somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কবি শঙ্খ ঘোষের সঙ্গে কিছু কথাবার্তা

০৩ রা নভেম্বর, ২০০৮ সন্ধ্যা ৬:১৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

শুধু ছন্দই কবিতা নয়, কবিতার থাকে আরও অনেক উপাদান: শঙ্খ ঘোষ

[কবি শঙ্খ ঘোষের জন্ম ১৯৩২ সালে, চাঁদপুরে, মামা বাড়িতে। পৈতৃকবাড়ি বরিশালের বানারীপাড়ায়। ১৯৪৭-এ দেশ-ভাগের সময় তিনি সপরিবারে চলে যান ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। বর্তমানে সেখানেই বসবাস করছেন। ৫০-এর দশকের উল্লেখযোগ্য কবিদের অন্যতম প্রধান একজন তিনি। তাঁর কাব্যগ্রন্থের মধ্যে- দিনগুলি রাতগুলি, নিহিত পাতাল ছায়া, পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ, মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে, ধুম লেগেছে হৃদকমলে, লাইনেই ছিলাম বাবা, গান্ধর্ব কবিতাগুচ্ছ, সবকিছুতেই খেলনা হয়, বাবরের প্রার্থনা, মূর্খ বড়ো, সামাজিক নয় প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও বেশকিছু গদ্য ও প্রবন্ধগ্রন্থও রয়েছে তাঁর। সম্প্রতি তিনি ঢাকায় এসেছিলেন এক পারিবারিক নিমন্ত্রণে। উঠেছিলেন ধানমণ্ডি ৭/এ সড়কের অরণি বিদ্যালয়ের পাশের এক বাসায়। সেই বাসার ৩য় তলার ফ্লাটে (১৩ অক্টোবর ২০০৮ রাতে) এবং শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটের লিটলম্যাগ প্রাঙ্গণের সামনে এক আড্ডায় (১৫ অক্টোবর ২০০৮ সন্ধ্যায়) তাঁর সঙ্গে বেশ কিছু বিষয়ে আলাপ-আলোচনার সুযোগ হয়েছিল। এগুলোর কিছু অংশ এখানে পত্রস্থ করা হলো- সফেদ ফরাজী।]


কবিতায় তরুণরা, বিশেষত বাংলাদেশের তরুণ কবিরা ছন্দকে কেউ বুঝে কিংবা কেউ না বুঝে প্রচলিত ছন্দের ব্যবহার বাদই দিয়েছেন প্রায়। এটা আপনি (শঙ্খ ঘোষ) কিভাবে দেখেন? সঙ্গে আরও যোগ করলাম, আমি নিজে যখন কবিতা লিখতে বসি, তখন প্রচল ছন্দের বিষয়টি মাথায় নিয়ে কবিতা লিখতে চাইলে কখনো কখনো কেমন যেন বাধার সম্মুখীন হচ্ছি বলে মনে হয়, কেন যেন মনে হয় ছন্দের জন্য, মাত্রা মিলানোর জন্য কবিতাটিতে আমি আমার মনের ভাবটি সঠিকভাবে প্রকাশ করতে পারছি না। তো ছন্দ বিষয়ে আপনার অভিমত জানতে চাই। এরপর শঙ্খ ঘোষ বলতে শুরু করলেন, কবিতায় ছন্দ ব্যবহার করা, না করা, এটা একান্তই ব্যক্তিগত বিষয়। কেউ যদি মনে করে আমি ছন্দে লিখব না, সে লিখবে না। ছন্দে লিখতেই হবে এমন তো কথা নেই। তবে চিত্রশিল্পী যেমন একটি শিল্পকর্ম নির্মাণের আগে তার রঙ, রঙের বিন্যাস ও তুলি চালানো বিষয়ে একটি ধারণা নিয়েই শিল্পকর্ম করতে বসেন। অবশ্য কেউ ইচ্ছে করলে রঙের বিন্যাস ও তুলি চালানোর সুনির্দিষ্ট ধারণা ছাড়াও রঙ নিয়ে বসে তুলি চালাতে পারেন। কিন্তু রঙের বিন্যাস ও তুলি চালানোর বিষয়ে সম্যক ধারণা থাকার পর যদি তিনি তাঁর সেই ধারণায় তুলি না চালিয়ে অন্য কোনো প্রকারে তুলি চালান, চালাতে পারেন। তার তো বিষয়টি জানা আছে, কোনভাবে চালালে কি হয়। না জানলে সেটি হয়তো অন্য বিষয় হবে। এ জন্য বলি, ছন্দটা জানা থাকা দরকার। ছন্দটা জানা থাকলে ছন্দ ভাঙাটা সহজ হয়। শিল্পের বিষয়টিই তো পরিশ্রমের। কেউ যদি সেই পরিশ্রম না করতে চায়, করবে না। আপনার যদি মনে হয় ছন্দের জন্য আপনি আপনার মনের ভাবটি সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ করতে পারছেন না, তাহলে ছন্দের ব্যবহার করবেন কেন? এক্ষেত্রে প্রশ্ন আসে যে, যারা ছন্দ ব্যবহার করেন, মিল দিয়ে কবিতা লিখেন তারা কি মনের সম্পূর্ণভাব প্রকাশ করতে পারেন না? আবার অনেকে মনে করেন কবিতায় অন্তমিলটাই বুঝি ছন্দ! তা তো নয়। প্রচল ৩টি ছন্দের ভেতরই লিখতে হবে এমন তো কথা নেই। এগুলো জেনে, এগুলো ভেঙে নতুন কিছুও হতেই পারে। ছন্দ ছাড়া যে কবিতা হবে না এমনটি নয়।
কলকাতায়ও ছন্দ বিষয়ে তরুণদের অনীহা আছে। তাদের অনেকেই আমাকে বলেছে, `ছন্দের দিন শেষ, বিশ্বকবিতা থেকে ছন্দ উঠে যাচ্ছে, তাহলে আমরা কেন ছন্দ নিয়ে পড়ে থাকব'। কিন্তু মজার বিষয় হলো, গত ৪০/৫০ বছরের বিদেশি কবিতার যতগুলো উল্লেখযোগ্য জার্নাল আমার হাতে এসেছে, তাতে ল করে দেখেছি, কোথাও ছন্দহীন কবিতা নেই, সবখানেই ছন্দে কবিতা লিখা হয়েছে, হচ্ছে। ব্যতিক্রম দু'একটা যে নেই, তা নয়। তাহলে কী করে বলি যে, বিশ্বকবিতা থেকে ছন্দ উঠে যাচ্ছে!
একবার পদাতিকের কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের একটি কবিতার বই প্রকাশ পাওয়ার পর তা নিয়ে বেশ আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়ে গিয়েছিল। অনেকেই বলতে শুরু করেছিলেন `সুভাষ, একি করল, একি করল'! বুদ্ধদেব বসু তো এ বিষয়ে একটি গদ্য লিখেও ছাপিয়েছিলেন। বিষয়টি হয়েছিল, সুভাষ দা'র ওই বইয়ের কবিতায় মনে হচ্ছিল কোথাও ছন্দের মাত্রা ঠিক আছে, কোথাও নেই। পরে দেখা গেল যে তিনি অক্ষরবৃত্তেই কবিতাগুলো লিখেছেন কিন্তু কোথাও কোথাও মাত্রা ভেঙে নতুন বিন্যাস করেছেন। তো একদিন সুভাষ দা' আর আমি রাতের বেলায় একসঙ্গে হাঁটছি, এমন সময় জিজ্ঞেস করলাম, দাদা আপনি এই কাজটি কেমন করে করলেন? সেই রাতের অন্ধকারে সুভাষ দা' আমার হাত জাপটে ধরে বললেন, বিশ্বাস করো, আমি এই বইয়ে এমন কি লিখেছি, আমি নিজেই জানি না। আমি তো তোমাদের মতো এত ছন্দ জানি না। এটি লিখার সময় ছন্দ সম্পর্কে আমি কোনো চিন্তাই করিনি, ছন্দ গুনে গুনেও লিখিনি। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তাহলে কিভাবে এটি সম্ভব হলো? উনি বললেন, আমি প্রথমে লক্ষ করেছি মানুষ কিভাবে কথা বলে, আর আমার চেনা একটি ধোপা বাড়ি ছিল, সেখানে ধোপারা কাপড় কাচার সময় যেভাবে শব্দ করে, সেই শব্দের রেশটি আমার কানে ছিল। এই তো।
ছন্দ বিষয়ে কবি শঙ্খ ঘোষের একটি উল্লেখযোগ্য বই `ছন্দের বারান্দা'। এটি সম্পর্কে তিনি জানান, ছন্দের বারান্দা বইটি আসলে প্রাথমিক ছন্দ শিক্ষার বই না। এটিতে কয়েকজনের কিছু কবিতা নিয়ে ছন্দ বিশ্লেষণ করে দেখানো হয়েছে। কারো যদি ছন্দ সম্পর্কে ধারণা না থাকে তাহলে এটি পড়তে পারবেন না। কলকাতায়ও এটিকে ছন্দ শিক্ষার বই ভেবে ভুল করেন অনেকেই। একবার দেখলাম, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের রেফারেন্স বইয়ের তালিকায় এই বইটির নাম। হয়তো নির্বাচকমণ্ডলী এই বইটি সম্পর্কে না জেনেই রেফারেন্স বইয়ের তালিকাভুক্ত করে থাকবেন। যারা ছন্দ জানেন, তাদের কিছুটা উপকারে আসতে পারে এটি। আসলে ছন্দ বিষয়টিই অভ্যাসের ব্যাপার। একবার অভ্যাস হয়ে গেলে ছন্দে, ছন্দ ভেঙে, যেকোনোভাবেই কবিতা লেখা যায়। আর ছন্দ বিষয়টি তো অনেকটা কানের ব্যাপার। লক্ষ করতে হবে, কান কি বলে। আর শুধু ছন্দই তো কবিতা নয়, কবিতার থাকে আরো অনেক উপাদান। অনেকের কবিতায় দেখা যায় ছন্দ মাত্রা তাল লয় সব ঠিকই আছে, কিন্তু ওতে কবিতা নেই। শুধু ছন্দ মাত্রার জন্যই কি কবিতা পড়ে কেউ? মূল ব্যাপারটি হলো, কবিতাটি কবিতা হয়ে উঠলো কি-না। কবিতা হয়ে উঠাটাই আসল বিষয়।

`গান্ধর্ব কবিতাগুচ্ছ' শঙ্খ ঘোষের উল্লেখযোগ্য একটি কাব্যগ্রন্থ। গান্ধর্ব কবিতাগুচ্ছ লেখার পটভূমি বিষয়ে জানতে চাইলে কবি জানালেন, তখন ১৯৮৭ সালের দিকে শিমলাতে থাকতাম। ওখানে গিয়েছিলাম এক বছরের জন্য। আমাকে এই সুযোগ দেয়া হয়েছিল একটি শর্তে, আমি সেখানে থাকব আর লেখালেখি করব। এছাড়া আর কোনো কাজ নেই আমার। তো গেলাম শিমলাতে। সেখানে যে বাড়িটিতে থাকতাম, সেটি ছিল পুরনো গভর্নেন্স হাউস। বিশাল বড় বাড়ি। লোকজন কেউ থাকে না। একা আমি। অনেকেই বলতেন, এই বাড়িতে ভূত আছে। একবার একজন এসেছিলেন আমার সঙ্গে সেই বাড়িটিতে থাকার জন্য। একরাত থেকে পরদিনই ব্যাগট্যাগ গুছাচ্ছে দেখে জিজ্ঞেস করলাম, কী ব্যাপার? কোথাও যাচ্ছেন? তিনি বললেন, আমি চলে যাচ্ছি। আমি বললাম, কেন? তিনি বললেন, এই বাড়িতে ভূত আছে। আমি বললাম, আপনি ভূত দেখেছেন? উনি বললেন, না দেখিনি, তবে আছে মনে হয়। তো সেই বাড়িতে থাকাকালে একদিন মেঘকুয়াশা ঘেরা সকালবেলায় খাতা-কলম নিয়ে লিখতে বসে গেলাম, `গান্ধর্ব কবিতাগুচ্ছে'র কবিতা। একটানে পাঁচটি কবিতা লিখে ফেললাম। ছয় নাম্বার কবিতাটার দেড় লাইন লেখার পরই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ পেলাম। কে যেন কড়া নাড়ছে। দরজা খুলে দেখি, আমার পরিচিত একজন। উনি বললেন, কি কিছু করছেন, বিরক্ত করলাম না তো? আমি বললাম, না না, কিছু করছি না, আসুন ভেতরে আসুন। উনি ভেতরে এলেন। উনার সঙ্গে প্রায় ঘণ্টাখানেক কথাবার্তা বলার পর উনি চলে গেলেন। এরপর আমি আবার টেবিলে গিয়ে বসলাম, কাগজ-কলম নিয়ে অসমাপ্ত কবিতাটি লিখতে চাইলাম। কিন্তু সেটি আর হলো না, সেই দেড় লাইনের কবিতাটিকে আমি আর সম্পূর্ণ করতে পারলাম না। এরপর বিভিন্ন সময়ে `গান্ধর্ব কবিতাগুচ্ছে'র কবিতাগুলো লেখা হয়েছে। কিন্তু সেই না-লিখতে পারা কবিতাটির জন্য সারাজীবন একটি দুঃখ থেকে গেল!


২.
শঙ্খ ঘোষের জন্ম যেহেতু বাংলাদেশে, শৈশব-কৈশোরও কেটেছে এখানেই, সেহেতু বাংলাদেশ সম্পর্কে তাঁর মনে দুর্বলতা কাজ করা যেমন স্বাভাবিক, তেমনি হয়তো অনেক স্মৃতিও তাড়া করে ফিরে তাঁকে। বাংলাদেশ সম্পর্কে তাঁর অনুভূতি কী, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর পরিবার-পরিজনের সঙ্গে বরিশালের বানারীপাড়ার নিজেদের বাড়ি ছেড়ে কলকাতায় চলে যেতে হয় আমাকে। এরপর দীর্ঘ ৫০ বছর পর ১৯৯৭ সালে একবার শুধু বানারীপাড়া গিয়েছিলাম, নিজের গ্রাম দেখতে, বাড়িটি দেখতে। এছাড়া ৪৭-এর পর বাংলাদেশে বেড়াতে আসা হয়েছে ৭৫, ৮৪, ৯৫, ৯৭ ও ২০০১ সালে। প্রতিবারই একটু ঘোরাফেরা করে, পরিচিত কয়েকজন কবি-সাহিত্যিকের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে চলে গেছি। সভা-সেমিনারের বিষয়টিতে আমার ভয় লাগে। তাই সভা-সমিতিতে আমি খুব একটা যাই না। এবারও এক পারিবারিক নিমন্ত্রণে বেড়াতেই এসেছি। বাংলাদেশের প্রতি আমার যে অনুভূতি তা তো ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।
আমার জন্ম চাঁদপুরে, মামা বাড়িতে। পৈতৃক বাড়ি বরিশালের বানারীপাড়ায়। বাংলাদেশ বলতে যে জায়গাটি আমার সবচেয়ে ভালো লাগার, সেটি হচ্ছে পাকশি (পাবনায়)। কারণ ওখানেই আমার শৈশব-কৈশোরের অধিকাংশ সময় কেটেছে। স্কুলজীবনের পুরোটাই পড়েছি পাকশি স্কুলে। আমার বাবা ছিলেন ওই স্কুলের হেডমাস্টার। আমার বড়দা' ওই স্কুলে ছয় মাস, আর ছোটভাই কাস সিক্স পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে। এক্ষেত্রে আমি আমার স্কুলজীবনের পুরোটাই বাবার স্কুলে পড়তে পেরেছি বলে একটা গর্ব গর্ব ভাব ছিল মনে। পাকশিতে আমার জীবনের খুবই মূল্যবান সময়গুলো কেটেছে। তাই পাকশির স্মৃতি আমার মনে উজ্জ্বল হয়ে আছে। আমার কাছে পৃথিবীর সেরা জায়গা হলো পাকশি। একবার বাংলাদেশে আসার পর ইচ্ছে হলো পাকশি থেকে ঘুরে আসি। তখন এখানকার দুই লেখক আবুল হাসনাত ও মফিদুল হক আমার সঙ্গে যেতে চাইলেন। তো একসঙ্গে পাকশি গেলাম। ঘুরেফিরে দেখলাম। তারাও আমার সঙ্গে ঘুরেফিরে দেখল। আমার মনে হলো, আমার চোখে আমি যা দেখি, তারা তো তা দেখতে পাবে না। কারণ আমার শৈশব-কৈশোরের পনের বছরের স্মৃতিবিজড়িত এলাকাটাকে আমি তো আমার স্মৃতি দিয়ে বিচার করছি আর তারা তো তা নয়। কিন্তু কৌতূহল থেকে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম, জায়গাটা খারাপ লাগছে না তো? তারা বলল, না জায়গাটা খুবই ভালো। অবশ্য সেই শৈশব-কৈশোরে দেখা পাকশির অনেক কিছুই আজ বদলে গেছে, আবার অনেক কিছুই আছে সেই আগের মতোই। ৪৭ সালে ম্যাট্রিক দিলাম। কলেজে ভর্তি হলাম। তখনই দেশভাগ হয়ে গেল। তারপর চলে গেলাম কলকাতায়। তারপর শুরু হলো অন্যরকম জীবন। বাংলাদেশের তিন জায়গা- চাঁদপুর, বানারীপাড়া ও পাকশির অনেক স্মৃতি আমাকে টানে। সবচেয়ে বেশি মন কাঁদে পাকশির জন্য। এখনও মাঝে মাঝে ঘুমে স্বপ্নের ভেতর দেখতে পাই পাকশি স্কুলে পড়ার সময়টাকে। ওখানে বেশ বড় একটা চর ছিল। সেখানে বেড়াতে যেতাম। জলে নামতাম। মাঝে মাঝে বিপদও হতো। একবার আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে বেড়াতে গিয়ে জলে নেমেছি। কিছুণ পর একবন্ধু চিৎকার করে বলতে লাগল, `আমি ডুবে যাচ্ছি আমাকে ধর, আমি ডুবে যাচ্ছি আমাকে ধর'। ওই বন্ধুটি প্রায়ই মিথ্যা কথা বলত বলে কেউই প্রথমে পাত্তা দিচ্ছে না। পরে দেখা গেল যে সত্যি সত্যিই ও ডুবে যাচ্ছে। তখন সবাই দৌড়ে গিয়ে ওকে টেনে তোলা হলো। ও আসলেই চোরাবালিতে পড়েছিল। আমার জীবনের কত কত স্মৃতি যে পাকশির!
বানারীপাড়ার সঙ্গেও আমার নাড়ীর যোগ অবিচ্ছেদ্য। ৫০ বছর পর ১৯৯৭ সালে যখন বানারীপাড়ায় গিয়েছিলাম তখনও নিজেদের বাড়িটি চিনতে একটুও ভুল হয়নি। ঠিক ঠিকই চিনতে পেরেছি। আমার স্মৃতির সেই গ্রাম, সেই বাড়ি, সেই বাগানবাড়ি, সেই গাছপালা ঘেরা প্রকৃতি, সেই পথঘাট, সেই নদী ৫০ বছর পরও সেই একই রকম রয়ে গেছে। বানারীপাড়া ঘুরে কলকাতা যাওয়ার পর পরিবারের সবাই আমার কাছে ওখানকার গল্প শুনতে চাইল। আমি কি ঠিক ঠিক চিনতে পেরেছি বাড়িটি? ওটি কি আগের মতো আছে? এমতো আরো অনেক প্রশ্ন। আমি বললাম, হ্যাঁ কারো সাহায্য ছাড়াই দিব্যি চিনতে পেরেছি, আর বাড়িটি একটুও বদলায়নি, কিছুই বদলায়নি। তখন আমার এক কাকা রেগে গিয়ে সবাইকে বললেন, ওর কথা বিশ্বাস করো না, ও মিথ্যা বলছে, আমি নিজে দেখে এসেছি কিছুই নেই আগের মতো, আর ও বলছে সব আগের মতো আছে, ডাহা মিথ্যা কথা। আমার এই কাকা দেশভাগের পর ৮৫/৮৬ সালের দিকে একবার এসেছিলেন বানারীপাড়ায়। তিনি তখন বাড়িটি দেখে গিয়ে খুব দুঃখভারাক্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন। উনার চোখে যে পরিবর্তনগুলো বেশি পড়েছিল সেগুলো হচ্ছে পুজোর ঘরটিতে প্রতিমা নেই, ঘরবাড়িতে কেমন যেন পরিবর্তন আনা হয়েছে, এইসব। কিন্তু আমি দেখলাম সেই গ্রাম, সেই পথ, সেই নদীনালা, সেই বাগানবাড়ি, গাছপালা, সেই মানুষজন সবই প্রায় আগের মতোই। দু'জনে আসলে দুই রকম অনুভূতি দিয়ে দেখা হয়েছে তো।
বানারীপাড়ায় গিয়ে যে বিষয়টি জেনে খুবই দুঃখ পেয়েছি তা হলো, আমার শৈশববন্ধু সহপাঠী আনোয়ারুল ইসলামের মৃত্যুর সংবাদ। ওখানে গিয়েই ওর খোঁজ করেছিলাম। একজন জানাল, ৭১ সালে যুদ্ধের সময় ওকে মেরে ফেলা হয়েছে। কলকাতায় চলে যাওয়ার পর ওর সঙ্গে আর দেখা হয়নি আমার। ৭১ সালের আগে একবার ও কলকাতায় গিয়েছিল। একদিন রাতে বাসায় ফেরার পর শুনি আমার একজন বন্ধু এসেছিল বাংলাদেশ থেকে, একটি ঠিকানা ও টেলিফোন নাম্বার কাগজে লিখে দিয়ে গেছে। এবং বলে গেছে, যত রাতই হোক ওকে যেন একটি ফোন করি আজই। আমি কাগজটি হাতে নিয়ে দেখি, তাতে লেখা নাম আনোয়ারুল ইসলাম, আর ঠিকানা ও ফোন নাম্বার কলকাতার একটি হোটেলের। রাত দুটো পর্যন্ত আমি ফোনে চেষ্টা করেছি আনোয়ারকে পেতে, রিং হয় কিন্তু কেউ ফোন ধরে না। সকালেও ফোন করেছি, রিং হয় কিন্তু ধরে না কেউ। সম্ভবত লাইনের কি যেন সমস্যা ছিল। পরে নিজেই ঠিকানাটা নিয়ে ওই হোটেলে গেলাম। গিয়ে খবর পেলাম আনোয়ারুল ততক্ষণে চলে গেছে। তখন খুবই খারাপ লেগেছিল, বেশি খারাপ লেগেছিল এই ভেবে, ও হয়তো ভেবে গেল, আমি ওকে ভুলে গেছি, তাই ওর সঙ্গে যোগাযোগ করিনি!

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, `রাইফেল রোটি আওরাত' উপন্যাসের লেখক, কবি, ঔপন্যাসিক আনোয়ার পাশা (জন্ম মুর্শিদাবাদের বহরমপুরে), যিনি ৭১ সালে বাংলাদেশে শহীদ হয়েছেন, তিনি তো আপনার (শঙ্খ ঘোষ) খুব কাছের বন্ধু। আনোয়ার পাশার `স্মৃতি লেখা' পড়ে জেনেছি, তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ `নদী নিঃশেষিত হলে' প্রকাশের আগে আপনার পরামর্শেই `আনোয়ার পাশা' নামে বইটি প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেন। আনোয়ার পাশা তো আগে `মুহম্মদ আনোয়ার' নামে লিখতেন। ও সময়ের কিছু স্মৃতিচারণ যদি করেন। কিছুটা দম নিয়ে শঙ্খ ঘোষ জানান, আনোয়ার পাশা আমার খুব কাছের বন্ধু ছিল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা একসঙ্গে পড়েছি। ওই সময়ে অশ্রুকুমার সিকদারসহ আরো অনেকেই আমরা একসঙ্গে ছিলাম। আনোয়ারের সঙ্গেও আমার যে কত স্মৃতি! কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ পড়ার সময় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটি ম্যাগাজিন বের হয়েছিল। এবং এটি সম্পাদনার দায়িত্ব পড়েছিল আমার উপর। তখন আনোয়ারেরও একটি কবিতা ওতে ছাপা হয়েছিল। আনোয়ার তখন `মুহম্মদ আনোয়ার' নামে লিখত, কিন্তু আমি ওটিকে `আনোয়ার পাশা' বানিয়ে ছেপে দিয়েছিলাম। (মৃদু হাসি)। এরপর, ও আনোয়ার পাশা নামেই লিখত। কবিতার বই করার সময়ও জানতে চেয়েছিল কোন নামে বই প্রকাশ করবে, তখন আনোয়ার পাশা নামটিকেই আমি সমর্থন করেছিলাম। এই আর কি। আনোয়ার পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে চাকরি পেয়ে বাংলাদেশে চলে আসার আগে আমার সঙ্গে দেখা করে একটি ডায়লগ দিয়ে এসেছিল, এখনও স্পষ্ট মনে আছে। একদিন হুট করে আনোয়ার এসে আমাকে বলল, আমি চললাম। আমি বললাম, চললাম মানে? ও বলল, পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে শিকতার একটি চাকরি পেয়েছি, তাই পাবনায় চলে যাচ্ছি, এখন তুমি থাক আমার দেশে, আমি গেলাম তোমার দেশে। আনোয়ারের এই কথাটি আমার মনে গেঁথে আছে!

শঙ্খ দা' এসব প্রসঙ্গগুলো যখন বলছিলেন, দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছিলেন থেকে থেকে, বিষণ্ণও লাগছিল খানিকটা। মাতৃভূমির অনেক স্মৃতি, শৈশব-কৈশোরের নানারঙের দিনগুলো, হারিয়ে যাওয়া প্রিয়জনদের মুখ কিংবা নিজের দেশ ত্যাগের যন্ত্রণা ইত্যাকার নানা অনুষঙ্গ অনেক বড় বেদনা হয়ে শঙ্খ দা'র মনে তখন প্লাবিত হচ্ছিল হয়তোবা। আর তখন আমার খুব মনে পড়ছিল শঙ্খ ঘোষের কবিতার সেই পংক্তিগুলি- `ডানার সীমানা নেই, নাশকের নিশানা পেরিয়ে/ কোথায় তোমার বাড়ি কোথায় তোমার দেশগাঁও-/ গ্রহতারকার নিচে পড়ে আছে সজল সময়/ বুকে হাত দিয়ে বলো আজও তাকে কতখানি চাও।' কিংবা `একলা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি/ তোমার জন্য গলির কোণে/ ভাবি আমার মুখ দেখাব/ মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে।/ একটা দুটো সহজ কথা/ বলব ভাবি চোখের আড়ে/ জৌলুসে তা ঝলসে ওঠে/ বিজ্ঞাপনে, রংবাহারে।/ কে কাকে ঠিক কেমন দেখে/ বুঝতে পারা শক্ত খুবই/ হা রে আমার বাড়িয়ে বলা/ হা রে আমার জন্মভূমি!...'




সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা নভেম্বর, ২০০৮ সন্ধ্যা ৬:২৭
৬টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

৫০১–এর মুক্তিতে অনেকেই আলহামদুলিল্লাহ বলছে…

লিখেছেন বিচার মানি তালগাছ আমার, ০৩ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০০



১. মামুনুল হক কোন সময় ৫০১-এ ধরা পড়েছিলেন? যে সময় অনেক মাদ্রাসা ছাত্র রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিল। দেশ তখন উত্তাল। ঐ সময় তার মত পরিচিত একজন লোকের কীভাবে মাথায় আসলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঝিনুক ফোটা সাগর বেলায় কারো হাত না ধরে (ছবি ব্লগ)

লিখেছেন জুন, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:০৯

ঐ নীল নীলান্তে দূর দুরান্তে কিছু জানতে না জানতে শান্ত শান্ত মন অশান্ত হয়ে যায়। ১৯২৯ সালে রবার্ট মোস নামে এক ব্যাক্তি লং আইল্যান্ড এর বিস্তীর্ণ সমুদ্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ অপেক্ষা

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২৩



গরমের সময় ক্লাশ গুলো বেশ লম্বা মনে হয়, তার উপর সানোয়ার স্যারের ক্লাশ এমনিতেই লম্বা হয় । তার একটা মুদ্রা দোষ আছে প্যারা প্রতি একটা শব্দ তিনি করেন, ব্যাস... ...বাকিটুকু পড়ুন

×