somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ইতি- আপনার শিউলি লতা

১৪ ই মার্চ, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:০৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



বিধান বাবু বাড়ি ফিরেই দরজায় খিল দিয়ে ঝিম মেরে বসে আছেন। সুধা সন্ধ্যা অব্দি কড়া নেড়ে শেষমেষ হাল ছেড়ে ঠাকুর ঘরে চলে গিয়েছে সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালতে। খুট করে ও ঘর থেকে দরজা খোলার আওয়াজ এলো। সুধা তড়িঘড়ি করে খাবার থালা নিয়ে ছুটে গেল। বিধান বাবু সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ না করে ছাতাটা নিয়ে বাইরে চলে গেলেন।
প্রচন্ড বৃষ্টি বাইরে। আজ পড়াতে না গেলেও হতো। কিন্তু মেয়েটাকে আজ কিছু কড়া কথা না বললেই নয়।

বিধান বাবুর বয়স ৪০ এর কোঠায়। মাথায় কাঁচা-পাকা চুল, রোগা শরীরে সাদামাটা চেহারায় বোকা বোকা হাসি। তিনি 'নয়ারহাট সরকারি হাইস্কুলের' বাংলার শিক্ষক। স্ত্রী সুধারানীকে নিয়ে এই মফস্বলে বাস করছেন বেশ কয়েক বছর ধরে। এখন শেষকালে এসে যদি কোনো কেলেঙ্কারি ঘটে, তার দায় বইতে পারা সহজ হবে না। এই চিন্তায় তার শুকনা মুখখানি যেন আরো শুকিয়ে গেছে। কোনো সন্তান-সন্ততি নেই এই দম্পতির। একটি ছেলে হয়েছিল বিয়ের বছর তিনেক পরে। মাস ছয়েকের মাথায় বিধাতা তাকেও ডেকে নিলেন। তবু স্ত্রীকে বিধান বাবু বড় ভালোবাসেন। সুধা তেমনি এক মেয়ে, আঠারো বছর তারা এক সাথে ঘর করছে। অথচ এমন খুব কম রাতই কেটেছে, সুধা স্বামীর কোলের কাছে কুন্ডলী পাকিয়ে শোয় নি। তবে গত রাতে স্বামী-স্ত্রীতে এক দফা কথা কাটাকাটি হয়েছিল। কথাসূত্রেই সুধা কিছু কটু কথা শুনিয়ে দিয়েছিল স্বামীকে। সেই ক্ষোভে সকালেও বিধান বাবু স্কুলে গেলেন খালি মুখে, দুপুরেও বাড়ি ফিরে সেই সন্ধ্যা পর্যন্ত খিল এটে বসে রইলেন। ঝগড়ার বিষয়বস্তু ছিল একটি চিরকুট। লেখা ছিল,

"স্যার বাবু, আমার শরীরটা ভালো না। আমার বিশ্বাস আপনি আর একবার ছুঁয়ে দিলেই সুস্থ হয়ে যাবো।"
ইতি,
আপনার শিউলি লতা

চিঠিখানি সুধাকে দিয়ে গেছে ছোট্ট শাকুর; শিউলির ছোট ভাই। শিউলি এবার দশম শ্রেণীতে। ওইটুকুন মেয়ের এই ধরনের কথার কি মানে থাকতে পারে সেই ভেবে সুধা সেদিনকার সব কাজ-কর্ম চুলায় দিল। স্বামীকে সে অবিশ্বাস কখনোই করে না। কিন্তু পুরুষকে কি ভরসা! একে তো তার ছেলেপুলে নাই। তাই বলে কি শেষমেষ মুসলমানের মেয়ের সাথে? না না, এমন কাজ তার স্বামী কখনোই করবে না। সে ব্রাহ্মণের ছেলে। জাত-গোত কি তবে ওই টুকুন মেয়ের কাছে বিলিয়ে দিতে পারে? তাদের নিজের মেয়ে থাকলেও তো এতো দিনে এমন ডাগরই থাকতো। সেদিন পুরো ভোর-সন্ধ্যা সাত-পাঁচ ভেবে কোনো দিশা বের করতে পারলো না সুধা। শেষটায় রাত্রে শুতে গিয়ে স্বামীকে একের পর এক প্রশ্নবিদ্ধ করতে লাগলো। কিন্তু বিধান বাবু তেমন গা দেখালেন না এ ব্যাপারে। ঠিকঠাক উত্তর না পেয়ে সুধার মনের খুঁতখুঁতে ভাব যেন আরো বহুগুণ বেড়ে গেল। সেই থেকেই গোলযোগ।
এখন আবার এই ঝড়-বাদলার মধ্যে ওই মেয়েটিকে পড়াতে চলে গেল না খেয়ে। এতো টান সেই মেয়ের প্রতি? নাহ্ সুধা আর ভাবতেই পারছে না!
.
বিধান বাবু শিউলিকে আজ কি কি বলবেন, সব মাথায় সাজিয়ে নিতে লাগলেন। রাস্তায় পানি জমে গেছে এরই মধ্যে। কাদায়-পানিতে মাখামাখি অবস্থা তার। সেইদিকে তার মোটেই খেয়াল নেই। নানান রাজ্যের ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছে তার মাথায়। এমন একটা অদ্ভুত চিঠি শিউলি কেন পাঠালো তাকে? কি বোঝাতে চেয়েছে সে? এমনও তো হতে পারে, অন্য কাউকে দিতে বলেছিল হয়তো, শাকুর ভুলে তার বাড়িতে দিয়ে গেছে। শুধু শুধুই হয়তো ভাবছেন তিনি। তার মত আধবুড়ো লোকের প্রতি শিউলির আর কি-বা মনোভাব থাকতে পারে!!
ছাতাটা বন্ধ করে দরজায় কড়া নাড়লেন তিনি। কাকভেজা হয়ে গেছেন একদম। ভেতর থেকে গামছা হাতে দরজা খুলে দিল শিউলি। শিউলির গায়ের রঙটা অস্বাভাবিক ফর্সা হওয়ায় সৌন্দর্যটা ঠিক ধরা পরে না, কিন্তু মেয়েটার চোখে মেঘমুক্ত আকাশে তারার দীপ্তি। বিধান বাবু জোর করে শিউলির চোখ থেকে নিজের চোখটা সরিয়ে নিলেন। গামছাটা নিয়ে গা-টা মুছে টেবিলের ওপাশের চেয়ারে গিয়ে বসলেন। শিউলি এক কাপ চা এনে টেবিলের উপর রেখে বিধান বাবুর মুখোমুখি বসলো। বিধান বাবুর মুখ স্বাভাবিকের থেকে অনেক গম্ভীর আজ। অথচ শিউলি মাথা নত করে মুখ টিপে হাসছে।
বিধান বাবু চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়ে বললেন, "তুমি এটা কেন করলে শিউলি লতা? চিঠিটা কাকে দিতে চেয়েছিলে?"

শিউলি এতোক্ষণে চোখ তুললো। ফিক করে হেসে দিয়ে বললো, "আপনাকেই স্যার বাবু।"

অপ্রস্তুত হলেন বিধান বাবু "তুমি লিখেছো তোমার শরীর খারাপ। তোমাকে দেখে তো অসুস্থ মনে হচ্ছে না"।

"কপালে হাত ছুঁইয়ে দেখুন। গা গরম।" চটজলদি জবাব দিল শিউলি।

বিধান বাবু হঠাত থতমত খেয়ে গেলেন যেন। কি বলবেন কিছুই ভেবে পেলেন না। শিউলি এবার খিলখিল করে হাসছে। তীব্র চাঁপা ফুলের গন্ধে চারপাশটা যেন ভেসে যাচ্ছে। পাশের ঘর থেকে চাপা গর্জনে শিউলির মা বলে উঠলেন, "আল্লাহ মাইয়াটারে হেদায়েত দ্যাও"। বিধান বাবু কেমন একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেলেন।
এইতো কিছু দিন আগে মাথার দু পাশে কলা বিনুনী করা এই ছোট মেয়েটি হেডমাস্টারের কাছে নালিশ করে এল যে, সে ক্লাসে ভালো বুঝতে পারে না; বিধান বাবু যেন তাকে বাড়ি এসে পড়ায়। মেয়েটির পড়ার মাথা ভালো। হেডমাস্টারের কথায় বিধান বাবু তাকে পড়াতে আসেন সপ্তাহে চার দিন। সেই প্রথম দিন যখন ওকে পড়াতে আসেন, শিউলি সেদিন কচি কলা পাতা রঙের একটা শাড়ি পড়েছিল। ঠিক এভাবেই মুখ টিপে হাসছিল। বিধান বাবুর সব কিছু স্পষ্ট মনে আছে। কিন্তু এই মেয়েটির সব খুঁটিনাটি মনে রাখার কোনো প্রয়োজন ছিল কি? সে তো কেবল তার ছাত্রী। ঘরে তার সুন্দরী স্ত্রী আছে, চাহিদার সবটুকুই তো মেটায় সে। তবে কেন..

হঠাত সম্বিৎ ফিরে পেলেন বিধান বাবু। পায়ের উপর আলতো চাপ অনুভব করলেন। "শিউলি এ ঠিক নয়। তুমি চিঠিতে মিথ্যা বলেছো। আমি তোমাকে স্পর্শ করি নি। আর একবার ছুঁয়ে দেবার কথা আসলো কেন তবে?"

শিউলি কন্ঠস্বর নিচু করে উত্তর দিল, "স্পর্শ করেন নি এ কথা ঠিক। তবে স্পর্শ করতে তো আমাকে বাধা দেন নি। এই মাত্রও দিলেন না।"

"আমি বিবাহিত, গোত্রে মিল নেই। তোমার বয়স অল্প। আমি তোমায় কষ্ট দিতে পারি না। এসব অন্যায়। আমি আমার স্ত্রীকে ভালোবাসি। তার অনুগত থাকতে চাই।" বিধান বাবু মুখস্থের মত বলে গেলেন।

শিউলি একটু সামনে ঝুকে এলো, "আমাকে? আমাকে ভালোবাসেন না?"

কন্ঠ দৃঢ় করতে চাইলেন বিধান বাবু "তুমি আমার ছাত্রী, তোমার বয়স কম। এসব..."

বাঁধা দিল শিউলি, "ভালোবাসেন?"

"বাসি"-চোখ নামিয়ে নিলেন বিধান বাবু। মাথা নত করে ফেললেন। মনে হল কথাটা স্বীকার করে বড় ভুল হয়ে গেছে। নিজেকে খুব তুচ্ছ মনে হলো তার। তিনি কি তবে প্রতারক, সুযোগ-সন্ধানী?

"চিঠিটা আমি ইচ্ছে করেই সুধা দিদিকে দিতে বলেছি। আমার অন্যায় হয়েছে।" গলা কেঁপে উঠলো শিউলির। ছলছল চোখের তারা দুটি মুহূর্তে যেন দপ করে নিভে গেল। বিধান বাবু কি ভেবে শিউলির শীর্ণ হাত দুটো শক্ত করে নিজের মুঠোয় ধরলেন। সত্যিই প্রচন্ড জ্বর মেয়েটার গায়ে। পায়ের উপর আলতো চাপ অনুভব করলেন বিধান বাবু। বিদ্যুৎ খেলে গেল তার সমস্ত সত্ত্বা জুড়ে।

ওই সব দিনগুলোতে চাঁপা ফুলের মিষ্টি গন্ধটা বিধান বাবু শিউলি কাছে থাকলেই পেতেন। এখনো মাঝে মাঝে সুধাকে আদর করবার সময় শিউলিকে মনে পড়ে যায়। ষোল-সতের বছর বয়সী এক তরুণী গামছা হাতে দাড়িয়ে আছে, রোগা মতন মুখে চোখ দুটো জ্বলছে, ডান পাশের বিনুনীটা পিঠের উপর ঠেলে দিয়ে মুখ টিপে হাসছে। শীর্ণকায় ফ্যাকাশে বর্ণের সরল সেই মেয়েটিকে মাথা থেকে দূর করবার তীব্র প্রচেষ্টা থেকেই মস্তিষ্কের নিউরনে নিউরনে তখন চাঁপা ফুলের গন্ধটা আরো প্রকট হতে থাকে। সঙ্গম ছেড়ে উঠে বসেন বিধান বাবু। সুধা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে হাতড়ে দিয়াশলাইটা খুঁজে দেয়। বিধান বাবু সিগারেট জ্বালেন জানালার কাছে গিয়ে।
নয়ারহাট ছেড়ে এসেছেন বহু দিন হল। এই নতুন শহরের স্বল্প ভাড়ার ছোট্ট ঘরটিতে জানালা অনেক বড়। জানালা দিয়ে রাতের তারাগুলো দেখতে বড় ভালো লাগে, শিউলির চোখের তারার মতন জ্বলজ্বল করে ওরা, হয়তো শিউলি ওদের মধ্যেই লুকিয়ে আছে। পেটের ভারে পেছন দিকে হেলে পড়া শিউলি লতা এই জানালাটি ধরে দাড়িয়ে থাকতে খুব ভালোবাসতো।
আচমকা শিশুর কান্নার শব্দে ভাবনায় ছেঁদ পড়লো বিধান বাবুর। তিনি কন্যার নাম রেখেছেন 'চাঁপা'। অবিকল শিউলির মত দেখতে চৌদ্দ মাস বয়সী শিশু কন্যাকে বুকে জড়িয়ে শান্ত করার চেষ্টা করে সুধারাণী....
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই মার্চ, ২০১৬ রাত ৯:০৩
৭টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

লালনের বাংলাদেশ থেকে শফি হুজুরের বাংলাদেশ : কোথায় যাচ্ছি আমরা?

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:১৪



মেটাল গান আমার নিত্যসঙ্গী। সস্তা, ভ্যাপিড পপ মিউজিক কখনোই আমার কাপ অফ টি না। ক্রিয়েটর, ক্যানিবল কর্পস, ব্লাডবাথ, ডাইং ফিটাস, ভাইটাল রিমেইনস, ইনফ্যান্ট এনাইহিলেটর এর গানে তারা মৃত্যু, রাজনীতি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

অভিনেতা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:১৫



বলতে, আমি নাকি পাক্কা অভিনেতা ,
অভিনয়ে সেরা,খুব ভালো করবো অভিনয় করলে।
আমিও বলতাম, যেদিন হবো সেদিন তুমি দেখবে তো ?
এক গাল হেসে দিয়ে বলতে, সে সময় হলে দেখা যাবে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪১


প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি! চুরি! সুপারি চুরি। স্মৃতি থেকে(১০)

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৪


সে অনেকদিন আগের কথা, আমি তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। স্কুলে যাওয়ার সময় আব্বা ৩ টাকা দিতো। আসলে দিতো ৫ টাকা, আমরা ভাই বোন দুইজনে মিলে স্কুলে যেতাম। আপা আব্বার... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:২৬


আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×