প্রশ্ন : আমেরিকান ও ফরাসি- দুই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির অনেক চমৎকার অভিনেতার সঙ্গে তো কাজ করেছেন। আপনার অভিনেতাদের আলাদা করেন কিভাবে?
রেনোয়া : অভিনেতাদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ভালো। একটা কারণে তো এ সম্পর্ক খুবই চমৎকার; তা হলোÑ আমি খুব ব্যর্থ অভিনেতা। আমার কাছে, অভিনেতা মানেই অদ্ভুতধরনের কিছু। আর আমি ভালোবাসি অভিনয় করতে। কখনও কখনও নিজের ফিল্মে করিও অভিনয়। কিন্তু আমার অভিনয় খুবই খারাপ। আমি এক বাজে অভিনেতা। আমার ঝামেলা আছে। অভিনয় না করার জন্য প্রযোজকরা আমাকে কথা শোনায়, অনুরোধ করে। যদি পারতাম, অভিনেতাই হতাম। কিন্তু পারি না। এ কারণে অভিনেতাদের পছন্দ করি এবং তাদের সঙ্গে ভালোভাবে সময় কাটাই।
এখন, প্রায়ই আমাকে অনেকে আমেরিকান ও ফরাসি অভিনেতাদের মধ্যে তুলনা করতে বলে। আমি বলি, কোনো পার্থক্য নেই; অভিনেতা তো অভিনেতাই। আপনি জানেন, হলিউড ও প্যারিসের মধ্যে পার্থক্য বোধ করা যায়; কিন্তু আমেরিকান ও ফরাসী অভিনেতার মধ্যে পার্থক্যকরণ পৃথিবীকেন্দ্রিক আমার চিন্তাধারার বিপরীত বিষয়। কারণ, আমার সব নীতি, আমার আচরণ যার উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে, তা তো বলেছিই- একটা নতুন মধ্যযুগের সূচনায় আছি আমরা; জাতিগতভাবে আলাদা করার দিন ফুরিয়ে গেছে। আমি বলতে চাইছি, পশ্চিমা দুনিয়ার মধ্যে। আমার কাছে, পৃথিবী আর কোনো দেয়ালে খাড়াভাবে ভাগ হয়ে নেই। ভাগ হয়ে আছে পাশাপাশি। বুঝতে পারছেন, কী বলছি? আপনার আছে শিল্পীর পৃথিবী, কিংবা জাতি; আর তারপর আপনার আছে কৃষকের জাতি; আছে ব্যবসায়ীর জাতি।
আপনাকে কিছু বলতে পারি? সাংহাইয়ের কৃষকের সঙ্গে সাংহাইয়ের ব্যাবসায়ীর যে যোগাযোগ, তারচেয়ে সাংহাইয়ের ব্যবসায়ীর সঙ্গে নিউইয়র্কের ব্যবসায়ীর যোগাযোগ গভীর। আপনি কি বুঝতে পারছেন পৃথিবীর বিভক্তিকরণ বলতে আমি কী বোঝাচ্ছি? আজ, আপনি যদি ফরাসি কৃষকের সঙ্গে কথা বলেন- তাহলে, বিশ্বাস করেন, সেই কথোপকথনের সঙ্গে ওহিওর যেকোনো কৃষকের কথোপকথনে অনেক মিল। অনেকটাই। কিন্তু আপনি যদি কোনো আমেরিকান শিল্পী ও আমেরিকার ব্যাংকারের সঙ্গে কথা বলেন, আপনার মনে হবে, তারা দু’জন দু’টি ভিন্ন জাতির নাগরিক।
প্রশ্ন : মিস্টার লুই জুভেঁর [ফরাসি অভিনেতা ও ফিল্মমেকার] সঙ্গে কাজ করেছেন?
রেনোয়া : হ্যাঁ আমি করেছি। অবশ্যই করেছি। লুই জুভে্যঁ সম্পর্কে কিছুই বলতে পারবো না আমি। চমৎকার অভিনেতা ছিলেন তিনি। ঘটনা হলো, অভিনেতাদের কখনোই আমি পরিচালনা করিনি। আমি পরিচালক না। আপনাকে বলি, আমি একজন গল্পকথক। আমি কেবল নির্দিষ্ট পথে অভিনেতাদের কাজের উপায় করে দেই। কিন্তু কাঠামোগত কারণ, কাঠামোগত কৌশল নির্ভর করে তাদের উপর।
আপনি জানেন, পরিচালনায় একটিই পথ আছে, সেটি স্বাভাবিক পথ। পরিচালক বলেন, ‘আমার দিকে তাকাও, দৃশ্যটি আমি অভিনয় করিয়ে দেখাচ্ছি।’ তিনি যদি কোনো মেয়েকে নির্দেশনা দেন, তিনি ছেলের সঙ্গে নির্বাক অভিনয় করবেন আর মেয়েটিকে জোর গলায় বলবেন তা অনুকরণ করতে। আর তারপর তিনি বলেন, ‘আমারটা দেখেছো? এখন তুমি ঠিক এমনটাই করো।’
এটা হাস্যকর। কারণ, মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ হলো পৃথিবীতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তো, আপনি যদি মানুষকে শ্রদ্ধা করেন, তাহলে আপনার অভিনেতার ব্যক্তিত্ববোধকে শ্রদ্ধার চেষ্টা করেন, আর তাদের নিজস্ব ব্যক্তিত্ববোধ খুঁজে পেতে চেষ্টা করেন সাহায্য করার, আর আপনার ব্যক্তিত্বের পোষ্য করতে তাদের উপর জোর না খাটান। আমি কী বলেছি, বুঝতে পারছেন?
প্রশ্ন : গ্রেট অভিনেতা লুই জুভ্যেঁর ও কম অভিজ্ঞ যেকোনো তরুণ অভিনেতা- এক কথা কি উভয়ের বেলাতেই?
রেনোয়া : এটা একই জিনিস। আপনি জানেন, হয় আপনি অভিনেতা, না হলে অ-অভিনেতা। এর মধ্যে যদি কোনো অ-অভিনেতাকে নির্বাচন করা হয়, তো, সেই অ-অভিনেতার সঙ্গে ছলচাতুরী করে আপনি আপনার ফিল্মের কাজ শেষ করতে চাইবেন বিপত্তি ছাড়াই এবং যে বেচারা নিজেকে অভিনেতা ভাবে, তাকে মনোকষ্ট না দিয়েই। কিন্তু আপনার জানা আছে, এদিক থেকে এটা একটা চালাকি। আমি বলতে চাই, অভিনেতার ক্ষেত্রে আদর্শিক পরিস্থিতিতে কাজ করুন। এ অবস্থায়, অভিনেতা হিসেবে তাদের কাজ তাদের করতে দেন।
প্রশ্ন : মিস্টার জ্যাচারি স্কট [মার্কিন অভিনেতা] বলেছেন, আপনার সঙ্গে কাজ করা ভীষণ উপভোগ্য।
রেনোয়া : হুম, এটা আমার জন্য আনন্দের; কেননা, আমার দিক থেকেও একই অনুভূতি হয়েছে। তারসঙ্গে কাজ করতে চমৎকার লেগেছে। ঘটনা হলো, ‘দ্য সাউথার্ন’ শেষ হওয়ার পর আমি বারবারই জ্যাচারির সঙ্গে কাজ করতে চেয়েছি; কিন্তু বুঝেনই তো, দুনিয়া বড়ই আজব। মনে হয়, একে অন্যের দেখা পাবেন হঠাৎ, তারপর আর খুঁজে পাবেন না একসঙ্গে কাজ করার পথ। জ্যাকের প্রতি দুঃখিত আমি, আর তারচেয়েও বেশি নিজের প্রতি।
প্রশ্ন : আপনার ফিল্ম দেখে দর্শকরা যখন হল থেকে বেরিয়ে আসে, তারা সঙ্গে করে কী নিয়ে যায় বলে আপনি মনে করেন?
রেনোয়া : হুম, সর্বস্তরের র্দশকের ব্যাপারে বলতে পারবো না। কারণ, আমি তাদের চিনি না। আমার ফিল্মের অল্পকিছু দর্শক নিয়ে বলতে পারি। কারণ, যেকোনো নির্মাতার মতো আমারও তাদেরকে ভয়ানক লাগে। আমি আরো বেশি বুঝতে চাই। হুম, আমার ক্ষেত্রে প্রায়ই কিছু প্রতিক্রিয়া হয়। ধরুন, প্রথমত, আমার মূলত এক ধরনের দর্শক আছে পৃথিবীতে, যাদের বয়স বিশের নিচে, বাচ্চা। জানেন তো, প্রায়ই আমি আমার প্রযোজকদের বলি প্রোগৃহে বিশোর্ধ্ব মানুষের সঙ্গে কথা না বলতে। আপনি কিভাবে ইংরেজিতে বলবেন? কেবল পূর্ণবয়স্কদের সঙ্গে? আমি বলি- ‘কেবল শিশু’।
না, আসলে, আমার দর্শকরা তরুণ। এখন, কিছু বয়স্ক মানুষও ফিল্ম দেখে আমার; কিন্তু যখন তারা বেড়ে ওঠে এবং জটিল হয়, আর কারণ খুঁজে ফেরে- তাদের সঙ্গ তেমন ভাল্লাগে না আমার, যেমনটা লাগে তরুণদের।
যেমন, ফ্রান্সে আমার শেষ ফিল্ম, বড় শহরগুলোর বিভিন্ন ফিল্ম-থিয়েটারে ফিল্ম শুরু হওয়ার আগে, আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ফিল্মটি দেখাতে বলেছিলাম। আর তা ছিল বড় সাফল্য। ফিল্ম-থিয়েটারেও এটা সফল হয়েছে; কিন্তু কোনো তুলনা নয়।
এখন, দর্শক নিয়ে আমার আরেকটি মতামত জানাবো। ফিল্ম কেবল নির্মাতা কিংবা অভিনেতা বা টেকনিশিয়ানদের জিনিস না, এটা একইসঙ্গে দর্শকদেরও কাজ। নির্মাতা যেমন ফিল্ম বানান, দর্শকরাও তেমনি। যে ফিল্মের শুটিং শেষ, প্রিন্টও করা হয়ে গেছে, সেই ফিল্ম আবার দর্শকরা বানাবেন কী করে- এ ধরনের প্রশ্ন যদি করেন, তাহলে সেটা আজব লাগবে। হুম, একেক ধরনের দর্শকের কাছে একটা ফিল্ম একেক রকম। দর্শক যদি ভালোমানের হয়, তাহলে ফিল্মও ভালো। এ এক রহস্য। আমরা রহস্যের ভেতর থাকি।
আমি আপনাকে কিছু কথা বলতে চাই। বিজ্ঞানে বিশ্বাস নেই আমার। মিস্টার আইনস্টাইনের বক্তব্য থেকে বিজ্ঞানের যে জিনিসটা শুধু আমি বিশ্বাস করি, তা হলো- সবকিছুই সম্পর্কযুক্ত। যখন বিজ্ঞানে বিশ্বাস নেই আমার, বিশ্বাস গাঢ় হয় রহস্যে- তাতে যে ফিল্ম বানানো হয়ে গেছে, সেটিই এক দর্শক মুহূর্তে বানাতে পারে। আমি এর বিরুদ্ধে না। আমি এটা বিশ্বাস করি।
প্রশ্ন : ফিল্মে নাটক দেখানোর কথা ভাবতে গেলে কী করতেন আপনি?
রেনোয়া : ঠিক বলেছেন। আর এটাই আমি এখন করতে শুরু করেছি। দু’টি নাটক লিখেছিলাম। তৃতীয়টার প্রস্তুতি নিয়েছি। আমার ভালো বন্ধু কিফোর্ড ওডেটসের ‘দ্য বিগ নাইফ’ নাটকের অভিযোজন লিখেছি। প্যারিসে সেটি সাফল্যের সঙ্গে দেখানো হয়েছে। আমি তো ব্যাপক ভক্ত। মঞ্চে আমি যা পছন্দ করি, তা চমকে ভরা। প্যারিসে যখন আমার প্রথম নাটক মঞ্চস্থ হলো, সেটা ছিল খুবই মনোমুগ্ধকর থিয়েটার, দ্য রেনেসাঁ। কিন্তু ফিল্মের সঙ্গে তুলনা করলে আপনার মনে হবে, সবকিছু কেমন ঘনিষ্ঠ।
প্রশ্ন : ক্যামেরাম্যানের সঙ্গে কি অন্তরঙ্গতায় কাজ করেন? আমার ধারণা, ক্যামেরার ব্যবহারবিধি নিয়ে আপনি উৎফুল্ল
রেনোয়া: আমি সবসময় ক্যামেরাম্যানের সঙ্গে অন্তরঙ্গভাবে কাজ করেছি। এখন আরো বেশি করি। কারণ, এখন আমি ফিল্মের দৃশ্যধারণের নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করেছি। আমার সর্বশেষ ফিল্মে আমি তেমনিভাবে শ্যুট করেছি। একদিক আটটি ক্যামেরা, অন্যদিকে পাঁচটি ক্যামেরায়। আমি বলতে চাই, আপনার কাছে যখন পাঁচটি ক্যামেরা আছে, সব ক্যামেরায় চোখ রাখতে পারবেন না আপনি। আর তখন তো ক্যামেরাম্যানই গুরু। তারমানে, তারা পুরো গল্পে সহযোগিতা করে; আপনার সঙ্গে চিত্রনাট্যে এবং ফিল্মেও অংশদারিত্ব করে।
[[কাগুজে মুদ্রণ : সপ্তসিন্ধু, দৈনিক ডেসটিনি, ঢাকা; ১১ সেপ্টেম্বর ২০০৯ সংখ্যা]]
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই সেপ্টেম্বর, ২০০৯ সন্ধ্যা ৭:২৫

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




