১) অর্থনৈতিক ও সামাজিক কল্যাণ:
একজন ওলীর জীবন হচ্ছে রাসূল (সঃ)-এর জীবনাদর্শনের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন। সঠিক উৎপাদন, কাম্য উৎপাদন এবং উৎপাদিত দ্র্রব্য কাম্য ব্যবহারের জন্য পবিত্র কোরআন মজীদে মহান আল্লাহতালা নির্দেশনা ও সীমারেখা প্রদান করেছেন। রাসূল (সঃ) উক্ত নির্দেশনা ও সীমারেখা প্রদান করেছেন। রাসূল (সঃ) উক্ত নির্দেশনা মডেলকে নিজের জীবনে বাস্তবায়িত করে উহার প্রয়োজ দেখিয়ে গেছেন। যেহেতু ওলীগণ হচ্ছেন রাসূল (সঃ) এর ট্রেডমার্ক স্বরূপ, সেহেতু ওলী কর্তৃক পরিচালিত জীবন ব্যবস্থার অনুসরণই একটি দেশের জন্য কাম্য উৎপাদন এবং সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য উৎপাদন সুনিশ্চিত করতে পারে। ওলীদেরনিকট মানুষের অভাব অসীম নয়। কারণ সন্তোষই হচ্ছে পরম ধন। ওলীদের মতে, সাধনা ও একাগ্রতার দ্বারা মানুষের ষড়রিপুর যথা: কাম, ক্রোধ, মোহ, মৎ ও মাৎসর্য নিয়ন্ত্রন করতে পারলে আত্মা ও মনের উন্নতি ঘটবে এবং এর ফলশ্রুতিতে মানুষ এমন একটি স্তরে উন্নীত হবে যখন মানুষ মৌলিক সমস্যার (অন্ন, বস্ত্র, স্বাস্থ্য, শিক্ষা প্রভৃতি) সমাধান লাভ করলে পরিতৃপ্ত হয়ে যাবে। যা না হলে চলে- তা পাওয়ার জন্য তার মনে কোন লোভ বা ক্ষোভ থাকবে না। ওলীদের মতে, যে সকল বস্তু মানুষের জন্য কল্যাণকর নয় কিংবা প্রয়োজনীয় নয় তা বর্জন করা উচিত। ওলীগণ অলস ব্যক্তিকে পছন্দ করেন না। “নবীর শিক্ষা, করুণা ভিক্ষা, মেহনত কর সবে” এটাই হচ্ছে ওলীদের জীবনের পথে প্রধান মূলমন্ত্র।
প্রকৃত ওলীগণ মানব সভ্যতার কল্যাণকামী। কামেল ওলীর সান্নিধ্য লাভকারী ব্যক্তিগণের অন্তর ও বাহির পবিত্র এবং অকৃত্রিক। এ ধরণের লোকজন অযথা পরিত্যাগকারী, নিরাম্ভর জীবনযাপনে অভ্যস্থ ও পরশ্রিকাতরতা বিমূখ। তারা স্বাধীন জীবন যাপনে আগ্রহশীল, স্রষ্টা ধর্মমুখী এবং কামনা ও প্রবৃত্তি মুক্ত। সৃষ্টিকে যথাযথ ব্যবহারের ক্ষেত্রে তাঁরা যত্নবান। বিশ্বের জনগণ আজ এ খোদায়ী দানকে অপব্যবহারের মাধ্যমে সম্পদের মোহগ্রস্ত হওয়ার দরুণ দুর্যোগ ও দুঃখ-কষ্টে নিপতিত হচ্ছে ওলীগণ ‘সন্তোষ পরমধন’ এ নীতির উপর গুরুত্ব আরোপ করে। ইহ ও পরজগতে কল্যাণ বা ‘ফালাহ’ অর্জনের জন্য ওলীগণ বিভিন্ন উপায় দেখিয়ে দেন। ইহজগতে ফালাহ বলতে বুঝায় বেঁচে থাকা, অভাব থেকে মুক্তিলাভ এবং ক্ষমতা ও সম্মান। মহান আল্লাহ বলেন, “আমি সৃষ্টি জগতের জন্য পর্যাপ্ত সম্পদের সৃষ্টি করেছি”। সুতরাং পৃথিবীতে মানুষের বেঁচে থাকার জন্য কোন সমস্যা থাকা উচিৎ নয়। সৃষ্টির সেরা জীবন হিসেবে মানুষের মর্যাদা ও ভূমিকা সহজেই অনুমেয়। খোদাতালা যেহেতু দুনিয়াতে পর্যাপ্ত সম্পদের সৃষ্টি করেছেন, সেহেতু মানুষের দারিদ্র্য ভোগ করার কথা নয়। বর্তমান বিশ্ব যে দারিদ্র্যের কষাঘাত চলছে তা সম্পদের অপব্যবহার ও অপবন্টনের ফল। মানুষের চারিত্রিক গুণাবলী অর্জিত হলে সম্পদের অপবন্টন রোধ করা সম্ভব। ওলীর সান্নিধ্য ও সাহচর্যের দ্বারা চারিত্রিক গুণাবলী অর্জিত হয়, মানুষের আত্মা, হৃদয় প্রবৃত্তি, মানসিকতা প্রভৃতির মধ্যে যুগান্তকারী পরিবর্তন হয় এবং মানবিক মূল্যবোধের বিকাশ ঘটে। বলা বাহুল্য, আত্মিক উন্নতি ছাড়া বস্তুগত উন্নয়ন অর্থহীন।
(২) কলব জারি, আত্মিক কল্যাণ ও স্রষ্টার প্রেমাগ্নি প্রজ্জ্বলিত করা
মানব দেহে কতগুলো চৈতন্য কেন্দ্র বা লতিফা রয়েছে যার অবস্থান সম্পর্কে কামেল ওলী ছাড়া আর কেউ সঠিক জ্ঞাত নয়। কামেল ওলি আত্মা-দর্শনের আয়নাতে সাধারণ মানুষের কলব পরীক্ষা করে চৈতন্য কেন্দ্র বা লতিফা মূলে নাড়া দেয়ার জন্য জিকির পদ্ধতি শিখিয়ে দেন। চোখ বন্ধ করে নির্জনে একগ্রচিত্তে পীরের নির্দেশমত পথে জিকিরের মাধ্যম কলব জারি তথা খোদার দর্শন সম্ভবপর হতে পারে। মহান আল্লাহ বলেন, “নিশ্চয়ই প্রকৃত ঈমানদার ঐ ব্যক্তি যার হৃদয়ে আল্লাহতালার জিকিরের সময় কম্পন আরম্ভ হয়”। কামেল ওলীগণ তাঁদের কার্যকলাপ ও তছরুফাতের মাধ্য দিয়ে রূহানী ফয়েজ বিতরণে ভক্ত ও আশেকগণকে তালিম দেন। ওলীগণ মানুষের উপর প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম। তাদের চেহারা মোবারক দর্শনে ও ছোহবতের তাছিরে ভক্তবৃন্দ সকল দুঃখ-কষ্ট ভুলে যায় এবং ভক্তবৃন্দের হৃদয়ে পবিত্র মনোমুগ্ধকর সুরভীর ঢেউ খেলে যায়। এলমে তাসাউফের (সুফী জ্ঞান) ভাষায় তাকে ‘তাছিরে এনায়েকাছি’ বা সামগ্রিক প্রভাব বলা হয়। বস্তুতঃপক্ষে, এ নশ্বর পৃথিবীতে মাধ্যম ব্যতিত কোন কাজ সময় হয় না, মাতা-পিতা ছাড়া যেরূপ সন্তান-সন্ততি হয় না। মাধ্যম যত শক্তিশালী হয়, সাফল্য তত বেশী হয়। সুতরাং আল্লাহ ও রসূল (সঃ) কে অর্জন করতে হলে উপযুক্ত মুর্শিদের প্রয়োজন। মহান আল্লাহ বলেন,
“হে মোমেনগণ! আল্লাহর পথে অগ্রসর হওয়ার উছিলা বা উপযুক্ত উপায় অবলম্বন কর”।
ওলীগণ হলেন খোদায়ী প্রেরণাপ্রাপ্ত রূহের অধিকারী। তাই । আল্লাহতালার প্রেম বা মহব্বত জাগাতে হলে ওলীদের আশ্রয় বা শিষ্যত্ব গ্রহণ একান্ত প্রয়োজন। ওলীদের সান্নিধ্য ও নির্দেশ পালনের মাধ্যমে ভক্তের প্রাণে আল্লাহতালার এশক-মহব্বত জাগ্রত হয়। প্রকৃতপক্ষে, কামেল ওলীর দর্শন লাভের সাথে সাথে ভক্তের প্রাণের আল্লাহতালার কথা স্মরণ হয়। কারণ ওলীগণ হলেন খোদাতালার নূরের ছায়াস্বরূপ। অতএব মহব্বতের সাথে ওলীদের সম্মুখে বসলে এবং তাঁদের ছোহবত লাভ করলে প্রকৃত ঈমানদারের অন্তরে খোদাতালার ভয়ভীতি সঞ্চারিত হয় এবং প্রেমের জোয়ার বয়ে যায়। তাই কামেল ওলীর সামনে অনেক আশেককে অজদ, হালকা ইত্যাদি করতে দেখা যায়। মহান আল্লাহ বলেন,
“হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর এবং তোমাদের মধ্যে যারা ‘উলিল আমর’ তাদের আনুগত্য কর। অনন্তর যদি তোমরা কোন বিষয়ে পরস্পর দ্বিমত হও, তবে ঐ বিষয়কে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সঃ)-এর উপর হাওলা করে দাও”।
ওলীদের ক্ষমতা সম্পর্কে হযরত বড় পীর (রঃ) বলেন,
“আমার সঙ্গীদের মধ্যে এমন একদল লোক আছে যারা কারও দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে সে ব্যক্তি সর্বোচ্চ স্তরে পৌছতে সক্ষম হন। এরূপ ব্যক্তি ইহুদী, নাছারা অথবা অগ্নপূজক হলেও উপরোক্ত সুফল প্রাপ্ত হবে”। (ফতহুর রব্বানী) ।
প্রকৃতপক্ষে বুজুর্গ ওলীর ভালবাসা বেহেশতের চাবি স্বরূপ। তাঁদের শক্তি চুম্বকের মত। যাকে আকর্ষন করেন সে মন্ত্রবৎ আকর্ষিত হয়ে যায়। তাকে কেউ ধরে রাখতে পারে না। ওলী মাটি ধরলে উহা সোনায় পরিণত হয়। ওলীগণের আদর্শ মানুষের জন্য ঈমান, একিন ও বন্দেগীর পুঁজি। ওলীগণের বানী ও আদর্শের ছোঁয়ায় রূহের বাগান সজীব হয়ে উঠে। ওলীর ছোহবত দুনিয়ার মোহকে শুষে নেয় এবং ছোহবত লাভকারী এলহাম ও গোপন রহস্যের স্বাদ গ্রহণে সমর্থ হয়। এক খোদা-পাগল ওলীর ছোহবত পাবার পর যে অভিমত ব্যক্ত করেছে তা প্রণিধানযোগ্য। খোদা-পাগল ব্যক্তি বলেন, “আমার জাহেরী জ্ঞানের কোন অভাব ছিল না, কিন্তু পরীক্ষা নিরীক্ষার পর যখন বুঝবার ও উপলব্ধি করার সুযোগ পেলাম তখন বুঝলাম, আমি প্রকৃত জ্ঞানী ছিলাম না, বরং একজন পাগল, গন্ডমূর্খ ছিলাম। আধ্যাত্মিক সূক্ষ্মজ্ঞান লাভের পর আমার ভাগ্যাকাশ চন্দ্রপূর্ণ হয়ে গেলো। প্রকৃতপক্ষে, স্থুল জ্ঞানের জালে আবদ্ধ থাকা অপেক্ষা জ্ঞানশূণ্য পাগল থাকা উত্তম”। (অমৃত সঞ্জীবনী) ।
প্রকৃতপক্ষে, সঠিক গুঢ়তত্ত্ব বুঝবার ক্ষমতা সবার থাকেনা, যেরূপ সকল মোরগ আনজীর ফল খেতে পারেনা। মানুষের কান যদি গাধার কানের সমতুল্য হয়, তবে ঐ কান দিয়ে খোদার আওয়াজ শোনা যাবে না। দু’টি আঙ্গুল দ্বারা যদি দু’টি চোখকে বন্ধ রাখা হয় তাহলে কি দুনিয়ার কিছু দেখা যাবে? দুনিয়া দেখা গেলনা বলে এটা প্রমাণ হয় না যে, দুনিয়া অস্তিত্বহীন। সত্যিকার অন্তর্চক্ষু ও নিবেদিত আত্মা ছাড়া দয়া ও মেহেরবানী লাভ করা যায় না।
(৩) কু-প্রবৃত্তির বিনাশ সাধন ও খোদার দিদাল লাভে সহায়তা করা
কামেলী ওলীর সাহচর্যের দ্বারা একজন মুরিদ নিজ নফজ বা প্রবৃত্তির বিরোধিতা করার শক্তি অর্জন করে এবং খোদা প্রেমে অনুরক্ত হয়ে পড়ে। কামেল ওলীর প্রভাবে একজন মুরিদ আল্লাহতালার রহস্যাবলী অবগত হওয়ার সুযোগ পায়। কামেল ওলীর সান্নিধ্যের ফলে একজন মুরিদ খোদার প্রেম-প্রেরণায় বিভোর হয়ে খোদার গোপন রহস্য দর্শনের মাধ্যমে খোদার একত্বে মিশে একাকার হয়ে যায় এবং তখন তার কাছে “দ্বিত্ব” বলে কোন কিছু থাকেনা। কামেল ওলীর সান্নিধ্যের দ্বারা দ্বীন দুনিয়া উভয় জাহানের কার্যসিদ্ধির সম্ভাবনা থাকে, কারণ উভয় জাহানের সম্পর্ক আছে। মাওলানা রুমীর ভাষায়,
“ওলীগণ আল্লাহর বিশিষ্ট বন্ধু, তাঁরা প্রাণজগতের জাছুস বা গুপ্তচর। তাঁরা প্রাণ জগতে সূক্ষ্ম চিন্তাধারার মত ঢুকে যায়। তাঁদের কাছে অবস্থার গুঢ় রহস্য ব্যক্ত হয়ে পড়ে”।
আজ সারা বিশ্বের মানুষ শান্তির অন্বেষায় পাগল। চতুর্দিকে খুনখারাবী, মুনাফেকী, জুয়াচুরি, ডাকাতি, রাহজানি, ধোঁকাবাজী, নিরাপত্তাহীনতা, সামাজিক অসম্প্রীতি ও অরাজকতার ঢল। মানবতা আজ তমশাচ্ছন্ন। যগের এ সন্ধিক্ষণে মানবের আত্মশুদ্ধির জন্য একজন কামেল ওলীর সান্নিধ্যের প্রয়োজনীয়তা তাই অপরিসীম। হযরত বড় পীর (রঃ) বলেন,
“হে আমার পেয়ারা! তুমি যখন আমার প্রতি তাকাও বা আগ্রহান্বিত হও, এগিয়ে আস, আমি তোমার মঙ্গলাকাঙ্খী। তোমার জন্য দোয়া করি। আর যখন আগ্রহ বিমূখ হও, পশ্চাতের দিকে তাকাও বা পেছন ফির, আমি তখনও পূর্ববৎ থাকি এবং তোমার জন্য কাঁদি, কারণ পিছন দিকে কিছু দেয়া নেয়ার নিয়ম নেই”।
(৪) আত্মশুদ্ধি লাভে সহায়তা করা ও স্রষ্টা-অনুরাগী করে তোলা
প্রকৃতপক্ষে, নবী রসূল (সঃ), কামেলগণ মানব জাতিকে পার্থিব অনুরাগ শিথিল পূর্বক স্রষ্টা অনুরাগী করে তোলেন। আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে মানবজাতিকে কর্মঠ চরিত্রবান করে তোলেন। খোদা যেহেতু গাফুরুর রাহিম, সেহেতু তিনি সব মাফ করে দেবেন এ ভরসায় যে সকল লোক পাপ কার্যে লিপ্ত হয় তাদেরকে কঠোর শাস্তির সম্মুখীণ হতে হবে। অনুরূপভাবে যারা খোদা প্রদত্ত সুযোগ সুবিধাকে নিজেদের উপকারার্থে লাগায় না, বরঞ্চ সুযোগ সুবিধাসমূহকে অস্বীকার করে তারা পথভ্রষ্ট। একজন কামেল ওলীর সান্নিধ্য মানব জাতিকে এ উভয় প্রকার বিপর্যয় থেকে রক্ষা করতে পারে। মাওলানা রুমী বলেন,
“মানব মনকে যখন পীরের জ্ঞানজ্যোতির প্রতি নিবদ্ধ করা হয়, তখন ইহার অংশ স্বরূপ তার জ্ঞান চক্ষু খুলে যায়”।
বস্তুতঃ কামেল ওলীর অনুসারীগণ নিজেদেরকে পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের নিয়ন্ত্রনপূর্বক খোদার নাম স্মরণে শান্তি লাভ করে এবং পুকুরের জলের মত স্বচ্ছ হয়ে যায়। সরোবরের পানি পান করে মানব যেমন তৃষ্ণা নিবারণ করে, তদ্রুপ কামেল ওলীর সুধা পানকারী ও রিপুর বিনাশ স্তর অতিক্রম করে খোদার পরিচিতি জগতে উন্নীত হয় এবং নিত্যজীবন লাভ করে। খোদা পরিচিতি জগতে উন্নীত হওয়ার পর স্রষ্টার সঙ্গে সৃষ্টির যোগাযোগ স্থাপিত হয় এবং ন্যায়নীতি বিবর্জিত হৃদয়হীন লোকগণ হিংস্র ব্যঘ্রসুলভ রক্তলোলুপ স্বভাব পরিহাসপূর্বক মানবীয় গুণ অর্জনে সমর্থ হয়। ফলশ্রুতিতে খোদার ইচ্ছাশক্তির নিকট নিজ ইচ্ছাশক্তিকে বিলীনপূর্বক “তছলিম বা রজা” গুণজ প্রকৃতি লাভে সমর্থ হয়। মাওলানা রুমী (রঃ) বলেন,
“তুমি ফেরেশতা এবং পশু উভয়ের স্বভাবে স্বভাবিত। পশুর স্বভাব থেকে মুক্ত হও, ফেরশতারও ঊর্ধ্বে যেতে সক্ষম হবে”।
কামেল ওলীর অনুগ্রহ লাভে ধন্য হবার জন্য প্রয়োজনীয় শর্তাবলী
প্রকৃতপক্ষে, খোদার দিদার ও ওলীর ছোহবত লাভে ধন্য হতে হলে একজন খোদাপাগল কামেল পীরের হাতে বায়াত গ্রহণ করতে হবে। শয়নে, স্বপনে, জাগরণে, সকল অবস্থায় কামেল পীরকে স্মরণ রাখতে হবে। কামেল পীরের প্রতি আনুগত্য থাকতে হবে। বিপদে-আপদে, সুখে-দুঃখে সকল অবস্থায় মিথ্যাকে সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করতে হবে। হারাম খাদ্য ভক্ষণ ও অবৈধ রুচি চিরতরে বর্জন করতে হবে। হালার রুজির তালাশ করতে হবে। কারো প্রতি হিংসা, বিদ্বেষ ইত্যাদি পোষণ করা কিংবা ক্ষতি করা থেকে বিরত থাকতে হবে। অপব্যয়কে বর্জন করতে হবে এবং কার্পণ্য করা চলবে না। কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্যকে সমূলে পরিত্যাগ করতে হবে। মৃত্যুর কথা স্মরণ করতে হবে এবং মৃত্যুকে নিকটবর্তী জানতে হবে। মাতা-পিতার ভালবাসা অর্জন করতে হবে। প্রতিদিন রাত্রে শয়নের প্রাক্কালে আত্ম-সমালোচনা করতে হবে এবং মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকার জন্য ‘তওবা’ করতে হবে। সকল প্রকার লোভকে হারাম করতে হবে।
পরমুখাপেক্ষীতা বর্জন করতে হবে এবং স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা চালাতে হবে। সকল বিপদে আপদে ধৈর্য ধারণ করতে হবে এবং খোদার ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিতে হবে। পূরণ করা যাবে না এরূপ প্রতিশ্রুতি দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। সত্যিকারের জ্ঞাণ আহরণ করতে হবে এবং গোঁড়ামীর উর্ধ্বে উঠতে হবে। ন্যায়ের প্রতি দৃঢ় থাকতে হবে। খোদার খানের কাছে নিজের অস্তিত্বকে সম্পূর্ণরূপে বিলীন করে দিতে হবে। প্রকৃতপক্ষে “ঐ ব্যক্তিই সফলকাম যার জ্ঞান বিশ্বাস পর্যন্ত, বিশ্বাস আল্লাহর ভয় ভীতি পর্যন্ত এবং আল্লাহর ভয় আমল পর্যন্ত, আমল পরহেজগারী পর্যন্ত, পরহেজগারী খোদার নৈকট্য লাভ পর্যন্ত এবং খোদার নৈকট্য লাভ প্রত্যক্ষ দর্শন পর্যন্ত” {হযরত জোনায়েদী বাগদাদী (রঃ)}। হযরত রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেন, “যে নিজেকে চিনেছে, নিশ্চয়ই সে খোদাকে চিনেছে”। সুতরাং প্রত্যেক মানুষের কর্তব্য হলো কামেল ওলীকে পীর ধরা, তাঁর আদেশ উপদেশ মেনে চলা এবং মৃত্যুর কথা স্মরণপূর্বক মুরশিদের সাহচর্যে থেকে এবাদত, রেয়াজত, জিকির, মোরাকেবা, মোশাহেদা করা, তজকিয়ায়ে নফছ ও তজকিয়ায়ে কলব হাসেল করতঃ খোদা প্রাপ্তির জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করা। কারণ ‘এছলাহে নফছ’ বা নফছের সংশোধনপূর্বক ‘হুজুরী’ কলব হাসেল করতঃ আল্লাহতালার সন্তুষ্টি বা নৈকট্য লাভ করাই প্রত্যেক মানুষের একান্ত কর্তব্য।
আজ মূল্যবোধের অবক্ষয় চরম আকার ধারণ করেছে। ইহার পরিণাম অতীব ভয়াবহ। অপ্রয়োজনীয় ও কুরুচিপূর্ণ ভূষণকে ফ্যাশন মনে করে চরিত্র বিনষ্টকারী আমোদ প্রমোদ এবং স্বাস্থ্য হানিকর পানীয়তে অভ্যস্থ হয়ে সমাজের এক বৃহৎ অংশ আজ কলুষিত। এ সকল নোংরা আচার ব্যবহার ও রীতিনীতির ফলে মানুষের কোমল মন বিলুপ্ত হয়ে মানবমন কঠোর ও নিষ্ঠুর হয়ে পড়ে এবং পশু সুলভ কামনা বাসনায় পরিপূর্ণ হয়ে যায়। তাই একটি সুখী সমৃদ্ধ সমাজ বিনির্মাণের জন্য অনন্ত শান্তির ফোয়ারা হযরত রসূল করিম (সঃ)-এর সুন্নাহর অনুসরণকারী কামেল ওলীর ছোহবত ও সান্নিধ্য একন্ত প্রয়োজন। প্রকৃতপক্ষে, ধর্ম হচ্ছে শরীয়ত, তরিকত, হাকীকত ও মারফতের একটি সমন্বিত রূপ। মারফত হচ্ছে একটি অনন্য মহাসাগর। এ মহাসাগরে ডুব দিতে হলে অন্তর পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে এবং প্রেম ও ভক্তির রসে সিক্ত করতে হবে। শরীয়ত, তরিকত ও হাকিকতকে মহাসাগর মুখী সাগরের সাথে তুলনা করা যায়। মারফতের মহাসাগরে পৌছতে হলে সমূদ্রগুলোকে প্রেম ও ভক্তির বারিধারা দিয়ে পরিপূর্ণ রাখতে হবে। অন্তর পরিচ্ছন্ন না হলে আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি ভক্তি আসবে না। আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি ভক্তি না থাকলে ঈমান হবে অসার, নামায হবে ব্যায়াম, রোজা হবে নিছক উপবাস, হজ্জ্ব হবে বিদেশ ভ্রমণ, যাকাত হবে অহংকারের নিদর্শন এবং বিদ্যা হবে নারীদের অলঙ্কারের ন্যায় অনুৎপাদনশীল। মনে যদি পবিত্র প্রেমের স্পর্শ না থাকে, উহা যদি কুটিলতা ও শঠামিতে পরিপূর্ণ থাকে তাহলে ঐ মানুষকে দোযখে টেনে নেবে। আল্লাহ আমাদের ভন্ড ও কপ পরিচয়ধারীদের হাত থেকে রক্ষা করুন এবং সুফী দর্শনের সত্যিকার ভাবধারায় উজ্জ্বীবিত হবার তওফিক দিন। আমিন!