আত্মা বা রূহু জীবজগতের প্রধান উপাদান যার বিহনে শরীর নিষ্প্রাণ, স্পন্দনহীন দেহ বা লাশ মাত্র। যদিও সাধারণ জীবাত্মাও পরমাত্মার মাঝে প্রভেদ স্বীকৃত। মূলত ইহা ইন্দ্রিয়সমূহের আওতার বাইরে অবস্থান যা মানব দেহকে সচল করার মাধ্যম বা দেহের প্রাণকেন্দ্র। সৃষ্টির এই অবিচ্ছেদ্য অংশ মানবাত্মা ও জীবাত্মার স্বরূপ জ্ঞান হতে তোমাদেরকে অতি সামান্য প্রদান করা হয়েছে। -আল কোরআন। তাই ক্ষুদ্র জ্ঞানে উপলব্ধি করা শুধু অসম্ভবই নয় অবাস্তবও বটে। তাই সহজভাবে স্বরূপ, অস্তিত্ব প্রাসঙ্গিক বিষয়ে বলা হয়েছে, ‘শত প্রতিবন্ধকতার নিñিদ্র আবরণ ভেদকারী আত্মার কল্পনা ভেদ একমাত্র আল্লাহই জ্ঞাত। ‘নিশ্চয়ই তিনি বক্ষের মধ্যে লুক্কায়িত সমস্ত ভেদ রহস্য সম্পর্কে পরিজ্ঞাত। -আল কোরআন
রূহ সারা শরীরে বিস্তৃত, ধরা ছোঁয়ার বাইরে কিন্তু ক্বলব বা জীবাত্মার অস্তিত্ব সম্পর্কে জ্ঞান-বিজ্ঞানের ধারক ও বাহক আল্লাহর নবী (সা.) বলেন, ‘নিশ্চয়ই মানুষের শরীরের মধ্যে একটা গোস্তের টুকরা আছে’ (উহাই ক্বলব)। প্রগতিশীল বিশ্বের উন্নয়নের হাতিয়ার ইসলাম ধর্মের শাশ্বত গ্রন্থ আল কোরআন মুসলিম ও অমুসলিম সবারই ‘সোর্স অব নলেজ’ ও ‘সোর্স অব সাইন্স’। এ কোরআন গবেষণার মাধ্যমেই উদঘাটিত হয়েছে ক্রমোন্নতির পথ, সৃষ্টির রহস্য, সৌর বিজ্ঞান, আধুনিক বিজ্ঞান ও বৈজ্ঞানিক তথ্যাবলী, উদ্ভিদ বিজ্ঞানের মিলন রহস্য, মাধ্যাকর্ষণ শক্তিসহ আরও অ™ভুত রহস্যাবলী এবং বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে আত্মার অস্তিত্ব।
বিজ্ঞানীরা গবেষণা করেছেন ‘আত্মা‘ নিয়ে। মানুষ মৃত্যুর সাথে সাথে দেহ থেকে ‘কী’ বের হয়ে যায় এটি প্রমাণ করার জন্য একটি নিñিদ্র কাচ বাক্সে অক্সিজেন দিয়ে একজন মুমূর্ষু ব্যক্তিকে রাখা হয়। বেশ কিছুক্ষণ পর বাক্সের এক পার্শ্বে কাচ ফেটে যাবার সাথে সাথে ওই ব্যক্তির মৃত্যু হয়। কিন্তু বুঝতে পারেনি ‘কী’ বের হলো।
বৈজ্ঞানিকভাবে এটি পরীক্ষা ও গবেষণার জন্য লন্ডনে ‘সোসাইটি ফর রিসার্স’ স্থাপন করা হয়েছে।
১৮৮২ সাল থেকে আজ পর্যন্ত আত্মার অস্তিত্ব সম্পর্কে বহু তথ্য প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। ১৯৮১ সালে বৃটিশ মনস্তত্ত্ববিদ জয় স্নেল বলেন, হৃদ স্পন্দন বন্ধ হয়ে গেলে দেহ থেকে ধোঁয়ার মত একটা কিছু বের হয়। পরবর্তীতে এই ধোঁয়া দেহের আকৃতি নেয়। আধুনিক কালে বিশেষভাবে প্রস্তুত অতি সুক্ষè এক ধরনের ক্যামেরা দ্বারা বিলিয়ান ফটোয় দেহের ওপর বর্ণবলয় ধরা পড়েছে। ফরাসি চিকিৎসক ‘হিপ্পোলাইট বরডুক’ তার স্ত্রীর মৃত্যুর ১৫ মিনিট ও এক ঘন্টা পর ছবি নিয়ে এক ধরনের ধোঁয়াকৃতির আচরণ দেখতে পেয়েছেন। বিজ্ঞানীরা এই ধোঁয়াকে ‘একটোপ্লাজম’ নাম দিয়েছেন। এ ‘একটোপ্লাজম’ থেকে দেহ গঠনের প্রমাণ দিয়েছেন বিজ্ঞানী ইভাক।
দৈহিক মৃত্যুর পর থেকে যে একটা কিছু চলে যায়, তা মৃত্যুর পর মৃত ব্যক্তির দেহ ওজন করেই বিজ্ঞানরা প্রমাণ করেছেন। এতে দেখা গেছে যে, প্রাণ চাঞ্চল্যের সবটুকু দেহ থেকে নিঃশেষে মিলিয়ে যাবার পর দেহের ওজন অর্ধেক থেকে এক তৃতীয়াংশ আউন্স কমে যায়। এতেই আত্মার অস্তিত্ব প্রমাণিত।
বিজ্ঞানীরা গবেষণায় বিংশ শতাব্দীর ক্রান্তিলগ্নে স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন যে, জীবাত্মার মাঝেই মানুষ সীমাবদ্ধ নয় বরং পরমাত্মাও আছে যার জন্য জীবাত্মার মত শক্তিশালী প্রাণকে সতেজ করার উপকরণ প্রয়োজন। আর ঐ উপকরণ হল তাসাউফ বা আধ্যাত্মিক জ্ঞান।
স্রষ্টার সাথে নৈকট্যহীনতার কারণে সৃষ্টির মনের অনুভূতিতে যে তীব্র ব্যাকুলতা জাগে তা দূরীকরণের মাধ্যমই হল আধ্যাত্মিকতা। জীবাত্মা পরমাত্মার একটা অংশ মাত্র। পরমাত্মার কাছ থেকে জীবাত্মা বা মানবাত্মা এসেছে এবং পরমাত্মাকে স্রষ্টার কাছে ফিরে যেতে হবে। পৃথিবীর মায়ায় মোহে, কর্মকোলাহলে আমরা সবাই প্রতিনিয়ত ব্যস্ত হয়ে অনন্ত যাত্রার কথা ভুলে যাই, কিন্তু এ মিথ্যা মায়ার বাঁধন ছিন্ন করে আপন আলয় স্রষ্টার কাছে অমৃতলোকে পৌঁছতে হবে।
অমৃতলোকে পৌঁছতে হলে, পরমাত্মীয়ের সান্নিধ্যে যেতে হলে, মনের কোণের শূন্যতা, দুঃখ-বেদনা লাঘব ও অনন্ত তৃষ্ণা মেটাতে হলে স্রষ্টার কাছে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ করা একান্ত প্রয়োজন। সুচারুরূপে, একনিষ্ঠভাবে আত্মসমর্পণ ও সান্নিধ্য লাভ ও যোগাযোগ স্থাপনের জন্য প্রয়োজন আধ্যাত্মিক জগতের একনিষ্ঠ ব্যক্তিত্বের সাথে সংযোগ স্থাপন ও তাসাউফ চর্চা করা। তাসাউফ চর্চার ক্ষেত্র হচ্ছে তরীকা। তরীকা হল শরীয়তের হাকীকত দ্বারা মারিফাতে উপনীত হওয়ার সুক্ষè সম্প্রসারিত পন্থা। শরীয়ত, তরীকত, হাকীকত, মারেফাতের সমন্বিত বিজ্ঞানই হল তাসাউফ। যারা এই বিজ্ঞান গবেষণায় মুখ্য উদ্দেশ্য হাসিলে সক্ষম তারাই পীর, মুর্শেদ, সূফী-আবদাল।
তাসাউফ কি! হযরত বড় পীর আবদুল কাদের জীলানী রহ. তাসাউফ শব্দের তাত্ত্বিক বর্ণনায় বলেন, তা, ছোয়াদ, ওয়াও, ফা-এর মিলিত রূপ তাসাউফ। ‘তা’ দ্বারা তওবা বোঝায়। তওবা দু’প্রকার ঃ প্রকাশ্যভাবে আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন ও সর্বান্তকরণে আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করা। ‘ছোয়াদ’ থেকে ছাফা বোঝায়। ভিতরে ও বাইরে নিজেকে সাফ করা বা পবিত্র, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা। ‘ওয়া’ দ্বারা বিলায়েত বোঝায়। বিলায়েত হচ্ছে ওলী-আল্লাহগণের জন্যে বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ রাজত্ব। এ তাসাউফ বা ইলমে মারেফত ইলমে শরীয়তের মতই অনস্বীকার্য বা অত্যাবশ্যকীয়।
নবী (সা.) এরশাদ করেন, ‘প্রত্যেক জিনিসের দুটি দিক আছে, প্রথমটি বাহ্যিক আর দ্বিতীয়টি অভ্যন্তরীণ।’ বাহ্যিক হল শরীয়ত আর আভ্যন্তরীণ হল তাসাউফ বা তরীকত ব্যবস্থা। এই জ্ঞানের মুখ্য উদ্দেশ্য আত্মোৎকর্ষ সাধন ও নৈতিক চরিত্রের অবক্ষয় থেকে আত্মশুদ্ধি লাভ করা। এই জ্ঞানকে ইলমে লাদুন্নী, ইলমে মারেফত, ইলমে তরিকত, ইলমে গায়েব, ইলমে বাতেন বলা হয়।
অনুরূপ আত্মাও দু’প্রকার। এক, জীবাত্মা বা নফস যা হিংস্র জানোয়ারের আত্মা, পশুর আত্মা ও শয়তানের আত্মার সমষ্টি। এই নফস পাপের দিকে ধাবিত করে। দুই, মানবাত্মা ও ফেরেশতার আত্মার সমষ্টি পরমাত্মা। এই পরমাত্মাকে রূহ বলে। এই রূহের তিনটি স্বরূপ আছে। যথা- মুতমাইন্না বা তৌহিদ পরিতৃপ্ত অন্তর, আম্মারাহ বা মন্দের দিকে উৎসাহদানকারী অন্তর, লাওআমা বা অনুশোচনাকারী অন্তর। এর মাঝে আম্মারাহ মন্দ, খারাপ ও অপকর্মের দিকে সর্বদা ধাবিত হয়।
তাই অন্তর আত্মাকে নিয়ন্ত্রণাধীন রাখতে তাসাউফের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আল্লাহ পাক বলেন, ‘আমি প্রত্যেক জাতির জন্যই একটি করে শরীয়ত সম্মত জীবন ব্যবস্থা দান করেছি এবং একটি আধ্যাত্মিক ব্যবস্থা দান করেছি।’ এ আয়াতের উল্লেখিত ‘মিনহাজ’ শব্দ দ্বারা তাসাউফ শিক্ষার প্রতি নির্দেশ করা হয়েছে। হুজুর পাক (সা.) এরশাদ করেন, ‘ধর্মীয় জ্ঞান এমন একটা সুপ্তাচরণ মনিতুল্য জ্ঞান যা খোদাপ্রেমিক আলেমগণ ছাড়া আর কেউ অবগত নয়। এই বিষয়ের উপর যদি কোন খোদাতত্ত্বজ্ঞ আলেম কোন কথা বলেন, তখন বস্তুবাদী আলেমগণ তা অস্বীকার করে অমান্য করে বসেন। মূলতঃ শরীয়তের প্রাণকেন্দ্র হচ্ছে তাসাউফ। আল্লাহ পাক হযরত খিজির (আ.)কে ইলমে বাতেন দান করেছিলেন। আল্লাহ বলেন, ‘আমি খিজিরকে ইলমে লাদুন্নী বা একটি তত্ত্বজ্ঞান শিক্ষা দিয়েছি।’ অনুরূপ হযরত ঈসা (আ.) সম্পর্কে বলেন, ‘আমি ঈসা (আ.)কে পবিত্র রূহু (অনাবিল আত্মা) দ্বারা সাহায্য করেছি।’ -আল কোরআন
অন্যত্র ইরশাদ হ"েছ নিশ্চয়ই ঐ ব্যক্তি পরিত্রাণ পেয়েছে, যে তার আত্মিক পবিত্রতা অর্জন করতে পেরেছে। আর সেই ধ্বংস হয়েছে, যে তার আত্মাকে অপবিত্র ও ম্লান করে দিয়াছে’ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসীর আযিযীতে বলা হয়েছে ‘যাক্কাহা’ দ্বারা আত্মশুদ্ধি লাভ করাকেই বুঝায়।
তাসাউফ, সূফী সাধনা মূলতঃ একটি বিজ্ঞান, এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ ফরমান ‘যাকে ধর্মীয় বিজ্ঞান বা আত্মতত্ত্ব জ্ঞান দেয়া হয়েছে, তাকে অবশ্যই সর্বোত্তম জ্ঞান দান করা হয়েছে’ শেখ আকবর (রহ.) বলেন, যাকে এই ধর্মীয় বিজ্ঞান দান করা হয়েছে তিনি প্রকৃত সূফী কেননা, এই হেকমতের অপর নাম তাসাউফ। তাসাউফ হচ্ছে আল্লাহকে প্রত্যক্ষ জানার ত্রিজ্ঞান, ‘আবশ্যক পরিমাণ দ্বীনে ইলম শিক্ষা করা প্রত্যেক মুসলমানদের প্রতি ফরজ।’ এই হাদিস শরীফের ব্যাখ্যায় হযরত হাসান (রা.) বলেন, ‘ইলম দু’প্রকার। ইলমুল ক্বালব উহা হল ইলমুল নাফেয় বা উপকারী (প্রকৃত ইলম যা তাসাউফ) আর ইলমুল লেছান বা জাহেরী জ্ঞান, ইহাই মানুষের প্রতি আল্লাহর দলীল স্বরূপ। অর্থাৎ জাহেরী আলেমগণকে আল্লাহপাক প্রশ্ন করবেন, তোমরা ইলম অনুযায়ী আমল কর নাই কেন? (এই আমল করার উপযুক্ত পরমাত্মা পয়দা করার জন্য মারেফত শিক্ষা অনস্বীকার্য)।
হাদিসের ইলম শব্দের ব্যাখ্যায় বিশিষ্ট হাদিস ব্যাখ্যা গ্রন্থ মিরকাত প্রণেতা বলেন, ইলম দু’প্রকার। ইলমে শরীয়ত ও ইলমে মারেফত। ঐ কিতাবে হযরত মালেক (রহ.)-এর উদ্ধৃতি দিয়ে বর্ণিত আছে ‘যে ব্যক্তি ইলমে জাহের (শরীয়ত) শিক্ষা করল ইলমে বাতেন (আধ্যাত্মিক, মারেফত) শিক্ষা করল না সে ফাসেক, যে ব্যক্তি ইলমে জাহের শিখলো না বাতেন শিক্ষা করল সে যিনদিক (কাফের পর্যায় ভুক্ত) আর যে ব্যক্তি উভয়ই শিক্ষা করল সেই মুহাক্কিক অর্থাৎ পরিপূর্ণ।
কোরআনের আয়াত ‘লি য়ুফাক্কিহু ফিদ দ্বীন’ এর ব্যাখ্যায় তাফসীরে মাজহারীতে আছে, ‘যে সমস্ত লোক ইলমে লাদুন্নি বা মারেফত লাভ করেছেন তারা সম্মানিত সূফী পদবাচ্য, উহা শিক্ষা করা ফরজে আইন। কারণ উক্ত ইলম মনকে গায়রুল্লাহ হতে পাক করে খোদার দিকে ফিরিয়ে দেয়।’ তাফসীরে রুহুল বয়ানে বলা হয়েছে, ‘ইলমের দ্বিতীয় প্রকার হল ইলমুল আছার এবং ক্বলব ও উহার সংশ্লিষ্ট অবস্থাদি বা মারেফত। সুতরাং মুসলমানদের উপর ক্বলবের অবস্থা সম্পর্কিত ইলম (মারেফত বা তাসাউফ) অর্জন করা অত্যাবশ্যক।’