বেশ কিছুদিন ধরেই আমরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ভ্যাট-বিরোধী আন্দোলন করে যাচ্ছি। সরকার আন্দোলন দমনের জন্য বলপ্রয়োগ থেকে শুরু করে সব ধরনের কূটকৌশলই নিচ্ছে। তার একটা হচ্ছে ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভাসিটির ছাত্রদের উপর পুলিশের গুলি।কিন্তু বৃহস্পতিবার এক প্রজ্ঞাপনে এনবিআর বলেছে ভ্যাট শিক্ষার্থীদের দিতে হবে না। এটি দিতে হবে প্রতিষ্ঠানকে। এর মধ্যে অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান জানিয়ে দিয়েছে ভ্যাট দেওয়া তাদের দায়িত্ব না। অর্থটা এমন দুধ দেবে খামারি,গরু ছাগল না।তাহলে সরকার কি চাচ্ছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আরো কমার্শিয়াল হোক! কোনো শিক্ষা বা গবেষণা এখানে না হোক! একটা বিষয় সবাই জানেন কি না জানি না, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে বাংলাদেশ মঞ্জুরি কমিশন গবেষণা বা শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য সহযোগিতা করে না। এনবিআরের এই ঘোষণা সরকারের শঠতার একটি অংশ। উদ্দেশ্য আমাদের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন থেকে সরিয়ে আনা, দোটানার মধ্যে ফেলে দেওয়া। আর আমরা আন্দোলনরত শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমে গেলে আমাদের ওপরে আক্রমণ চালানো। সেটাই কিন্তু হয়েছে। বৃহস্পতিবার রাতে আমাদের শিক্ষার্থীদের ওপর জয় বাংলা স্লোগানে হামলা হয়েছে।আর তো পুলিশি অ্যাকশন ছিলই। তবে আশার কথা এত কিছুর পরও আমরা শিক্ষার্থীরা আমাদের নৈতিক দাবি থেকে সরে আসেনি। আন্দোলন আমরা করে যাচ্ছি। ধর্মঘট ডেকেছি। এ ধর্মঘট নৈতিকতা প্রতিষ্ঠার ধর্মঘট, ন্যয্যতা প্রতিষ্ঠার ধর্মঘট।
শিক্ষার ওপর ভ্যাট আরোপের সিদ্ধান্তই অনৈতিক। সেটি কে পরিশোধ করল তা বড় ব্যাপার নয়। আজকাল অনেকেই বলে, বাংলাদেশের মতো এত সস্তায় শিক্ষা কোথাও নেই। কথায় কথায় এসব মানুষ ইউরোপ আমেরিকার উদাহরণ টানেন। তাদের যুক্তি ইউরোপ বা আমেরিকায় শিক্ষা গ্রহণ করতে গেলে একজন শিক্ষার্থীকে অনেক টাকা গুনতে হয়। কথাটা আসলে কতটা ঠিক তা জানা দরকার আমাদের। আমারা সবাই জানি : ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা শিক্ষা গ্রহণ করতে বৃত্তি নিয়ে যাই এবং আমাদের কোনো অর্থ গুনতে হয়না। এটা ঠিক যদি বৃত্তি নিয়ে না যওয়া হয় তাহলে হয়তো ২০ থেকে ৩০ লাখ টাকা লেগে যায়। কিন্তু সেটা আমরা অইউরোপীয় বলে। ইউরোপের যেকোনো শিক্ষার্থী সে দেশের বা ইইউভুক্ত কোনো দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গেলে ন্যূনতম অর্থ খরচ করতে হয়। শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণকে জায়েজ করতে যেসব ধনী দেশের উদাহরণ দেয়া হয় আমরা, সেসব দেশ শিক্ষা ও গবেষণা খাতে তুলনামূলকভাবে আমাদের দেশ থেকে অনেক অনেক বেশি খরচ করেন। এটা আমাদের কম বেশি সবারই জানা, ইউরোপ বা আমেরিকায় যেসব শিক্ষার্থী গবেষণার কাজ করেন তাদের সবাইকে হয় বিশ্ববিদ্যালয় বা সরকার থেকে অর্থ দেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁদের বসার অফিসসহ আরো অনেক রকম সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়। আর আমাদের দেশে? আমাদের দেশে একজন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীকে এখন মাসে কম টাকা গুনতে হয় না। আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বললে তো প্রশ্নই নেই। উপরের সারির কোনো একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আমাকে সাড়ে তিন মাস/চার মাসে শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের ফি হিসেবেই গুনতে হয় প্রায় ৬০-৭০ হাজার টাকা। এ ছাড়া নিজের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার খরচ তো আছেই। অনেকেই ভাবেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যাঁরা পড়তে আসেন তাঁরা বেশির ভাগই ধনাঢ্য পরিবারের। এই ধারণা যাঁরা করেন তাঁরা নিতান্তই অবিবেচক। প্রায় সব ধনাঢ্য পরিবারের সন্তানরা ‘এ’ লেভেল ‘ও’ লেভেল পাস করার পর ইউরোপ আমেরিকা চলে যান উচ্চ শিক্ষার্থে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসা বেশির ভাগ শিক্ষার্থী আসেন মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আমার মত। আমার প্রথম লক্ষ্য ছিল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হব কম্পিউটার সায়েন্স এ্যান্ড ইঞ্জিয়ারিংয়ে।পছন্দমতো বিষয় না পেয়ে আমি ভর্তি হয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ায় আমার বাবাকে জমি বিক্রি করতে হয়ছে টিউশন ফির জন্য। এর ওপর নতুন করে ভ্যাট বসানোতে তাঁর অবস্থা হয়েছে ‘ছেড়ে দে মা কেদে বাঁচি’ প্রবাদের মতো।কারণ ১২ টা সেমিস্টার শেষে আমার বাবাকে একটা অতিরিক্ত সেমিস্টার সমতুল্য টাকা খরচ করতে হবে। অর্থাৎ তাঁর ছেলেকে পড়াশোনা না করালেই বাঁচতেন। কিন্তু কী করা! একমাত্র ছেলেকে শিক্ষিত করতেই হবে যে তার। যদি আমার অঢেল টাকা হত, তাহলে আমাকে এক রুমে কয়েকজনের সাথে থাকতে হতো না। মেসে রান্না না হলে না খেয়ে থাকতে হতনা।বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার খরচ বেশি নেয়, তাই তারা ভ্যাট আরোপ করেছে। এটি হাস্যকর কথা!
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসাবে আমাদের এই ভ্যাটবিরোধী আন্দোলনকে শুধু আমাদের নিজেদের আন্দোলন হিসেবে দেখলে ভুল হবে। এটা ঠিক আমরা শিক্ষার্থীরা আমাদের নিজেদের অধিকার এবং স্বার্থের জন্য আন্দোলন করছি। আমরা সবাই তা করে থাকি। আন্দোলনরত শিক্ষার্থী হিসাবে আমরা অনেককেই সংবিধানের কথা উল্লেখ করছি, প্লাকার্ডে, স্লোগানে তা লিখেছি, শিক্ষা আমাদের মৌলিক অধিকার। সংবিধানে এ অধিকারের কথা বলা আছে।রাষ্ট্র যে আইন দিয়ে আমাদের শাসন করার কথা বলছে সেই আইন লঙ্ঘন করছে।’ শুধু লঙ্ঘন নয়, রাষ্ট্র তো আমাদের শিক্ষার দায়িত্ব নিচ্ছেই না বরং আমাদের থেকে মুনাফা নেয়ার চেষ্ঠা করছে। শিক্ষাকে পণ্য করার এ প্রক্রিয়া অনেক আগ থেকেই শুরু হয়েছে এ দেশে।প্রথম এইটা প্রয়াত সাইফুর রহমান তুলে ধরেন পরে ২০০৭ সালে এইটা জনসম্মুখে আসে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নৈশকালীন কোর্সের নামে মুনাফা করার শিক্ষা চালু করা হয়। নৈশকালীন এই বাণিজ্যের বিরুদ্ধে তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ করেছিল।কিন্তু শেষপর্যন্ত হার মানতে হয়েছে। এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ প্রত্যেকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে লাখ লাখ টাকা আদায় করে নৈশকালীন শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। শিক্ষাকে পণ্য করার ভ্রুণটা ওখান থেকেই তৈরি হয়েছিল। আমরা সেটা রোধ করতে পারিনি। এখন শিক্ষার ওপর ভ্যাট আরোপ করে শিক্ষাকে ধ্বংস করার ষোলোকলা পূর্ণ করা চেষ্ঠা হচ্ছে।
শুধু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসাবে আমরা নয় বরং আমাদের অভিভাবক, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, অভিভাবক নন এমন, শিক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট সবাইকেই দাঁড়াতে হবে শিক্ষা ধ্বংস করার এই প্রক্রিয়াকে রুখতে।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থী হিসাবে আমরা আসলে লড়ছি নৈতিকতার প্রশ্নে। আমাদের আন্দোলন অন্যায়ের বিরুদ্ধে। ন্যায় প্রতিষ্ঠার পক্ষে। ন্যায় প্রতিষ্ঠার এ লড়াইয়ে আপনারা যদি না থাকেন, তাহলে আপনারা অন্যায়কে সমর্থন করলেন, অন্যায়ের পক্ষে থাকলেন। আন্দোলনরত শিক্ষার্থী হিসাবে আমরা রাষ্ট্রের একটা অন্যায্য কর্মকে চ্যলেঞ্জ করলাম। এতে যদি এ যাত্রায় আমরা পরাজিত হয় রাষ্ট্র আরো স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠবে। এর মাশুল শুধু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসাবে শুধু আমি না এবং আমার অভিভাবকই নন, সবাইকেই গুনতে হবে।আসুন পাবলিক প্রাইভেট ভুলে আমরা সবাই এক কাতারে দাঁড়িয়ে শিক্ষার বাণিজ্য করণ রুখে দেই ।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ রাত ৩:১৭