somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমার মাদকাসক্ত জীবন-(শেষ পর্ব)

২৩ শে ডিসেম্বর, ২০০৮ দুপুর ১২:০২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমার মাদকাসক্ত জীবন-(শেষ পর্ব)

অনেক নেশা নিয়ে কথা বলা হলো। তাৎক্ষণিকভাবে যা মনে এসেছে তাই লিখেছি। পরে পড়তে গিয়ে মনে হয়েছে, কত কিছুই না বাদ থেকে গেছে। যেটুকু থেকে গেছে, থেকে যাক মনের মুকুরে। কোনো একদিন হয়ত তা আবারো ফুল হবে, পাখি হবে, কথা বলবে। তবে একটা বিষয় জানানো জরুরি মনে করছি তা হলো, কেন আমি নেশার জগতে এলাম? এ প্রশ্নটা নেশা ছেড়ে দেয়ার পর দিনের পর দিন ভেবেছি, কখনো কখনো নেশা করা অবস্থাতেও। কী এমন দুঃখবোধ ছিল যা আমাকে নেশার দিকে তাড়িত, ধাবিত করেছিল? কিংবা বেদনাহত? সিলিং-এর দিকে তাকিয়ে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে অনেক বিনিদ্র রজনী কেটে গেছে। কিন্তু ফলাফল হতাশাজনক।
আমি যখন খুব ছোট, দাদার ঘাড়ে চড়ে ঘুরে বেড়াই, একটা প্রজাপতির পেছনে ছুটে বেড়াই, ফুল দেখে বিস্ময়াভূত হই, পাখি দেখলে ধরতে যাই, সেসময় মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলো। এবং কী আশ্চর্য যে, এই যুদ্ধে আমি বড় দুই ভাইকে হারালাম। জোতদার খতমের নামে আমি কোলে বসা থাকা অবস্থায় হারালাম, দাদাকে, বড় চাচাকে। তারপর থেকে তো পালিয়ে বেড়ানো জীবন। নৌকায় করে, এ গাঁ থেকে ওগাঁয়ে, বাংকারের ভেতর যুদ্ধ বিমান থেকে বাঁচার জন্য। দু ছেলে মারা যাবার পর মা’র যন্ত্রণা, কষ্ট, বেদনার কথা নাই বা বললাম। সেই থেকে কি একটা বিষাদ আমাকে তাড়া করছিল? মা’র বিষাদ আমার মধ্যে সংক্রমিত হয়েছিল? কিংবা বাবার সমূহ স্বপ্নের ভার একাকী বহনের অপারগতা আমাকে উন্নাসিক করেছিল? শুধু ভেবেছি আর উত্তর খুঁজেছি। আরো অনেকেরই তো বাবা মারা গেছে, মা গেছে, ভাই গেছে তারাও কি আমার মতো? চারপাশ ঘেটে দেখলাম, না। তাহলে, শৈশবের স্মৃতি কতটুকু আমাকে প্রভাবিত করে? দেখলাম, তেমন কিছু নয়। কোনো রাগ নেই, অভিমান নেই, দুঃখ নেই। বড় হচ্ছি আর চারপাশকে বুঝতে চেষ্টা করছি। বাবা নেশা বলতে শুধু সিগারেট খেতেন। তার কাছ থেকেও আমি কিছু পাই নি। তাহলে, কে দিলো আমাকে এ নেশা? অনেক ভেবে যেটা উদ্ধার করলাম, সেটা হলো, আমারি দোষে আমি প্রত্যহ হতেছি আলাদা।
দোষ আমার একার। নিষিদ্ধের প্রতি আকর্ষণ প্রত্যেকেরই থাকে। আর আমার আছে অজানার প্রতি আগ্রহ। আমি আসলে দেখতে চেয়েছিলাম, নেশাতে কি এমন আছে ? যা মানুষকে অন্যরকম বানিয়ে দেয়। আমি এও দেখেছি যে, পিতা তার ২ বছরের শিশুকে ফুটবলের মতো থাত্থি মারছে। বউকে ধমকাচ্ছে, টাকা দে নাইলে মাইরা ফ্যালামু। কী বিভৎস সে দৃশ্য। আবার এও দেখেছি, দুদিন ধরে বাড়িতে কোনো খাবার নেই, বাড়ি ফিরতে পারছে না। সন্তান, বউকে কিভাবে মুখ দেখাবে? এই বেদনায় গাঁজা খেয়ে পড়ে আছে বেহুস হয়ে। আমার তো সেসব কিছুই ছিল না। তাহলে? শুধু কি অজানাকে জানা? নাকি আর কিছু। বই পড়তাম প্রচুর। গল্পের বইয়ের চরিত্রগুলো কি আমার মধ্যে ঢুকে পড়েছিল? ডাকাত হতে চেয়েছিলাম? গুন্ডা? হিরোইজম কাজ করছিল? কাকে দেখানোর ছিল আমার সেই হিরোইজম? প্রেমিকাকে? কিন্তু সে তো প্রেমে পড়েছিল আমার ভালোমানুষটির জন্য। তাহলে? আমাকে কেউ ভয় পেতো না, পাড়ার কুকুর পর্যন্ত না। বরং আমিই ভয় পেতাম। তবে জেদ ছিল প্রচুর, এখনো। কোনো একটা বিষয়ের প্রতি আগ্রহ জন্মালে সেটার নাড়িভুড়ি না বের করা পর্যন্ত ক্ষান্ত হতাম না। তবে কি এই জেদটাই কাল হয়েছিল? কিন্তু কার উপর জেদ? সেটিও স্পষ্ট নয়। আজ যে বন্ধুরা আমার মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, যারা আমাকে একদিন এই নিষিদ্ধ পথে সঙ্গ দিয়েছিল তাদের প্রতি করুণা তো নই, এখনো প্রগাঢ় বন্ধুত্ব অনুভব করি, জীবন বাজি রাখি। তবে সত্য যে, সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে। আমার ভালো কোনো কোম্পানী ছিল না। জীবনে ভালো কম্পানীর দরকার আছে। আমি বলছি, আপনারা এই বিষয়টির দিকে খেয়াল রাখুন, আপনার ছেলে, আপনার মেয়ে, বন্ধু, কাজিন, ভাই-বোন, প্রেমিক-প্রেমিকা, নিকটাত্মীয়রা কাদের সাথে মেশে, কোথায় যায়? এটা খুব জরুরি।
আমি দেখেছি যে, ছেলে নেশা করে ফিরছে, বাবা মা কিছুই বুঝতে পারছে না। তাদের বলছি, রন্টুকে আজ ওরকম দেখাচ্ছে কেন? সরাসরি তো বলতে পারি না যে, আপনার ছেলে নেশা করেছে। সব নেশা করার ফলে দেখলেই বুঝে যাই কে ভালো আর কার মাঝে শয়তান বাসা বেধেছে। তো তারা বলে, একটু টায়ার্ড বোধহয়। ওর এক বন্ধুর পার্টি ছিল। সবাই খুব ভালো। হায়রে কপাল। কী বিশ্বাস! আমি ওঠার সময় বলেছি, কিছু মনে করবেন না, ওর দিকে খেয়াল রাখবেন। তখন আমার দিকে এমন ভ্র“ কুঁচকে তাকিয়েছে যে, কথা আর এগোয় নি। ক’মাস পরে জেনেছি, তাদের সংসারটা নরক হয়ে গেছে। আমি বলি, কৌতুহলী হয়েও নেশার স্বাদ নিতে যাবেন না। সবার সব ক্ষমতা থাকে না। আমি পেরেছি বলে, আরেকজনও পারবে এমন ভাবাটা অন্যায়। এটা মহামানবের পরিচয় নয়। আমার কোনো নেশাতেই থিতু না হওয়ার কারণ, বেঁচে যাবার কারণ বললে, এককথায় বলতে হয় যে, আমি চেয়েছিলাম, এখনো চাই; আমি আমার মতন বাঁচবো , অন্যকারো মতন নয়। নেশা আমাকে তা করতে দেয় নি। বারবার সে আমাকে চালিত করতে চেয়েছে তার মতো করে। আগেও বলেছি, সে চেয়েছে আমি নির্জীব হয়ে যাই, ভঙ্গুর হয়ে পড়ি, বিছিন্ন হয়ে পড়ি... আর আমি বরাবর চেয়েছি, উজ্জ্বল আলো, হৈ হুল্লোড়, প্রাণোচ্ছল জীবন। এই বৈপরীত্যই আমাকে বাঁচিয়েছে। আঁধার আমার ভালো লাগে না। অথচ নেশাখোর মাত্রই আঁধারের উপাসক। প্রতিটি জীবনে দুঃখ আসবে, বেদনাক্রান্ত হবে কিন্তু তাই বলে নেশা করে সেসব থেকে পালিয়ে বাঁচতে চাওয়াটা বোকামী। স্বামী অরবিন্দ’র কথা বলি, তিনি বলছেন তোমার চিন্তা প্রবাহকে রোধ করো না, তাকে বিস্তার পেতে দাও। দেখবে সে এমনিতেই ম্লান হয়ে আসছে। যেমনটা একটা পুকুরে ঢিল ছুড়ে দিলে একটা তরঙ্গ জেগে ওঠে কিন্তু একসময় মিলিয়ে যায়। আমিও তাই বলি, দুঃখ, বেদনাকে এভাবে মিলিয়ে যেতে দিন। নেশা দিয়ে বাঁধ দিতে যাবেন না। ক্রমে শক্তিশালী হয়ে উঠবে। যেমনটা জলবিদ্যুৎ তৈরির কৌশল থেকে আমরা শিক্ষা নিতে পারি। আমি খুব সাধারণ মানুষ। আমার কখনো উচ্চাকাক্সক্ষা ছিল না। আমাকে এটা হতে হবে, ওটা হতে হবে, এই করতে হবে, সেই করতে হবে। বাবা আমাকে সবসময় বলেছেন, মানুষের মতো মানুষ হও। আমি সেই সাধনাই করে গেছি।
( শেষ করতে পারলাম না, ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি আপনাদের কাছে, আগামীকাল শেষ করব)
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ইসলামে পর্দা মানে মার্জিত ও নম্রতা: ভুল বোঝাবুঝি ও বিতর্ক

লিখেছেন মি. বিকেল, ১৯ শে মে, ২০২৪ রাত ১:১৩



বোরকা পরা বা পর্দা প্রথা শুধুমাত্র ইসলামে আছে এবং এদেরকে একঘরে করে দেওয়া উচিত বিবেচনা করা যাবে না। কারণ পর্দা বা হিজাব, নেকাব ও বোরকা পরার প্রথা শুধুমাত্র ইসলাম ধর্মে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুরসি নাশিন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৯ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:১৫


সুলতানি বা মোগল আমলে এদেশে মানুষকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছিল৷ আশরাফ ও আতরাফ৷ একমাত্র আশরাফরাই সুলতান বা মোগলদের সাথে উঠতে বসতে পারতেন৷ এই আশরাফ নির্ধারণ করা হতো উপাধি... ...বাকিটুকু পড়ুন

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন আর আদর্শ কতটুকু বাস্তবায়ন হচ্ছে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৯ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৭

তার বিশেষ কিছু উক্তিঃ

১)বঙ্গবন্ধু বলেছেন, সোনার মানুষ যদি পয়দা করতে পারি আমি দেখে না যেতে পারি, আমার এ দেশ সোনার বাংলা হবেই একদিন ইনশাল্লাহ।
২) স্বাধীনতা বৃথা হয়ে যাবে যদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

সকাতরে ঐ কাঁদিছে সকলে

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৩:২৯

সকাতরে ওই কাঁদিছে সকলে, শোনো শোনো পিতা।

কহো কানে কানে, শুনাও প্রাণে প্রাণে মঙ্গলবারতা।।

ক্ষুদ্র আশা নিয়ে রয়েছে বাঁচিয়ে, সদাই ভাবনা।

যা-কিছু পায় হারায়ে যায়,... ...বাকিটুকু পড়ুন

বসন্ত বিলাসিতা! ফুল বিলাসিতা! ঘ্রাণ বিলাসিতা!

লিখেছেন নাজনীন১, ১৯ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৪:০৯


যদিও আমাদের দেশে বসন্ত এর বর্ণ হলুদ! হলুদ গাঁদা দেখেই পহেলা ফাল্গুন পালন করা হয়।

কিন্তু প্রকৃতিতে বসন্ত আসে আরো পরে! রাধাচূড়া, কৃষ্ণচূড়া এদের হাত ধরে রক্তিম বসন্ত এই বাংলার!

ঠান্ডার দেশগুলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

×