somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নিকিরা, রাজকন্যার বন্ধু ও আমার বিপন্ন বিস্ময়

১৮ ই জুলাই, ২০১৩ রাত ১২:০০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


নিকিরা, ল্যাটিন আমেরিকার ছোট্ট দ্বীপ সেন্ট ভিনসেন্টের মিষ্টি মেয়ে । রাজকন্যার সমান বয়সী, ওর মা কামেসিয়া single mother । মেয়ে আর এক বছরের ছোট্ট ছেলে জেরীকে নিয়ে সংগ্রামী জীবন কামেসিয়ার ! কিন্তু সবসময় মিষ্টি হাসি লেগে আছে কামেসিয়ার ঠোঁটে, মুখে । অনেক কষ্ট বুকে নিয়েও কেউ মৃদু হাসি দিয়ে তার দু্র্নিবার কষ্টকে সমাহিত রাখতে পারে তেমন মানুষ খুব কমই আছে, আমার গল্পের নায়িকা কামেসিয়া তাদের একজন ।

নিকিরা আমার রাজকন্যার সদ্য শুরু হওয়া স্কুল জীবনের প্রথম ও নিবিড় বন্ধু ।ওরা হাত ধরধরি করে হাটে, হাসে, আনন্দে উল্লাসে মেতে ওঠে একসাথে । স্কুল বাসেও হাত ধরাধরি করে ওঠে । একজন আর একজনের জন্য অপেক্ষা করে পরম মমতায়, তারপর একসাথে নামে বাস থেকে । বাস থেকে নেমে যখন দুরন্ত দুবাহু বাড়িয়ে রাজকন্যা ছুটে আসে আমার দিকে, কামেসিয়া তখন তাকিয়ে দেখে উদাস দৃষ্টিতে আনমনে...ওর চোখের কোনে লেগে থাকা চিক্ চিক্ অশ্রুবিন্দু আমাকে কৌতুহলী করে..আমার কৌতুহল আর সহমর্মিতায় ও ভীষন আর্দ্র হয়ে ওঠে । সারল্য ভরা হাসি ওর দু ঠোঁট বেয়ে ঝরে পড়ে । আমার কৌতুহলের মুখোমুখী দাঁড়িয়ে ও বলে, " তোমার রাজকন্যার তোমার বুকে ছুটে যাওয়ার মুহূর্তে আমি আমার নিকিরাকে কল্পনা করি... আলী তোমাকে আমার সব গল্প বলবো...তুমি লিখবে কথা দাও..যেন আর কোন কিশোরী আমার মত প্রতারিত না হয়, ওদের সন্তানের বাবারা যেন জীবিত হয়েও মৃত না হয় আমার নিকিরা জেরীর মত !! আমি ওকে কথা দিয়েছি লিখবো একজন নিকিরার মায়ের প্রতারিত হবার গল্প !

মন্ট্রিয়লে ওদের বাস পাঁচ বছর । সময়ের ব্যাপ্তিতে কম হলেও নিঃসঙ্গ প্রবাস জীবনের নিরিখে এক দীর্ঘ সময় । ওরা আমাদের সুপ্রতিবেশী ও আমার Tax client । ওকে বহনকারী American Air lines যখন কানাডার ভুমি স্পর্শ করে কামেসিয়া মাত্র চৌদ্দ বছরের কিশোরী..প্রেমিকের হাতে হাত, দুরু দুরু বুক, চোখে নিঃসীম স্বপ্ন...বিশ্বের ধনী দেশের লোভী হাতছানী আর রঙীন স্বপ্নের ঘোরে ভাসতে থাকা ক্যামেছিয়া তখনও জানে না কি দুঃস্বপ্ন ওৎ পেতে আছে ওর জন্যে...!

ওর প্রেমিক ও দালালের ভালবাসার ছোঁয়া ( যেটা এখন ওর কাছে ধর্ষনের নামান্তর ) নানান স্বপ্নের জাল বোনা পর্বের হঠাৎ সমাপ্তি চকিতে ওকে বুঝিয়ে দিল ও ব্যবহৃত হবে ও হচ্ছে । ল্যাটিন আমেরিকার দারিদ্র প্রপীড়িত দেশ নিকারাগুয়া, চিলি, বলিভিয়া, মেক্সিকো, আফ্রিকার সাদ, সোমালিয়া, সেনেগাল, সুদান, এথিওপিয়া সহ বিশ্বের দরিদ্র দেশ থেকে দালাল ধরে আসা মেয়েরা এরকম বিপনন যোগ্য পণ্য হয়ে নানান হাত ঘুরতে থাকে । কামেসিয়াও তাদের একজন। এভাবে নানা হাত ঘুরতে থাকা প্রতিবাদী কামেসিয়াকে ফেলে পালালো প্রেমিক প্রবর ! শেষ পর্যন্ত YMCA হলো কামেসিয়ার জীবনের পরম আশ্রয় । মানবিক সংগঠনের সহায়তায় humanitarian category-তে কানাডা হলো তার স্হায়ী নিবাস ।

একদিন কামেসিয়ার ডাক্তার আপয়েন্টমেন্ট থাকাতে ওর অনুরোধে আমার মেয়ের সাথে নিকিরাকেও আমাদের বাসায় নিয়ে আসি । সেদিন ওঁরা দুজন একসাথে খেলেছে, খেয়েছে । হঠাৎ দরজায় আজ (২৮-৯-২০১১) দুপুরে অসহিষ্ণু করাঘাত ও কলিং বেলের শব্দে উৎকন্ঠিত আমি জরুরী ফোনালাপের মাঝখানে দরজা খুলে দেখি উৎভ্রান্ত চেহারায় কামেসিয়া ! তার বিনীত আবেদন, " বন্ধু তুমি কি আমার নিকিরাকে স্কুল বাস থেকে আনতে পারবে তোমার মেয়েকে আনবার সময় ?" আমি জরুরী কিছু আঁচ করে সহাস্য সম্মতি দিলাম । পরের দিন সকালে ধন্যবাদ দিয়ে সে নিজেই জানালো তার বয় ফ্রেন্ড (Nikirar বাবা ) তাকে সামান্য টিভি চ্যানেল দেখা নিয়ে আঘাত করেছে যার ক্ষত চিহ্ন আমারও চোখ এড়ায়নি । সে ৯১১ কল করে পুলিশ ডেকেছিল । পুলিশের জন্য অপেক্ষা করার কারনে সে আমার সাহায্য চেয়েছিল । আজকে নাকি তার বয় ফ্রেন্ড আবার ফোন করে পটাতে চেয়েছিল " আজকে নুতন দিন. " অপমানে ক্ষুব্ধ কামেসিয়া স্পষ্ট জানিয়েছে " আমি তোমাকে এই চার সীমানার মধ্যে দেখতে চাই না " কামেসিয়া আরও বললো ' প্রথম থেকেই ও এরকম হিংস্র আচরণ করতো "এখানকার নিয়ম অনুযায়ী কোর্টএর রায়ে ওর বয় ফ্রেন্ডকে তার মেয়েকে দেখতে হলে বাড়ির বাহিরে কোন নির্দিষ্ট জায়গায় দেখতে হবে । আমি বললাম তুমিতো একাই থাকো ওকে কেন পাত্তা দিচ্ছ ? জবাবে আমাকে যা জানালো তার সারমর্ম এরকম "নিকিরা একজন বাবা চায়, ওকে কি করে বঞ্চিত করি !?" কামেসিয়াকে দেখে অসহায় বাঙালি মায়ের প্রতিচ্ছবি মনে হোল । নারীদের মাতৃত্ব তাদেরকে কতখানি অসহায় আর নির্ভর করে দেয় কামেসিয়াকে দেখে নির্বাক বিস্ময়ে সেটা নুতন করে আবার উপলব্ধি করলাম । এই বয় ফ্রেন্ড নাম ফ্রেন্ডলী হলেও সে মোটেও friendly নয় । নিকিরাকে দেখতে আসার সুযোগে জৈবিক দায়িত্ব ছাড়া পিতৃত্ত্বের আর কোন দায়িত্ব সে পালন করেনি ; দীর্ঘ দিনের তথাকথিত দাম্পত্য সম্পর্কও তাকে এতটুকু নিরাপত্তা বলয়ে সুরক্ষিত করেনি । দীর্ঘ শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনে দ্রুত ক্ষয়ে যাওয়া কামেসিয়া নিঃসঙ্গ শূন্যতার হাহাকারে তাই খুঁজেছে এতটুকু মমতার ছোঁয়া...বয়সে অপেক্ষাকৃত তরুন দ্বিতীয় বয় ফ্রেন্ড আঞ্জেস তাই সহমর্মিতা দিয়ে তার ক্ষতে কিছুটা হলেও নিরাপত্তার মলম বুলিয়েছিল ।

গত সপ্তাহে আমার নুতন বাড়িতে যাওয়ার চুক্তি পত্রে সই করলাম । কামেসিয়ার কাছে এতদিন গোপন রেখেছি ইচ্ছাকৃতভাবে ।

আজ কথা প্রসঙ্গে মুখ ফসকে বেরিয়ে গেলো । মনে হলো ও যেন হঠাৎ তড়িৎতাহত হয়েছে । এতদিনে তৈরি হওয়া নির্ভরতার সাঁকোতে চিড় ধরার মতো ধরা গলায় জানালো আমার অসুখ হোলে কাকে অনুরোধ করব বল মেয়েটাকে স্কুল বাস থেকে আনতে? আমি আশার আলো ছড়িয়ে বললাম আমার চেয়ে ভালো কোন বন্ধু পেয়ে যাবে । অনেকটা আশাহতের মত শোনাল ওর কণ্ঠ ! খানিকটা হতাশ ভঙ্গিতে বলল আমার এই অল্প জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতায় ভাল বন্ধু দুর্লভ মনে হয়েছে । অধিকাংশ বন্ধুই বন্দুক হয়ে গেছে ! বুঝলাম আমার আশার আলো ছড়াতে ব্যর্থ হয়েছি । বিষন্ন হাসি মিলিয়ে গেল ওর দু ঠোঁটের কোনে...আমি দ্রুত আশ্বস্ত করে বললাম আমার দরজা সবসময় তোমার জন্য অবারিত...তোমার নিকিরা চাইলেই বেড়াতে নিয়ে আসতে পারো ..

কামেসিয়া তার দ্বিতীয় boyfriend এর মা হতে যাচ্ছে ! অদ্ভুত ভালোবাসার পাঁচ মেশালি জীবন কামেসিয়ার । এই সন্তান সে চাইনি, কিন্তু এখানেও সেই পুরুষের প্রভুত্ত্বকামী ভালবাসার কাছে বার বার পরাজিত কামেসিয়া । তার নুতন বয় ফ্রেন্ড সোজা জানিয়েছে সে এই সন্তানের দায়ভার নিতে পারবে না...সে নুতন গার্ল ফ্রেন্ড এর সান্নিধ্য সুখে বিভোর. পাল্টা বয় ফ্রেন্ড খোঁজা নিঃসঙ্গ মা কামেসিয়ার বন্ধনহীন দায়হীন সংসারের এই বোধকে আমি আজ পর্যন্ত ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি । ক্রমাগত প্রবঞ্চিত কামেসিয়ার জীবনে এভাবেই দিন যায় দিন আসে । নুতন নিকিরা পুরাতন কামেসিয়া হয়ে তার জায়গা দখল করে ! ওরা ভেসে যায় জীবন জীবিকার প্রয়োজনে, নুতন boyfriend এর সন্ধানে...

নিকিরার জন্মদিনের দাওয়াতে গিয়ে ফেরার সময়ে একটা দৃশ্য আমাকে বেশ হতচকিত করেছে । কামেসিয়া সবসময় বলতো নিকিরা ওর বাবাকে খুব ভালোবাসে । জন্মদিনে ওর বাবা এসেছে দরজার বাইরে দাড়িয়ে, ভেতরে ঢোকার আইনগত বাধা তাই...নিকিরা তার বাবার কোলে ছুটে গিয়ে ওই যে বুকে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে সুরু করল..বাবা মেয়ের এই বিষাদ করুন মিলন দৃশ্য অন্য কোলে ছেলে জেরী .আমার বিদায় মুহূর্তেও সে কান্না না থামায় পরিবেশটা অনেকটা হরিষে বিষাদের মত মনে হল । স্কুলে একদিন নিকিরার মাকে দেখলাম, কারন শ্রেণী শিক্ষিকা ডেকেছেন নিকিরা ক্লাস এ কোন কথা শোনে না । আমি বললাম (নিকিরাকে শুনিয়ে )নানা ওতো অনেক লক্ষী মেয়ে । শুনে নিকিরা দুষ্টামি মাখা মিষ্টি হাসি দিল। আমার সাথে নিকিরার বেশ ভাব হয়ে গেছে । মাঝে মাঝে চুপি সারে নানা আবদার নিয়ে হাজির হয় । বাবা মায়ের কলহের বলি নিকিরার ছোট্ট নিষ্পাপ হাসি আর জেদি একরোখা আচরণ আমাকে ভাবায় ব্যথিত করে...।

আজ আমার শেষ দিন , নুতন বাড়িতে যাবার বাক্স পেঁটরা গোছানোর তদারকিতে কামেসিয়াদের কথা কিছুটা ভুলেই গিয়েছিলাম । হঠাৎ আমার দরজায় ডুকরে কেঁদে উঠা শিশুর কান্নায় সচকিত আমি দরজা খুলেই হতভম্ব ! ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকা নিকিরাকে নিয়ে ওর মা নির্বাক দাঁড়িয়ে...আমার দৃষ্টি বিপন্ন...আমার বিস্ময় বিপন্ন !!



সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই জুলাই, ২০১৩ রাত ১২:০০
৩টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অপরূপের সাথে হলো দেখা

লিখেছেন রোকসানা লেইস, ১৪ ই মে, ২০২৪ রাত ১:৩৫



আট এপ্রিলের পর দশ মে আরো একটা প্রাকৃতিক আইকন বিষয় ঘটে গেলো আমার জীবনে এবছর। এমন দারুণ একটা বিষয়ের সাক্ষী হয়ে যাবো ঘরে বসে থেকে ভেবেছি অনেকবার। কিন্তু স্বপ্ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমরা কেন এমন হলাম না!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪১


জাপানের আইচি প্রদেশের নাগোইয়া শহর থেকে ফিরছি৷ গন্তব্য হোক্কাইদো প্রদেশের সাপ্পোরো৷ সাপ্পোরো থেকেই নাগোইয়া এসেছিলাম৷ দুইটা কারণে নাগোইয়া ভালো লেগেছিল৷ সাপ্পোরোতে তখন বিশ ফুটের বেশি পুরু বরফের ম্তুপ৷ পৃথিবীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অভিমানের দেয়াল

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:২৪




অভিমানের পাহাড় জমেছে তোমার বুকে, বলোনিতো আগে
হাসিমুখ দিয়ে যতনে লুকিয়ে রেখেছো সব বিষাদ, বুঝিনি তা
একবার যদি জানতাম তোমার অন্তরটাকে ভুল দূর হতো চোখের পলকে
দিলেনা সুযোগ, জ্বলে পুড়ে বুক, জড়িয়ে ধরেছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি

লিখেছেন প্রামানিক, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



২৬শে মার্চের পরে গাইবান্ধা কলেজ মাঠে মুক্তিযুদ্ধের উপর ট্রেনিং শুরু হয়। আমার বড় ভাই তখন ওই কলেজের বিএসসি সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র ছিলেন। কলেজে থাকা অবস্থায় তিনি রোভার স্কাউটে নাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিকেল বেলা লাস ভেগাস – ছবি ব্লগ ১

লিখেছেন শোভন শামস, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৪৫


তিনটার সময় হোটেল সার্কাস সার্কাসের রিসিপশনে আসলাম, ১৬ তালায় আমাদের হোটেল রুম। বিকেলে গাড়িতে করে শহর দেখতে রওয়ানা হলাম, এম জি এম হোটেলের পার্কিং এ গাড়ি রেখে হেঁটে শহরটা ঘুরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×