আজকাল বাচ্চাদের শৈশব স্মৃতি বাচ্চারা নিজে বুঝবার আগেই বাবা মায়েরাই নানা রং এ নানা ঢং এ রুপকথাময় সব স্মৃতি তৈরী করে ফেলেন তাদের জন্য। সেই একদিন বয়সের বাচ্চা থেকে স্যুইট সিক্সটিন পর্যন্ত ফটোগ্রাফী দিয়ে, ভিডিও দিয়ে স্মৃতি ধরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যান। হয়ত পারলে মায়ের পেটের ভেতরেও বাচ্চা কেমনে বড় হলো সেই স্মৃতিও ধরে রাখতেন তারা।
আহা কি সুন্দর সব স্মৃতিময় ছবি ছাবা আর ভিডিও! আমি দেখে মুগ্ধ হই আর মুগ্ধ হই!
আর আমার শৈশবের স্মৃতিগুলি! হায় বেদনার। শুধুই বেদনার। বড়ই বেদনার!
আজ লিখছি আমি সে সব বেদনাময় শৈশব স্মৃতির উপাখ্যান। আমি বোধ হয় ছোট থেকেই বড়ই শিল্পপ্রেমী ছিলাম কিন্তু আমার মায়ের ভাষ্যমতে আমি ছিলাম হাড় জ্বালানী হাড়মুলি টাইপ বাচ্চা কিন্তু আমি জানি আমি আসলেই ছিলাম একজন শিল্পপ্রেমী এবং এ সব শিল্পের মাঝে ছবি আঁকার ব্যপারটাই আমাকে সবচাইতে বেশি আকৃষ্ট করেছিলো তবে ঠিক কবে কখন পৃথিবীর এই অষ্টম আশ্চর্য্যের চাইতেও বেশী অবাক করা ভালোলাগার বিষয়টাতে আগ্রহী হয়েছিলাম সে কথা মনে করবার চেষ্টা করলেই স্মৃতি বিস্মৃতির অতল গহ্বর খুড়ে প্রথম যে শিল্পীর আঁকা ছবি দেখে মুগ্ধ হয়েছি বলে মনে পড়ে সেই শিল্পী আর কেহ নন স্বয়ং আমার মা। উফ এতক্ষন দাঁড়ি কমা বিহীন এত বড় লম্বা চওড়া কথা বলে হাফিয়ে উঠলাম। যাইহোক বলছিলাম আমার ছবি আঁকার প্রতি ভালোবাসা শুরুর শৈশবের ইতিহাস। একদিন মায়ের হিসেবের ডায়েরীর এক পাশে ছোট্ট করে আঁকা দেখলাম একটি মেয়ের মুখ। মনে হয় রোজকার বাজারের ফর্দ বা হিসেব নিকেশের যোগ বিয়োগ করতে গিয়েই, আনমনে কলমের একটানে এঁকেছিলেন তিনি সে প্রোট্রেইটখানি আর সেই ছবিই সেদিন সূচনা করে দিলো একজন সম্ভাবনাময়ী, ভবিষ্য শিল্পীর অঙ্কন চর্চার সুদূর ইতিহাসের স্বর্ণযুগের। সে ছবিটির একমাত্র মুগ্ধ দর্শক যে আমি ছিলাম সে আর কেউ জানুক না জানুক আমার মা জননী জেনে গিয়েছিলেন খুব অচীরেই।
কারন ঠিক তার এক মিনিট পর থেকেই তার হিসেবের খাতায় যেখানে সেখানে, যত্র তত্র সেই মেয়ের মুখখানি একটানে, দুইটানে, তিন, চার বা পাঁচ টানেই মনের মত করে আঁকবার ব্যর্থ প্রচেষ্টারত আমার মত অক্লান্ত পরিশ্রমী, অধ্যবসায়ী শিল্পীর অব্যাহত অঙ্কন চর্চার কথা তিনি কি আর না জেনে পারতেন? মায়ের ছিলো খুব অদ্ভুত রকমের সুন্দর একটা জাপানীজ কলম। এক জাপানী মেম কলমটা মাকে দিয়েছিলেন। দেখতে একদম খাপ খোলা একটা লিপস্টিক। গোলাপী লিপস্টিকটা মাথা বের করে আছে। এই কলমটার উপর আমার যে কি পরিমান দূর্বার ঝোঁক ছিলো, তা আমি বলে বুঝাতে পারবোনা। সুযোগ পেলেই মা যখন রান্নাঘরে বা পাশের বাড়িতে বেড়াতে যেতেন, আমি থাকতাম তক্কে তক্কে। কলমটা খুলেই আঁকিবুকি শুরু করতাম। সেটা ছিলো ঝর্না কলম । অমন কলম আজকাল আর দেখিনা। তবে কি যে ভালো লাগে কলমটার কথা ভাবতেই। তবে মা আমার নানা রকম শখের মতন এই শখটারও মোটেই মূল্য দিতেন না। আমি তার কলম ধরলেই কি করে যেন তিনি বুঝে যেতেন। হয়ত কলমের খাপটা আমি ঠিকঠাক লাগাতেই পারতাম না আর অমন তেড়াবেকা লাগানো দেখেই বুঝে ফেলতেন মা যে এই কলম ধরেছেন কোন নিমাই দ্ত্ত!
আর তারপর পিঠের উপর দুমদাম গুড়ুম গাড়াম আর আমার ত্রাহী চিৎকারে দাদু, ফুপু, চাচা, চাচীরা কেউ এসে বাঁচাতেন আর বলতেন "আহা এমন করো কেনো? ও বড় হয়ে পাবলো পিকাসো হতে চায়। "
আজকালকার বাচ্চাদের যেমন বাবা মায়েরা নানা রকম রং পেন্সিল, প্যাস্টেল, ক্রেয়ন কিনে দেন আমার ছোটবেলায় মোটেও সেটা আমার ছিলো না। আমি জানতামও না এমন করেও কেউ তার আঁকা ছবি নানান রঙ্গে রাঙ্গাতে পারে। কিন্তু ঐ যে কথায় আছে না ক্রিয়েটিভ মানুষেরা যেভাবেই হোক কিছু একটা বুদ্ধি বের করেই নেবে। তো আমারও সেটাই হলো। মায়ের ড্রেসিং টেবিলটাই হলো আমার সেই রং বেরং এর ছবি রাঙ্গানোর সরঞ্জামের স্থান। মায়ের খোপকাটা কুমকুমের বাক্সটা, সে যে কি সুন্দর আরেক ভালো লাগা। আজকাল তো সেটাও আর দেখিনা। একটা গোল বক্সে ঠিক ওয়াটার কালারের মত থরে থরে সাজানো গোল গোল নানান সব লাল নীল, হলুদ কমলা মনহরনকারী রঙ। কুমকুমের বক্সটা খুলে একটা ছোট্ট সাদা প্লাস্টিকের কাঠি দিয়ে মা কপালে টিপ আঁকতেন। আমার কাছে এমন লোভনীয় জিনিস খুব কমই ছিলো। তবে তা নিজের কপালে টিপ আঁকবার জন্য নয় মোটেই। সে সব রঙে আমি চাইতাম আমার বর্ণহীন ছবিগুলো রাঙিয়ে দিতে। মায়ের কুমকুমের গোল বাক্সে কত নানা রকমের রং আর লিপিস্টিকের লাল রংটা ঠিক যেন লাল টকটকে গোলাপের পাপড়ির রং। আর মাঝে মাঝেই মা লালের উপর সেই কুমকুমের বাক্স থেকে সাদা রংটা বুলিয়ে দিলেই সেটা হয়ে উঠতো অদ্ভুত আরেক নতুন রং গোলাপী। এমন ম্যাজিকাল কারিশমা! আমি হা করে চেয়ে চেয়ে দেখতাম কিন্তু মা তো সে সব আমাকে ধরতেই দেবেন না। তাই আমিও তক্কে তক্কে থাকলাম।
যেই না মা দুপুরবেলা খেয়ে দেয়ে ঘুমাতে গেলেন। বাসার অন্য সকলেরাও ভাতঘুমে বিভোর। কাজের মানুষ থেকে শুরু করে দাদীমা পর্যন্ত ঘুমুচ্ছিলেন নাক ডেকে! আমিও সেই মোক্ষম সুযোগ কাজে লাগিয়ে মায়ের কুমকুমের বাক্স আর তার নতুন কেনা ম্যাডোরা লিপস্টিক আর টিবেট নেইলপলিশের বটলটা নিয়ে পা টিপে টিপে ছাঁদের ঘরে উঠে এলাম। তারপর ছাঁদে দড়িতে মেলে দেওয়া দাদীমার সাদা ঝকঝকে শাড়িটা টেনে নিয়ে ছাদের কোনের ঘরে মেঝেতে মেলে তার উপর লাল নীল হলুদ সবুজের নক্সা করতে বসে গেলাম। আচ্ছা মতন মনের সাধ মিটিয়ে রাঙিয়ে দিলাম নানান রঙে সাদা ধপধপে শাড়ীটা। লাল নীল হলুদ কমলা বেগুনী নানান সব রঙে শাড়ীটা কি যে সুন্দর লাগছিলো। আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিলাম নিজের সৃষ্টির দিকে! হঠাৎ গগণ বিদারী চিৎকারে সাড়া বাড়ী জেগে উঠলো। আমি তাকিয়ে দেখলাম আমাদের বাসার নতুন বুয়া রুখমনিয়া অতি ভয়ার্ত চোখে দাঁড়িয়ে রয়েছে আমার পিছে।
রুখমনিবুয়া মনে হয় ছাদে মেলে দেওয়া শুকানো কাপড় তুলতে এসে দেখেছিলো দাদীমার সাদা ধপধপে শাড়ি ক্যানভাসে আমার লাল নীল হলুদ সবুজ কুমকুম লিপস্টিক মিডিয়ার অপরুপ কারুকার্য্যময় শিল্পকর্ম। আমার এত সৌন্দর্য্য শিল্পকর্মে সে মুগ্ধ না হয়ে আমাকে অবাক করে দিয়ে আতংকিত হয়ে সে কিনা অমন এক হৃদয় বিদারক গগণ ফাটায়ক চিৎকার দিলো! সেই চিল চিৎকারে আমার পিলে চমকানোর আগেই দেখি পুরো বাড়ির লোকজন জেগে জড়ো হয়েছে আমার চার পাশে।
মা খুবই বেরসিকের মত সামনে এগিয়ে এলেন আর এসেই সাড়াশীর মত চেপে ধরলেন আমার কান আর তারপর পিঠের উপর ধুপধাপ গুড়ুম গাড়াম। আমি কাঁদতে কাঁদতে বুঝতেই পারলাম না আমার এত সুন্দর শিল্পকর্ম দেখে তারা মুগ্ধ না হয়ে রাগান্বিত হয়ে উঠলো কেনো!
এরপর মায়ের কলম, কুমকুমের বাক্স লিপস্টিক এসব চলে গেলো আমার ধরাছোঁয়ার বাইরে। এমন কি কাপড় শুকুতে দেবার দড়িটাও অনেক উপরে উঠিয়ে দেওয়া হলো আমার নাগালের বাইরে। তাই বলে কি আমি পাবলো পিকাসোর চিত্রকর্ম বা সৃষ্টিশীল প্রতিভা ঠেকে থাকতে পারে? আমি আবিষ্কার করে নিলাম নতুন রকম অঙ্কনের সরন্জামাদি।
ছাদে খেলতে গিয়ে একটুকরো ইট পেয়ে গেলাম মনের মত। যে ইট দিয়ে অনায়াসে ছবি আঁকা যায় ছাদের খরখরে মেঝেতেই (অনেকেই হয়ত ভাবছেন এই মহিলার সমস্যাটা কি ছাদ আর ছাদের ঘর কি এর পিছু ছাড়ে না!) সে যাইহোক বলছিলাম ইটের টুকরোয় ছাদের মেঝেতে ছবি আঁকার আবিষ্কারের কথা। ইট দিয়ে ছবি আঁকতে আঁকতেই আমি হয়ে উঠলাম ইটতুলি বিশারদ। কোনো কোনো ইটের টুকরো খুবই শক্ত টাইপ আর লাল টকটকে মোটেই ভালো ছবি হয় না তা দিয়ে আবার কোনো কোনো ইটের টুকরো মোলায়েম যেন মাখন সেগুলোর রং একটু ফ্যাকাশে কিন্তু তা দিয়ে ছবি উঠে আসে অনায়াসেই। সে যাইহোক সেবারে আমার চাচাতো ভাই তখন মনে হয় নাইন টেনে পড়তো। তার সাইন্স প্রাকটিক্যাল খাতায় সে জবাফুল এঁকেছিলো । আমাকে আদর করে আবার সে তার খাতাখানা খুলে দেখিয়েছিলো কি করে জবাফুল এঁকেছে সে। আমার প্রতি বোধ করি তার অনেক দয়া ও মায়া হয়েছিলো আমার চিত্রকর্মের প্রতি অতিশয় আগ্রহ মনোভাব দেখে। তাই দেখে আমিও শুরু করলাম ইটের টুকরোয় জবাফুল অঙ্কন প্রাকটিস আমাদের বাসার ছাদে। এর পর আবিষ্কার করলাম ইটের টুকরো পানিতে ভিজিয়ে নিলেও সে হয় আরেক মহা রঙ্গিন আবিষ্কার।
যাই হোক আবিষ্কারক আমি একদিন মহা আবিষ্কারের সুযোগ পেয়ে গেলাম আবারও। চাচাত ভাইয়া ঈমনের প্রাকটিক্যাল খাতাটা তার পড়ার টেবিলে খোলা পড়ে ছিলো। হয়তো পরীক্ষা আসন্ন হওয়ায় কিছুক্ষণ আগেই সে পড়া ছেড়ে উঠেছিলো। আমি মহা সুযোগটা হাতছাড়া করলাম না। সেটা নিয়ে উঠে এলাম চুপিচুপি আবারও বাসার ছাদে। এক এক পাতা উল্টাই আর মুগ্ধ অপার বিস্ময়ে দেখি, জবাফুল, ব্যাঙ , কেঁচো আরো কত কি? আহা কোন বুদ্ধিতে, কোন যাদুর ছোঁয়ায় মানুষ এঁকে ফেলতে পারে অনায়াসে এসব? মুগ্ধতার পর মুগ্ধতা। হঠাৎ নীচ থেকে হাউকাউ চিল্লাচিল্লি। উঁকি দিয়ে দেখি ঈমন ভাইয়া উঠানের মাঝে তূর্কী নাচ নাচছেন আর বাড়ীর সবাই কার যেন নাম ধরে খুঁজাখুঁজি করছেন। ভালো করে কান পেতে শুনলাম সে আর কারো নাম নয় সে আমারই সুমধুর নাম। একেবারে কানের ভেতর দিয়া মরমে পশিলো গো! কিন্তু ভয়ে তো ছাদ থেকে নামবার কোনো উপায় খুঁজে পেলাম না। এখন খাতা নিয়ে নামলেই তো বিপদ। ভাবলাম একটা কাজ করা যাক উপর থেকেই ঈশ্বর প্রদত্ত কোনো আলৌকিক বস্তুর মত ফেলে দেইনা খাতাটা। যেই ভাবা সেই কাজ তবে বদমাশ খাতাটা নিউটনের সূত্রের যথার্থতা পালন করতে গিয়ে, আমার মত ছোট্ট অবুঝ শিশুকে মাধ্যাকর্ষন শক্তির ক্রিয়াকলাপ হাতে নাতে বুঝাতে সোজা গিয়ে পড়লো উঠানের একধারে খোলা ড্রেইনের মাঝে আর তারপর....
আমার বলার কিছু ছিলোনা.. চেয়ে চেয়ে দেখলাম খাতা ড্রেইনের মাঝে...
যেহেতু আমি অস্থিমজ্জায় শিল্পী কাজেই কেউ আমাকে শিল্প না শেখালেও শিল্পের নানান দিক আমার মাথায় খেলবেই আর তাই তখন আর্ট এন্ড ক্রাফ্ট কাকে বলে না জানলেও আমার মাথায় পাবলো পিকাসোর ভূত মনে হয় চুপি চুপি বলে দিলো আর্ট ক্রাফ্ট এবং কাটিং পেস্টিং বা হয়ত ম্যুরাল শিল্পের কথাও আর তাই তো আমার মাথায় অমন সুবুদ্ধি চেপেছিলো। মায়ের নানা রকম ম্যাগাজিনে কি সুন্দর সব ছবি। সিনেমার নায়িকা থেকে শুরু করে ফুল ফল লতা পাতা কত কি? আমি কিছুদিন আগে রাস্তায় গাড়ি করে ছুটে যাবার সময় দেখেছিলাম এক বেড়ার বাড়ির দরজায় বেড়ার গায়ে খবরের কাগজ বা ম্যাগাজিনের কাটিং সিনেমার নায়িকা ববিতা শাবানা কবরীদের ছবি গ্লু দিয়ে লটকিয়ে রেখেছে। আমার মাথায় তখনই এসেছিলো মায়ের তো অমন সব ছবিওয়ালা ম্যাগাজিন আছে। সাথে সাথেই ফন্দী আটা। মা কিচেনে যেতেই আমি মায়ের সেলাইমেশিনের বক্সে রাখা ইয়া বড় কাপড় কাটার কাঁচিটা চুপি চুপি বের করে সে সব ম্যাগাজিনের ছবি কাটতে বসলাম। একই সাথে মামীর দেওয়া খুব সুন্দর একটা খেলনা টেলিভিশন যা ব্যাটিরীসেটিং না তবে হাত দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ছবি চেঞ্জ করতে হয় সেটা বাড়ি দিয়ে ভাঙ্গলাম আর সেগুলোর ছবিও কাটলাম। কারন সে সবের মাঝেও ছিলো ববিতা শাবানা কবরীদের ছবি। সেসব ছবি গ্লু না থাকায় গ্লু এর বিকল্প পানি দিয়ে ভিজিয়ে ভিজিয়ে সেটে দিলাম মায়ের সবচেয়ে শখের পলিশ করা কাঁঠের বইএর আলমারীতে এবং একইসাথে দেওয়ালে, দরজায় জানালায়। মা কিচেন থেকে ফিরে চারিদিকে তাকিয়ে দেখে চক্ষু চড়কগাছে তুললেন আর সব শেষে পানি লেগে বার্নিশকরা কাঠের আলমারীর চেহারা দেখে মায়ের চেহারাও এক নিমিষে পালটে গেলো আর তারপর ধুপধাপ ধুড়ুম ধাড়ুম।
তখন আমি ক্লাস টু তে পড়ি। আমার এক অতি প্রিয় টিচার আক্তার স্যার, যার নাম আমার হৃদয় আকাশে এখনও উজ্জল নক্ষত্রের মত জাজ্বল্যমান। তিনি সবাইকে বললেন পরদিন একটা করে যার যা ইচ্ছা ছবি এঁকে আনতে। আমি বাসায় ফিরে মাকে বললাম আর তারপর আমার এতদিনের অবিরল চিত্রকর্ম চর্চা করা বিষয়গুলো থেকেও কি আঁকবো কি আঁকবো করে কিছুই ভেবে পেলাম না। বরং কি আঁকবো কি আঁকবো করে মায়ের জীবন অস্থির করে তুললাম। বিরক্ত হয়ে মা একটা চিঠি লেখা প্যাডের সাদা কাগজ ছিড়ে কলসী কাঁখে নদীর ধারে গাঁয়ের বধু এঁকে দিলেন। বললেন, যা এইটা নিয়ে স্যারকে দিয়ে দে আর আমার জান বাঁচা এইবার।
আহা আমি এত বড় চিত্রশিল্পী হয়ে নিজের আঁকা ছবি না দিয়ে মায়ের আঁকা দেবো কেনো? আমার কি প্রেস্টিজ জ্ঞান নেই? আমি এরপর বসলাম নিরলস প্রচেষ্টায় মায়ের আঁকা ছবিখানি কপি করতে। শেষমেশ অক্লান্ত প্রচেষ্টায় রাত ১১টা অবধি একখানা ছবি দাঁড়া করালাম। গ্রামের খড়ের ছাউনি দেয়া কুড়েঘর, পাশে কলাগাছ, আকাশে সূর্য্য, মেঘ, পাখি সেসবও জুড়ে দিতে ভুললাম না। তারপর সে ছবি বাসার একে দেখাই তাকে দেখাই। কেউ পাত্তাই দেয় না। শেষমেষ একটু পাত্তা পেলাম আমাদের বাসার বুড়ো দারোয়ান জামালভাইয়ার কাছে। পকেট হাতড়ে বের করে আনলেন তিনি হালকা সবুজ ক্রেয়নের ভাঙ্গা আধখানা টুকরা। বললেন, এটা দিয়ে কালার করো মামনি।
আমার কাছে তখন সেটাই সবে ধন নীলমনি। নানা নীলমনি না, সবুজমনি। আমি সেই ছোট্ট আধখানি হালকা সবুজ রঙ লুফে নিলাম। কিছু না হোক কলাগাছটাতো রঙ করা যাবে। যেই ভাবা সেই কাজ।
শুরু করলাম কলাগাছে রঙ লাগানো। বাহ!! কি সুন্দর লাগছে কলাগাছটা এখন, ঠিক যেন কলাগাছের মতই। কলাগাছের ছেড়া ছেড়া কচি কলাপাতা রঙ করা নিজের ছবিটার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষন। তখন আবার বাসার সবাই ঘুমাতে গেছে। কোথাও কোনো সাড়া শব্দ নেই। কিছুক্ষন পর মনে হলো আরে গায়ের বঁধুর শাড়িটাও কলাপাতা রঙ হতে পারে। যেই ভাবা সেই কাজ। করে দিলাম সবুজ রঙ শাড়ি গায়ের বধু। মনটা উসখুস করতে লাগলো। ধ্যাৎ পুরো ছবিতে শুধু কলাগাছ আর শাড়িটাতেই রঙ করা গেলো। নদী, বাড়ি আকাশ, বাতাশ সেসব কে রঙ করবে এখন!! ধ্যাত দেই না হয় এবার আকাশটাকেও সবুজ রঙ করে। কি আর হবে!!!সন্ধ্যার দিকে আমি একবার সবুজ সবুজ অমন আকাশ দেখেওছিলাম কাজেই হতেই পারে আকাশ সবুজ। এর কিছুপর দিলাম বাড়িটাকেও সবুজ করে। পথে যেতে একবার সবুজ রঙ কার যেন টিনের বাড়ি দেখেছি আমি। এর পর সূর্য্য, নদী, ফুল, পাখি, পাতা, মেঘ, নৌকা, মাঝি, ঝোপ, ঝাড়, সব ঘচাঘচ সবুজ রঙ হতে লাগলো।
পরদিন স্কুলে......
আক্তার স্যার একে একে সবার ছবি হাতে নিয়ে দেখছেন। আমার পালা আসতেই আমি হাসি হাসি মুখে স্যারের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। এই বুঝি স্যারের অবাক মুগ্ধ দৃষ্টি ঝরে পড়বে আমার ছবিখানির দিকে। কিন্তু একি!!! তার বদলে স্যারের আৎকে ওঠা!!:-*
:এই সব কি আঁকছো!!! ফুল, পাতা, লতা, ঘাস, বাড়ি, ঘর, নদী, মেঘ, আকাশ দীন দুনিয়া সব সবুজ রঙে রঙীন!!
আর এইটাই বা কি ! খ্যান্ত বুড়ি নাকি ! খ্যাক খ্যাক খ্যাক........
আমার অক্লান্ত পরিশ্রম ও নিরলস প্রচেষ্টার পর অনিদ্র রাত কাঁটিয়ে আঁকা কলসী কাঁখে গায়ের তরুণী বঁধুটার মুখ ততক্ষনেই খেয়াল করে দেখলাম, আমি সেটা এঁকে ফেলেছি গাল তোবড়ানো আশী বছরের বুড়ির মত করে।
যাইহোক রঙতুলি ইটতুলি কাঁঠতুলি কিংবা খ্যান্তবুড়ি ছেড়ে আমার মন পড়েছিলো আগুন নিয়ে খেলায়। অবাক হয়ে দেখতাম বটে সবাই কি সুন্দর ফস করে দিয়াশলাই জ্বালিয়ে আগুন বের করে। দাউ দাউ জ্বলে ওঠা কি সুন্দর রং ঐ আগুনের শিখাটার! খুব অবাক আর মুগ্ধ হতাম আমি। মোমের শিখা, চুলার আগুন, এমনকি সিগারেটের আগুনের ফুলকির সৌন্দর্য্যেও বিমোহিত ছিলাম আমি। আমিও জ্বালতে চাইতাম অমন করে বারুদের আলো। কিন্তু মা তো সেটা দেবেনই না বরং উঁচু আলমারীর মাথায় উঠিয়ে রাখলেন। তবে আমার সেই মোক্ষম সময় ঠিক দুক্কুরবেলা ভূতে মারে ঠেলা। মা ঘুমাতেই চুপি চুপি টেবিলের উপর উঠে লুকানো দিয়াশলাই হাতে নিয়ে টেবিলের উপর দাঁড়িয়েই ফস করে জ্বালিয়ে দিলাম লকলকে আগুন। ঠিক ঠিক পেরেছিলাম তবে শুধু দিয়াশলাই কাঠিতেই না বুকে লেস লাগানো ডিজাইন জামার লেসটাতেও। এমন সময় কই থেকে ছুটে এলো মা। তারপর এক নিমিষে হাতের মুঠোর লেসশুদ্ধ আগুনটাকে চেপে ধরে নিভিয়ে ফেললেন আগুনটা আর তারপর চিরায়ত ধুড়ুম ধাড়ুম গাড়ুম গুড়ুম।
আমাদের বাসাটার সামনে ছিলো বিশাল ফুলবাগান ও পিছনে ছিলো ফল ও সবজী বাগান। সেখানে ফুটে উঠতে দেখলাম আমের মুকুল। কি তার অদ্ভুত সুবাস। প্রাণ জুড়িয়ে যায়। আমের ফুলকেই নাকি আমের মুকুল বলে আর মুকুল থেকে নাকি হয় ছোট্ট ছোট্ট বাবু আম। একরাতে ঝড়ে কিছু আম ঝরে পড়লো। মা বললেন ভালো হয়েছে এসব দিয়ে আচার করা যাবে। বুয়া বলল "আপামনি কাল তোমাকে কাঁচা আমের ভর্তা খুবই মজাদার খাওয়াবো।" জিভ দিয়ে টকাস করে এমন শব্দ করলো সে আমি ভাবলাম না জানি কি সে মজার খানা! আমি অপেক্ষা করে রইলাম পরদিনের আমভর্তার জন্য। কিন্তু পরদিন সেকথা বলতেই মা বল্লেন "এসব খেতে হবেনা এখন, দুপুরে খাবার পরে দেখা যাবে " কিন্তু দুপুরে খাবার পরে সে কথা মা বুয়া সবাই ভুলে গিয়ে দিবানিদ্রায় মগ্ন হল। কি আর করা যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে। আমি তাই একলাই সেই কার্য্য হাতে তুলে নিলাম। কারণ আমার সকল ক্রিয়েটিভির সকল একলা চলার মোক্ষম সময়টাই ছিলো ঠিক দুক্কুরবেলা আর তখনই সকল ক্রিয়েটিভিটির ভূত আমার মাথায় ঢেলা মারতো। যাইহোক আমের ঝুড়ি থেকে তুলে নিলাম দুটো, তারপর চারটে তারপর পাঁচ ছয় সাত আট আম। কিচেন কাউন্টারের তখন সবাই বলতো সেল্ফ তার নীচে থেকে দুইটা বটির ছোটটা বের করে আনলাম। সেটা নাকি মাছ কাটার বটি। বড়ই ধারালো। সেটাই আমার সাইজমত পেলাম। অন্যটা ভীষন বড় টানতেই পারিনা। যাইহোক ছোট বটিটা আর কোচড় ভর্তি আম নিয়ে আর একটা আম বাম হাতে ধরে ডানহাতে আমের আরেক সাইড ধরে দিলাম ঘ্যাচ! প্রথম প্রচেস্টাতেই আমের বদলে সোজা নিজের বুড়ো আঙুল দুভাগ করে ফেল্লাম আর তারপর গলগল রক্ত! ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি সব আম মাটিতে ফেলে বটি মটি ছুড়ে দিয়ে সোজা ছুটলাম। মাথায় চিন্তা ব্যান্ডেজ করতে হবে। মা বা কাজের বুয়ারা হাত কাঁটলেই আঙ্গুলে জড়ায় কাপড়ের ফালি। আমি তেমন পাবো কই! এইদিকে রক্ত গলগল ভাসাভাসি কান্ড। তাড়াতাড়ি কোনো কূলকিনারা না পেয়ে সোজা পুতুলের বাক্সের অতি প্রিয় বউ পুতুলের লাল টকটকে শাড়িখানাই বিসর্জন দিলাম আমার ফাস্ট এইডের চিকিৎসাকার্য্যে। আমি এক হাতে কাপড়টা জড়াই আরেক হাতে খুলে যায় । মেঝেতে উলটো হয়ে নেংটু পুটু পড়ে রইলো আমার অতি অতি প্রিয় বউ পুতুলটা।
কোনোভাবেই রক্ত বন্ধ না করতে পেরে মায়ের বিছানার পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে রইলাম। এক হাতে আঙ্গুল চেপে ধরে। হঠাৎ ঘুমের মাঝে মা এক চোখ খুলে আমার অমন ভালোমানুষী কাতর চেহারা দেখেই বুঝে ফেললেন কিছু এক অঘটন ঘটিয়েছি আমি অঘটনঘটনপটিয়সী..... লাফ দিয়ে উঠে রক্ত দেখে নিজেই চিলচিৎকার দিলেন।আর তারপর টেনে নিয়ে ধুয়ে মুছে সাফ করে সত্যিকারের ব্যান্ডেজ বেঁধে দিলেন ডেটল দিয়ে কিন্তু পিঠের উপর গুড়ুম গাড়ুম বর্ষিত না হলেও অবিশ্রান্ত বাক্য বর্ষন বর্যিত হতেই লাগলো হতেই লাগলো- এমন পাঁজীর পা ঝাড়া শয়তানের লাঠি বাঁদরের হাড্ডি মেয়ে হয়েছে। নিশ্চয় একে বাঁদরের হাড্ডি দিয়েই বানানো হয়েছিলো আল্লাহ তায়ালা কোনো এক বদ বাঁদরের হাড্ডি থেকে তোকে বানাইসে বুঝছিস.........
তখন আমি ক্লাস থ্রীতে। মজার ব্যপারটা হল গান, নাচ, ছবি আঁকা,কবিতা আবৃতি ও যেমন খুশী সাজো এর ৫টি বিভাগে অংশগ্রহন করে আমি ক্রমান্বয়ে সব রকম পজিশনের অধিকারী হলাম। যথাক্রমে নাচে প্রথম, গান ও ছবি আঁকায় দ্বিতীয়, কবিতা আবৃতি ও যেমন খুশী তেমন সাজোতে তৃতীয়। কিন্তু এমন অদ্ভুত সব পুরষ্কার পেলাম যা শুনলে অনেকেই হয়তো হাসবে। তবে সেসব পুরষ্কারের মূল্য কতখানি ছিলো আমার কাছে সে একমাত্র এই আমিই জানতাম আর আজও জানি। নাচ করে পেলাম একটা কাঁচের গ্লাস ও প্লেট। সে গ্লাস ও প্লেট আমি এত যতন করে ক্রোকারীজের আলমারীতে তুলে রাখলাম যেন সাত রাজার ধন এক মানিক। কাউকে ছুতে দেইনা, কাউকে ধরতে দেইনা। একদিন স্কুল থেকে ফিরে এসে দেখি আমার এত সাধের গ্লাসটি আলমারীর মধ্যেই ভেংগে পড়ে আছে। অনেক গোয়েন্দাগিরি করেও কে ভেংগেছে বা কি হয়েছে এ রহস্য আমি বের করতে পারলাম না। মা বলেছিলেন কোনো ভাবে পড়ে গিয়ে ভেংগেছে হয়তো। আমার মন আজও বিশ্বাস করতে পারেনা, কোনো কারন ছাড়াই আমার প্রিয় সেই গ্লাস প্লেটের অকাল মৃত্যুকে।
একবার ছবি এঁকে পেয়েছিলাম একটা ড্রয়িং কপি ও এক বক্স ওয়াটার কালার। দুঘন্টার মধ্যে সে খাতার প্রতিটা পাতা আঁকিবুকি দিয়ে ভরে ফেললাম।ওয়াটার কালারটা একটু একটু করে খরচ করতাম কারণ এটা আমার কাছে একেবারেই একটা নতুন প্রিয় জিনিস ছিলো।
দুদিনেই খাতা তো ভরে দিয়েছিলাম নানান ছবি দিয়ে। আর এত অল্প অল্প করে খরচ করা ওয়াটার কালার বক্সটার ব্লু কালারটা একদিন স্কুল থেকে ফিরে এসে দেখি বেমালুম গায়েব। কাজের বুয়া ঐ কালারে পানি মিশিয়ে তার সাদা শাড়ীতে ব্লু দিয়েছিলো নাকি।এমন অবিশ্বাস্য ঘটনা আমার জীবনেই ঘটবে কেনো আজো তার উত্তর পাইনা।
আমি লুকিয়ে বাবার সোনার নিবের পেন, মায়ের লিপস্টিক পেন দিয়ে আঁকিবুকি করে তার অবস্থা খারাপ করে ফেলতাম। এই কারণে অনেক বকা ঝকা মারধোর খেতাম তবুও সেই নেশা কাটতো না। পাঁচ বছর বয়সে বাবা আমাকে একটা খুব সুন্দর বল পয়েন্ট পেনের মত পেন্সিল দিলেন যার সারা গা প্লাসটিকের আর ঘুরালেই পেন্সিলের শীশটা বের হয়। মা পই পই করে বলে দিলেন এই পেন্সিলপেন যদি ভাঙ্গিস তো তোর খবর আছে। আমিও প্রতিজ্ঞা করলাম এই পেনসিলপেন আমি কিছুতেই ভাঙ্গবো না। আমি অনেক বেশি যত্ন করে এই পেনসিলপেন টিকিয়ে রাখার প্রানপন পণ করলাম। ভাবলাম আমার এই পেন পেন্সিলভাঙ্গা বদনাম এবারে ঘোচাবো। তাই সাবধানে রেখে দিলাম স্কুল ব্যাগের নীচের চেম্বারে। কিন্তু বিঁধি বাম! পরদিন সকালেই পাশের বাড়ির রুনি এসে বসলো আমার পড়ার ঘরটায়। তারপর আমার ব্যাগে কি আছে না আছে দেখতে গিয়ে পেয়ে গেলো সেই পেন্সিলপেন। হাতে নিয়ে চকচক করে উঠলো ওর চোখ। আমি সাথে সাথেই ছোঁ দিয়ে নিয়ে নিলাম পেন্সিলটা। কিন্তু রুনিও নাছোড়বান্দা। সেও টান দিয়ে পেন্সিলটা নিয়েই মোচড় দিয়ে ভেঙ্গে ফেললো পেন্সিলটা।
আমি করুন চোখে চেয়ে রইলাম পেনটার দিকে। এত চেষ্টা করেও বাঁদর বদনাম ঘোচানো গেলো না আর তার পরবর্তী ফল কি হয়েছিলো নিজেরাই ভেবে দেখো সবাই।
সবার শৈশবের স্মৃতিগুলি কত শত আনন্দের আর আমারগুলি? শুধুইবেদনার ..........এক্কেবারেই .......স্মৃতি তুমি বেদনা.......
আজ আমি অনেক রং নিয়ে বসি। এই তো সেদিন সন্ধ্যা সাতটা থেকে রাত ১ টা পর্যন্ত বসে ছিলাম আমার নতুন কেনা মেটালিক কালারের শ্রাদ্ধ করতে। কি সব আবোল তাবোল এঁকে চলেছিলাম। পরদিন ভোরে উঠতে হবে। স্কুল যেতে হবে কিন্তু উঠতেই পারছিলাম না। এই আমি সেই আমি যত খুশি নষ্ট করি রং আর যত খুশি নষ্ট করি খাতা। কেউ বকা দিতে আসে না, পিঠের উপর আর কেউ দুড়ুম দাড়ুম গুড়ুম গাড়ুম দিতে আসে না। তবুও তবুও আমার মন কাঁদে ফেলে আসা শৈশবের সেই মধুর দিনগুলিত....... ছুটে যায় মন যেখানে আর ফেরবার পথ নেই...... নেই ফিরে যাওয়া .......
ছেলেবেলা আমার ছেলেবেলা
মিষ্টিসূরের সেই পিছুটান,দূর-কলতান,
কেমন আছিস, কোথায় আছিস তুই?
গভীর রাতে চমকানো দুঃস্বপ্ন দেখে
হুড়মুড়িয়ে মায়ের ঘরে, জায়গা নিতে,
আজও কি তুই দৌড়ে পালাস?
বিড়বিড়িয়ে পড়িস কি তুই ভূত তাড়ানো মন্ত্রগুলো চক্ষুমুদে?
খুব সকালে ঘুম ভাঙ্গানি পাখির ডাকে,
শিউলিতলা শিশিরভেজা ঘাসের পরে
নগ্নপায়ে খামখেয়ালী হাটিস কি তুই ?
বিনিসুতোয় গাঁথিস কি তুই আজও মালা জাফরাণী রং শিউলিফুলে!!!
ছুটির দিনে সবাই যখন ভাতঘুমে ঘোর,
দুপুরবেলা চিলেকোঠার আলসেঘেসে বসিস কি তুই?
গুনগুনিয়ে ভাজিস কি সূর আপনমনে?
একা একা খেলিস কি তুই আজও একা পুতুলখেলা, নিসঙ্গবেলা ?
দুইবেনীতে চুলের ফিতা সাদা কালো,
চোখের ভিতর লাল নীল রঙ কমলা হলুদ
ঘোর লাগা সব স্বপ্নগুলো দেখিস কি তুই ?
ছুটিস কি তুই ধরতে আজও ঝিলমিল রং,প্রজাপতির রঙ্গিনপাখা ....
মেঝের পরে উপুড় হয়ে, বই এর পিছের শেষ পাতাটায়,
ক্যালেন্ডারের উল্টোপিঠে,অথবা সেই চকখড়িতে
তুই কি আজও আঁকিস ছবি?
সেই যে ছিলো ক্ষ্যান্তবুড়ি, ভুতুমপেঁচা রাজকুমারী কাঁকনমালা ?
জুতোর বাক্সে বানাস কি ঘর পুতুলগুলোর
বিছান বালিশ, কৌট দিয়ে যতন করে
মুড়িয়ে দিস টুকরো কাপড়, লেসের ফিতায়?
আতশকাঁচে থাকিস চেয়ে মুগ্ধ চোখে ঝুম অপলক আগের মত?
বৌ পুতুলের গায়ে জড়াস লালশাড়িটা,
পুঁতির মালা, নাকের নোলক, মায়ের ফেলে দেওয়া
কোনো পুরোন দুলে, গয়নাগাঁটি পরাস কি তুই?
রান্নাবাটি পাতার ঝোল আর টুকরো ইটে চচ্চড়িমাছ হাপুস হুপুস?
কাঁচের বাক্সে হাওয়াই মিঠা, শনপাপড়ি,
আমের সবুজ কাঁচামিঠায় বোশেখ দুপুর,
মায়ের নিষেধ তেঁতুল আচার, চুম্বকটান..
এখন কি তা তেমন টানে আগের মত?
আচ্ছা এবার বলতো রে তুই......
এখনও কি কষ্টে ভুগিস?
কাঁদিস কি তুই চুপিচুপি ?
ঠিক তেমনি, একা একা যেমনি পেতিস
দুঃখগুলো, নিঝুম দুপুর মেঘেরা তোর
ব্যথার সাথী, ডাহুকপাখি গাছের ডালে।
আবার ভুলে দৌড়ে যেতিস বারান্দাতে
অবাক চাওয়া ঝুলরেলিং এ ফেরিওয়ালা কিংবা
পথের বস্তি শিশু, সঙ্গহীনা, তোরই দোসর,
ঠিক যেন তোর দুঃখ ভোলা, দমকা হাওয়া একটা ঝলক!
ছেলেবেলা, কেমন আছিস?
অনেক ভালো তাইনারে বল?
এখন তো তুই অনেক বড়, অনেক কঠিন পাথরবাটি?
আগুন পোড়া সোনার কাঁঠি, জ্বলজ্বলে কোন টুকরো হীরা,
ঝকঝকে চাকচিক্যে ভরা, রাংতামোড়া,
অভিমানী ছেলেবেলা।
কেমন আছিস? কোথায় আছিস বল?
একছুট্টে দেখে আসি একটু তোকে
বায়োস্কোপের রঙিন কাঁচের ঘুলঘুলিতে.....
চোখটা পেতে একটুখানি!
অনেক আগে লেখা একটা ছেলেবেলার কবিতা জুড়ে দিলাম
ছেলেবেলা আমার ছেলেবেলা
সবার জন্য ভালোবাসা..... আর বাবামায়েদেরকে বলছি ক্রিয়েটিভ বাবুদেরকে কখনও বকবেন না মারবেনও না। শুধুই মাথায় তুলে রাখবেন আদরে আদরে আর ভালোবাসায়.....
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে মে, ২০২৩ বিকাল ৫:১৪