গ্রীষ্মের আম, কাঁঠাল, জাম, তাল, তরমুজের পাশাপাশি লিচুও আমাদের দেশে বেশ জনপ্রিয় একটি ফল। মে থেকে জুন এই সময়ে বাহারি লিচুর রঙে ও স্বাদে ভরে যায় আমাদের দেশীয় হাটবাজারগুলো। এই ফলটিতে আছে ভিটামিন সি, পটাশিয়াম, কপার, এন্টি-অক্সিডেন্ট, ফাইবার। লোভনীয় এই ফলটিকে নিয়ে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা বিখ্যাত শিশুতোষ কবিতাও আছে -
বাবুদের তাল-পুকুরে
হাবুদের ডাল-কুকুরে
সে কি বাস করলে তাড়া,
বলি থাম একটু দাড়া।
পুকুরের ঐ কাছে না
লিচুর এক গাছ আছে না
হোথা না আস্তে গিয়ে
য়্যাব্বড় কাস্তে নিয়ে
গাছে গো যেই চড়েছি
ছোট এক ডাল ধরেছি ......
সুস্বাদু ও জনপ্রিয় এই লিচুর বিচি/বীজ দেখতে কিংবা শুনতে একটি সাধারণ বস্তু। কিন্তু চলতি বছর গলায় লিচু আটকে মৃত্যু ৮ শিশুর, সচেতনতার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের, এই ধরনের সংবাদ পড়লেই নিরীহ দর্শনের লিচুর বীচি নিয়ে আঁতকে উঠতে হয়। লিচুর বিচি গলায় আটকে মারা যাচ্ছে শিশু, দেখিয়ে দেয় যে সাধারণের মোড়কে জড়ানো এই ফলের ভেতরের বীজটি সুযোগ পেলেই প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে।
কিন্তু কিভাবে ?
এই প্রাণঘাতী ঘটনার পেছনে দায়ী শিশুদের ছোট শ্বাসনালী এবং লিচু বীজটির শ্বাসনালীতে আটকে যাওয়া। এই পুরো ঘটনাটিকে বলে choke বাংলা অর্থ শ্বাসরুদ্ধ হওয়া বা শ্বাসরোধ করা। এমনটি নয় যে এই শ্বাসরুদ্ধ হওয়া শুধু লিচুর বিচি দিয়েই হয়। আকারে ছোট ফলগুলো, গাজর আপেল ইত্যাদির টুকরো, মাংসের ছোট হাড়, খেলনার ছোট একটি অংশ ইত্যাদি শ্বাসনালীতে আটকে যেতে পারে, যাকে বলা হয় foreign body obstruction. এবং এর ফলে হয় Choking বা শ্বাসরুদ্ধ অনুভব করা, শ্বাস-প্রবাহ আটকে যাওয়া।
Choking এর প্রকারভেদ ও যেভাবে বুঝবো
যদি বাইরের বস্তুটি মৃদু ভাবে শ্বাসনালীতে আটকে আংশিক বাতাস চলাচল বন্ধ করে, তাহলে দুই বছরের বেশী বয়সীরা কাশি দিতে পারে এবং কাশির মাঝে শ্বাসগ্রহণের সময় অদ্ভুত শব্দ wheeze করতে পারে। যদি বাচ্চা কাশি দিতে পারে এবং শব্দ করতে পারে তাহলে তার সেই কাশি দেওয়াকে থামানো উচিত নয়। এটির মাধ্যমে অনেক সময় mild airway obstruction দূর হয়ে যায়। এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে মৃদু মাত্রায় mild শ্বাসনালীতে কিছু আটকে যাওয়া যেকোনো মুহূর্তেই পূর্ণভাবে শ্বাসনালীতে আটকে complete airway obstruction করতে পারে।
আবার যদি বয়সে বড় বাচ্চার শ্বাসনালীতে কিছু আটকে যায় একই সাথে তীব্র শ্বাসকষ্টে সে দুহাত দিয়ে গলার দুইপাশ চেপে ধরে, কথা বলতে পারে না, কাশি দিতে পারে না, ঠোঁট ও হাতের আঙ্গুল, কানের লতি নীল হয়ে যায়; তাহলে এই ঘটনাটিকে severe airway obstruction ধরে নিতে হবে এবং সাথে সাথে জরুরী পদক্ষেপ নিতে হবে।
চোখের সামনে এমন একটি ঘটনা, বুঝতে পারলাম এটি severe airway obstruction। এখন কি করবো ?
মনে রাখতে হবে severe airway obstruction এর ক্ষেত্রে প্রাণ রক্ষাকারী এপ্রোচ একেক বয়সীদের জন্য একেকরকম হয়।
শুরুতেই দুটো জিনিস মাথায় রাখতে হব।
তীব্র শ্বাসকষ্টে ভোগা বাচ্চাটি ওই মুহূর্তে সচেতন নাকি অচেতন ?
বয়স কত ? শূন্য থেকে এক বছর বয়সী শিশু ? নাকি এক বছরের অধিক বয়সী ( যেমন তিন বা চার বছর বয়সী বাচ্চা)।
যদি হয় সচেতন বা conscious তিন/চার বছর বয়সী বাচ্চা/ আরও বড় তাহলে - আমরা খুবই দ্রুত abdominal thrust পদ্ধতি প্রয়োগ করবো। কিভাবে abdominal thrust করতে হয় তা একবার চল্লিশ সেকেন্ডের ভিডিওটি দেখে মনে মনে কয়েকবার কল্পনা করলেই, যে কেউ প্রয়োগ করতে পারবেন। আমার ব্যক্তিগত ধারণা এক বছরের বেশী বয়সী যেসব বাচ্চা আমাদের দেশে লিচুর বীজ গলার আটকে মারা গেল, তাদের অনেকের প্রাণ বাঁচানো যেত যদি পরিবারের কেউ abdominal thrust পদ্ধতিটি জানতো বা দ্রুত প্রয়োগ করা যেত।
যদি আমরা দেখতে পাই, সচেতন বা responsive এক বছরের কম বয়সী শিশুর choking তাহলে, আমরা নিচের ভিডিওটির মতো করে Back slaps আর Chest thrust দেওয়া শুরু করবো। ঘাবড়ানোর কিছু নেই, পদ্ধতিটির সহজ বাংলায় বলা যায় বিশেষ উপায়ে পেছনে চড় ও বুকে চাপ দেওয়া। আসুন চার মিনিটের ছোট্ট একটি ভিডিও দেখি। বলা তো যায় না, এই চার মিনিট কোনও শিশুর জীবন বাঁচিয়ে দিতে পারে !
কয়েকবার দেখে নিয়ে মনে মনে ধাপগুলো কল্পনা করে নিলেই Back slaps and Chest thrust পদ্ধতি সহজেই এক বছরের কম বয়সী সচেতন বা responsive শিশুর choking এর ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে পারবেন।
আমরা এতক্ষণ বয়স ভেদে সচেতন, conscious, responsive শিশু ও বাচ্চাদের ক্ষেত্রে severe airway obstruction বা choking এর ক্ষেত্রে দ্রুততার সাথে করনীয় নিয়ে জানলাম। কোন লক্ষণগুলো তীব্র বা severe airway obstruction ( তীব্র শ্বাস কষ্টে বয়সে একটু বড় বাচ্চার ক্ষেত্রে নিজের দুই হাত দিয়ে নিজেরই গলা চেপে ধরা, কথা বলতে পারে না, কাশি দিতে পারে না, ঠোঁট- হাতের আঙ্গুল-কানের লতি নীল হয়ে যায় ) তাও জেনে নিলাম।
এখন প্রশ্ন, যদি শিশু বা বাচ্চা যদি choking এর কারণে হঠাৎ করেই অচেতন বা unresponsive হয়ে যায় ?
সে ক্ষেত্রে যে পদ্ধতিটি জীবন বাঁচাতে পারে তা হল - CPR বা Cardiopulmonary resuscitation।
শুধু choking এর ক্ষেত্রেই নয় আরও অনেক ইমারজেন্সি মেডিক্যাল কন্ডিশনে CPR প্রাণ বাঁচাতে পারে। জীবনের প্রয়োজনে CPR সম্বন্ধে জানা সব সাধারণ মানুষেরই উচিত। আমি পরবর্তী সময়ে অন্য পোস্টে CPR নিয়ে সহজ ভাষায় বিস্তারিত লেখার চেষ্টা করবো যেহেতু বাচ্চা ও বড়দের জন্য CPR এর টেকনিক আলাদা আলাদা।
শেষে একটি রিয়েল লাইফ সিনারিও দেখি। আমেরিকায় একজন পুলিশের বডিক্যামে ধারণ করা নিচের এই ভিডিওটি। choking এ আক্রান্ত একটি শিশুকে কিভাবে জীবনের পথে ফিরিয়ে আনা হল, চলুন একসাথে দেখি -
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জুন, ২০২৩ দুপুর ২:২৫