somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

২৪ বছর পরের একদিন - ১

২০ শে অক্টোবর, ২০০৯ দুপুর ১২:৪৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ছেলেটার সাথে আমার প্রথম পরিচয় প্রায় ২৪ বছর আগে, সেন্ট মেরীস্‌ স্কুলে, নার্সারী বা কেজিতে ঠিক মনে নেই।খুব ফরসা, চুপচাপ একটা ছেলে কিন্তু মাথাভর্তি দেখি দুনিয়ার আইডিয়া ঘুরপাক খাচ্ছে! সাখাওয়াত নামটা অনেক বড়, তাই প্রথম শ্রেনী শাখা ক, শাখা খ থেকে আইডিয়া নিয়ে আমরা ওর নাম দিলাম শাখা :)। সেন্ট মেরীসের ইটের মাঠে বাদাম দিয়ে ফুটবল খেলা, বেজমেন্ট অডিটোরিয়ামের অ্যাসেম্বলী, স্কুলের পাশ দিয়ে অজানা জায়গায় চলে যাওয়া ভূতুড়ে রাস্তাটার দিকে উকিঝুকি মারা বাদ দিয়ে সাখাওয়াতের সাথে আমার যে স্মৃতিটা মনে পড়ে সেটা হচ্ছে স্কুল ছুটির পরে আমরা দুইতলায় একদম একপাশের ক্লাসরুমটার সামনে দাড়িয়ে আছি কখন আমাদেরকে নিতে আসবে সেই আশায়। ঐটা বোধহয় ক্লাস টু এর ঘটনা। সেই সময় থেকে বোধহয় ওর সাথে আড্ডা মারা শুরু। এরমধ্যে আমার ছবি আঁকার দূরবস্হা দেখে আম্মু আমাকে নিয়ে গেলো শিশু একাডেমীতে। ওখানেও গিয়ে দেখি সাখাওয়াত! ও অবশ্য আমার ঠিক উল্টা কারণে ভর্তি হয়েছিলো :)। আমাকে দিয়ে এইসব জিনিস হবে না দেখে আমি ওর ছবি আঁকা দেখাতেই বেশী মনযোগ দিতে লাগলাম। ক্লাস ফাইভে উঠে ভর্তি হলাম চট্টগ্রাম সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে। এখানেও সাখাওয়াত! সত্যিকারের বন্ধুত্বের শুরু বোধহয় এখান থেকেই। মনে আছে ওর কাছে শুনলাম তিন বন্ধুকে নিয়ে ফাটাফাটি কিছু বই আছে, নাম তিন গোয়েন্দা। কিছুদিনের মধ্যে আমাদের গল্প করার টপিকে পরিণত হলো ফেলুদা, কিশোর পাশা, মুসা আমান, রবিন মিলফোর্ড, শার্লক হোমস্‌রা। তখন মনে হতো গোয়েন্দা হতে না পারলে জীবনটাই বৃথা। একদিন ও বললো, ও হচ্ছে রবিন মিলফোর্ড। আমি অবাক হয়ে ভাবলাম তাইতো! এরকম চেহারা, মাথাভর্তি বুদ্ধি, শান্তশিষ্ট, সবকিছু জানে এরকম ছেলে রবিন মিলফোর্ড না হয়ে কি হবে? অনেক চেষ্টা করেও নিজের মধ্যে কিশোর বা মুসার কিছু দেখতে না পেয়ে খুবি হতাশ হয়েছিলাম। ওর বাসা ছিলো চন্দনপুরা, স্কুলের কাছে হওয়াতে ওদের এলাকায়ও যাওয়া শুরু হলো এই সময়ে। গভর্নমেন্ট হাই স্কুলের পাহাড়ে দৌড়াদৌড়ি করতে করতে দুইজনে একসাথে এরপরে চলে গেলাম ফৌজজদারহাট ক্যাডেট কলেজে।

ক্যাডেট কলেজের অদ্ভুত কষ্টের, কান্না চেপে রাখা জুনিয়র লাইফগুলোতে সাখাওয়াতের মতো পুরান বন্ধুদের দেখে মনে হতো নাহ জীবনটা অতটা খারাপ না। ক্লাসরুমে জানালার পাশের সীটে বসে গালে হাত দিয়ে ও সারাদিন খাতায় আকিবুকি কাটতো। পরে ওর খাতা নিয়ে দেখতাম কেমন অদ্ভুত সুন্দর সব ছবি তৈরী হয়ে গেছে। ওর থেকে আইডিয়া পেলাম পারস্‌পেক্টিভ জিনিসটা আসলে কি! ওর অসাধারণ হাতের লেখায় ওয়াল পেপার দেখে অন্য হাউজের আমরা সবসময় ওর উপর বিরক্ত, কিন্তু টার্ম এন্ড নাইটে দেখতাম অনেক পোলাপাইন রিপোর্ট কার্ড হাতে ঠিকি ওর রুমে গিয়ে লাইন দিয়েছে ;)। আমরা প্রায় অন্যদের সম্বন্ধে বলি ছেলেটা অনেক মেধাবী ছিলো, অনেক ভালো ছেলে ছিলো। মেধাবী আসলে কোন প্রকারে হতে পারে সেটার জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ সাখাওয়াত। খাতায় আকিবুকি কাটা ছাড়া ওকে কোনদিন পড়তে দেখি নাই, তাও সবসময় রেজাল্ট ভালো। অবশ্য ও কোনদিন এসব নিয়ে মাথাও ঘামাতো না। এসএসসিতে ৩/৪ নাম্বারের জন্য যখন স্ট্যান্ড করলোনা তখনো দেখলাম অন্যরা ওর জন্য মন খারাপ করলেও এই ব্যাপারটা নিয়ে ও কি পরিমাণ নির্লিপ্ত! রুম ক্রিকেটের ফাস্ট বোলার, আবার মাঠে গিয়ে প্রয়োজনে স্পিনার, শুধু সিনিয়রদের দেখে দেখে শিখে কলেজের বেস্ট ড্রামার হয়ে যাওয়া। ইন্টার ক্যাডেট কলেজ মিটে ওর বাজানো দেখে গার্লস ক্যাডেট কলেজ ওকে হায়ার করলো ওদের সাথে বাজানোর জন্য (যে ঘটনা নিয়ে ওকে পরে অনেক পঁচানি খাইতে হইছে :))। পরে ওর মনে হলো ড্রামস্‌ না; গীটার বাজালে ভালো হয়, কিছুদিনের মধ্যে দেখলাম হোটেল ক্যালিফোর্নিয়া বাজাচ্ছে - গড গিফ্টেড ট্যালেন্ট কি জিনিস হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যেতো ওকে দেখলে। আর্ট কম্পটিশন, ওয়ালপেপার, কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এইগুলাতো আমাদের 'স্যাক' এর জন্য সবসময় ডালভাত। আমার চরম অজনপ্রিয়তার পাশে অদ্ভুত ভালো ছেলে হিসেবে ওর তুমুল জনপ্রিয়তা দেখে ভাবতাম শালা এত ভালো থাকে কেমনে? ক্যাডেট কলেজ লাইফ শেষে হিসাব কষতে গিয়ে দেখলাম সাখাওয়াতের মতো অল্প কিছু অসাধারণ বন্ধুকে পাশে পাওয়াটাই এই ৬ বছরের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। পরে ও যখন বুয়েটে পড়তো গেলো আর আমি এনএসইউতে তখন একদিন ও বলেছিলো, "আমাদের আর একসাথে পড়া হলনা"।

বুয়েটে ওর রশীদ হলের রুমে যখন প্রথম গেলাম তখন খুব উৎসাহ নিয়ে ও আমাকে ওর হল আর আর্কিটেক্চার ডিপার্টমেন্ট দেখালো। আর্কিতে কি অদ্ভুত অদ্ভুত ঘটনা ঘটে সেগুলো বুঝানোর চেষ্টা করলো। আস্তে আস্তে দেখা সাক্ষাত কম হতে লাগলো, দুইজনেই নিজেদের ক্যাম্পাস নিয়ে ব্যস্ত। ২০০২ এর দিকে হঠাৎআমরা সেন্ট মার্টিন্‌স যাওয়ার প্ল্যান করলাম। সাখাওয়াতকে ফোন দিলাম, শিওর ছিলাম ও যাবেনা; কিন্তু দেখলাম রাজী হয়ে গেলো। ওকে বানানো হলো টুরের অফিসিয়াল ফটোগ্রাফার। ওর মাথায় কি কারণে চুল পড়ে যাচ্ছিলো, ছোট ছোট চুলের কারণে দিল চাহতা হ্যায় এর অণুপ্রেরণায় ওকে ডাকা শুরু করলাম 'সিড'। পকেটে অল্প টাকা নিয়ে ট্রলারে উত্তাল সমুদ্র পাড়ি দিয়ে সেন্ট মার্টিন্‌সের সবুজ পানিতে আর প্রবালে দাবড়ে বেড়ানো, ছেড়াদ্বীপের ঠান্ডা বালিতে শুয়ে থাকা, ঘোর পূর্ণিমায় রাতে বীচে বসে গান গাওয়া, স্কুলঘরের এক রুমে ছয়জন গাদাগাদি করে থাকা, ফিরবার সময় সন্ধাবেলায় টেকনাফের গ্রামে কাদার মধ্যে নেমে পড়ে মাইলদুয়েক রাস্তা হাটা, কোনমতে শেষ বাস ধরে গভীর রাতে চট্টগ্রাম এসে পৌছানো..লাইফের প্রথম সত্যিকারের অ্যাডভেন্চারের সহযাত্রী ছিলো সাখাওয়াত। ঢাকা ফিরে আস্তে আস্তে আবার যে যার জীবনে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। যোগাযোগ আরো কমে গেলো।

ক্রমশ..

২৪ বছর পরের একদিন - ২
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে অক্টোবর, ২০০৯ দুপুর ২:৪৯
১৯টি মন্তব্য ১৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

৫০১–এর মুক্তিতে অনেকেই আলহামদুলিল্লাহ বলছে…

লিখেছেন বিচার মানি তালগাছ আমার, ০৩ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০০



১. মামুনুল হক কোন সময় ৫০১-এ ধরা পড়েছিলেন? যে সময় অনেক মাদ্রাসা ছাত্র রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিল। দেশ তখন উত্তাল। ঐ সময় তার মত পরিচিত একজন লোকের কীভাবে মাথায় আসলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঝিনুক ফোটা সাগর বেলায় কারো হাত না ধরে (ছবি ব্লগ)

লিখেছেন জুন, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:০৯

ঐ নীল নীলান্তে দূর দুরান্তে কিছু জানতে না জানতে শান্ত শান্ত মন অশান্ত হয়ে যায়। ১৯২৯ সালে রবার্ট মোস নামে এক ব্যাক্তি লং আইল্যান্ড এর বিস্তীর্ণ সমুদ্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ অপেক্ষা

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২৩



গরমের সময় ক্লাশ গুলো বেশ লম্বা মনে হয়, তার উপর সানোয়ার স্যারের ক্লাশ এমনিতেই লম্বা হয় । তার একটা মুদ্রা দোষ আছে প্যারা প্রতি একটা শব্দ তিনি করেন, ব্যাস... ...বাকিটুকু পড়ুন

×