ঘড়ির কাঁটায় ৩টা ২০ । দুপুর গড়িয়ে বিকাল হতে চলেছে । সিলিং ফ্যানটার দিকে একমনে উর্ধ্বদৃষ্ঠে চেয়ে লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে হুয়ামুন স্যারের সৃষ্টি করা অদ্ভূত জীব হিমু । হিমু আজ সন্ধ্যা পর্যন্ত উপবাস করেছিল কিন্তু এখন ওর পেটের ভিতর ইঁদুর দৌড়াদৌড়ি করছে । তাই অগত্যা উপবাস ভঙ্গ করতে হিমু তার হলুদ চাদরটা গায়ে জড়িয়ে রওনা দিল মজনু মিয়ার ভাত এবং মাছের হোটেলের উদ্দশ্যে । পাঞ্জাবীর পকেটে হাতড়িয়ে দেখল সেখানে ৩৫টাকা আছে । ৩০ টাকা দিয়েই ভরপেট মাছের ঝোল এবং ভাত খাওয়া হয়ে যাবে হিমুর । বাকি ৫টা দিয়ে রূপাকে একটা ফোন করতে হবে । হিমুর কাছে এখন উপবাস ভঙ্গ করার চেয়ে রূপাকে ফোন করা জরুরী মনে হল ।
তরঙ্গিনী স্টোরে পৌঁছে হিমু ফোন করল রূপাদের বাসায় । রিঙ হচ্ছে কিন্তু কেউ ফোন তুলছে না । তৃতীয়বার ফোন দিতেই হিমু এক নারী কন্ঠের আওয়াজ শুনতে পেল । হিমু কিছুটা হাঁফ ছেড়ে বাঁচল । ভাগ্যিস রূপার বাবা ফোনটা রিসিভ করে নি !
-হ্যালো, কে বলেছেন ?
- রূপা , আমি হিমু ।
- হিমু তুমি ! এতদিন পরে । তোমাকে কতগুলা চিঠি পাঠিয়েছি একটারও জবাব দাও নি । সেদিন বলেছিলে তুমি নাকি অসুস্হ । এখন কেমন আছ ?
- খুব বেশী ভালো না !
-বাইরে বের হয়েছ কেন ?
-আরে বাবা খেতে যাচ্ছি ! খিদে
লেগেছে ।
-হোটেলে খাবা ?
-আর কোথায় খাবো ?
- নিশ্চয়ই ওই পঁচা মজনু মিয়ার
হোটেলে ?
- হুম ।
-তুমি আমাদের বাসায় আস !
-কি ? এখন তোমাদের
বাসায় যাবো কেন ?
-তোমাকে আসতে বলছি আস ! একটা রিক্সা নাও ! ১০ মিনিটের ভিতর চলে আসবা ! এখনই আসবা !
-কিন্তু রূপা !
-কোন কথা শুনতে চাই না ! তুমি এখনই আসবা ! না আসলে কিন্তু খবর আছে !
টুট টুট টুট...
রূপা ফোনটা রেখে দিয়েছে । হিমু কি করবো ঠিক বুঝতে পারছে না । অনেক চিন্তাভাবনার পরে হিমু অতঃপর যাওয়ার সিদ্ধান্তই নিল । তাছাড়া অনেকদিন রূপার সাথে দেখা হয় না । এই সুযোগে সেটাও হয়ে যাবে । হিমু রূপাদের বাসার উদ্দশ্যে রওনা দিল ।
একবার কলিংবেল বাজানোর পরপরই রূপা দরজা খুলে দিল ! মনে হচ্ছিলো যে হিমুর জন্যই অপেক্ষা করছিল ! হিমুকে দেখেই রূপার মুখটা একরাশ হাসিতে ভরে গেল । রূপা হিমুর হাত ধরে টানতে টানতে ডাইনিং এর দিকে
নিয়ে যেতে যেতে বলল,
-চল তোমার খিদে লেগেছে । আগে খেতে দেই !
-হুম ! কি রান্না হয়েছে আজকে ?
-খুব বেশি কিছু না ! আগে জানলে ভাল কিছু রান্না করতাম !
হিমু দেখল খাবার টেবিলের আয়োজন একেবারে খারাপ না ! বিশেষ করে চিংড়ি মাছের মালাইকারী টা বেশ দেখা যাচ্ছে । হিমু হাসি মুখে ভাত মুখে দেয় !
ভাত মুখে নিয়ে রূপার দিকে তাকিয়ে দেখে ও হিমুর দিকে অদ্ভুদ চোখে তাকিয়ে আছে । হিমুকে সামনে বসিয়ে এর আগেও ও যতবার খাইয়েছে ততবারই ওর চোখে এমন একটা চাপা আনন্দ
দেখেছে হিমু ! অদ্ভুদ মায়া নিয়ে
মেয়েটা ওর খাওয়া দেখছে ! হঠাৎই হিমুর চোখে পানি চলে আসতে চাইলো । তাড়াতাড়ি করে পানি মুখে দিল হিমু !
রূপা ব্যস্ত হয়ে বলল,
-কি হল ?
-এতো ঝাল কেন ?
-ঝাল ? কই দেখি ?
রূপা খানিকটা অবাক হয়ে হিমুর প্লেট থেকে মাছের কিছু অংশ মুখ নিল !
-কই ঝাল ?
-ঝাল না ? দেখ ঝালের জ্বালায় আমার চোখে পানি চলে এসেছে !
-তাই না ! ঢং ! পানি খাও !
হিমু আবার খাওয়া শুরু করলে রূপা বলল
- আরেকটা মাছ দেই ?
-না থাক ! তুমি খেয়েছো তো ?
-আমার খাওয়া নিয়ে আপনাকে চিন্তা করতে হবে না ! আপনি খান !
হিমু চুপ করে খেতে লাগল । মাঝে মাঝে হিমু রূপার দিকে তাকিয়ে
দেখল ও আবার সেই অদ্ভুদ মায়ার
চোখে ওর খাওয়া দেখছে ! হিমুর মনটা হঠাত্ই কেন জানি ভাল হয়ে যায় ! নীরবতা ভেঙ্গে
রূপা আবার বলল ,
- জানো আজ পূর্ণিমা । রাতের আকাশে আজ অজস্র তারার মেলায় জোত্স্নারা খেলা করবে ।
- তাই নাকি ?
- হুম । তুমি রাতে আবার আসবে ? তাহলে তুমি আমি দুজনে মিলে জোত্স্না দেখতাম ।
- আচ্ছা আসব ।
- সত্যি ?
- হুম ।
রূপার মনটা এক অদ্ভূত ভালো লাগা দিয়ে ভরে গেল । হিমু বলল,
-আচ্ছা তোমার কি কোনো নীল রঙের শাড়ি আছে?
-কেন বল তো?
-যদি থাকে তাহলে, নীল রঙের শাড়ি পরে গেটের কাছে দাঁড়িয়ে থাকবা । আমি এলেই গেট খুলে দেবে।
-আচ্ছা...
হিমুর খাওয়া শেষ হতে না হতেই রূপা তোয়ালে নিয়ে এসে হাজির ! হিমু চলে যাওয়ার আগে রূপা হিমুকে একটা নীল খামে ভরা চিঠি দিল ।
হিমু নগরীর পিচ ঢালা পথ ধরে হাঁটছে । রূপার দেয়া চিঠিটা এখনও হিমুর পাঞ্জাবীর পকেটেই রয়েছে । চিঠিটা এখন হিমুর পড়তে ইচ্ছা করছে না । প্রিয় মানুষগুলোর চিঠি পড়ার জন্য প্রিয় মূহুর্তের প্রয়োছন । আর হিমুর কাছে সেই সময়টা মাঝরাত । যখন কোলাহলপূর্ণ নগরীটা শান্ত এবং নিরব হয়ে যায় । হিমুর মনে হল বাদলকে একটা কল করা দরকার । অনেক দিন ওর কোনো খোঁজ নেয় নি হিমু । তাই মেসে ফিরার আগে একবার তরঙ্গিনী স্টোরে যাওয়া দরকার ।
রাত ১১টা । আকাশ ভেঙ্গে জোত্স্না নেমেছে । হিমু মেসে লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে । রূপাদের বাসায় গেল না । আবারও মাসখানেক এর জন্য ডুব দিল
। কেননা ভালোবাসার মানুষটির খুব কাছে যেতে নেই । তাতে ভালোবাসা বাড়ে না বরং কমে ।
অন্যদিকে বাসার গেটের কাছে নীল শাড়ি পড়ে হিমুর জন্য অপেক্ষা করছে রূপা । রূপা জানে হিমু কথনোই আসবে না । তবু রূপার মত মায়াবতী মেয়েরা হিমুদের জন্য আজীবন অপেক্ষা করে...