বহুকাল পূর্বেকার কথা। আমি তখন সবেমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় এ ভর্তি হইয়াছি। অতি নাদান এক পোলা। মুখ দিয়া দুধের গন্ধ আসে। দুনিয়ার হাবভাব তেমন কিছু বুঝি না। আপনাকে লুকাইয়া রাখি, আড়ালে-আবডালে থাকি। জনসম্মুখে মাপিয়া মাপিয়া কথা বলি, টিপিয়া টিপিয়া পথ হাঁটি।
আমাদের ক্লাস আরম্ভ হইতো দুপুর দেড়টায়। এইখানে বলিয়া রাখা প্রয়োজনঃ আমাদের নিজস্ব কোন শ্রেণিকক্ষ ছিলো না, হিসাববিজ্ঞান বিভাগে ক্লাস করিতাম; সেইখানে ক্লাস ফাঁকা না পাওয়া গেলে অর্থনীতি বা ফিন্যান্স বিভাগে ক্লাস করিতে হইতো। আমাদের বিভাগটি নতুন হওয়ায় কিছু অবহেলা সহ্য করিতে হইতো। মধ্যাহ্নভোজ সম্পন্ন করিয়াই ক্লাস অভিমুখে দৌঁড়াইতাম।
আমার মেস হইতে বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রায় দশ মিনিট এর পথ। বেশিরভাগ সময় হাঁটিয়াই যাইতাম। তো সেইদিন মধ্যাহ্নভোজ করিতে বেশ দেরি হইয়া গিয়াছিলো। খুব সম্ভব বুয়া রান্নাবান্না করিতে বিলম্ব করিয়াছিলেন।
পানাহার সম্পাদনপূর্বক বইপত্র লইয়া ক্লাস অভিমুখে দিলাম ভোঁ দৌড়। ক্যাম্পাসে পৌঁছিয়া দেখিলাম দশ মিনিট বিলম্ব হইয়া গিয়াছে। অর্থনীতি, ফিন্যান্স বিভাগে গিয়া দেখিলাম আমাদের কেহ নাই। ভাবিয়া লইলাম হিসাব বিজ্ঞান বিভাগ এ ক্লাস হইতেছে।
যাহা ভাবিয়াছি তাহাই হইলো। হিসাব বিজ্ঞান বিভাগেই ক্লাস হইতেছে। দৌঁড়াইয়া শ্রেণিকক্ষে ঢুকিলাম; বুঝিতে পারিলাম আমার বিলম্ব দেখিয়া মাস্টারমশাই বেশ বিরক্ত হইয়াছেন।
টানা দেড় ঘন্টা ক্লাস হইলো। হঠাৎ নিম্নদেশে প্রচন্ড চাপ অনুভব করিলাম। জলবিয়োগ করা ফরজ হইয়া গিয়াছে। মেস হইতে বের হওয়ার সময়ই বেগ পাইয়াছিলো, সময়ের অভাবে করা হয় নাই। মনে মনে রাগ হইলো এই ভাবিয়া যে, কোন কুক্ষণে এতো জল পান করিয়াছিলাম।
ক্লাস শেষ হয় না। অনুমতি লইয়া বাহিরে যাইবো সেই সাহসও হয় না। শক্ত হইয়া বসিয়া রহিলাম। ক্লাস শেষ হইলেই হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচিবো। পাশের বন্ধুকে বলিলাম, "আমার জন্য দোয়া করো। কোন দুর্ঘটনা যেন না ঘটে। মান-ইজ্জত যেন বজায় থাকে।"
আধা ঘন্টা পর ক্লাস শেষ হইলো। আমার অবস্থা ততক্ষণে কাহিল। স্যার বের হইতেই দৌঁড়াইয়া বাহিরে আসিলাম। বামপাশে ওয়াশরুম। ঢুকিয়া পড়িলাম। হঠাৎ লক্ষ্য করিলাম আমার পাশের টয়লেট হইতে জনৈকা বালিকা বাহির হইতেছে। আমাকে দেখিয়া সে থমকাইয়া দাঁড়াইলো। তখনও আমার কিছু খেয়াল হয় নাই।
সহিসালামতে কাজকর্ম সারিয়া বেশ আরাম পাইলাম। কোন দুর্ঘটনা না ঘটায় খোদাকে ধন্যবাদ দিয়া যখন বাহিরে আসিলাম, দেখি হিসাববিজ্ঞান বিভাগ এর দুইজন আপু আমাকে ডাকিতেছেন। টয়লেট হইতে কিছু দূরেই তাহারা বসিয়াছিলেন।
সম্মুখে যাইতেই এক আপু জিজ্ঞাসা করিলেন, "মেয়েদের টয়লেট এ ঢুকেছেন কেন? এটা যে মেয়েদের টয়লেট জানেন না?"
আমি কী বলিবো; বলিলাম, "জানি না তো।"
"ওই যে বড় করে লেখা আছে দেখুন। অন্ধ নাকি?" আপুটি বলিলেন।
খেয়াল করিয়া দেখি দরজার উপরে বড় বড় অক্ষরে লিখা, "ছাত্রী টয়লেট"।
বড় লজ্জায় পড়িয়া গেলাম; বলিলাম, "খুব সিরিয়াস ছিলো, তাই খেয়াল করি নি।"
আপুটির দয়া হইলো; বলিলেন, "চোখ-কান খোলা রাখবেন।"
আমি "আচ্ছা" বলিয়া কাটিয়া পড়িলাম। চারিপাশে চোখ বোলাইলাম; মনে মনে আপনাকেই জিজ্ঞাসা করিলাম, "আমার এহেন বোকামি কর্মকান্ড কেহ দেখিতে পায় নাই তো?"
না, কেহই দেখিতে পায় নাই। মনটিকে শক্ত করিয়া দ্বিতীয়বারের মতো খোদাকে ধন্যবাদ জানাইয়া অন্য ক্লাসে আসিয়া আসন গ্রহণ করিলাম।
আমার মুখ গোমড়া দেখিয়া জনৈক বন্ধু জিজ্ঞাসা করিলো, "কী খবর?"
যেন কিছুই হয় নাই এমন ভাব ধরিয়া "ভালোই" বলিয়া অন্যদিকে মুখ ফিরাইলাম।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই অক্টোবর, ২০১৮ সকাল ৭:১৪