দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের হীরক রাজা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বীরবিক্রমের কথাই শেষ কথা। সব নীতিগত সিদ্ধান্ত হয় এই হীরক রাজার মৌখিক নির্দেশে। কোথাও কোনো ফাইলে তার স্বাক্ষর নেই। তার প্রয়োজনও পড়ে না। মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা তার হুকুম পালন করেন মাত্র। তার কথার বাইরে কথা বলার সাহসও কারও নেই। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাদের মধ্যে গেজেট নোটিফিকেশনে সবার কাজের পরিধি চিহ্নিত করা হয়েছে। যেমন এইচ টি ইমাম সংস্থাপনবিষয়ক উপদেষ্টা, ড. কাজী আলাউদ্দিন আহমদ শিক্ষা ও রাজনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা, মেজর জেনারেল (অব.) তারিক সিদ্দিকী প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা, কিন্তু একজনের কাজের পরিধি নির্ধারণ হয়নি। তিনি আলো-আঁধারের খেলার রহস্যময় উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বীরবিক্রম। বিদ্যুৎ ও জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে তাকে সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব দেওয়া না হলেও তিনিই এ মন্ত্রণালয়ের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী সম্রাট। কারা বিদ্যুৎ প্লান্ট পাবে, কে কতটা পাবে, দর কী হবে_ তা সব তার মুখের কথায়ই হয়ে যায়। যেন আলাদিনের দৈত্যের মতো। কোম্পানি চাওয়া মাত্রই তিনি দিয়ে দিতে পারেন। দেশে আজিজ খান বা সামিট গ্রুপের তিনি খাস লোক। আমেরিকান কিছু গ্যাস কোম্পানির তিনি খাস মেহমান। এটা সবার কাছে ওপেন সিক্রেট। বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ে সাবেক প্রতিমন্ত্রী ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুর কার্যালয়টি এখন তার অফিস। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়েও তার অফিস রয়েছে। দুইজায়গায়ই তিনি দাপটের সঙ্গে বসেন। সরকারের ভেতরেই বলাবলি হচ্ছে অতীতে এই মন্ত্রণালয়ে জবাবদিহিতার কিংবা স্বচ্ছতার ঊধর্ে্ব তৌফিকের মতো প্রতাপশালী ভাগ্যবান কেউ আসেননি।
বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রী ব্রিগেডিয়ার (অব.) এনামুল হক ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত হয়েছেন। সুমহান মুক্তিযুদ্ধে তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীর অদম্য সাহস মাথায় গৌরবের বীরবিক্রম মুকুটখানি পরালেও আজ সরকারের আড়াই বছরের মেয়াদে এসে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে তিনি এক স্বৈরাচারী একনায়কের বিতর্কিত চরিত্রে আবির্ভূত হয়েছেন। তার আড়ালে-আবডালে তটস্থ কর্মকর্তাদের ফিসফাস গুঞ্জন নানা কৌতূহলের জন্ম দেয়। তাদের ভাষায়, তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীর মুখের কথাই এখানে আইন। তার ইচ্ছাই সবাইকে অনুসরণ করতে হয়। বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা আড্ডার ছলে প্রতিবেদককে বললেন, এখানে তুঘলকি কারবার চলছে। তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী যেন হীরক রাজার আসন নিয়েছেন। আর আমরা সবাই যেন কোরাস করে বলছি, 'যায় যদি যাক প্রাণ, হীরক রাজা ভগবান'। সরকার বিদায় নিলে মামলা আর হয়রানির নির্দয় দহনে অনেককেই হয়তো পড়তে হবে। কিন্তু তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বীরবিক্রম যা চেয়েছেন তা করতে পেরেছেন। ভবিষ্যতে দুঃসময় এলে সবাই কারাগারে গেলেও তিনি আমেরিকার বিলাসী জীবনকে বরণ করে নিতে পারবেন অনায়াসে। এর মানে কী, জানতে চাইলে ওই কর্মকর্তা বললেন, 'ইশারা হি কাফি', কান পাতলেই সব খবর পেয়ে যাবেন। লুকোচুরি কিছুই হচ্ছে না।
ইতিহাসের সব রেকর্ড ভঙ্গ করে কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্লান্টের নামে তার একান্ত আপন ব্যবসায়ীদের হাতে বিদ্যুৎ খাত তুলে দিতে পেরেছেন তিনি। এমন আইন তার জন্য করতে হয়েছে সরকারকে, যার মাশুল ভবিষ্যতে কাকে দিতে হবে এই চিন্তায় অনেকেই উদ্বিগ্ন।
তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বীরবিক্রমের বিদ্যুৎ খাত নিয়ে কেলেঙ্কারির ইতিহাস এবারই নতুন করে ঘটেনি। আওয়ামী লীগের আগের শাসনামলে এই মন্ত্রণালয়ের সচিব থাকাকালে রুরাল পাওয়ার কোম্পানি নামে একটি বিদ্যুৎ কোম্পানিকে ময়মনসিংহে ৭০ মেগাওয়াটের একটি প্লান্ট দেওয়া হয়, যার ব্যয় হয়েছিল ৬৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। অথচ একই ক্ষমতাসম্পন্ন ফেঞ্চুগঞ্জের প্লান্ট পিডিপি ৩৫ মিলিয়ন ডলারে নির্মাণ করে। এ ঘাপলার রহস্যময় তাৎপর্য নিয়ে নানা কথা উঠেছিল। গুজব না সত্যি, তা জানা না গেলেও বাতাসে খবর রটেছিল আমেরিকায় একজনের অ্যাকাউন্টে ৯০ হাজার ইউরো জমা হয়েছিল। বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের শাসক তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বীরবিক্রম দায়িত্ব গ্রহণের পর আগুন লেগে বন্ধ হয়ে যাওয়া ঘোড়াশাল ও আশুগঞ্জ বিদ্যুৎ প্লান্ট সচলে আগ্রহী নন। তার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুই নাকি বেসরকারি খাতে নতুন নতুন প্লান্ট তার পছন্দের কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়া। বিনা টেন্ডারে বিদ্যুৎ প্লান্ট কোনো কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়ার আড়ালে বা গোপন আঁধারের খেলায় যে ব্যক্তিগত প্রাপ্তি ঘটে তার সুখ অন্য রকম। এটা প্রমাণ করা যায় না, উপলব্ধি করা যায় আর বোঝা যায়। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাদের মধ্যে জেনারেল তারিক সিদ্দিকী, ড. গওহর রিজভী, ড. কাজী আলাউদ্দিন আহমদ, এইচ টি ইমাম, ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলীর পরিশ্রমের স্বাক্ষর পাওয়া যায়, চোখে দেখা যায়। একজন উপদেষ্টারই শুধু কষ্ট-পরিশ্রমহীন অস্বচ্ছ লাভজনক সাম্রাজ্য রয়েছে, তিনি হলেন ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বীরবিক্রম। সর্বত্র তার ছায়া। সর্বত্র তার উপস্থিতি। সর্বত্র তার নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালিত হয়। কিন্তু কোথাও তাকে প্রমাণ রেখে যেতে হয় না। জিনের বাদশার মতো এই অলৌকিক ক্ষমতাধর মানুষটির নির্দেশে বিভিন্ন কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি, বিদেশি মেহমানদের সঙ্গে বৈঠক, সবই হয়। অসহায় প্রতিমন্ত্রী চাকরি-বাকরির কিছু তদবির-টদবির করে আর এলাকা শাসন নিয়ে খেয়ে-পরে বেঁচে আছেন মাত্র। আমলারা বলেন, আহা! বেচারা প্রতিমন্ত্রীর জন্য বড্ড মায়া হয়।
সরকার যখন ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প গ্রহণ করল, তখন টার্গেট ছিল ৫২০ মেগাওয়াটের আটটি প্রকল্পের। কিন্তু গত বছরের এপ্রিলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মন্ত্রণালয় পরিদর্শনে আসার আগের দিন নাটকীয়ভাবে ৮০০ মেগাওয়াট করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কোনো ধরনের সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়াই দুই-তিন দিন পর এটা এক হাজার ২০০ মেগাওয়াটে পরিণত করা হয়। যখনই খবর ছড়িয়ে গেল ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হচ্ছে, তখন মৌমাছির মতো, 'কানামাছি কানামাছি কোথা যাও নাচি নাচি' বলে দলে দলে পার্টি আসতে থাকল তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীর দরবারে। তিনি ভাবলেন, এই সুবর্ণ সুযোগ হেলায় হারানো যাবে না। যদি টেন্ডারে যেতে হয় তাহলে তার খাস লোকদের কাজ দেওয়া যাবে না। আর তার কীইবা আসে যায়! তিনি রাজনীতিবিদ নন, জনগণের প্রতিনিধিও নন। যদি কলঙ্ক হয় তাহলে তার ঢোল আওয়ামী লীগ সরকারের গলায় ঝুলবে। তিনি দ্রুত সম্পন্ন করার নামে বিনা টেন্ডারে বিদ্যুৎ প্লান্ট দেওয়ার আইনি কাজটি সরকারকে দিয়ে কবুল করালেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জনগণের বিদ্যুতের চাহিদা পূরণে বরাবরই আন্তরিক। দেশকে অন্ধকার থেকে আলোর জগতে বের করে এনে ব্যবসা-বাণিজ্যের চাকা সচল করতে তার আন্তরিকতার ঘাটতি নেই। তাই তার সরকার দুই মাসের মধ্যে বিদ্যুৎসংক্রান্ত পরিকল্পনার ঘোষণা দিতে চেয়েছিল। সেখানে তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী তার হিসাব-নিকাশ থেকে এ ঘোষণা দিতে ১০ মাস লাগিয়েছেন। তার পছন্দের লোকদের কাজ পাইয়ে দেওয়ার জন্য তার এই বিলম্বের কারণ বলে প্রকাশ্যে বলাবলি হয়ে আসছে। তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বিদ্যুৎ প্লান্ট নিয়ে এখন যতটা বেপরোয়া-আগ্রাসী তার ধারেকাছেও নেই জ্বালানি নিয়ে। তিন-চার বিলিয়ন ডলারের প্রজেক্ট করতে চান যা কাতার থেকে আমদানি করে বড় কোম্পানিকে দেওয়া হবে। এ জন্য দুই-তিন বছরে কোনো অগ্রগতি নেই। সরকারের অপর মহল থেকে যখন গ্যাস প্রশ্নে জানতে চাওয়া হয়, তখন বলছেন সময়মতো আসবে। সরকারের ৭৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্লান্ট গ্যাসের জন্য সচল করা যাচ্ছে না। এগুলো সচল না করে গ্যাস আমদানির কথা ভাবছেন। সরকারের গ্যাসভিত্তিক গ্যাস প্লান্টে ইউনিটপ্রতি উৎপাদন খরচ হয় দেড় থেকে দুই টাকা। কুইক রেন্টালে উৎপাদন খরচ সর্বনিম্ন ১০ ও সর্বোচ্চ ২২ টাকা পর্যন্ত পড়বে প্রতি ইউনিটে। জ্বালানিসচিব থাকাকালীন বিদ্যুৎ খাতের শাহেন-শাহ আজিজ খানের কেপিসিএলের মাধ্যমে যে পরকীয়া সম্পর্ক তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী গড়েছিলেন সেই সম্পর্ক এখন রমরমা। আজিজ খানের সামিট গ্রুপের হাতে এখন বিদ্যুৎ খাতের সিংহভাগ। অবাক বিস্ময়ে মানুষ দেখে কীভাবে নির্লজ্জের মতো সামিট গ্রুপকে একাই আটটি পাওয়ার প্লান্ট দেওয়া হয়। এখন তারা গ্যাসভিত্তিক প্লান্টও চান। জ্বালানিসচিব থাকাকালে দাউ দাউ করে মাগুরছড়া গ্যাস ফিল্ডে আগুন জ্বলেছিল। সেদিনের আমেরিকান কোম্পানি অক্সিডেন্টাল এখন শেভরন।
তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী মূল চুক্তির বাইরে সম্পূরক চুক্তি করায় বাংলাদেশ এখনো প্রাপ্য ৩৩ হাজার কোটি টাকা পায়নি শেভরনের কাছ থেকে। ছাতক ও টেংরাটিলা গ্যাস ফিল্ড জীবন্ত ক্ষেত্র হলেও পরিত্যক্ত দেখিয়ে তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী দিয়েছিলেন বিতর্কিত নাইকোকে। নাইকোর এদেশীয় এজেন্ট কাশেম শরীফ নাকি তার ভাগ্নে। জানা যায়, বিএনপি আমলে চুক্তি হলেও প্রক্রিয়া বা সূচনার অভিষেক ঘটেছিল তার সময়ে। ফুলবাড়ী কয়লাখনিতে এশিয়া এনার্জির সঙ্গে বিএনপি আমলে যে চুক্তি হয়েছে সেটিরও প্রক্রিয়া তার হাত দিয়ে শুরু। যেখানে জ্বালানি, যেখানে বিদ্যুতের বড় বড় ব্যবসা ও কোম্পানি সেখানই তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী।
-পীর হাবিবুর রহমান
সূত্র:বাংলাদেশ প্রতিদিন
(কপিপেষ্ট করার জন্য দুঃখিত)