেরিয়ে গেছে। খাটের এক পাশে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে স্যালাইন আর রক্তের দুটো ব্যাগ। সেখান থেকে লাইন এসে ঢুকেছে রানার বাম হাতে। উঠে বসতে গিয়ে দেখে মাথাটা হালকা চক্কর দিয়ে উঠল রানার। রানা বুঝতে পারল তার আরো এক ব্যাগ রক্ত নেয়া লাগতে পারে পরে। তবে পরেরটা পরে। আপাতত আগের কাজ হচ্ছে এখান থেকে বের হওয়া। বুঝা সে কোথায় আছে। তাই উঠে বসার পর কতক্ষন সময় নিল ধাতস্থ হতে। এরপরে হাতের লাইন সব টেনে খুলে ফেলল রানা। বিছানা থেকে নেমে সটান দাঁড়িয়ে গেল। সাথে সাথে মাথাটা আবার একটু ঘুরে উঠল। পাশের দেয়াল ধরে একটু ধাতস্থ হয়ে নিল আবার। এখনো রানার পরনে সেই কমব্যাট ফেটিগ। হাতড়ে হাতড়ে দেখল তার অস্ত্রগুলো সব যায়গামত আছে কিনা। খালি কোমড়ে লুকানো ছোট স্টিলেটো ছুরিটা বাদে আর কিছু পেলো না রানা। সমস্যা নেই, রানার জন্য ছুরিই যথেষ্ট। এই চিন্তা করে ছুরিটা ডান হাতে বাগিয়ে ধরে ধির পায়ে রুম থেকে মাথাটা বের করে দুই পাশে উকি দিল রানা। লম্বা একটা করিডরের একদম শেষ রুমে আছে রানা। সামনের দিকে অনেকগুলা রুম আছে। আশার কথা হচ্ছে, সবগুলোরই এখন পর্যন্ত দরজা বন্ধ। আস্তে আস্তে একদম নিঃশব্দে সামনে এগোলো রানা। পুরো করিডরটা প্রায় বিশ মিটারের মত লম্বা। রানাকে সম্ভবত ব্যাথা কমানোর জন্য মরফিন দেয়া হয়েছে। সে তার তীক্ষ্ণ স্নায়ুর চাপ, যেটার কারনে সে আফ্রিকার ইউএন মিশনে কখনো ব্যার্থ হয়নি, তা পুরোপুরিভাবে অনুভব করছে না। তবু রানা সম্পুর্ন ইচ্ছা শক্তির জোরে এগিয়ে চলেছে। বেরিয়ে যেতে হবে এখান থেকে। করিডরের শেষ মাথায় আসতেই বের হওয়ার দরজার ওই পাশে বেশ অনেকগুলা গলায় কথা বলার আওয়াজ পাওয়া গেল। রানা ছুরিটাকে শক্ত করে বাগিয়ে ধরে পাশের এক দরজায় ঠেলা দিল, অল্টারনেটিভ রাস্তার জন্য। কিন্তু দরজটা ভিতর থেকে বেশ ভালোভাবে আটকানো। কিছু করার নেই। সামনের ওই দরজা দিয়েই বেরোতে হবে। যা হয় হবে ভেবে, দরজাটায় হালকা ধাক্কা দিয়ে খুলে ফেলল রানা।
দরজা খুলতেই রানা মুখোমুখি হয়ে গেল লিডারের ডান হাত করিম বেগের সাথে। কোন এক কারনে করিম তখন এই দরজার দিকেই আসছিল। রানার প্রথমে চোখ পড়ল করিমের হাতে অথবা কোমড়ে কোথাও কোন অস্ত্র আছে কিনা। নেই দেখে বাঘের ক্ষিপ্রতায় ডান হাত সামনে বাড়িয়ে সামনে ছোট একটা লাফ দিল রানা। করিম কিছু বুঝে উঠার আগেই দেখল তার গলায় রানার হাত সাড়াশি চাপে চেপে ধরে আছে, ছুরিটা তাক করে আছে তার গলার এক পাশে। আহত বাম কাধে অতর্কিত নাড়া লাগায় আবার রক্তক্ষরন শুরু হয়ে গেল প্রায় সাথে সাথেই। রানা দাত চেপে তা সহ্য করে নিল। এবার নজর দিল পুরো রুমে। এবং তারপরে পুরোই জমে গেল রানা। অন্তত ৪টা অটোমেটিক রাইফেল তার দিকে তাক করে দাঁড়িয়ে আছে লিডারের বিভিন্ন সাগরেদ। আর লিডার নিজেও এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে রানার পরবর্তি পদক্ষেপ দেখার জন্য। রানা বুঝল এইখানে হার না মেনে উপায় নেই। আস্তে করে হাত থেকে ছুরিটা ফেলে দিল, করিমের গলা ছেরে পিছনে সরে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো রানা। গলা ডলতে ডলতে পিছনে এক পাশে সরে গেল করিম বেগ, চোখে তার নিদারুন ভয়ের চিহ্ন। মাত্রই জমের হাত থেকে ছাড়া পেয়েছে, তা বুঝতে একটুও দেরি হয়নি তার। সবাই লিডারের দিকে তাকালে, লিডার রানার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, "জনাবকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি আমার প্রান বাঁচানোর জন্য।"
রানার মুখে কোন অভিব্যাক্তি নেই এই কথায়। চুপচাপ দাঁড়িয়ে সে তাকিয়ে আছে লিডারের চোখের দিকে।
লিডার তার কথা চালিয়ে গেল। এতক্ষন তার সামনে যা ঘটল, তা যেন লিডারের চোখেই পড়েনি, এমনভাবে পরের কথাগুলো বলল এবার, "আপনাকে ভাড়া করা হয়েছিল এস্যাসিন হিসেবে। বাড়তি কাজ হিসাবে আপনি আমার প্রান বাচালেন, এই জন্য আপনার পারিশ্রমিক কিছুটা বাড়িয়ে দিব বলে ঠিক করেছি আমি। তো বলুন, কত চান আপনি ??" লিডারের কন্ঠে স্পষ্ট কৌতুক।
রানা এবার নড়ে উঠল। সাথে সাথে সবগুলো অস্ত্রের নলগুলো সচল হল রানার সাথে। রানা দেয়ালের পাশ থেকে সরে এসে রুমের অন্য পাশে লিডারের কাছ থেকে কিছুটা দূরে, সোফায় এসে বসল।
লিডার এবার তার মুখোমুখি অন্য সোফায় বসে তাকিয়ে রইল রানার দিকে।
রানা কিছু বলছে না দেখে, লিডার বলে উঠল আবারো, "জনাবের অন্য কোন ইচ্ছা থাকলে তাও বলতে পারেন। সাধ্যের মধ্যে হলে তা অবশ্যই পুরন হবে।
এবার রানা বলে উঠল, "ইচ্ছা তো একটা অবশ্যই আছে। সেইজন্যই তো গিয়েছিলাম সেইখানে, এবং ভাগ্যচক্রে আপনার প্রানও বাচালাম।
"তো বলুন শুনি আপনার ইচ্ছার কথা।"
রানা লিডারের চোখের দিকে তাকিয়ে স্থির কন্ঠে উত্তর দিল, "আমার ইচ্ছা হল, আপনার এই সংগঠনে যোগ দেয়া। আপনাদের উদ্দেশ্যে নিজের প্রান বিকিয়ে দেয়া।"
রানার উত্তরে রমিজ বাদে ঘরের সবাই যেন এক্কটা চাবুকের বাড়ি খেয়ে জেগে উঠল। শুধু রমিজের মুখের ভাব পরিবর্তন হল না। এটা পরিষ্কার ওরা রানাকে বিশ্বাস করছে না। করার কথাও না।
“আমাদের সাথে যোগ দিতে চান, সেটা তো অনেক ভালো কথা জনাব। কিন্তু সেজন্য যে আগে নিজের পরিচয়টা জানাতে হয়। আসল পরিচয়। এবং জানেন নিশ্চয়ই যে, সেটা সত্যিই আসল কিনা তা চেক করে দেখার নিজস্ব ব্যাবস্থা আছে আমাদের। তাই আগেই বলে দিচ্ছি যে, যদি তা ভুয়া প্রমানিত হয়, তবে আপনি এই বাড়ি থেকে আর জীবিত বের হতে পারবেন না। তো, চোখ নাচিয়ে লিডার রানাকে একটা সন্দিহান দৃষ্টি দিয়ে বলে চলল, বলুন তাহলে, কে আপনি ??”
একে একে সবার উপরে চোখ ঘুরিয়ে আনল রানা। ডান হাত দিয়ে বাম কাধে আরো একটু জোরে চেপে ধরল। রক্ত পরাটা বন্ধ করতে হবে। রানা বলল, “ আমি একজন গভর্মেন্ট এজেন্ট। আন্ডার কভার। আমার উপরে মিশন ছিল সোর্ড অফ আহকামের লিডারকে খুজে বের করে তাকে টারমিনেট করা।”
এই কথাটা শুনার সাথে সাথেই অবিশ্বাসে লিডারের মুখ কিঞ্চিত হা হয়ে গেল। সে বিস্মিত ভাবে সোফা থেকে দাঁড়িয়ে গেল পুরা। আর রুমের বাকি সবাই তাদের অস্ত্রেগুলো আরেকটু শক্ত করে ধরল রানার দিকে তাক করে।
রমিজের চোখে এবার কিছুটা বিস্মিত ফুটে উঠল, “কে আপনি ?? আপনাকে এই মিশন কে দিয়েছে ??”
রানার চোখ নির্ভিক। সে লিডারের চোখে চোখ রেখে উত্তর দিল, “আমি মাসুদ রানা।
to be continued....
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে অক্টোবর, ২০১৩ সন্ধ্যা ৬:৫৯