মুক্তিযুদ্ধ ও আমাদের কবিতা
রফিকউল্লাহ খান
বাঙালি জীবনের সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ভূমিকা বৈপ্লবিক যুগান্তরের সম্ভাবনায় তাৎপর্যবহ ও সুদূরপ্রসারী। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে পাকিস্তানী স্বৈরশাসন বিরোধী প্রতিটি আন্দোলনের অনিঃশেষ চেতনা আমাদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক জীবনের মতো শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রেও যুগান্তকারী পরিবর্তন সাধন করেছে। স্বাধীনতাযুদ্ধের বৈপ্লবিক চেতনার স্পর্শে এক অপরিমেয় সম্ভবনায় উজ্জীবিত হয়ে ওঠে আমাদের সাহিত্যলোক। সেই উজ্জীবনী শক্তি একাত্তরের রক্তøাত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে বর্তমান সময়েও বহমান। সঙ্গতকারণেই একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে আমাদের জীবনে ও সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধের অবদানকে নতুন করে মূল্যায়ন করা জরুরি হয়ে পড়েছে। স্মৃতি ও বিস্মৃতির দোলাচলে বাঙালি জাতিসত্তা যেরূপ বিভ্রান্তি ও সংকটের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে, জাতীয় জীবনের এই পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে ইতিহাসের সেই রেনেসাঁসীয় গতি ও শক্তির পুনঃপর্যবেক্ষণ প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। কেবল বর্তমান প্রজন্মের জন্যেই নয়, বিভ্রান্তিপ্রবণ সমাজমানসের জন্যও এই পর্যবেক্ষণের উপযোগিতা কম নয়।
১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের পর এ-ভূখণ্ডের সমাজমানস এক অন্তঃশীলা দুঃখদহনে হয়ে পড়েছিল অবসন্ন, গতিচ্যুত। দীর্ঘদিনের লালিত সুখস্বপ্নের যে বিকৃত মুখচ্ছবি পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে আত্মপ্রকাশ করে, স্বাভাবিকভাবেই তা সংবেদনশীল চিত্তে অনিবার্য করে তোলে গভীরতর রক্তক্ষরণ ও স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণা। প্রগতি ও গণতন্ত্রবিমুখ পাকিস্তান রাষ্ট্র বাঙালি জাতিসত্তার ভিত্তিমূল পর্যন্ত বিনষ্ট করতে সচেষ্ট হয়। ফলে, আত্মসন্ধান, সত্তাসন্ধান ও জাতিসত্তাসন্ধানের প্রশ্নটি নতুন পরিস্থিতিতে নতুন রূপে আত্মপ্রকাশ করে। এই পটভূমিতেই সংঘটিত হয় ভাষা আন্দোলন। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়েই ক্ষুব্ধ, অগ্নিগর্ভ সমাজসত্তার শিল্পিত আত্মপ্রকাশের পথ সুপ্রশস্ত হয়। আত্মত্যাগ ও রক্তদানের অভিজ্ঞতা থেকে দ্বন্দ্বোত্তরণের শিল্পশক্তি অর্জন করে জীবনলগ্ন ও প্রগতিপরায়ণ কবিমানস। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্র“য়ারি এ-কারণেই বাঙালি জাতির ইতিহাসের এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। কেননা, এই ঘটনার মধ্য দিয়েই সূচিত হয় বাংলাদেশের কবিতার নবযাত্রা। তিরিশোত্তর বাংলা কবিতার নেতিবাদী জীবনতন্ত্র থেকে, চল্লিশের দশকের সমাজবাদী কাব্যধারাবিমুখ সামন্তাদর্শ অনুসারী কবিতার ধারা থেকে এক স্বতন্ত্র ধারার কবিতার জন্ম হলো। ’জীবনের বিচ্ছিন্ন অংশগুলোকে ফিরে পাবার ও চূর্ণিত সত্তার পূর্ণ অবয়বটিকে বোধ-কল্পনার পরিধি সীমায় আকর্ষণের আকাক্সক্ষায়, এবং ব্যক্তিচেতনার খণ্ডদ্বীপে দাঁড়িয়ে সমষ্টি ও সমগ্রতার মূল ভূ-ভাগের দিকে বাহু বিস্তারের উজ্জ্বল-করুণ উৎকণ্ঠায় স্পন্দিত’ হয়ে ওঠে এ-সময়ের কবিমানস। দেশ-বিভাগের পর আবহমান বাংলা কবিতার মূল ধারা থেকে বিচ্ছেদের যে আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছিল, ভাষা আন্দোলনের পর সেই মূল ধারার সঙ্গে পুনরায় যুক্ত হলো এ-ভূখণ্ডের কবিতা। সাংস্কৃতিক নবজাগরণের রাজনৈতিক চরিত্র বাংলা কবিতার ধারায় যে মাত্রা সংযোজন করলো, তা অভূতপূর্ব ও যুগান্তকারী। ব্যক্তিতন্ত্রের যে আত্মমুখিতা ঔপনিশেক সমাজকাঠামোতে পলায়নবাদী চেতনায় রূপ নেয়,তা থেকেও বহুলাংশে বেরিয়ে এলো বাংলাদেশের কবিতা। ব্যক্তির স্বাধীন বিকাশের শর্ত মেনে নিয়েও বলা যায়, যে কোনো সমাজের কবিতা যদি সেই সমাজের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর চেতনার প্রতিনিধিত্ব না-করে, তাহলে সেই কবিতার আবেদন দীর্ঘস্থায়ী হতে পারেনা। বিশেষ করে যে মধ্যবিত্ত-মন কবিতার পাললিক ভূখণ্ড, বাংলাদেশে সেই মধ্যবিত্তের বিকাশও স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত নয়। ইংরেজ বণিকের মানদণ্ডের সংস্পর্শে যে মধ্যবিত্তের যাত্রা সূচিত হয়েছিল, প্রায় দু’শ বছরেও বাংলাভাষী ভূখণ্ডে সেই মধ্যবিত্তের শ্রেণীচরিত্র কোনো সুস্পষ্ট রূপ পায়নি। বরং সামান্তাদর্শ, কুসংস্কার, প্রচলিত মূল্যবোধ প্রভৃতির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণে এ-দেশের মধ্যবিত্ত চরিত্র বিমিশ্র স্বভাব নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে। বিশেষ করে, বাংলাদেশ ভূখণ্ডের মধ্যবিত্ত শ্রেণীবিকাশের স্বতন্ত্র ও জটিল রূপ তার ব্যক্তিসত্তার বৈশিষ্ট্যকে গোড়া থেকেই ভিন্ন ধারায় প্রবাহিত করেছে। দেশ বিভাগের পর সেই ব্যক্তিসত্তায় যে দ্বন্দ্ব, অনিশ্চয়তাবোধ ও অস্থিরতার জন্ম হয়েছিল, ভাষা আন্দোলন সেখানে নিয়ে এলো মুক্তচেতনার পথ-নির্দেশনা। ভাষা আন্দোলনের নবজাগরণসুলভ চারিত্র বাংলাদেশের কবিতায় যে ব্যক্তি ও সমষ্টিচেতনার জন্ম দিলো, বিগত পঞ্চাশ বছরে তা বহুমুখী স্বভাবধর্ম নিয়ে বিকশিত ও পল্লবিত হয়েছে। গণতন্ত্র, সাম্যবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা প্রগতিশীল জীবনদৃষ্টি, রাজনৈতিক অধিকার অর্জনের প্রশ্নে উচ্চকন্ঠ আত্মপ্রকাশ প্রভৃতি কবিতার শরীরে ও বক্তব্যে শিল্পিত অভিব্যক্তি পেয়েছে। এর ফলে কবিতার চরিত্র যে রাজনৈতিক হয়ে উঠলো তা বলা যাবেনা। বরং রাজনীতি সচেতনতা আমাদের অধিকাংশ কবির ব্যক্তিত্ব ও মানসগঠনকে করে তুললো পরিপক্ব ও স্বাবলম্বী। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের কবিতার ইতিহাস থেকে আমরা জানি একটি জাতির আত্মবিকাশের ক্ষেত্রে প্রকৃত দিকনির্দেশনা দান কবিতার অন্যতম প্রধান ধর্ম। বিশেষ করে উনিশ ও বিশ শতকের পূঁজিবাদী বিশ্ব এবং সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীন স্বপ্রতিষ্ঠ হওয়ার আকাক্সক্ষায় জাগ্রত দেশগুলোর কবিতার চরিত্র আলাদা হয়ে গেছে। ইংলেন্ডের কবি টি. এস. এলিয়ট যখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসলীলার সামনে দাঁড়িয়ে চরম হতাশায় লন্ডন ব্রীজের পতন দৃশ্যকে কবিতায রূপ দিচ্ছেন, তখন সাম্রাজ্যবাদ কবলিত এ-ভূখণ্ডের কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন, ’বল বীর, বল উন্নত মম শির’। ভাষা আন্দোলনের পরে উপনিবেশ-কবলিত বাংলাদেশের কবিতাও এ-কারণেই তীব্র অহংবোধ ও সমষ্টিচেতনার বহুমুখী অভিব্যক্তিতে এবং ব্যক্তিসত্তার সমাজলগ্ন আকাক্সক্ষা রূপায়ণের ঐকান্তিকতায় নবতর চারিত্র্য বৈশিষ্ট্য লাভ করলো। পঞ্চাশ দশকে আবির্ভূত যে-সকল কবি সমাজ সচেতনতার মধ্য দিয়ে কাব্যরচনা শুরু করেন, দেশবিভাগ-জনিত সামাজিক-রাজনৈতিক অব্যবস্থা তাঁদের মধ্যেও একধরনের পলায়নমুখী দ্বন্দ্বময় ও বিষণœ মানসিকতার জন্ম দিয়েছিল। কিন্তু ভাষা আন্দোলন সেই বিশ্লিষ্ট দ্বন্দ্বদীর্ণ ও হতাশা-আক্রান্ত কবিদেরকেও সাবলম্বী ও আত্মবিশ্বাসী কাব্য প্রেরণায় উদ্দীপ্ত করে তোলে।
২
বিগত পঞ্চাশ বছরের বাংলাদেশের কবিতার যে সম্পন্নতা ও বহুমাত্রিক বিস্তার, তার মূলে রয়েছে ভাষা আন্দোলনের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রেরণা। দেশ বিভাগের পর ‘নতুন কবিতা’ (১৯৫০) নামে যে সংকলন প্রকাশিত হয়েছিল সেখানে অন্তর্ভুক্ত অনেক কবিই পরবর্তীকালে বাংলাদেশের কবিতার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। কিন্তু ঐ সংকলনে বিধৃত কবিতা বক্তব্য ও কাব্যভাষার সাথে পরবর্তীকালের কবিতা তুলনা করলেই াামাদের কবিতায় ভাষা আন্দোলনের প্রভাবের স্বরূপ সুস্পষ্ট হয়ে উঠে। পঞ্চাশের দশকে কাব্য রচনায় আত্মনিয়োগ করেন ভাষা আন্দোলন তাঁদের কবিতার বিষয় ও প্রকরণে এক স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে। এ-সময়ের নবোদ্ভুত কবিদের মধ্যে শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, আল মাহমুদ প্রমুখের কবিতায় ভাষা আন্দোলন বড় ধরনের পালাবদলের সূত্রপাত করেছে। এইসব কবি বেরিয়ে এসেছেন নিঃসঙ্গতার অন্ধকার থেকে ব্যক্তিচেতনার নিভৃত স্বার্থপর জগত থেকে। স্থবির সমাজব্যবস্থার অন্তর্গত যে বিক্ষোভ ও রক্তক্ষরণ কবিরা তা উপলব্ধি করেছেন গভীরভাবে। ভাষা আন্দোলনের বাস্তব অভিঘাত একজন কবির চৈতন্যে কতটা আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারে শামসুর রাহমানের একটি কবিতা থেকে আমরা তা উপলব্ধি করতে পারি:
“ আমরা যখন ঘড়ির দুটো কাঁটার মতো
মিলি রাতের গভীর যামে,
তখন জানি ইতিহাসের ঘুরছে কাঁটা
পড়েছে বোমা ভিয়েতনামে।”
( প্রেমের কবিতা, নিরালোকে দিব্যরথ )
কেবল ভিয়েতনাম কেন, পৃথিবীব্যাপী সাম্রাজ্যবাদী ধ্বংসযজ্ঞের প্রতিবাদে কবিরা সমাজ ও রাজনীতি-মনস্কই কেবল হয়ে ওঠেনি, তাঁদের মন-মানস ঋদ্ধ হয়েছে আন্তর্জাতিকতাবোধেÑ বিশ্বমানবের সঙ্গে মিলনসাধনায়। কবিতার উপকরণ, ব্যবহৃত শব্দগুচ্ছ, পরিপ্রেক্ষিত, জীবনলোক, ঐতিহ্যসূত্র, পুরাণের জগৎ অপরিবর্তিত থাকলেও কবির আত্মপ্রকাশের প্রকৃতিতে ঘটে গেছে বড় ধরনের রূপান্তর। ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা কবিকে করে তুলেছে আত্মবিশ্বাসী ও ব্যক্তিত্বমণ্ডিত। যে শামসুর রাহমানের কবিতাকে আমরা নগর-মানসের প্রতিবিম্ব হিসেবে চিহ্নিত করি, সেই নাগরিক অস্তিত্বকেও কবি প্রত্যক্ষ করেন অন্য চোখে: ’ এ-শহর প্রত্যহ লড়াই করে বহুরূপী নেকড়ের সাথে।’ (এ-শহর ) হাসান হাফিজুর রহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদের কাব্যবস্তু ও কাব্যভাষা বাংলা কবিতার নতুন উৎসমুখ খুলে দেয়। হাসান হাফিজুর রহমান তাঁর সেই বিখ্যাত ’অমর একুশে’ অনুভূমিক ও ভাষণধর্মী কাব্যপঙ্তিমালায় উচ্চারণ করেন:
“এখানে আমরা ফ্যারাউনের আয়ুর শেষ ক’টি বছরের
ঔদ্ধত্যের মুখোমুখী,
এখানে আমরা পৃথিবীর শেষ দ্বৈরথে দাঁড়িয়ে
দেশ আমার, স্তব্ধ অথবা কলকণ্ঠ এই দ্বন্দ্বের সীমান্তে এসে
মায়ের øেহের পক্ষ থেকে কোটি কণ্ঠ চৌচির করে দিয়েছি
এবার আমরা তোমার।”
( অমর একুশে, বিমুখ প্রান্তর )
এই স্বদেশ ও জীবনলগ্নতা কেবল বাংলাদেশের নয়, সমগ্র বাংলা কবিতার পটভূমিতেই এক স্বতন্ত্র চেতনায় বিশিষ্ট হয়ে উঠেছে। কবিতায় ভাবালুতার পরিবর্তে প্রাধান্য পেলো মননশীলতা, নিঃসঙ্গ একাকী ভূখণ্ডে জেগে উঠলো আত্মবিশ্বাস ও সংগ্রামের রক্তিম চেতনাগুচ্ছ। ব্যক্তিগত প্রেমবোধের সঙ্গে যুক্ত হলো দেশপ্রেম। কয়েকটি দৃষ্টান্ত সহযোগে বিষয়টি ব্যাখ্যা করা যেতে পারে Ñ
১) ‘আমার হৃৎপিণ্ডের মত
আমার সত্তার মত
আমার অজানা øায়ুতন্ত্রীর মত
সর্বক্ষণ সত্য আমার দেশ
আমার দেহের আনন্দ কান্নায় তোমাতেই আমি সমর্পিত’
( হাসান হাফিজুর রহমান : অনন্য স্বদেশ, আর্ত শব্দাবলী )
২) ‘সেই দুইজন-বহুজন এল একাকার, অন্ধকার’
সমুদ্রের পিঙ্গল শ্যাওলা, সরীসৃপ-বানরের হাড়
এল তা’রা এল পাহাড়ের অরণ্যের প্রান্তরের একা
বিবাদী মিছিল।
(আলাউদ্দিন আল আজাদ : ঊত্তরাধিকার , মানচিত্র )
৩) ‘তাড়িত দুঃখের মত চতুর্দিকে স্মৃতির মিছিল
রক্তাক্ত বন্ধুদের মুখ উত্তেজিত হাতের টঙ্কারে
তীরের ফলার মত
নিক্ষিপ্ত ভাষার চিৎকার:
বাঙলা, বাঙলা ÑÑ
আমার নিদ্রিতা মায়ের নাম ইতস্তত উচ্চারিত হলো।’
( আল মাহমুদ : নিদ্রিতা মায়ের নাম, কালের কলস )
৪) ‘এখন কেবল
শব থেকে শবের সিঁড়িতে একটি আকাক্সক্ষা হেঁটে যায়
জীবনের নামে। এখন সে জীবনের নাম
স্বপ্ন আর রক্ত আর ঘাম।’
( আজীজুল হক : যন্ত্রণা, ঝিনুক মুহূর্তে সূর্যকে )
৫) ‘শৃঙ্খলিত, বিদেশীর পতাকার নীচে আমরা শীতে জড়োসড়
নিঃশব্দে প্রেমিকের দীপ্ত মুখ থেকে জ্যোতি ঝরে গেছে ...’
( শহীধ কাদরী : উত্তরাধিকার , উত্তরাধিকার )
এ-ধরনের দৃষ্টান্ত থেকে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, ভাষা আন্দোলন ও রাজনৈতিক বক্তব্যনির্ভর কবিতাকেই আমরা প্রাধান্য দিচ্ছি। কিন্তু মনে রাখতে হবে, কবিতার আবহমান বিষয়বস্তুর সঙ্গে এই সমষ্টিচেতনানির্ভর কাব্যবস্তুর সংযোগ বাংলাদেশের কবিতাকে এক বলশালী স্বাবলম্বী ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করেছে। কিন্তু শেষ উদ্ধৃতির জীবন ও ব্যক্তিমুখিতা কবিতার এক নতুন স্বভাবধর্ম তুলে ধরে। ঐ সময়ে রচিত পশ্চিম বাংলার কবিতার সঙ্গে তুলনা করলেই বাংলাদেশের কবিতার স্বতন্ত্র চরিত্র, কাব্যভাষা, প্রতীক ও চিত্রকল্পের নবত্ব এবং জীবনজিজ্ঞাসার অভিনবত্ব আমরা অনুভব করতে পারি। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, ভাষা আন্দোলন বিভ্রান্তির অন্ধকার থেকে জাতীয় চৈতন্যকে মুক্তি দিয়ে প্রবাহিত করেছিলো আত্মসন্ধান ও জাতিসত্তাসন্ধানের ব্যাপক পরিসরে। ব্যক্তির অস্তিত্বজিজ্ঞাসাও স্বার্থপর নিভৃত জগৎ থেকে বহুলাংশে বেরিয়ে আসতে শুরু করে। ব্যক্তির আত্ম-জিজ্ঞাসায়ও ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতে থাকে সমষ্টি-অস্তিত্বের সংরাগ ও সংগ্রাম। ষাটের দশকে উদ্ভূত নতুন কবিদের মধ্যে জীবনের না-অর্থক দিকগুলোই বেশিমাত্রায় অভিব্যক্ত হতে দেখি। এ-সময়ের কবিদের ‘জন্মাদ্ধ’, ‘জন্মেই কুঁকরে’ যাওয়া, ‘স্বপ্নের বাস্তবে’র মুখোমুখি, আত্মরতিপ্রবণ এবং মধ্যবিত্তের জীবনচক্রে ঘূর্ণায়মাণ কবিমানসেও জীবনের রূপ ও তাৎপর্য স্বতন্ত্র অবলোকনের বিষয় হয়ে উঠেছে।
৩
১৯৫২থেকে ১৯৭০ কালপর্ব বাংলাদেশের কবিতার আত্মসংস্থিত হওয়ার কাল। কেননা, এ-সময়ে কবিরা সামাজিক-রাজনৈতিক আকাক্সক্ষা ও সংক্ষোভকে যেমন কবিতায় রূপায়িত করেছেন, ব্যক্তিসত্তাবিকাশের বহুমুখী সম্ভাবনা নিয়েও তেমনি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। সমাজ-অন্তর্গত ব্যক্তি-অস্তিত্বের যে হতাশা, পরাভবচেতনা, নৈঃসঙ্গ্যবোধ ষাটের দশকের নবোদ্ভূত কবিদের কবিতায় লক্ষ করি, সেখানেও বৃহত্তর সমাজমানসবিচ্ছিন্ন নগরজীবনের অব্যাহত বিনষ্টি, অবক্ষয় সম্ভাবনাহীনতার অনুভব কাজ করেছে। এই বোধগুলোকে বিশ শতকের তিরিশের দশকের নেতিবাদী কবিতার অনুকরণ বললে ভুল হবে। কারণ, এ-সময়ের কবিরা যে সমাজপটভূমির মধ্য থেকে আত্মপ্রকাশ করেছেন, তার সংরক্ত অনুভবই এ-ক্ষেত্রে সর্বাপেক্ষা কার্যকর ছিলো বলে মনে হয়। পাশ্চাত্যের শিল্পকলা ও কবিতার অঙ্গীকার এ-ক্ষেত্রে সঞ্চার করেছে বিশ্বজনীন চেতনাপ্রবাহ ও প্রকরণ-সতর্কতা।
১৯৭১ সালের নয় মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর বাংলাদেশের কবিতার ক্ষেত্রে যুগান্তকারী পরিবর্তনসম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়ে যায়। সমাজসংস্থার সমান্তরালে কবিদের আবেগজীবনেও বড় ধরনের রূপান্তর সাধিত হয়। বিভিন্ন দশকের কবিদেও সম্মিলিত পদচারণায় বাংলাদেশের কাব্যস্বভাবে সূচিত হয় এক জটিল জঙ্গম। যুদ্ধের অভিজ্ঞতায় পূর্ববর্তী বিভিন্ন দশকের কবিরা কাব্যোপকরণের প্রশ্নে প্রায় অভিন্ন বিন্দুতে এসে মিলিত হন। একটা সামাজিক চরিত্রও বাংলাদেশের কবিতা এ-সময়ে অর্জন করে। ভাষা আন্দোলনের অব্যবহিত পরে অনেকটা এইরূপ পরিস্থিতির সৃষ্টি হলেও ব্যক্তিসত্তার নব্যবিকাশের সম্ভাবনায় অনেক কবিই সামাজিক বক্তব্য প্রকাশের প্রশ্নে ব্যক্তিরুচিকেই প্রাধান্য দিলেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সংরক্ত চেতনা, গণতন্ত্রায়ন ও শিল্পায়নের অবাধ বিকাশের সম্ভাবনায় নবগঠিত রাষ্ট্রসত্তায় ব্যক্তির আকাশচুম্বী স্বপ্ন একটা সামষ্টিক চরিত্র নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে। ফলে ষাটের দশকের শেষার্ধে উদ্ভূত অনেক কবি এবং সমকালীন সামাজিক রাজনৈতিক জঙ্গমতার মধ্যে আত্মপ্রকাশকামী তরুণ কবিদের মধ্যে কখনো কখনো চেতনাগত ঐক্য সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। অভিজ্ঞতা-উৎস অভিন্ন হলেও অভিজ্ঞান ও জীবনবোধ অনেক কবির আত্মপ্রকাশের স্বাতন্ত্র্যকে চিহ্নিত করেছে। যুদ্ধোত্তরকালের নবোদ্ভূত কবিদের রক্তিম জীবনাবেগ, সদ্য স্বাধীন দেশের বাস্তবতায় সীমাতিরিক্ত প্রত্যাশা ও অবশ্যম্ভাবী ব্যর্থতাবোধ, প্রেম ও নিসর্গভাবনায় প্রচলিত ধারা থেকে বেরিয়ে আসার প্রবণতা প্রভৃতি একটা সামাজিক রূপ লাভ করে। ষাটের দশকের অনেক কবি স্ব-উদ্ভাবিত পরিণত আঙ্গিকে অভিন্ন কাব্যবস্তুকেই যেন প্রকাশ করলেন। পঞ্চাশের দশকের শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, আল মাহমুদ, শহীদ কাদরী এবং ষাটের দশকের অধিকাংশ কবিই নিজস্ব কাব্য-অবয়বে সমকালের সংরক্ত চেতনা ধারণ করলেন। ষাটের দশকের শেষ দিকে আবির্ভূত বেশ কয়েক জন কবি এ-সময়ে আত্মপ্রকাশের তীব্রতায়, ব্যক্তি ও সমষ্টির নির্বাধ আবেগজীবন উন্মোচনের ঐকান্তিকতায় এবং দেশপ্রেমের রক্তিম কাব্যকলা সৃষ্টিতে যথেষ্ট আলোড়ন সৃষ্টিতে সমর্থ হন।
কলকাতা কেন্দ্রিক মধ্যবিত্তের আবেগ-জীবনের যে তীব্র আত্মপ্রকাশ তিরিশের দশকের বাংলা কবিতায় লক্ষ করি, সেখানে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সমাজ-চৈতন্য ও ব্যক্তি-অস্তিত্বের পাশাপাশি কলোনিয়াল মধ্যবিত্তের ব্যর্থতাবোধ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলো। রূপান্তরহীন সমাজ-কাঠামোতে ব্যক্তির আত্মপ্রকাশ যে কতটা বেদনাদীর্ণ, নিঃসঙ্গ ও আত্মরতিপ্রবণ হতে পারে, তিরিশের দশকের অনেকের কবিতায় তা সুস্পষ্ট। ঔপনিবেশিক সমাজের মধ্যবিত্তের ব্যর্থতাবোধ, ব্যক্তিক ও সামষ্টিক আত্মমুক্তির আকাক্সক্ষা এই সময়ের কবিতায় শতধারায় উৎসারিত হয়েছিল। বিশ শতকের চল্লিশের দশক থেকে বাংলাদেশ ভূখণ্ডের কবিদের যে নতুন অভিযাত্রার সূচিত হয়, সেখানে ব্যক্তির স্বাবলম্বী আত্মপ্রকাশের তীব্রতার সমান্তরালে সামাজিক দায়িত্বচেতনা ও অস্তিত্বেও প্রশ্নে ইতিহাস-ঐতিহ্য মন্থন নতুন মাত্রা পেয়েছে। আহসান হাবীবের কবিতায় প্রাধান্য পেল সমাজের মাত্রা, আবুল হোসেনের কবিতায় ব্যক্তির মাত্রা, ফররুখ আহমদ রোম্যান্টিক ঐতিহ্যলোকে সন্ধান করলেন সমকালের উজ্জীবনমন্ত্র এবং সৈয়দ আলী আহসানও অনেকটা পুঁথি সাহিত্যের লোকায়ত অনুভূতিগুলেকে সমকালীন সমাজমানসের অনুকূলে বিন্যস্ত করলেন। এবং সানাউল হক নিসর্গলোকের উদার পটভূমিতে চেতনা বিস্তৃত কওে যেন দেশপ্রেমের দীক্ষা নিলেন। ১৯৪৭-এর দেশ বিভাগ এই সব কবির মনোজগতে স্বাভাবিক ভাবেই এক স্বপ্নময় প্রত্যাশার জন্ম দিয়েছিল। কিন্তু পাকিস্তানের নয়া ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ-নিপীড়ন, বাংলাভাষা ও সাহিত্যের প্রতি অশ্রদ্ধা অতি দ্রুত মোহভঙ্গের কারণ হয়ে ওঠে। উনিশশো আটচল্লিশ সাল থেকে সূচিত ভাষা আন্দোলন ও তার রক্তাক্ত পরিণতি বাংলাদেশের কবিতাকে বাংলা কবিতার প্রচলিত ধারা থেকে স্বতন্ত্র ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করে। এবং বাংলাদেশের কবিতার জন্য স্বতন্ত্র, স্বাবলম্বী ও অস্তিত্বময় পটভূমি প্রস্তুত করে দেয়।
ষাটের দশকের কবিদের মধ্যে সিকদার আমিনুল হক, রফিক আজাদ, আবদুল মান্নান সৈয়দ, আসাদ চৌধুরী, মোহাম্মদ রফিক, মাহমুদ আল জামান, মহাদেব সাহা, নির্মলেন্দু গুণ, মুহম্মদ নূরুল হুদা, আবুল হাসান, হুমায়ুন আজাদ, সাযযাদ কাদির প্রমুখ পঞ্চাশের দশকের কবিতার বিপ্রতীপ এক নতুন ধারার সৃষ্টি করলেন। পঞ্চাশের কবিরা যেখানে সমকালীন জীবনাবেগ রূপায়ণের প্রতি ঐকান্তিক এবং সমাজ ও সমষ্টি-সংলগ্ন, সেখানে ষাটের দশকে উদ্ভূত কবিরা সমকালের আন্দোলন-সংঘাত-রক্তপাত ও উজ্জীবনের পটভূমিতে বিস্ময়করভাবে বর্হিজগত-বিমুখ, আত্মমগ্ন এবং পলায়নপর। মনে রাখা প্রয়োজন ষাটের দশকের কবিদের সামনে স্ব^প্ন অথবা পলায়ন এ-দুয়ের কোনো বিকল্প ছিল না। মুক্তিযুদ্ধোত্তর কালে যে-সকল নতুন কবি আবির্ভূত হলেন, দ্বিধাহীন আত্মপ্রকাশ-আকাক্সক্ষা, সমাজ ও রাষ্ট্রের বস্তুগত পটপরিবর্তনের সুখবোধ এবং আনন্দভূতি অনেকের স্বপ্নলোককেই করে তুললো বস্তুসম্পর্করহিত। প্রেম ও সংগ্রামের দ্বৈরথ অগ্রজদের কারো কারো মতো এঁদেরকে আলোড়িত করেনি। বরং যুদ্ধোত্তর কয়েক বছরের মধ্যে জাতীয় জীবনের বিপর্যয়, মুক্তিযুদ্ধ-অর্জিত চেতনার ক্রমবিলীয়মান রূপ, পাকিস্তানি আমলের পরাজিত দৃষ্টিভঙ্গির পুনরুত্থান, সেনাতন্ত্রের বিকৃত মুখচ্ছবি, গণতন্ত্রের পরিবর্তে স্বৈরতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা, পরাজিত সা¤প্রদায়িকতার পুনরুজ্জীবনচেষ্টা এবং সংবিধানের মূলস্তম্ভগুলোর অপসারণ জাতীয় চৈতন্যকে নিক্ষেপ করে গভীর অন্ধকার ও অনিশ্চয়তাগহবরে। এই পরিস্থিতিতে সংবেদনশীল কবিচৈতন্যের যে প্রতিক্রিয়া, সমাজ ও সময়ের অন্তঃস্বর অনুধাবনে তার তাৎপর্য অপরিসীম।
৪
সমাজবাস্তবতা ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার সূত্র ধরেই আমাদেরকে মুক্তিযুদ্ধোত্তর কবিতার স্বরূপ নিরূপণ করতে হবে। এ-সময়ের কবিতায় প্রধানত যে-লক্ষণগুলো সুস্পষ্ট, তাহলো, রক্তাক্ত যুদ্ধের অভিজ্ঞতার সমান্তরালে ব্যক্তির আত্মপ্রকাশ ও আত্মপ্রতিষ্ঠার প্রতিযোগিতা। বৃহৎ ত্যাগের অনুভবে আত্মমুগ্ধ অবসন্ন চৈতন্যের বাস্তবতা-অতিরেক স্বপ্ন-কল্পনা। ব্যর্থতাবোধের দ্রুত স¤প্রসারণ। এ-ব্যর্থতাবোধ ষাটের দশকীয় ব্যক্তিকেন্দ্রিক নয়, মূলত সমাজনির্ভর। প্রত্যাশা, স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের নতুন চারিত্র্য। সংগ্রামী জীবনাকাক্সক্ষার নবতর মাত্রা। শ্রেণীবৈষম্য সম্পর্কে সজাগতা ও শ্রেণীসাম্য প্রতিষ্ঠার আকাক্সক্ষা। এবং এজন্য নবতর সংগ্রামের প্রস্তুতি। যতোটা সরল রেখায় লক্ষণগুলো উপস্থাপিত হলো, কবিতায় তার রূপায়ণ অবশ্যই ততোটা সরল-বক্ররেখায় চিহ্নিত নয়।
মুক্তিযুদ্ধের পর চল্লিশ, পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকের কবিরা আত্মপ্রকাশের ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব কাব্যবস্তুর সন্ধান পেলেন। সৃজন-মননের যৌথ রাগে অভিজ্ঞতা ও অভিজ্ঞানকে তাঁরা নিজ নিজ বোধের মাত্রা অনুযায়ী রূপ দান করলেন। কিন্তু এতো বড় একটা সামাজিক-রাজনৈতিক পটপরিবর্তন কাব্যস্বভাবের যতোটা রূপান্তরের সম্ভাবনা জাগিয়েছিলো, অল্পসংখ্যক কবি ছাড়া অধিকাংশই তা অনুধাবনে ব্যর্থ হলেন। উল্লেখ্য যে, বাঙালির ইতিহাসে ভাষা আন্দোলন কিংবা মুক্তিযুদ্ধের যে তাৎপর্য, কেবল কাব্যবিষয়ের মধ্যে তাকে সীমায়িত করে দেখা ঠিক হবে না। জীবনের সামগ্রিক পরিবর্তনে বস্তুজগৎ ও চেতনার বৈপ্লবিক রূপান্তরে কবিতার রূপ, রীতি, শব্দ অর্থাৎ সামগ্রিক প্যাটার্নেরই পরিবর্তন অনিবার্য হয়ে পড়ে। যেমন দেখেছি ইউরোপীয় রেনেসাঁসের কবিতা, ফরাসি বিপ্লবের সাহিত্য-শিল্প, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ কিংবা রুশ বিপ্লবের কবিতা এবং বিপ্লবমন্থিত লাতিন আমেরিকার কবিতা। আমাদের কবিরা মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধ-পরবর্তী চেতনার রূপান্তরিত রূপ কতোটা ধারণ করতে পেরেছেন কবিতায়, তা বিশ্লেষণ করে দেখা যেতে পারে। এ সময়ে কবিতাচর্চায় সক্রিয় আহসান হাবীব, আবুল হোসেন, সৈয়দ আলী আহসান এবং সানাউল হকের কবিতায় মুক্তিযুদ্ধ নতুন বোধের উৎসমুখ হয়ে উঠেছে। যেমন,
১. কোথাও পড়ে না চোখে বধ্যভূমি, অথচ প্রত্যহ
নিহতের সংখ্যা বাড়ে। কোথাও একটিও
লাশ কিংবা কবর পড়ে না চোখে, অথচ প্রত্যহ
শবাধার ব্যস্ত হয়ে হেঁটে যায় এবাড়ি ওবাড়ি। ( আহসান হাবীব )
২. অনেক শেখানো অনেক পড়ানো
বহু পুরুষের মর্চে ধরানো
ভাগ্যটার
ঝুটি ধওে নাড়া দেবার সময়
এসেছে এবার... ( আবুল হোসেন )
৩. আমার মনে হয়
সমুদ্রের সামনে যুগযুগান্তের সাক্ষ্য বিদ্যমানÑ
মহাকালকে এখানে অনুধাবন করা যায় একটি
প্রার্থনার কাম্যে। ( সৈয়দ আলী আহসান )
৪. নক্ষত্রের আলো
মুক্তিসেনা চিতার শরীর, বাংলার ন’মাসী উন্মেষ
কখনো কাতর; অকাতর রক্তক্ষরা ধাবমান তরী,
অশোচ আতুর ঘরে সর্ষে ঝাঁঝ, রদ্ধদ্বার ছায়াকালো :
সেখানে আমার জন্ম Ñ কী আনন্দ স্বাধীন বাংলাদেশ। ( সানাউল হক )
উল্লিখিত উদ্ধৃতিগুচ্ছ পরিণত অভিজ্ঞতা ও গভীরতর আবেগধর্মের সাক্ষ্যবাহী। কবিরা যুদ্ধ ও যদ্ধোত্তর ট্রাজিক জীবনচৈতন্যের অঙ্গীকার আশ্চর্য কুশলতায় উপস্থাপন করেছেন কবিতায়। পঞ্চাশের দশকে উদ্ভূত কবিদের চেতনা ও সৃষ্টিতে মুক্তিযুদ্ধের আবেদন বহুমাত্রিক। অবশ্য যুদ্ধকালীন সক্রিয়তা বা নিষ্ক্রিয়তাও অনেকক্ষেত্রে কবিদের আবেগ-মননের চারিত্র্য নির্দেশ করেছে। শামসুর রাহমান, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, হাসান হাফিজুর রহমান, আজীজুল হক, আলাউদ্দিন আল আজাদ, সৈয়দ শামসুল হক, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, সাইয়িদ আতীকুল্লাহ, মোহম্মদ মনিরুজ্জামান, আল মাহমুদ, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, ফজল শাহাবুদ্দীন, জিয়া হায়দার, আবুবকর সিদ্দিক, শহীদ কাদরী প্রমুখ যুদ্ধ ও যুদ্ধোত্তর জীবনসমগ্রতার অঙ্গীকারকে বিচিত্রভাবে প্রকাশ করেছেন। সঙ্গত কারণেই জীবনচেতনা ও শিল্পাদর্শের প্রশ্নে এঁরা সকলেই স্বনির্মিত কাব্যাদর্শের বৃত্তেই আবর্তিত হয়েছেন। যেমনÑ
১. এবং পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে জ্বলন্ত
ঘোষণার ধ্বনি প্রতিধ্বনি তুলে
নতুন নিশান উড়িয়ে, দামামা বাজিয়ে দিগি¦দিক
এই বাংলায়
তোমাকে আসতেই হবে, হে স্বাধীনতা! ( শামসুর রাহমান )
২. বন্দী, তুমি এখনও ভুলতে পারছ না
কী অন্তহীন এই বন্দী দশা,
বন্দী, সেই থেকে তোমার ঘুম পলাতক
যদিও মুক্তিসেনারা এসেছিল
একদিন (জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী )
৩. এবার মোছাব মুখ তোমার আপন পতাকায়।
হাজার বছরের বেদনা থেকে জন্ম নিল
রক্তিম সূর্যের অধিকারী যে শ্যামকান্ত ফুল
নিঃশঙ্ক হাওয়ায় আজ ওড়ে, দুঃখভোলানিয়া গান গায়।
মোছাব তোমার মুখ আজ সেই গাঢ় পতাকায়। ( হাসান হাফিজুর রহমান )
৪. একটি কবিতা একজন কবির হৃৎপিণ্ড চিবিয়ে খাচ্ছে
রক্ত
একটি স্বপ্ন একজন প্রেমিকের চোখ উপড়ে নিচ্ছে রক্ত
রক্ত
রক্ত রক্ত রক্ত
উন্মোচিত জরায়ুতে কি এতো রক্ত থাকে? ( আজীজুল হক )
৫. শুভঙ্কর কোথায় জন্মেছিলো?
নিশ্চয় প্রাচ্যভূমি
সেখানে জীবনটা
আয়নার উল্টোপিঠ;
এবং ইতিহাস দস্যুর উপাখ্যান। ( আলাউদ্দিন আল আজাদ )
৬. যখন তিরিশ লক্ষ মানুষের রক্তে প্লবমান আমার স্মৃতি,
এখনো তো আমার স্মৃতি;
যখন তিন কোটি মানুষের গৃহত্যাগে বিলীয়মান আমার সভ্যতা
এখনো তো আমার সভ্যতা;
যখন বলীবর্দের দ্বিখণ্ডিত খুরে কম্পমান আমার স্বপ্ন,
প্রিয় ব্রহ্মপুত্র, এখনো তো আমার স্বপ্ন। (সৈয়দ শামসুল হক )
উদ্ধৃত কবিতাংশগুলো বাংলা কবিতার ধারায় বিষয় ও প্রকরণে কেবল নতুন মাত্রাই যুক্ত করে নি, বাঙালির বস্তু-অভিজ্ঞতা ও অস্তিত্বজিজ্ঞাসার ক্ষেত্রে যুগান্তরের ইঙ্গিত বহন করছে। জীবনাভিজ্ঞতা ও বোধের তীব্রতায় এ-সময়ের কবিতা অপরিমেয় গতি, ব্যাপ্তি ও গভীরতা লাভ করেছে। যুদ্ধোত্তর জীবনের সমাজ ও ব্যক্তিমানুষের অনিশ্চয়তা, অবক্ষয় ও নৈরাশ্য কবিমনকে পীড়িত করলেও পলায়নের পরিবর্তে দুঃখ, যন্ত্রণা ও রক্তিম স্মৃতি-আক্রান্ত বস্তুবিশ্বকেই গ্রহণ করলেন কবিরা। ভাষা আন্দোলনের চেতনায় উজ্জীবিত কবিরা দীর্ঘায়ত সংগ্রামের অভিজ্ঞতাকে শব্দে-শোণিতে-আবেগে-মননে বাক্সময় করে তুললেন :
১. কমলকে চেন তুমি;
সুন্দর সুঠাম দেহ
প্রদীপ্ত চোখ
দুপুর রোদের মত
তীব্র প্রখর।
একটা বুলেট
কমলের ডান চোখ
ছিঁড়ে নিয়ে গেছে। ( আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ )
২. আমার বুকের রক্তে বাংলার শ্যামল প্লাবিত
যেন কোন সবুজাভা নেই আর, সকল সবুজে
থোকা থোকা লাল রক্ত, আর সেই
সবুজের বক্ষদীর্ণ রক্তের গোলকে
সোনার বাংলার ছবি
মুহূর্তে পতাকা হয়ে দোদুল বাতাসে : (মোহম্মদ মনিরুজ্জামান )
৩. এই তো আমার মুখ ভাইসব, এই তো আমার মুখ!
আমার মুখচ্ছবির মধ্যে এইতো চারজন যুবক প্রবেশ করলো।
কচুরিপানার শিকড়ের মত কালো উজ্জ্বল দাড়ি। দুমড়ানো
পোশাক। যারা সর্বশেষ আহ্বানে হৃদয়ের ভেতর
অস্ত্র জমা রেখেছে। এখন আমার মুখের ভেতর তাদের
গুপ্ত অধিবেশন। যে অতর্কিতে
শহরগুলোকে দখল করা হবে
আমার মুখ তারি রক্তাক্ত পরিকল্পনা। ( আল মাহমুদ )
৩. বাংলার বৃষ্টির ধারাযন্ত্রে
মন্ত্র ঝরে অদ্ভুত বিদ্রোহ অবিরাম
সংগ্রাম।
... ... ...
বাংলার যে কোনো ঘাঁটি ভিয়েতনাম,
আজীবন বিদ্রোহী বিপ্লবী
বাংলার গ্রাম। ( আবুবকর সিদ্দিক )
৪. মধ্য-দুপুরে, ধ্বংসস্তুপের মধ্যে, একটা তন্ময় বালক
কাঁচ, লোহা, টুকরা ইট, বিদীর্ণ কড়ি-কাঠ,
একফালি টিন,
ছেঁড়া চট, জংধরা পেরেক জরো করলো এক নিপুণ
ঐন্দ্রজালিকের মতো যতো
এবং অসতর্ক হাতে কারফিউ শুরু হওয়ার আগেই
প্রায় অন্যমনস্কভাবে তৈরী করলো কয়েকটা অক্ষর
‘স্বাÑধীÑনÑতা’। ( শহীদ কাদরী)
বোধ ও দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতা সত্ত্বেও রক্তে-ঘামে তৈরী স্বদেশ এবং প্রতœস্মৃতির রক্তিম অভিজ্ঞতাপুঞ্জকে এইসব কবি চেতনার কেন্দ্রে স্থাপন করেছেন। এবং সংগ্রামের অভিজ্ঞতা অভিজ্ঞানে রূপান্তরিত হয়ে বিশ্বজনীন সংগ্রাম ও মানবতাবোধে উজ্জীবিত হয়েছেন কবিরা। যুদ্ধোত্তর কয়েক দশকে জাতীয় জীবনে যেসব অভাবিত রাজনৈতিক দুর্যোগ সংঘটিত হয়েছে, তা কেবল জাতীয় জীবনকেই বিপন্ন করেনি Ñ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত সকল গণমুখী মূল্যবোধকেই বিপর্যয়ের সম্মুখীন করেছে। এই পরিস্থিতিতে কবিদের চেতনার রূপান্তরও অনিবার্য হয়ে পড়েছে। রূপান্তরের রক্তাক্ত পরীক্ষায় কেউ উত্তীর্ণ হয়েছেন, আবার কেউ-বা পরিণত হয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত শক্তির বশংবদে। সাইয়িদ আতীকুল্লাহ’র উপলব্ধিতে এই সমাজসত্যেরই ছায়াপাত লক্ষ করা যায় :
ঘৃণিত যারা একাত্তরে তারাই ছলে বলে, কূটকৌশলে
বাজিমাত করার ফিকিরে আছে প্রায় সবখানে
নানা পিশাচের সঙ্গে তারা আজ মিলিয়েছে গলা
দৈর্ঘ্যে প্রস্থে নারকীয় অতি বিকট একটি বাগানে
একাত্তরেও হেস্তনেস্ত হয়নি পুরোপরি সবটা।
শামসুর রাহমানের কবিতায় সময় ও সমাজচৈতন্যের এই র্মমন্তুদ ক্রমধারা সুস্পষ্ট ধরা পড়েছে। যুদ্ধোত্তর সর্বগ্রাসী বিপর্যয়ের কালে তিনি প্রথম পর্যায়ে অন্তর্মুখিতায় নিমজ্জিত হন। জাতিসত্তার প্রতিবাদ ও সংগ্রামের প্রেক্ষাপটে সিসিফাসের মতো জেগে ওঠে তাঁর কবিমন। তিনি অনুভব করেন, “ এ কোন খাঁচায় আছি? চাবি দেয়া পুতুলের মতো / ঘুরি ফিরি, মাথা নাড়ি; ক্লান্ত হলে শিক গুণে গুণে / ঘুমের খাঁচায় ঢুকি।” ( খাঁচা ) আর আল মাহমুদ ‘আস্থা’ হারান ‘মানবিক নির্মাণের প্রতি’। কিন্তু সময় ও জীবনমুখি চেতনা কবি শামসুর রাহমানকে দাঁড় করিয়ে দেয় রক্ত আর মিছিলের স্রোতে। পঞ্চাশের অনেক কবির মধ্যেই এই রূপান্তর সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে নব্বইয়ের গণ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে। শিল্পীর মানস-রূপান্তরের শক্তি-উৎস নিঃসন্দেহে মুক্তিযুদ্ধের অবিনাশী চেতনা।
৫
ষাটের দশকে ঊদ্ভূত কবিবৃন্দ যুদ্ধোত্তরকালে বাংলাদেশের সম্মিলিত কাব্যধারায় ইতিবাচক গতি সঞ্চারে সমর্থ হন। উল্লেখ্য যে, এই সব কবির অধিকাংশই মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। বাংলা কবিতার পালাবদলে মুক্তিযুদ্ধের অবিনাশী অবদানের রূপ ও স্বরূপ এঁদের কবিতা পাঠে অনুধাবন করা যায়। আবেগের তীব্রতায় বিক্ষোভে-প্রতিবাদে, প্রেমে-সংগ্রামে, আসক্তি ও ঘৃণায় যুদ্ধ ও যুদ্ধোত্তর সমাজসত্তার সমগ্র রূপ ধরা পড়েছে এঁদের কবিতায়। এই সংরক্ত চেতনাবাহী কবিদের মধ্যে সিকদার আমিনুল হক, রফিক আজাদ, আবদুল মান্নান সৈয়দ, আসাদ চৌধুরী, মোহাম্মদ রফিক, আহমদ ছফা, মাহমুদ আল জামান, আবু কায়সার, মহাদেব সাহা, হুমায়ুন কবির, নির্মলেন্দু গুণ, মুহম্মদ নূরুল হুদা, আবুল হাসান, হুমায়ুন আজাদ, মাহবুব সাদিক, সাযযাদ কাদির, হেলাল হাফিজ প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। কয়েকটি দৃষ্টান্ত সহযোগে উল্লিখিত কবিদের বোধ ও রূপসৃষ্টির অনন্যতা সন্ধান করা যেতে পারে:
১. কিন্তু শেষ নয় হে মাতৃভূমি
এই ধর্ষিত দেশ থাকবেনা অনাসক্ত
আর স্থিও আতপ্ত বাতাসে। নেকড়ের মুখ থেকে
একটি হরিণ ছানাও অতর্কিতে মুক্ত হয়ে যায় শুনেছি
দেশও হবে Ñ
আমার বাংলাদেশ। ( সিকদার আমিনুল হক )
২. আমার অনেক কিছুই নেই ÑÑ
কিন্তু তাতে আমার কিছু এসে যায় না
আমার কোনো অভাবও নেই
কারণ আমার একটি সুন্দও পতাকা আছে,
এখন আমার শুধূ একটি আগ্নেয়াস্ত্র চাই,
আর কিছু নয়। (রফিক আজাদ )
৩. নারকেল সবুজ পাতার বালির ঢাকা চাঁদেও সোনালি কামান
নিঃশব্দ ওঙ্কাওে গর্জে উঠে তুমুল জ্যোৎস্না ছুঁড়ে মারে
এই চলে সারা রাত
জ্যোৎস্নায় তমসায় বাদানুবাদ
গৃহযুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধে রূপান্তরিত হয়ে যায়। ( আবদুল মান্নান সৈয়দ )
৪. পৃথিবীর ইতিহাস থেকে কলঙ্কিত পৃষ্ঠাগুলো রেখে
চ’লে আসি ক্যানাডার বিশাল মিছিলে স্লোগান সোনাতে।
মানুষের জয় হোক, নিপীড়িত জনগণ জয়ী হোক অন্তিম সমরে।
অসত্যের অন্যায়ের পরাজয়ে খুশি হোক বিশ্বের বিবেক,
পলাতক শান্তি যেন ফিওে আসে আহত বাংলার ঘরে ঘরে

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।





