মানুষের মধ্যে যেসব লোক অদৃশ্য ও ভবিষ্যত সম্বন্ধে জ্ঞানের অধিকারী বলে দাবী করে তারা বিভিন্ন নামে পরিচিত। যেমন- গণক, ভবিষ্যদ্বক্তা, যাদুকর, ভবিষ্যৎদ্রষ্টা, জ্যোতিষী, হস্তরেখা বিশারদ প্রভৃতি। এসব ভবিষ্যদ্বক্তা নানা পদ্ধতি ও মাধ্যম ব্যবহার করে তথ্যাবলী উপস্থাপন করার দাবী করে থাকে। পদ্ধতিগুলোর মধ্যে রয়েছে- চায়ের পাতা পড়া, নানা প্রকার রেখা ও নকশা আঁকা, সংখ্যা লেখা, হাতের তালুর রেখা পড়া, রাশিচক্র খুঁটিয়ে দেখা, স্ফটিক বলের প্রতি স্থির দৃষ্টিপাত করা, হাড় দিয়ে খটর খটর বা ঝনঝন করানো, লাঠি ছোঁড়া ইত্যাদি। আলোচ্য প্রবন্ধে ভাগ্য গণনার নানাবিধ কলা-কৌশল ও এর শারঈ ভিত্তি নিয়ে আলোচনা করা হবে ইনশাআল্লাহ্।
অদৃশ্য প্রকাশে ও ভবিষ্যদ্বাণী করতে সক্ষম হওয়ার দাবীদার জ্যোতিষীদেরকে প্রধানত দু'ভাগে বিভক্ত করা যায়।
১. প্রথমতঃ ঐসব জ্যোতিষী যাদের প্রকৃতপক্ষে কোন সত্য জ্ঞান বা গুপ্ত রহস্য জানা নেই; বরং তারা তাদের নিকট আগত লোকদেরকে তাই বলে, যা সাধারণত অধিকাংশ লোকের ক্ষেত্রে সচরাচর ঘটে থাকে। তারা প্রায় সময়ই অর্থহীন কিছু ধর্মীয় কর্মকান্ড সম্পন্ন করার মাধ্যমে পূর্বপরিকল্পিত সাধারণ অনুমান প্রকাশ করে থাকে। কখনো কখনো তাদের কিছু অনুমান অতি সাধারণতার জন্য সত্য হয়ে যায়। অতিসামান্য যে কয়েকটি ভবিষ্যদ্বাণী সত্য বলে প্রকাশ লাভ করে, অধিকাংশ মানুষের মধ্যে সেগুলো মনে রাখার প্রবনতা দেখা যায়; কিন্তু যেগুলো আদৌ সত্য বলে প্রকাশিত হয় না, তার বেশীরভাগই মানুষ খুব দ্রুত ভুলে যায়। প্রকৃত সত্য কথা হচ্ছে, কোন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে যদি পুনরায় মনে না পড়ে, তাহলে কিছু দিন পরে সকল ভবিষ্যদ্বাণীর অর্ধেকই মানুষ অবচেতনভাবে ভুলে যায়। উদাহরণস্বরূপ, প্রতিটি নতুন বৎসরের শুরুতে আসন্ন বছরে মানুষের জীবনে সংঘটিতব্য ঘটনা সম্পর্কে বিভিন্ন খ্যাতিমান জ্যোতিষীদের নানা রকম ভবিষ্যদ্বাণী প্রকাশ করা উত্তর আমেরিকার একটা সাধারণ প্রথার রূপ পরিগ্রহ করেছে। ১৯৮০ সালে প্রচারিত ও প্রকাশিত বিভিন্ন প্রকার ভবিষ্যদ্বাণীর উপর পরিচালিত এক গবেষণা জরিপে দেখা যায়, সবচেয়ে নির্ভুল ভবিষ্যদ্বাণীর মাত্র ২৪% সঠিক হয়েছিল!
২. যাদের সঙ্গে জ্বিনের সখ্যতা ও যোগাযোগ এবং বিভিন্ন ধরনের অপজ্ঞান রয়েছে, তারা এ দ্বিতীয় শ্রেণীর দলভুক্ত।
এ দলটির গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি, কারণ এর শিরকের মত বৃহত্তর ও জঘন্যতম গুণাহের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এ কাজে জড়িতদের উপস্থাপিত তথ্যাবলী সাধারণত কিছুটা নির্ভুল হয়, যা মুসলিম ও অমুসলিম উভয়ের জন্য বড় ফিৎনার কারণ।
জ্বিনের জগৎ (১ম ভাগ)
'জ্বিন' সম্পর্কে কোরআনে সম্পূর্ণ একটি সূরা অবতীর্ণ হওয়া সত্ত্বেও কিছু কিছু লোক জ্বিনের অস্তিত্বকে অস্বীকার করার চেষ্টা করেছে। ক্রিয়াপদ 'জান্না', 'ইয়াজুন্ন' হতে উৎপন্ন হওয়া 'জ্বিন' শব্দটির আক্ষরিক অর্থের ভিত্তিতে তারা দাবী করে, জ্বিন হচ্ছে 'চতুর ভিনদেশী' বা 'ভিন্ন জাতের প্রাণী'। আবার অনেকে এমনও দাবী করেন যে, জ্বিন হচ্ছে স্বভাবে অগ্নিময় এমন ধরনের মানুষ যার মস্তিস্কে অন্তরের উপস্থিতি নেই। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এ পৃথিবীতে মানুষের সঙ্গে সহাবস্থানকারী আল্লাহর অপর এক সৃষ্টি হল জ্বিন জাতি। মানব জাতির সৃষ্টির পূর্বেই আল্লাহ তায়ালা জ্বিন জাতি সৃষ্টি করেন। মানব সৃষ্টির উপাদান হতে ভিন্নতর উপাদানের সমষ্টিতে আল্লাহ তায়ালা জ্বিন জাতি সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
"অবশ্যই আমি মানুষকে ছাঁচে ঢালা শুকনো ঠনঠনে মাটি থেকে পয়দা করেছি, আর (হ্যাঁ,) জ্বিন! তাকে তো আমি আগেই আগুনের উত্তপ্ত শিখা থেকে সৃষ্টি করেছি।" {সূরা আল হিজর, আয়াত ২৬-২৭}
লোকচক্ষুর আড়ালে থাকার কারণে তাদেরকে জ্বিন নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা আদমকে সিজদা করার হুকুম দানকালে ফিরিশতাদের মাঝে অবস্থান করা সত্ত্বেও ইবলীস (জ্বিন জাতির অন্তর্ভুক্ত) সিজদা করতে অস্বীকার করলে তাকে এ অবাধ্যতার কারণ জিজ্ঞেস করা হয়েছিল। এ ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা বলেন, "সে বললো (হ্যাঁ), আমি তো তার চাইতে শ্রেষ্ঠ; তুমি আমাকে আগুন থেকে বানিয়েছো আর তাকে বানিয়েছো মাটি থেকে।" {সূরা সোয়াদ, আয়াত ৭৬}
আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, "ফিরিশতাদের নূর (আলো) হতে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং জ্বিনদেরকে করা হয়েছে আগুন হতে।" {সহীহ মুসলিম, হা/৭১৩৪}
আল্লাহ তায়ালা আরও বলেন,
"(স্মরণ করো,) যখন আমি ফিরিশতাদের বলেছিলাম, তোমরা সবাই আদমকে সিজদা করো, তখন তারা সবাই সিজদা করলো, কিন্তু ইবলিস ছাড়া, (সে সিজদা করলো না); সে ছিলো (আসলে) জ্বিনদেরই একজন ..." {সূরা আল কাহাফ, আয়াত ৫০}। তাই ইবলিসকে পদস্খলিত ফিরিশতা মনে করা ভুল।
জ্বিনদের অস্তিত্বের ধরন অনুযায়ী এদেরকে সাধারণত তিন শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায়। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, "তিন শ্রেণীর জ্বিন রয়েছে। এক প্রকার জ্বিন সারাক্ষণ আকাশে উড়ে বেড়ায়, দ্বিতীয় প্রকার জ্বিনেরা সাপ ও কুকুর হিসাবে বিদ্যমান, তৃতীয় প্রকার জ্বিন পৃথিবী অভিমুখে অগ্রসরমান তথা পৃথিবীতে অবস্থান করে এবং এরা এক জায়গায় বসবাস করা সত্ত্বেও এখানে সেখানে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘোরাফেরা করে।" {আত-ত্বাবারী ও আল-হাকিম}