রেহান ( ছদ্মনাম) নামের একজন যুবকের অভিজ্ঞতা দিয়েই শুরু করি। একদিন রেহান ঘুম থেকে উঠে ফেসবুক মেসেঞ্জারে দেখতে পেল, তার সদ্য প্রয়াত বন্ধুর ফেসবুক আইডি থেকে তার কাছে অস্লীল ভাষায় টেক্সট এসেছে। কিংবা পিউয়ের ( ছদ্মনাম) অভিজ্ঞতাই ধরা যাক , পিউ এক দুপুরে দেখতে পেলো তার একটি ব্যাক্তিগত ছবি বিকৃত হয়ে সোশাল মিডিয়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং সেখানে অপরিচিত শখানেক লোক নানা ভাষায় তাকে কটূক্তি করছে। উপরের দুইটি ঘটনা সোশাল মিডিয়ার যুগে খুব স্বাভাবিকই বলা যেতে পারে। কিন্তু এই দুইটি ঘটনা বিশ্লেষনের দাবী রাখে। এখানে রেহান আর পিউয়ের সাথে যা হয়েছে, তাকে ইন্টারনেটের ভাষায় ‘ট্রল’ বলা হয়। । কিন্তু এইতো এই বিশ বছর আগেও ট্রলের (Troll) বাংলা অর্থ ছিলো ক্রিয়াবাচনে ‘নৌকার পিছনে পানির ভিতরে টোপ নাড়াচাড়া করে বড়শি দিয়ে মাছ ধরা’, এবং ব্যাক্তিবাচনে ‘ স্ক্যান্ডিনেভিয়ান পুরানের এক দানব’ । অথচ হাতের মুঠোয় মুঠোফোন আর বিদ্যুৎগতির ইন্টারনেট মানুষের রোজকার জীবনে একটি অনবদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়ে, ট্রল (Troll) শব্দটির অর্থ বদলিয়ে নতুন করে বানিয়েছে ‘ইন্টারনেটে কটুক্তি ও বিদ্বেষমূলক কথা ছড়ানো’ । কিছু কিছু বিদেশী শব্দ যেমন আমাদের বাংলাভাষায় নিজেকে পরিবর্তন না করেই অনূদিত হয়েছে, ট্রল আসলে সেরকমই একটি শব্দ, যার ভাবানুবাদ ‘ ইন্টারনেটে কটুক্তি ও বিদ্বেষমূলক কথা ছড়ানো’। তবে একটি ট্রল তখনই ট্রল যখন সেটা তিনটি শর্ত পূরণ করবে। প্রথমত, যে ট্রল করবে তার পরিচয় হতে হবে অজ্ঞাত। দ্বিতীয়ত, ট্রল সামাজক নীতি ও শৃঙ্খলাকে তোয়াক্কা করবে না। তৃতীয়ত, যারা ট্রল করবে অর্থাৎ ‘ অন্যের প্রতি বিদ্বেষমূলক কটূক্তি করবে’ তারা সেটি করে একধরনের বিনোদন লাভ করবে।
এটা নতুন করে প্রমানের কিছু নেই যে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো আমাদের মস্তিষ্ককে প্রভাবিত করা শুরু করেছে এবং একই সাথে আমাদের আচরণকেও প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে। কাজেই যে ব্যাক্তি ট্রলের স্বীকার হয়েছেন, তা তার মনোদৈহিক অবস্থা ও আচরণেও অস্বাভাবিকতা আসতে পারে। মনোবিদরা এমন ব্যাক্তির ক্ষেত্রে ডিপ্রেশন এমনকি সুইসাইডেরও কেস হিস্ট্রি পেয়েছেন। কিন্তু কেন এমন আচরণ কিংবা কোন ধরনের মনস্তত্ত্ব কাজ করে ওপেন প্ল্যাটফর্মে অপরকে আক্রমনের মধ্যে ? এটা নিয়েও কিন্তু বিস্তর গবেষণা হয়েছে। বেশ কয়েকটি স্বনামধন্য মেডিকেল জার্নালে এটা নিয়ে লেখাও প্রকাশিত হয়েছে। যারা ট্রল করেন, তাদের মনস্তত্ত্বকে মনোবিজ্ঞানীরা একটি নির্দিষ্ট ধারাতে ফেলতে সক্ষম হয়েছেন। মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, ট্রল করা মানুষরা যে ব্যাক্তিত্বের বৈশিষ্ট দেখায় তাকে ‘ Dark tetrad’ বলে।
‘Dark tetrad’ গঠিত আত্মমগ্নতা, মানসিক অস্থিরতা, প্রতারনা, অন্যকে পীড়ন করে আনন্দিত হওয়ার মানসিক বিকার এই চারটি স্তর নিয়ে। বিজ্ঞানীরা এটাও দেখিয়েছেন, তুলনামূলক পুরুষদের মধ্যেই এই মানসিকব্যাধির হার বেশী। ট্রল বা অন্যকে আঘাত করে পাওয়া অসুস্থ এই মানসিক বিনোদনকে অনেকসময় এডিকশনের পর্যায়েও তুলনা করা হয়। কারন এখানে ‘ addictive nature of reward’ থাকে, যার মোহ ‘dark tetrad’ personality এর লোকেরা কাটাতে পারে না।
মানুষের অপরের প্রতি সহানুভূতি বা এমপ্যাথির দুটি ভাগ আছে। একটি হচ্ছে কগনিটিভ আরেকটি হচ্ছে এফেক্টিভ। কগনিটিভ এমপ্যাথি হচ্ছে- অন্য মানুষের অনুভূতি সনাক্ত করা এবং তা বুঝতে পারা। এফেক্টিভ হচ্ছে- অন্য মানুষের ব্যাক্তিগত অনুভূতি অনুভব করার ক্ষমতা। ‘dark tetrad’ personality’ বা যারা ট্রল করেন তাদের এফেক্টিভ এমপ্যাথি কম থাকে কিন্তু কগনিটিভ এমপ্যাথি বেশী থাকে। অর্থাৎ এই ধরনের মানুষেরা বুঝেন অপরের অনুভূতি কেমন কিংবা অপর মানুষেরা কেমন আচরনে আঘাত পান। কিন্তু যারা ট্রল করেন, সেই ‘dark tetrad’ personality এর লোকেরা সেটাকে মোটেও পাত্তা দেন না। এ ক্ষেত্রে তাদের মোটিভেশন হচ্ছে ‘atypical social rewards’ । সোজা বাংলায় ‘ অপরের এই বিষয়টি নিয়ে তাকে আঘাত করতে আমার ভালো লাগে’ এই ধরনের মানসিকতা। আরেকটি গবেষণায় দেখা যায় যে, সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন ও একাকীত্ব ধারন করা মানুষের মধ্যে এমন আক্রমনাত্নক আচরনের হারটাও বেশী।
তাহলে এই ট্রল নামের মানসিক ব্যাধির সস্তা বিনোদন থেকে তথ্য প্রযুক্তির অবাধ যুগে নিজেকে নিরাপদ রাখার উপায় কি? ট্রল শিকারীদের হাত থেকেই বা নিস্তারের রাস্তা কোনটা ?
উত্তর - ‘উপেক্ষা করা’।
আপনার প্রতি একজন আক্রমনাত্নক কারন সে আপনার প্রতিক্রিয়া দেখে নিজে অস্বাস্থ্যকর প্রশান্তি লাভ করতে চায়, যা একটা চেইন রিএকশনের মতোন। তাই তাকে উপেক্ষা করুন এবং তার কর্মকাণ্ডের প্রতি অপ্রতিক্রিয়াশীল হোন, এটাই নিজের মানসিক সুস্থতা বজায় রাখার উপায় নিঃসন্দেহে।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই এপ্রিল, ২০২৩ রাত ৮:৫৩