ইবনু আব্বাস (রা.) বলেন, রাসূল (সা.) এবং তাঁর একদল সাহাবী উকায বাজারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করলে আসমান থেকে ইলাহী সংবাদ শ্রবণে শয়তানরা বাধাগ্রস্থ হল।* তাদের প্রতি উল্কাপিন্ড নিক্ষিপ্ত হল। তাই তারা ফিরে এল তাদের লোকজনের নিকটে। তাদের লোকেরা ফিরে আসার কারণ জিজ্ঞেস করলে তারা সংঘটিত ঘটনা বলল। কেউ কেউ বলল, নিশ্চয়ই কিছু একটা ঘটেছে; ফলে তারা কারণ উদঘাটনে পৃথিবীর চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ল। তাদের মধ্যে কয়েকজন রাসূল (সা.) এবং তাঁর সাহাবীদেরকে সালাতরত অবস্থায় দেখতে পেয়ে কোরআন তেলাওয়াত শ্রবণ করল। এমতাবস্থায় তারা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করল যে, নিশ্চয়ই এটাই তাদেরকে আসমানী সংবাদ শ্রবণ থেকে বাধা দান করেছে। তখন তারা তাদের লোকজনের নিকটে ফিরে গিয়ে বলল,
"আমরা এক বিস্ময়কর কোরআন শুনে এসেছি, যা (তার শ্রোতাকে) সঠিক (ও নির্ভুল) পথ প্রদর্শন করে, তাই আমরা তার ওপর ঈমান এনেছি এবং আমরা আর কখনো আমাদের মালিকের সাথে কাউকে শরীক করবো না" {সূরা আল জ্বিন, আয়াত ১-২}। {বুখারী, হা/৪৪৩; মুসলিম, হা/৯০৮; তিরমিযী, আহমদ}
রাসূলুল্লাহ (সা.) কর্তৃক ইসলাম প্রচারের পূর্বে জ্বিনেরা ভবিষৎ সম্পর্কে বিভিন্ন সংবাদ সংগ্রহ করতে সক্ষম হলেও পরবর্তীতে তা আর পারেনি। এ কারণে তারা তাদের সংবাদের সঙ্গে অনেক মিথ্যা মিশ্রিত করে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, "জ্বিনেরা সংবাদ পাঠাতেই থাকবে যতক্ষণ না এটা যাদুকর বা গণক পর্যন্ত পৌঁছে। মাঝে মাঝে সংবাদ পাঠানোর পূর্বেই একটি উল্কাপিন্ড আঘাত করবে। আর উল্কাপিন্ড দ্বারা আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ার পূর্বেই যদি সংবাদটি পাঠাতে সক্ষম হয়, তাহলে এর সঙ্গে একশ'টা মিথ্যা যোগ করে পাঠাবে।" {বুখারী, হা/২৩২; তিরমিযী}
আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে গণকদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, 'এরা কিছুই না'। তারপর গণকদের কথা মাঝে মাঝে সত্য হওয়ার ব্যাপারে আয়েশা (রা.) উল্লেখ করলেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, 'এটা সত্য সংবাদের অংশবিশেষ যা জ্বিনেরা চুরি করে এবং এ তথ্যের সঙ্গে একশ'টি মিথ্যা যুক্ত করে তার বন্ধুর কাছে প্রকাশ করে'। {বুখারী, হা/৬৫৭; মুসলিম, হা/৫৫৩৫}
ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) একদিন বসেছিলেন, এমন সময় এক সুদর্শন লোক** তাঁর পাশ দিয়ে চলে গেল। ওমর (রা.) বললেন, 'আমার যদি ভুল না হয়, লোকটি এখনও প্রাক-ইসলামী বিশ্বাসের অনুসরণকারী অথবা সম্ভবত সে তাদের মধ্যে যেসব গণক রয়েছে তার অন্তর্ভুক্ত। ওমর (রা.) লোকটিকে তাঁর নিকটে আনার জন্য আদেশ করলেন এবং তিনি তাঁর অনুমানের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলেন। লোকটা উত্তর দিল, একজন মুসলিমকে আজ এমন এক অভিযোগের সম্মুখীন হতে হচ্ছে, যা আমি আর কখনও দেখিনি। ওমর (রা.) বললেন, নিশ্চয়ই আমাকে এ ব্যাপারে জানানো তোমার দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত। তারপর লোকটি বলল, জাহেলী যুগে আমি তাদের ভবিষৎ-গণনাকারী ছিলাম। এ কথা শুনে ওমর (রা.) বললেন, সবচেয়ে বিস্ময়কর যে বিষয়টি তোমার পরী (নারী জ্বিন) তোমাকে বলেছে তা আমাকে বল। লোকটি তখন বলল, আমি একদিন বাজারে থাকাবস্থায় সে উদ্বিগ্ন হয়ে আমার নিকটে আগমন করে বলল, 'অপমান হওয়ার পর হতাশাগ্রস্থ অবস্থায় তুমি কি জ্বিনদের দেখতে পাওনি? আর তাদেরকে (জ্বিনদেরকে) এমন অবস্থায় দেখতে পাওনি যে, তারা মাদী উট ও এদের পিঠে আরোহণকারীদের অনুসরণ করছে?' ওমর (রা.) মন্তব্য করে বললেন, 'হ্যাঁ, এটা সত্য'। {বুখারী, হা/২০৬}
জ্বিনদের সাথে যোগাযোগকারী মানুষকে অর্থাৎ জ্বিনদের সাহায্যে যেসব ভবিষ্যদ্বক্তারা ভবিষ্যদ্বাণী করেন, তাদেরকে জ্বিনেরা অতি নিকট-ভবিষ্যত সম্পর্কে জানাতে সক্ষম। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, ভবিষ্যদ্বক্তার নিকটে কেউ গমন করলে, উপস্থিত ব্যক্তিটি গণকের নিকটে আসার পূর্বে কী কী পরিকল্পনা তৈরী করেছিল তা গণকের জ্বিন আগত ব্যক্তির সাথী জ্বিনের {(ক্বারীন)- যে জ্বিন প্রতিটি মানুষের সাথে সর্বদা অবস্থান করে।} নিকট থেকে অবগত হয়। ফলে আগত ব্যক্তিটি কী কী করবে বা কোথায় কোথায় যাবে তা জানাতে গণক সক্ষম হয়। আর এভাবেই একজন গণক বা ভবিষ্যদ্বক্তা আগন্তুক ব্যক্তির অতীত সম্পূর্ণভাবে জানতে পারে। সেই গণক সবিস্তারে বলতে সক্ষম হয়, আগন্তুকের পিতা-মাতার নাম, জন্মস্থান এবং ছোটবেলার কর্মকান্ড সম্পর্কে। জ্বিনের সাথে যোগাযোগ রয়েছে এমন একজন ভবিষ্যদ্বক্তার আলামত হচ্ছে যে, সে বিস্তারিতভাবে অতীতের বর্ণনা দিতে পারবে। কারণ মুহূর্তের মধ্যেই বিশাল ব্যবধানের দূরত্ব অতিক্রম করা, গোপনীয় বিষয় বা ঘটনা, হারানো দ্রব্য, অদৃষ্ট ঘটনাবলী সম্পর্কে অনেক তথ্য সংগ্রহ ও সরবরাহ করা জ্বিনের সাধারণ একটি বৈশিষ্ট্য। এ ক্ষমতার সত্যতা আমরা নবী সুলায়মান (আ.) এবং সাবার রাণী বিলকিস সম্পর্কে কোরআনের বিবরণে দেখতে পাই। সুলায়মান (আ.)-কে রাণী বিলকিস দেখতে আসলে, রাণীর দেশ থেকে তার সিংহাসন নিয়ে আসতে তিনি (সুলায়মান) উপস্থিত সকলের উদ্দেশ্যে নির্দেশ প্রদান করলেন এবং তৎক্ষণাৎ সেখানে উপস্থিত মানুষ, জ্বিনসহ অন্যদের মধ্যে,
"বিশাল (বপুবিশিষ্ট) এক জ্বিন দাঁড়িয়ে বললো, তোমরা বর্তমান স্থান থেকে উঠবার আগেই আমি তা তোমার কাছে নিয়ে আসবো, এ বিষয়ের ওপর আমি অবশ্যই বিশ্বস্ত ক্ষমতাবান।" {সূরা আন্ নামল, আয়াত ৩৯}
* মূলতঃ এ দিন বা এ সময় থেকে শয়তানদের ইলাহী খবরাখবর শোনায় বাধা প্রদান এবং তাদের উপর উল্কাপিন্ড নিক্ষেপ করা শুরু হয়নি। বরং তা এর আগে থেকেই শুরু করা হয়েছিলো। হয়তো শয়তানরা এর কারণ এ ঘটনার মাধ্যমে এ সময়ে জানতে পেরেছে মাত্র। কারণ এ সম্পর্কিত যেসব শব্দ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, তা অতীত নির্দেশক। দ্রঃ সহীহ বুখারী, ২য় খন্ড, পৃ. ৭৩২।