আমরা এতো প্রশংসা প্রিয় কেনো? এবং আমরা এতো সমালোচনা বিমুখ কেনো? ( দেখুন দুই বাক্যের সাথেই আমি “আমরা” শব্দ লাগিয়েছি। আমরা মানেই আমি ও তুমি)
এলাকায় এক বড় ভাই ছিলেন। “প্রশংসার বিনিময়ে খাদ্য” (প্রবিখা) কার্যক্রম চালাতেন। বিকাল বেলায় জোড় করে ধরতেন, দোকানে নিয়ে যেতেন... “আয় আয়। সিঙ্গারা খেয়ে যাবি” সিঙ্গারায় মুখ দিতেই বলে বসবেন-
-“আচ্ছা এই যে আমার হাটা চলা...কেমন... মানে স্ট্যাইল টা কেমন? আমার ব্যবহার?
-জ্বি বস আপনার ব্যবহার রীতিমতো রাজভোগ মিষ্টির মতো।
-মিষ্টি খাবি? এই কে আছিস এদেরকে রাজভোগ মিষ্টি দে...শোন আমার ড্রেস আপ তা দেখেছিস...আমার সাথে যায়???
-বস একদম একটা কমপ্লিট প্যাকেজ। ভরপুর নাস্তার পর যেমন চা খেলে প্যাকেজ...” চাও চলে আসে। আমাদের দিন কাটে প্রশংসার বিনিময়ে খাবার খেয়ে। তারপরও পালিয়ে আসি। ২০ টাকার নাস্তার বিনিময়ে লাখ টাকার মিথ্যে প্রশংসা করতে ...কতদিন ভালো লাগে?
কেউ কেউ সময় মতো প্রশংসা না পেলে রীতিমতো বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। এক বন্ধু ছিলেন এমন। রীতিমতো হাত গুটিয়ে থমথমে গলায় বলতো-“শালা আমার কথা কেও বলেনা...আমি যে কত কি করলাম...সব শালা আসলেও শালা...” আমি ভীরু ভীরু গলায় বলি –“ওস্তাদ একটু অন্য চিন্তায় ছিলাম। তুমি কিন্তু অসাম বস। হাত গুটাইও না প্লিজ... আরো প্রশংসা করতাছিতো… ডোন্ট ওরি...”
বাংলাদেশে কোনদিন যে এমন দেখা যাবে মানুষ পিছনে ছুড়ি ধরে বলবে “আমার পক্ষে কিছু ভালো কথা বল দেখি...খুব ভালো না হইলে কিন্তু ঢূকাইয়া দিমু...বোঝোস...।।
একই ভাবে আমরা সমালোচনা বিমুখ। আমি টানা ৬ মাস ভালো কথা বলার পর কাউকে একটু সমালোচনা রকমের কিছু বলেছিলাম। সে আমাকে জানিয়েছিলো “আপনার সাথে কথা বললে আমি যে ভালো মানুষ সে কথাই ভুলে যাবো...” আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললাম। আমার ৬ মাস বৃথা হয়ে গেলো একটা সমালোচনার জন্য। তার চেয়েও বড় কারন যে এমন কথা বললো তার বয়স ২৪/২৫ বছর। তরুন দের প্রশংসা প্রিয় হওয়া এবং সমালোচনা বিমুখ হওয়া জাতির অধঃপতনের বড় লক্ষন।
যে ভয়াবহ সমালোচনা আর বিরোধীতার মুখে আমাদের নবীজিকে পরতে হয়েছিলো তার কোনই তুলনা নেই। তিনি শুধু বিরোধকেই জয় করেননি বিরোধীদের কেও জয় করেছিলেন।৭০ বছর বয়েসে রবীন্দ্রনাথ দুঃখ করে বলেছিলেন ,তাকে যে পরিমান সমালোচনার ভয়ঙ্কর আঘাতের মুখোমুখী হতে হয়েছিলো তা জেনো আর কারো সইতে না হয়। তিনি তার সমালোচনার জবাব তেমন দেননি। একবার মাত্র ডিএল রায় (সম্ভবত“সোনার তরী”র সমালোচনা)এর একটা লেখার লিখিত জবাব দিয়েছিলেন। মহাত্বা গান্ধীকে চার্চিল ব্যঙ্গ করে ডাকতেন “অর্ধনগ্ন ভিক্ষুক” বলে। গান্ধীজির উত্তর ছিলো “আমি নগ্নও হতে চাই, ভিক্ষুকও হতে চাই। প্রকৃতিকে পাবার জন্য দুটোই হবার দরকার আছে।” তিনিও তার কাজ থামিয়ে রাখেননি। “অপন্যাস” লেখক হুমায়ুন আহমেদও থেমে যাননি। উপন্যাস ই তিনি লিখেছেন, সেইসবকে অপন্যাস এখন আর কেও বলেনা।
শেক্সপিয়ার পৃথিবী ব্যাপী বিখ্যাত হতে শুরু করেন তার মৃত্যূরও ১০০ বছর পর থেকে, মৃত্যূর কিছুদিন আগেও জীবনানন্দ দাশ দুঃখ করে বলেছিলেন “এতো যে কবিতা লিখলাম একটাও কি টিকে থাকবেনা?” এদের কেউই তাদের যোগ্য প্রশংসার এতটুকূও পাননি, তাই বলে তারা কাজ থামিয়ে রাখেননি।
এইসব বড় মানুষের ব্যাপার। আমরা ছোট মানুষ। আমরা অবশ্যই প্রশংসা প্রেমী হবো এবং অবশ্যই সমালোচনা বিমুখ হবো।