কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের সদস্যরা নিজেকে জানার বা আত্ম উপলব্ধির চেষ্টা করে যাচ্ছেন। আসলে নিজেকে বোঝার চেষ্টাটাই সবচেয়ে বড় ব্যাপার। হাদিস শরিফে বলা হয়েছে- যদি স্রষ্টাকে চিনতে চাও তবে আগে নিজেকে চেনো। হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ বলেন, মানুষ আমার রহস্য। আমি মানুষের রহস্য। এ রহস্য উদ্ঘাটনের জন্যেই মানুষের সৃষ্টি।
মানুষ আল্লাহর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। সকল সৃষ্টির ওপর আধিপত্য দিয়ে আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন, বানিয়েছেন তার প্রতিনিধি। একমাত্র মানুষকেই তিনি দিয়েছেন সেই জ্ঞান, বুদ্ধি ও মেধা যা দিয়ে সে আল্লাহর অসীম সৃষ্টিশীলতা ও কুশলতাকে অনুধাবন করতে পারে। মানুষকে তিনি কত গুরুত্ব দিয়েছেন তা বোঝা যায় এভাবে যে, প্রথম নাযিলকৃত আয়াতে মানুষের জন্মরহস্যকেই তিনি তুলে ধরেছেন- ‘মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে জমাটবদ্ধ রক্তপিণ্ড থেকে’। মজার ব্যাপার হচ্ছে, কোরআন নাযিলের ৯০০ বছর পর ১৬৭৭ সালে মাইক্রোস্কোপ আবিষ্কারের পর স্পার্ম সেল নিয়ে গবেষণা করে বিজ্ঞানীরাও একই তথ্য দিলেন।
মানুষ যে আল্লাহর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি তা তিনটি মাপকাঠি দিয়ে আমরা বোঝার চেষ্টা করতে পারি। স্থান, গতি এবং বিশেষ বিবেক।
স্থানের মাপকাঠিতে অন্যান্য সৃষ্টিবস্তুর তুলনায় মানুষ যথেষ্ট ক্ষুদ্র একটি অস্তিত্ব। সাড়ে ৩ হাতের মানুষকে ২৫ হাজার মাইলের পৃথিবীর তুলনায় একটি বালিকণাই বলা যায়। আর সে যখন পৃথিবীরও ১৩ লক্ষ গুণ বড় সূর্যের তুলনায় দাঁড়ায় তখন কী হয় তা বলাই বাহুল্য। এটা তো বাহ্যিক। কিন্তু মানুষের অন্তর্গত স্থানের কি কোনো সীমাবদ্ধতা আছে? মানুষের ব্রেনে নিউরোন সেল রয়েছে ১০০ বিলিয়ন। যদি চোখ বন্ধ করে চিন্তা করি তাহলে এক সূর্য তো বটেই এরকম হাজার-কোটি সূর্যের ধারক গ্যালাক্সিকে আমার ভেতরে নিতে কোনো অসুবিধা হয়? হয় না। এটাই মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব।
দ্বিতীয় হলো- গতি। প্রতিটি মানুষের মধ্যেই আছে মন নামের এক রহস্যময় অস্তিত্ব। মনের গতিকে কি আলোর গতি বা অন্য কোনো মাপক দিয়ে পরিমাপ করা যায়? আলোর গতি সেকেন্ডে ১ লক্ষ ৮৬ হাজার মাইল। মনের গতি কি এর চেয়েও বেশি নয়?
তৃতীয় হলো- বিশেষ বিবেক। সাধারণ সচেতনতা আল্লাহ সবাইকেই দিয়েছেন। একটা পিঁপড়াও জানে কোথায় ঘর করলে ডিম নিরাপদ থাকবে। সাইবেরিয়া থেকে হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে শীতের পাখি যেমন বাংলাদেশে আসে তেমনি আবার ঠিক ঠিক চিনে ফিরেও যায়। মানুষকে আল্লাহ এই সাধারণ বিবেক যেমন দিয়েছেন, তেমনি দিয়েছেন বিশেষ বিবেক- মানব সৃষ্টির শুরু থেকেই প্রজন্মান্তরে যে জ্ঞান সঞ্চারিত হয়ে আসছে।
আর যদি কুশলতার কথা বলি তাহলে যেকোনো সৃষ্টির চেয়ে বিস্ময়কর বোধ হবে মানুষের সৃষ্টি। মানুষের ডিএনএ-তে তিনশ কোটি কোড রয়েছে। মাতৃগর্ভে যখন ভ্রূণের সঞ্চার হয় তখনই স্থির হয়ে যায় কোন জিন শরীরের কোন অংশটি তৈরি করবে। এমনকি তা নাকের সূক্ষ্ম লোম থেকে শুরু করে মুখের দাড়ি পর্যন্ত।
আল্লাহর সৃষ্টির এ পরিকল্পনা ও আর্কিটেকচারাল কনসেপ্ট- এটা এত নিখুঁত ও রহস্যময় যে, স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হিসেবে আমি কে, কেন এসেছি, সৃষ্টিজগতে আমার অবস্থান কোথায়- এই আত্মজ্ঞানই হওয়া উচিত মানুষের সকল জ্ঞান, সকল শিক্ষাব্যবস্থার ভিত্তি। আর ধ্যান বা আত্মমগ্নতা এই আত্মজ্ঞান লাভেরই মোক্ষপথ। পবিত্র কোরআনে এ ইঙ্গিত করেই বলা হয়েছে আসমান জমিন এবং দিবারাত্রি পরিবর্তনের মধ্যে আমি চিন্তাশীলদের জন্যে রেখেছি নিদর্শন।
জীবনের সবচেয়ে নিশ্চিত ঘটনা হলো মৃত্যু। কিন্তু সময়টা অনিশ্চিত। অলি-বুজুর্গ, সাধক যারা এ বিষয়টা নিয়ে চিন্তা করেন তারা বলেন, দমে দমে আল্লাহ আল্লাহ কর। কারণ দম যতক্ষণ আছে ততক্ষণই জীবন। যেমন, কেউ কোমায় আছে, কথা বলতে পারে না, খেতে পারে না, কাউকে চেনে না। বছরের পর বছর বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে কৃত্রিম যন্ত্রপাতি দিয়ে। তারপরও কিন্তু কেউ বলবে না লোকটা মারা গেছে। কারণ তার এখনও দম আছে। এই দম আমরা প্রতি ২৪ ঘণ্টায় ১ লক্ষ ৬০ হাজার বার নিই, ছাড়ি। একবার দম নিয়ে যদি তার পরেরবার ছাড়তে না পারতাম তাহলে সেটাই কিন্তু হতো আমার মৃত্যু মুহূর্ত। তার মানে প্রতি মুহূর্তেই আমার আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা উচিত। বলা উচিত- শোকর আলহামদুলিল্লাহ। যে হই না কেন স্রষ্টার প্রতি ধন্যবাদ জানানোর বিকল্প কিছু হতে পারে না। কারণ আলো বাতাস পানিসহ চারপাশের সমস্ত পরিবেশটা বিবেচনা করলে আমরা প্রতি মুহূর্তেই স্রষ্টার আশীর্বাদপুষ্ট।
এ শুকরিয়া, এ স্মরণ এবং এ উপলব্ধির জন্যে প্রয়োজন মানসিক প্রস্তুতি, প্রয়োজন ধ্যান। ব্যায়াম করলে একজন শারীরিকভাবে সুস্থ থাকতে পারেন। কিন্তু সুষম মানসিক গঠন ও বিকাশে প্রস্তুতির প্রয়োজন আছে। এ প্রস্তুতি বা ধ্যানের মাধ্যমেই মানুষ লাভ করে ইলমে তাসাউফ বা আধ্যাত্মিক জ্ঞান।
নবীজী (স) হেরা পর্বতের গুহায় ধ্যান করেছেন। একসময় আল্লাহ তাঁকে যথাযথ সত্য অবহিত করেছেন। তবে ধ্যানকে কার্যকরী ও ফলপ্রসূ করার জন্যে আল্লাহ কিছু খুঁটি ঠিক করে দিয়েছেন যাতে আমরা দিকভ্রান্ত না হই বা ছিটকে না পড়ি। কলেমা নামাজ যাকাত রোজা হজ- ইসলামের এ ফরজগুলোই সেই খুঁটি।
সূরা আর রহমানে আল্লাহ বলছেন, হে জ্বীন ও মানুষ, তোমরা অসীমে যেতে পারবে। কিন্তু পারবে না আমার আয়ত্তের বাইরে যেতে। ধ্যানের মাধ্যমে আমরা এই অসীমেই যেতে পারি। ধ্যানে আমি যখন আল্লাহকে চিন্তা করবো তখন সূর্যের ভেতর দিয়ে চলে গেলেও এর হাজার ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের তাপ শরীরে লাগে না। মনের গতিকে কোনো ছাদ, কোনো দেয়াল, কোনো হিমালয়ই আটকে রাখতে পারে না। ধ্যানের মধ্য দিয়েই আল্লাহ প্রদত্ত এই অসীম শক্তি উপলব্ধ সত্যে পরিণত হয় মানবমনে।