মনে করুন আপনার মেয়ে খাদিজা বা তামান্না বা প্রিয়াংকা বা যে কোন নাম, শুয়ে আছে হাসপাতালের বিছানায়। বয়স এখনো দুই হয়নি, অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি।
হাসপাতাল ভর্তি রোগী, কিন্তু ডাক্তার ও চিকিৎসা সরঞ্জামের অপ্রতুলতা পরিবেশটাকে ভারী আর দুর্বিষহ করে তুলেছে। তবুও মনের অজান্তে একটি আশা আপনাকে প্রশান্তি এনে দেয়। একদিন তামান্না ভাল হবে, আবার আপনি তাকে জড়িয়ে ধরবেন, সে তার দুর্বোধ্য ভাষায় বা বু বা বি করে আপনাকে কিছু বলার চেষ্টা করবে, আর আপনি আবেগে আহ্লাদে হেসে তার পেট কচলিয়ে দেবেন।
মেয়েটি আপনার ঘুমোচ্ছে, আপনি তার কপালে চুমু খেয়ে একটু বাইরে গেলেন খাবার কিনতে।
দোকানদারকে পয়সা দিচ্ছেন এমন সময় প্রচন্ড শব্দে আকাশ বাতাস কেঁপে উঠল। হাসপাতালের দিকে তাকিয়ে দেখলেন ছাদের মাঝামাঝি জায়গা থেকে ধোঁয়া উঠছে আর একটি জঙ্গি বিমান সাই করে আপনার মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। এক অজানা আশঙ্কায় আপনার বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো, আপনি হাতের খাবার ফেলে ছুটলেন হাসপাতালের দিকে। সদর দরজা থেকে ধোঁয়া আর ধোঁয়া, কিচ্ছু দেখা যায়না, মানুষের ছোটাছুটি আর বাচ্চাদের বুক ফাটানো আর্তনাদ আপনার হৃদয়টাকে থেতলে দিতে চায়। তবুও আপনি সব শক্তি আর সাহস সঞ্চার করে জুয়াইরিয়ার রুমের দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন। দরজাটা খোলাই ছিল। পুরো রুমে কংক্রিটের ধোঁয়া, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। যত্রতত্র পড়ে আছে ভাংগা দেয়ালের অংশ। ফুটো হয়ে যাওয়া দেয়াল বেয়ে আসা রোদের আলোয় কাকে যেন দেখা যাচ্ছে। একটি মেয়ে ধুলোর পুকুরে মুখ ডুবিয়ে শুয়ে আছে, যেমন করে থাকত আপনার মাহযাবিন যখন সে অভিমান করত। গায়ে তার ন্যাপি ছাড়া আর কিছুই নেই, নীরব নিথর দেহটি দেখে আপনার মনে পড়ল আপনার মাইমুনা ও ক্লান্ত হলে এমন করে অলস ভাবে শুয়ে থাকত। আপনি ডাক দিলেন, "শাফি, ও শাফি"। ইসহাক আপনার কথায় সাড়া দেয়না। আপনি তাকে কোলে তুলে নেন, তার ধুলো মাখা মুখে আপনার কান্নার নোনতা পানি মিশে একাকার হয়ে যায়।
না সে আর আপনার সাথে খেলা করবেনা, আপনার দাড়ি ধরে আর টানাটানি করবেনা।
চোখে পানি চলে এসেছে? আরে নাহ্, আপনাকে তো শুধু কল্পনা করতে বলেছি, আপনাকে কি এসবের মুখোমুখি হতে হবে নাকি? আপনি তো আর সিরিয়া বা ইরাকে থাকেন না।
যদি মুখোমুখি হতেন তাহলে কি করতেন? ফিলিস্তিনের সেই বাবাটার মত বাচ্চার লাশ জড়িত ধরে বলতেন "কথা বল আরিয়ানা, আমাকে ছেড়ে যাসনে মা"
বাস্তবতা কি আর আবেগ মানে? আপনার চোখের সামনেই আপনার কলিজার টুকরো বাচ্চাকে চিরতরে বিদায় করে আসা হবে।
আল্লাহর অশেষ মেহেরবানি যে একজন মানুষের দুঃখে দুঃখিত হতে আমাদের সেই দুঃখ অতিক্রম করতে হয়না।
আমরা যেন আমাদের দোআয়, আমাদের সাদকায়, আমাদের যাকাতে এই সব বাবা মা দেরকে মনে রাখি।
ও হ্যা, আমার গল্পের সেই বাবাটি পরে অস্ত্র হাতে নিয়েছিল মেয়ে হত্যার প্রতিশোধ নিতে। সে মুসলমান ছিল তাই তাকে জঙ্গি ডাকা হয়েছিল আর আকাশ থেকে বোমা ফেলা সেই পাইলটকে সর্বোচ্চ সামরিক পুরস্কার দেওয়া হয়েছিলো। সে ইহুদী ছিল।
সাদি হক, নটিংহাম।