মানুষের ভাবনা-চেতনা, সব কিছুর যেমন পরিণতি থাকে না, তেমনি কিছু কিছু ঘটনা এ রকমটা ঘটে- যার কোন ব্যাখ্যা থাকে না, হয়তো প্রয়োজন পড়ে না ।
কল্প
সুবিদ বাজার এর একটি নাম করা স্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্র । ক্লাস ফোর পর্যন্ত কল্পের মা তাকে স্কুল থেকে আনা নেওয়া করতো , কিন্ত এখন সে বড় হয়েছে, তাই একা একা যাওয়া আসা করে, কারণ মা বলেছে, সে বড় হচ্ছে,
নিজের দায়িত্ব তাকে নিজে নিতে শিখতে হবে । কল্প তাই মেনে নিয়েছে। কারন, ক্লাস ফোর এ সে তার বাবা কে হারায়। তিনি নিখোজ- কল্প ‘র মা’র ধারণা। এলাকার সকলে বলে, তিনি মৃত। অনেকে বলে থাকে, তার একটি রহস্যময় মৃত্যু হয়েছে। কোন একদিন ভোরে, ফজর এর নামাজ এর জন্য বেরিয়ে , আর কখনো ফিরে আসেন নি।
আর ক্লাস ফোর এর পর থেকে এখন পর্যন্ত নিজের দায়িত্ব নেয়ার মত কঠিন কাজটি করার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে।
আপ্রাণ চেষ্টা করছে, কল্প ’র ধারণা, সে খুব ভীতু ধরনের মানুষ । কিন্তু সে যে আসলে ভিতু, এটা কাউকে জানতে দেয়া যাবে না । নিজের মাঝেই রাখতে হবে । সবাই যদি জেনে যায়, কল্প ভীতু, তবে বন্ধুরা তো তাকে নিয়ে মজা করবেই, সেই সাথে তার বড় ভাই মজা করবে। আর তার সাথে যোগ দিবে বাড়ীর সবাই ।
সময় ৬ঃ৪৫
কল্প’র স্কুলে যাবার সময় হয়ে গেছে, সে ঘুম থেকে উঠে তৈরি হয়ে গেছে । নাস্তার জন্য টেবিল এ এসে দেখলো টেবিলে নাস্তা নেই । মাকে ডাকতে যাবে ,ওমনি বসার ঘরের সোফায় ... মাকে সে ঘুমিয়ে থাকতে দেখলো ।
কল্প’র খুব মায়া হল মাকে এভাবে ঘুমুতে দেখে ।
কল্প হাঁটছে , স্কুলের পথে ।
এই পথ কল্প ‘র খুব পরিচিত । যাওয়ার পথে সবুজে ঘেরা,একটা ছোট টিলার মত একটা জায়গা পড়ে । যাকে এলাকার লোকজন বলে, “মরা টিলা” । লোকজন এখানে তেমন আসেন না, কেন না, এই টিলা নিয়ে নানা লোকে নানান্ গল্প বলে ।
সব কয়টি ই ভয়ানক গল্প । কল্প ‘র যখন ৬ বছর বয়স, তখন সে তার বাবার সাথে এখানে এসেছিল একবার। কিন্তু আসার পর এর ঘটনা আর তার মনে নেই। তবে সে স্পষ্ট মনে করতে পারে, সে এখানে এসেছিল, বাবার সাথেই এসেছিল ।
হঠাৎ কে যেন ডেকে ঊঠলো , “ কল্প !”
কল্প আড় চোখে টিলার দিকে একবার তাকালো, কোথাও কেউ নেই , আর সাথে সাথে তার সমস্ত শরীর অজানা আতঙ্কে শিউরে ঊঠলো । সে হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিল ... ... স্কুলের পথে । একবার মনে হল পিছন ফিরে তাকাবে, কিন্তু আর সাহস পেল না ।
কল্প হাটছে, তার কাছে আজ মনে হচ্ছে, পথ যেন আর শেষ হচ্ছে না। আর খুব ক্লান্ত লাগছে, ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো, সময় ৬ঃ৫৫ । তাকে আরো দ্রুত যেতে হবে, কারন আর ৫ মিনিট এর মধ্যে না পৌছালে , স্কুলে আর ঢুকতে দেয়া হবে না। কিন্তু কল্প যত দ্রুত হাটার চেষ্টা করছে, ততই যেন তার মনে হচ্ছে, তার পায়ের সাথে কোন ভাড়ী কিছু বাধা আছে, হাটতে খুব কষ্ট হচ্ছে । তবু কল্প হাঁটছে । কল্প বুঝতে পারছে,সে আপ্রান চেষ্টার পরও হাটার গতি বাড়ছে না, বরং কমছে ।
ক্লান্তি যেন কিছুতেই ছাড়ছে না কল্প কে। তার মনে হচ্ছে, একটু বসে নিতে হবে, ওদিকে আবার স্কুলে দ্রুত পৌছাতে হবে, কিনতু একটূ বিশ্রাম না নিলে, আর যাওয়া হবে না তার। তাই কল্প একটু বসলো । ব্যাগ থেকে পানি বের করে, গট গট করে সব গূলো পানি খেয়ে নিলো কল্প । একটু থামলো না।
কল্প পানি খেতে খেতে নিজেই অবাক হল, এই ভেবে যে, এভাবে করে এক টানে পানি সে কখনই পান করে নি ।
হঠাথ করে কল্প’র কাছে নিজেকে অপরিচিত মনে হতে লাগলো । কল্প সমস্ত চিন্তা বাদ দিয়ে, উঠে দাড়ালো ।
আবার হাটা শুরু করবে স্কুলের পথে , কিন্তু সে এবার পা নাড়াতে পারছে না। হয়তো বেশ ক্লান্ত , তাই পারছে না।
আবার চেষ্টা করলো হাঁটার । নাহ, এবার পারলো না।
ভারী বিপদ হয়ে গেল দেখি । কল্প ঘড়ীর দিকে তাকালো , সেকি !
ঘড়ি থেমে আছে ৬ঃ৫৫ তে । যে পরিমান সময় গিয়েছে , তাতে মনে হচ্ছে এক ঘণ্টার উপরে পার হয়ে গেছে এখানে । কল্প শেষ বারের মত চেষ্টা করলো, সামনে পা বাড়ানোর ।
কিন্তু সম্ভব হল না। পিছনে ফিরে তাকানোর মত সাহস সে পাচ্ছে না, কারন পিছনে ফেলে এসেছে ঘন সবুজে আচ্ছন্ন টিলা, যার রহস্য আজ পর্যন্ত কেউ জানে না ।
কি করবে বুঝতে পারছে না। সাহস করে পিছনে তাকাবে কি না ভাবছে সে । আশে পাশে কোথাও কাউকে দেখা যাচ্ছে না। খুবই অবাক করা ঘটনা ঘটছে । আজ তো মঙ্গলবার ৩রা আগস্ট । শামসুল স্যার এর ক্লাস এ পরিহ্মা হবার কথা। এমনটা কখনই ঘটে নি কল্প’র সাথে যে সে পরিক্ষায় অনুপস্থিত । ভেবেই বেশ অস্থির বোধ করতে লাগলো সে ।
হঠাৎ তার বুকে ধক করে উঠলো । না , এটা হতে পারে না। এ কি করে সমস্ত শরীর জুড়ে তার এক প্রকার শিতল স্রোত বয়ে গেল । কানে যেন চি করে একটা বায়ু শূন্য আওয়াজ হতে লাগলো ।
আজ ৩রা মে । কল্প’র বাবা’র নিখোঁজ হবার দিন ... অথবা মৃত্যু দিবস...
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৬ দুপুর ২:৫১