হরতাল অবরোধ অনলাইন ক্লাস আর ছুটির দিনে অফলাইন মানে ফিজিক্যাল ক্লাসের ভীড়ে পাগল পাগল অবস্থায় একদিন ময়ূরপঙ্খী নাও ভাসিয়ে দিয়ে চললাম শীতলক্ষ্যার বুকে। আমাদের রিভার ক্রুজের বুকিং দেওয়া হয়েছিলো কিছুদিন আগের এক ট্যুরিজম ফেয়ারে। নানা ঝামেলায় আর বের হওয়াই হয়ে উঠছিলো না। শেষমেষ সময় হল। কাঞ্চনব্রীজ পার হয়ে কিছুদূর গিয়ে পৌছালাম সেই শীতলক্ষ্যার তীরে রূপগঞ্জ শীতলক্ষ্যা ফেরিঘাটে। তীরে নেমেই চোখ জুড়িয়ে গেলো নীল নীল রঙ এক ময়ূরপঙ্খী নাও এর সৌন্দর্য্যে। যদিও এই নৌকায় ভাসিনি আমি। আমাদের ছিলো অন্য বড় নৌযান কিন্তু এই অপরূপা ময়য়ুরপঙ্খীর ছবি তুলে নিতে দোষ কি? ছবি তোলার পর আমাদের শীপে উঠলাম আমরা। একটু একটু শীত নামা সকাল মনে পড়িয়ে দিলো আমার ছেলেবেলা। আহা কতদিন এই সকাল আর ভোরের আলো আর হাওয়া গায়ে মাখা হয়নি আমার!
নৌযানটিতে এমন সব কেবিনও ছিলো। ইচ্ছে করলেই কেউ কেউ আগের দিনের জমিদারদের মত এইখানে গড়গড়িয়ে গড়গড়াতেও ফুক দিতে পারেন। নীচ তলায় ছোট ছোট কেবিনে ছোট ছোট ব্যাগগুলি রেখে উঠে আসলাম উপরের ডেকে। তখনও আমরা ছাড়া কেউ সেখানে আসেনি। কিছু পরেই এলো জাহাজের ক্যাপটেইন। আমার চোখ পড়ে গেলো তার সাদা ধপধপে সুন্দর ক্যাপটাতে। মনে মনে পরিকল্পনা করলাম আজ একটু এই নৌযান চালাতেই হবে আমাকে।
এই দেখো সত্যি সত্যি চালিয়েছি কিন্তু!
এই ছবিগুলি একটু ছোট করে দিলাম যেন ভালো করে দেখা না যায়! আমি লজ্জাবতী তো!
একটু পরেই বাকী সব লোকজনেরা আসতে শুরু করলো। সবশেষে এলো এক আনন্দময় দল। তারা জানালো এই ভ্রমনে তারা গান বাজনা করবে আমরা চাইলে যোগ দিতে পারি। দলনেতা খুবই আন্তরিক আর অমায়িক মানুষ ছিলেন। যাইহোক জানলাম তারা কেউ কেউ কবিতা আবৃতি করে শিমুল মুসতাফার কাছে তালিম নিচ্ছেন কেউ বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সঙ্গীতে পড়ছেন। কেউ কেউ সাংবাদিক কেউ কেউ লেখক একজন ছিলো থিয়েটার করে। সবাইকে দেখে তো আমি মুগ্ধের উপর মুগ্ধ!
মুগ্ধতা চেপে ডেকে বসে বসে ভেসে যেতে দেখলাম তীরের সবুজ গাছ পালা বাড়ি ঘর। মাঝে মাঝে বড় বড় বালীর বার্জ ভেসে আসছিলো। অনেকগুলো দিন পরে এই সব দৃশ্যে মন ভরে যাচ্ছিলো আমার।
কিছু পরে জাহাজের উলটোদিকের ঢাকা ডেওয়া ডেকে শুনতে পেলাম গান বাজনা। আমিও গিয়ে সামিল হলাম তাতে। তারা আমাকে বললো গান শুনাতে। গান শেষ হতে না হতেই লোকজন জানালো আমরা এখন নামবো মুড়া পাড়া জমিদার বাড়ি। ছোট্ট একটা নৌকায় করে যেতে হবে তীরে। সেই তীর ধরে আবার একটু হাঁটতেও হবে। তবেই পাওয়া যাবে সেই জমিদার বাড়ি।
জমিদার বাড়ির বিশাল ভবনটি এখন কলেজে রুপান্তরিত হয়েছে। সামনের বিল্ডিংটা সংস্কার আর রং টং করা হলেও ভেতরে বেশ ভাঙ্গাচুরা ভগ্ন দশার সাথে রংহীন ছাল বাকল উঠে যাওয়া দৃশ্য ছিলো। যেই লোক এত বিশাল রাজবাড়ি বানাতে পারে একদিন কত যত্নেই না রেখেছিলেন এই ভবনের প্রতিটি কোনা ঘুচি আর আজ কেউ নেই তারা। মনে পড়লো সেই গান আর বুঝি বুঝলাম সেই গানের অর্থ সেদিন প্রথম " একজনে ছবি আঁকে আনমনে ও মন, আরেকজনে বসে বসে রং মাখে আবার সেই ছবিখান নষ্ট করে কোন জনা কোন জনা ?? তোমার ঘরে বসত করে কয়জনা মন জানোনা... যাইহোক ভেতর বাড়িতে হয়ত সেথায় একদিন পূজা মন্ডপ বসতো সেথায় ছিলো এক অভূতপূর্ব বর্নীল দৃশ্য। এক গাদা সাদা চামড়ার বিদেশি মানুষজন কোনো এক ডকুমেন্টারীর শ্যুটিং করছিলো।
আর ভেতর বাড়ি লাল নীল কাপড় দিয়ে সজ্জিত ছিলো। আর তাতে একটা মোটা দড়ি ধরে টানাটানি দৃশ্যে অভিনয় করছিলেন দুই দল হলুদ আর নীল জামায়।তাদেরকে এত সুন্দর দেখাচ্ছিলো। ইচ্ছে হচ্ছিলো ওদের সাথে গিয়ে একটু নেচে আসি। আমি সারা জীবনের পারফর্মার আমি কখনই অডিয়েন্স হতে লাইক করি না।
যাইহোক এই মূল ভবনটি ছাড়াও এবং সামনের বিশাল পুকুরটি ছাড়াও পেছনে রয়েছে এক বিশাল ভেতরবাড়ি এবং পুকুর। সবই আজ ভগ্ন দশা। তবুও এই জানালায় মন হাারিয়েছিলাম কিছু সময়ের জন্য। মনে হলো যেন জমিদার বাড়ির কোনো রুপসী কন্যা বা বঁধু তার আয়ত নয়নে তাকিয়ে আছে আমার দিকে অদৃশ্যে অজানায়।
মুড়াপাড়া জমিদার বাড়ি সম্পর্কে আরও তথ্য- এককালের দাপুটে জমিদারদের বসবাসের বাড়িগুলোই বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসাবে খুঁজে পাওয়া যায়। কালের বিবর্তনে টিকে থাকা তেমনি এক শতবর্ষী জমিদার বাড়ি নারায়ণগঞ্জের রুপগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত মুড়াপাড়া জমিদার বাড়ি (Murapara Jamidar Bari) বা মঠেরঘাট জমিদার বাড়ি। যা বর্তমানে টিকে থাকা জমিদার বাড়িগুলোর মধ্যে বেশ আকর্ষণীয়।
১৮৮৯ সালে প্রায় ৬২ বিঘা জমির উপর বাবু রামরতন ব্যানার্জী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত এই জমিদার বাড়িটি বেশ কয়েকবার সংস্কার করা হয়। এরপর বিভিন্ন সময়ে বাবু রামরতন ব্যানার্জীর বংশধরেরা মূল ভবনের সামনের ও পেছনের অংশ সম্প্রসারণ, পুকুর খনন ও দালানের উঁচুতলার কাজ করেছেন। মুড়াপাড়া জমিদার বাড়িতে কারুকার্যমন্ডিত ৯৫ টি কক্ষ, মন্দির, ভান্ডার, কাছারি ঘর, অতিথিশালা ও বৈঠকখানা, আস্তাবল, দৃষ্টিনন্দন নাচের ঘর এবং সামনে ও পিছনে দুইটি পুকুর রয়েছে। ভবনের প্রবেশের মুখে বিশাল ফটক জমিদার বাড়ির বিশালতার আভাস দেয় আগে থেকেই। এছাড়া দালানের মন্দিরের চূড়াটি প্রায় ৩০ ফুট উঁচু।
১৯৪৭ সালে ভারত উপমহাদেশ বিভক্ত হবার পর জমিদার পরিবারের সকলে কলকাতা চলে যান, তখন বাড়িটি কিছুদিনের জন্য পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকে। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান সরকার এখানে কিশোরী সংশোধন কেন্দ্র ও হাসপাতাল চালু করে। পরবর্তীতে ১৯৬৬ সালের দিকে ভবনটি স্কুল-কলেজের কাজ পরিচালনা করবার জন্য ব্যবহার করা হতো। ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর মুড়াপাড়া জমিদার বাড়িটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনার তালিকাভুক্ত করে। বর্তমানে মুড়াপাড়া জমিদার বাড়িতে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, যা সরকারি মুড়াপাড়া কলেজ নামে পরিচিত।
https://www.youtube.com/watch?v=6RUQGVY3gKY
ঐতিহাসিক মুড়াপাড়া জমিদার বাড়ি ভ্রমণ | Murapara Jamidar Bari, Rupganj, Narayanganj | Flying Bir
ভেতরবাড়ির ফটকে।
জমিদার বাড়ি ঘুরে ফের ভেসে চললাম আমরা শীতলক্ষ্যায়। এবারের গন্তব্য ছিলো জামদানী পল্লী পরিদর্শন ও সাথে তো জানাই আছে আরেকটা কাজ। কাজেই সেই জামদানী পল্লীতে পৌছে আমরা আনোয়ার জামদানীতে গেলাম। কারিগরেরা শাড়ী বুনছিলো।
তারা পাঁচ ভাই। একই পেশায় রয়েছে বছরের পর বছর জুড়ে এবং তারা প্রথমে বক্সে করে শাড়ী আনছিলো সে সব আমার পছন্দই হচ্ছিলোনা। আমি বলছিলাম আরও সুন্দর কিছু। শেষে তারা আমাকে নিয়ে গেলো তাদের তিনতলা বাড়ীর তিনতলার ঘরে। সোফা ডাইনিং টেবলে সজ্জিত ছিলো সেই ঘর আর দেয়াল জুড়ে স্টিলের আলমারী। এতক্ষনে উনারা বের করলেন আসল জামদানী। কিন্তু দাম যা হাকলেন তাতে তো শাড়ি কেনার ইচ্ছাই আর একটু হলে গায়েব হয়ে যাচ্ছিলো। বেড়াতে এসে কেউ এত টাকা আনবে নাকি? শেষে দরাদরী করে কিছু শাড়ি কেনা হলো ও টাকা বিকাশ করতেই হলো।
সে যাইহোক এই অদ্ভুত সুন্দর জামদানীগুলো কিনে আমি আনন্দিত। চাই এই কারিগরেরা বেঁচে থাকুক হাজার বছর।
এরপর বোটে ফিরে খানাপিনা। পোলাও রোস্ট মাছ ভাঁজা, বেগুন ভাজা আরও কি কি যেন ছিলো শেষে পান্তুয়া মিষ্টি। খানাপিনার ছবি আর তুলিনি আমার সুন্দর সুন্দর হাড়িপাতিল ছাড়া সেসব তোলা কি ঠিক হবে তাই। যাইহোক খানা পিনা শেষে ঐ গানের দলের শিল্পীরা আবারও বসালো গানের মেলা। আবারও তাতে সামিল হয়ে গেলাম আমরা। পরিচিত হলাম কিছু মেধাবী মানুষের সাথে সাথে। আবার নিজেকেও একটু পরিচিতি করালাম। তারাও জানালো আমাদেরকে পেয়ে তারাও অনেক বেশি আনন্দিত হয়েছে। আমি বরাবর রুপদর্শী নহি বটে কিন্তু গুণদর্শী। একদল গুনে ভরা মানুষের সঙ্গ তাই আমার বড় ভালো লাগলো সেদিন। গলায় গলা মিলিয়ে একটু গাইলাম।
হাতে হাত মিলিয়ে একটু নাচলামও আবোল তাবোল। তারপর ফেরার পালা। সবাই মিলে মানে ওদের দলের সাথে ভীড়ে গিয়ে ছবিও তুললাম আমরা গ্রুপ ফোটো। যাইহোক সেটা আর দিলাম না।
মানুষ জন ছাড়াও ওদের থেকেই জানা আরেকটা জিনিসের সাথে পরিচিত হলাম সেটা মুক্তা ড্রিংকিং ওয়াটার। এর বিশেষত্ব হলো এই পানি উৎপাদন করেন প্রতিবন্ধীরা। এ পানির কারখানায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ছাড়া আর কেউ কাজ করেন না। এ পানি থেকে যে লাভ আসে, তার পুরো অংশই প্রতিবন্ধীদের কল্যাণে ব্যয় করা হয়।সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ‘শারীরিক প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্ট’-এর অধীনে পরিচালিত হচ্ছে মৈত্রী শিল্প প্ল্যান্ট। এখানে তৈরি হচ্ছে এই ‘মুক্তা’ ব্র্যান্ডের বোতলজাত পানি।তাদের জন্য শুভকামনা।
https://www.banginews.com/web-news?id=8e180b1a65efdfd603a7b5eaa85eddb339c317d0
অনেক আনন্দে কেটে গেলো একটা দিন সাথে নিয়ে কিছু স্মৃতি অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান আহরন। আসলেই মাঝে মাঝে আমার মনে হয় এই যে মানুষ কত খরচ করে বিদেশ ভ্রমনে যায়। অথচ দেখা হয় না চক্ষু মেলিয়া ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া একটি ধানের শীষের উপর একটি শিশির বিন্দু!!
সবার জন্য ভালোবাসা.........
মিররমনির মন খারাপ। তাই তার জন্য স্পেশাল আমার সেইলর প্রিন্ট ছবি!
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই ডিসেম্বর, ২০২৩ রাত ৮:০৯