জ্বিনজাতির বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে তাদেরকে দু'শ্রেণীতে ভাগ করা যেতে পারে। মুসলিম (আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাসী) এবং কাফির (আল্লাহর অস্তিত্বে অবিশ্বাসী)। আল্লাহ তায়ালা মুসলিম জ্বিনদের সম্পর্কে বলেন,
"(হে নবী,) তুমি বলো, আমার কাছে এ মর্মে ওহী নাযিল করা হয়েছে যে, জ্বিনদের একটি দল (কোরআন) শুনেছে, অতঃপর তারা (নিজেদের লোকদের কাছে গিয়ে) বলেছে, আমরা এক বিস্ময়কর কোরআন শুনে এসেছি, যা (তার শ্রোতাকে) সঠিক (ও নির্ভুল) পথ প্রদর্শন করে, তাই আমরা তার ওপর ঈমান এনেছি এবং আমরা আর কখনো আমাদের মালিকের সাথে কাউকে শরীক করবো না, আর (আমরা বিশ্বাস করি,) আমাদের মালিকের মানমর্যাদা সকল কিছুর ঊর্ধ্বে, তিনি কাউকে স্ত্রী কিংবা পুত্র হিসেবে গ্রহণ করেননি, (আমরা আরো জানি,) আমাদের (কতিপয়) নির্বোধ আল্লাহ তায়ালার ওপর অসত্য ও বাড়াবাড়িমূলক কথাবার্তা আরোপ করে" {সূরা আল জ্বিন, আয়াত ১-৪}
অনত্র আল্লাহ বলেন,
"আমাদের মধ্যে কিছু আছে যারা (আল্লাহর অনুগত) মুসলিম, আবার কিছু আছে যারা সত্যবিমুখ (কাফির); যারা (আল্লাহর) আনুগত্যের পথ বেছে নিয়েছে তারা মুক্তি ও সৎপথই বাছাই করে নিয়েছে। যারা সত্যবিমুখ তারা অবশ্যই জাহান্নামের ইন্ধন (হবে)" {সূরা আল জ্বিন, আয়াত ১৪-১৫}
কাফির (অবিশ্বাসী) জ্বিনদেরকে বিভিন্ন নামে আরবীতে ও বাংলাতে উল্লেখ করা হয়ঃ ইফরীত, শয়তান, ক্বারীন, দৈত্য, পিশাচ, অপদেবতা, ভূত, পেত্নী, প্রেতাত্মা ইত্যাদি। এরা নানাভাবে মানুষকে ভ্রান্তপথে পরিচালিত করার আপ্রাণ চেষ্টা-সাধনা করে থাকে। যে কেউ তাদের প্রতি কর্ণপাত করে, সে-ই তাদের কর্মী হিসাবে মানবীয় শয়তান রূপে পরিগণিত হয়।
এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন,
"আমি এভাবেই প্রত্যেক নবীর জন্যে (যুগে যুগে কিছু কিছু) দুশমন বানিয়ে রেখেছি মানুষের মাঝ থেকে, (কিছু আবার) জ্বিনদের মাঝ থেকে" {সূরা আল আনয়াম, আয়াত ১১২}
প্রতিটি মানুষের সঙ্গে ক্বারীন (সঙ্গী) নামক একজন জ্বিন রয়েছে। এটা এ জীবনে মানুষের পরীক্ষার অন্যতম এক গুরুত্বপূর্ণ দিক ব্যতীত কিছুই নয়। এ জ্বিনটি তাকে নিচু প্রকৃতির কামনা-বাসনার প্রতি অবিরত উৎসাহিত করে এবং সরল-সত্য পথ থেকে বিচ্যুত করার প্রচেষ্টায় রত থাকে। এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেছেন যে, "জ্বিনদের মধ্য হতে একজন করে সাথী তোমাদের প্রত্যেকের সঙ্গে যুক্ত করে দেয়া হয়েছে। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, এমনকি আপনার সাথেও, হে রাসূলুল্লাহ (সা.)! তিনি উত্তরে বলেন, হ্যাঁ আমার সাথেও। কিন্তু ব্যতিক্রম হচ্ছে যে, আল্লাহ তায়ালা আমাকে এ ব্যাপারে সাহায্য করেছেন এবং সে আনুগত্য স্বীকার করেছে। তাই সে আমাকে শুধু সৎকাজ করতে বলে।" {সহীহ মুসলিম হা/৬৭৫৭}
সুলায়মান (আ.)-কে নবুয়তের নিদর্শন স্বরূপ জ্বিনদের নিয়ন্ত্রণ করার মত অলৌকিক ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছিল। আল্লাহ বলেন,
"সুলায়মানের (সেবার) জন্যে মানুষ, জ্বিন ও পাখীদের মধ্য থেকে এক (বিশাল) বাহিনী সমবেত করা হয়েছিলো, এরা আবার বিভিন্ন ব্যূহে সুবিন্যস্ত ছিলো।" {সূরা আন্ নামল, আয়াত ১৭}
কিন্তু অন্য কাউকে এ ক্ষমতা দেয়া হয়নি। জ্বিনদেরকে নিয়ন্ত্রণ করার অনুমতি কাউকে প্রদান করা হয়নি। তাছাড়া কেউ তা পারেও না। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, "আমার সালাত ভাঙ্গার জন্য গতরাতে জ্বিনদের মধ্য হতে এক ইফরীত* থু থু নিক্ষেপ করেছিল। তবে তার উপরে বিজয়ী হতে আল্লাহ তায়ালা আমাকে সাহায্য করেছেন। সকালে তোমাদের সবাইকে দেখানোর জন্য আমি তাকে মসজিদের একটি খুঁটির সাথে বাঁধতে চেয়েছিলাম। তারপর আমার ভাই সুলায়মানের দোআ মনে পড়ল,
'হে আমার মালিক, (যদি আমি কোনো ভুল করি) তুমি আমাকে ক্ষমা করো, তুমি আমাকে এমন এক সাম্রাজ্য দান করো, যা আমার পরে আর কেউ কোনোদিন পাবে না, তুমি নিশ্চয়ই মহাদাতা।' {সূরা সোয়াদ, আয়াত ৩৫}" {বুখারী, হা/৭৫; মুসলিম, হা/১১০৪}
মানুষ জ্বিনদের নিয়ন্ত্রণ করতে অক্ষম। কেননা এ বিশেষ অলৌকিক ক্ষমতা কেবল সুলায়মান (আঃ)-কে প্রদান করা হয়েছিল। এমতাবস্থায় আছর বা আকস্মিক ঘটনা ব্যতীত অধিকাংশ সময় জ্বিনদের সঙ্গে যোগাযোগ সাধারণত ধর্মদ্রোহী ও নিষিদ্ধ কর্মকান্ড সম্পাদনের মাধ্যমে করা হয়। {আবূ আমীনাহ বেলাল ফিলিপ্স, জ্বিন সম্পর্কে ইবনে তাইমিয়ার রচনা, (ঢাকাঃ তাওহীদ পাবলিকেশন, ১৯৮৯), পৃ. ২১}। এভাবে উপস্থিত করা বা ডাকায় জ্বিনেরা তাদের সাথীদেরকে পাপকাজে লিপ্ত হতে ও স্রষ্টায় অবিশ্বাস করতে সাহায্য করতে পারে। আল্লাহ্র সাথে শরীক করার মত জঘন্য পাপকর্মে লিপ্ত করতে যত বেশী সম্ভব মানুষকে আকৃষ্ট করাই তাদের মূল উদ্দেশ্য।
জ্বিনদের সাথে গণকদের একবার যোগাযোগ ও চুক্তি সম্পন্ন হলে ভবিষ্যতে ঘটবে এমন কিছু ঘটনা সম্পর্কে জ্বিন তার অনুসারী গণকদের জানাতে পারে। ভবিষ্যতে ঘটবে এমন সব ঘটনার সংবাদ জ্বিনেরা কিভাবে সংগ্রহ করে সে সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, জ্বিনেরা প্রথম আসমানের নিম্নাংশ পর্যন্ত পৌঁছতে এবং ভবিষ্যতে ঘটবে এমন সব ঘটনাবলী সম্পর্কে ফিরিশতারা পরস্পর যে আলোচনা করে তা শুনতে সক্ষম। তারপর তারা পৃথিবীতে ফিরে এসে শ্রবণকৃত সংবাদগুলো তাদের সেই চুক্তিকৃত বন্ধুদের নিকট পরিবেশন করে। {বুখারী; মুসলিম হা/৫৫৩৮} মুহাম্মদ (সা.)-এর নবুঅত প্রাপ্তির পূর্বে এ ধরনের অনেক ঘটনা সংঘটিত হত এবং গণকরাও তথ্য প্রকাশে অনেকাংশে নির্ভুল ছিল। তারা রাজকীয় আদালতে আসীন হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করার পাশাপাশি প্রচুর জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। এমনকি পৃথিবীর কিছু কিছু দেশে তাদের পূজা-অর্চনাও করা হত।
রাসূল (সা.)-এর উপরে কোরআন নাযিল হওয়ার সময় হতেই এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। আসমানের নীচের অংশে পাহারা দেবার জন্য ফিরিশতাদের নিযুক্ত করা হয় এবং বেশিরভাগ জ্বিনকে উল্কা ও ধাবমান নক্ষত্র দিয়ে তাড়ানো হয়। এক জ্বিন কর্তৃক বর্ণিত বিস্ময়কর ঘটনাটি আল্লাহ্ তায়ালা কোরআনের ভাষায় উল্লেখ করেছেন,
"আমরা আকাশমন্ডল ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করেছি, আমরা একে কঠোর প্রহরী ও উল্কাপিন্ড দ্বারা ভরা পেয়েছি, আমরা আগে তার বিভিন্ন ঘাটিতে কিছু (একটা) শোনার প্রত্যাশায় বসে থাকতাম; কিন্তু এখন আমাদের কেউ যদি (এসব ঘাটিতে বসে) কিছু শোনার চেষ্টা করে, তাহলে সে প্রতিটি জায়গায় আগে থেকেই তার জন্যে (পেতে রাখা এক) একটি জ্বলন্ত উল্কাপিন্ড (দেখতে) পায়" {সূরা আল জ্বিন, আয়াত ৮-৯}
আল্লাহ তায়ালা আরও বলেন,
"তাকে আমি প্রতিটি অভিশপ্ত শয়তান থেকে হিফাযত করে রেখেছি। হ্যাঁ, যদি কেউ চুরি করে (ফিরিশতাদের) কোনো কথা শুনতে চায় তাহলে সাথে সাথেই একটি প্রদীপ্ত উল্কা তার পেছনে ধাওয়া করে।" {সূরা আল হিজর, আয়াত ১৭-১৮}