সারাদিনের কর্মব্যস্ত স্কুল কোচিং শেষে এইমাত্র বাসায় আসল একুশ । ক্লান্তি ওর সারা শরীর জুড়ে খেলা করছে । তবু ব্যাগটা প্রিয় বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল।
এই এক চিলতে বারান্দাটা বেশ প্রিয় একুশের । এই বারান্দাটা ওর শত মন খারাপের সাক্ষী ।একুশ পাশের ফ্লাটের বারান্দা টার দিকে তাকালো এবার । না কাউকে দেখা যাচ্ছে না । আজ আর কেউ বারান্দায় বিড়াল কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে নেই । মেয়েটা আজ আর নীল আকাশটার দিকে একমনে তাকিয়ে নেই ।
একুশ আরও কিছুক্ষন দাড়িয়ে থাকল ! তারপর নিজের রূমের বিছানায় গিয়ে গা এলিয়ে দিল । আজ মনে হয় দিনটা খুব খারাপ যাবে ।
আজ সারাটা দিন হৈম বিছানায় শুয়ে আছে । না ইচ্ছা করে নয়। ভীষণ ঠান্ডা লেগেছে মেয়েটার । সাথে প্রচন্ড জ্বর এবং মাথাব্যথা । একুশ অনেক রাতে যে একবার বারান্দায় এসে রাতের জোছনা দেখে সেটা হৈম জানে । তাই কাল রাতেও ও বারান্দায় দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু একুশ আসে নি কোন কারণে। তবুও হৈম দাঁড়িয়ে ছিল অনেকক্ষন। সেখান থেকেই ঠান্ডা লেগে জ্বর এসেছে হৈমের। হৈমের মনটা খুব আনচান করছে বারান্দায় যেতে । কেননা, ও জানে একুশ এখন বারান্দায় আসে । চুপিসারে চোরা চোখে তাকিয়ে থাকে ওর দিকে। হৈম যখন ওর বিড়াল ছানাকে আদর করে তখন সেটা দেখে একুশের চোখে মুখে কিছুটা হিংসার ছাপ ফুটে উঠে । এই ব্যাপারটাতে খুব মজা পায় হৈম ।
হৈমও একুশকে চুপিসারে দেখে তবে সেটা যখন তখন নয় ।যখন একুশ গীটার বাজায় তখন । একুশ যখন গীটার বাজায় তখন ছেলেটা কেমন যেন হয়ে যায়। উদাস হয়ে নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। কেমন যেন নিজের থেকে হারিয়ে যায় । আচ্ছা এমন কেন ছেলেটা । এতো মায়া লাগে কেন ছেলেটার জন্য । কেমন যেন ভবঘুরে ছেলেটা । চুলগুলো বড় বড় আর বড্ড এলোমেলো । হৈমের বড্ড ইচ্ছে করে মাঝে মাঝে একুশের ওই বড়চুল গুলো আরো এলোমেলো করে দিতে।
হৈম জানে একদিন সে সেটা করতে পারবে ।কারণ হৈম জানে মন থেকে যেটা চাওয়া হয় শেষ পর্যন্ত পাওয়া যায় ।
একুশের আর বাসায় ভালো লাগছে না । সারাটা দিনে একবারও হৈমকে দেখতে পায় নি ও । আজ অনেকদিন পর হলুদ পাঞ্জাবি টা বের করে গায়ে দিল একুশ । চুল
গুলো আঁচড়াতে গিয়েও আঁচড়াল না। থাকনা এভাবেই আগোছালো। কখনও কারও সময় হলে সেই নাহয় ঠিক করে নেবে তার নিজের মত করে । আজ একুশ সারাটা রাত স্তব্ধ নগরীর সোডিয়াম বাতির নিচে পিচঢালা পথে হাঁটবে । একা একা । না খুব একটা একা নয় । নীল আকাশটা, রাতের জোছনা আর পথশিশুগুলো তো আছেই । একেবারে মন্দ কিসের।
হৈমের জ্বর বাড়ছে। তবুও বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে আছে। কখন একুশ আসবে। ছেলেটা এতো বাজে কেন । এই রাত্রিবেলা বাইরে না গেলে কি চলত না । হৈম ভাবছে ও এখন কিছু বলবে না । কিন্তু যেদিন একুশ ওর হবে সেদিন হৈমও ওকে আচ্ছা করে বকা দিবে । ওর উপর অভিমান করে গাল ফুলিয়ে বসে থাকবে । নাহ হৈম মনে হয় সেটা পারবে না । যদি পারতই তবে এখন কেন কাঁদছে ? নাহ আসলেই একুশ ছেলেটা ভীষন খারাপ। বড্ড খারাপ।
ভোরের আলো ফুটেছে কিন্তু একুশের চোখে ঘুম নেই । সারাটা রাত শুধু এপাশ ওপাশ করেই কেটে গেছে । যতবার চোখ বন্ধ করছে ততবারই পাশের ফ্ল্যাটের নিষ্পাপ মেয়েটার মুখটা ফুটে উঠেছে একুশের মনে ।
রংধনু আঁকিবুঁকি করে যায় ওর মনের এপাশ ওপাশ। মেয়েটাকে একটা লাল গোলাপ দিয়ে বলতে ইচ্ছে করে, "প্লিজ.. সারাজীবন বইয়ের পাতায় পাপড়ি করে রেখে দিও.."।
এক চিলতে বারান্দাটায় চুপিসারে দাঁড়িয়ে পাশের ফ্ল্যাটের বারান্দায় এককোণে দাঁড়িয়ে থাকা সেই মায়াবী বালিকাকে দেখতে সবচাইতে বেশি ভালো লাগে একুশের । সৌম্য শান্ত শূণ্যতার মাঝে খুব বিষন্ন হয়ে কেন জানি শুধু তাকেই ভাবতে ইচ্ছে করে।
কিন্তু ছোটবেলা থেকেই বইয়ের পোকা হওয়ায় একুশ ছিল কিছুটা নারী বিদ্বেষী ছেলে। অন্য ছেলেদের মতো বন্ধু আড্ডার প্রথম টপিক হবে "সাবালিকা" - এই ব্যাপারটা একদমই সহ্য করতে পারত না। বোধহয় নিজের পছন্দের মেয়েটাকে "পছন্দ করি" এই কথাটা বলতে মানা আছে এই টাইপের ছেলেদের। কখনোই তাই বলা হলো না কোনকিছুই।
অনেক বছর পরে।
নীরব কোন রাতে ফেসবুকে হঠাৎ একটা নাম দেখে মনের মাঝে হোঁচট খেল একুশ । এলোমেলো স্কুল জীবনে দেখা পাশের বাসার বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁডিয়ে থাকে সেই চিরচেনা বালিকার ফেসবুক আইডি না এটা??
অনবদ্য এক টেনশন টেনশন অনুভূতি নিয়ে হৈমকে ফেসবুকে মেসেজ করল একুশ । এক অজানা আতংকে ওর মন ছুঁয়ে গেল । রুদ্ধশ্বাস ৩২ মিনিট ৫৮ সেকেন্ড । একসময় অন্যপাশ থেকে রিপ্লাই ও এলো।
..
..
..
তারপর ঠিক কি যে হলো... আর মনে নাই। শুধু মনে আছে, একুশ ছেলেটা আর আগের মত নারী বিদ্বেষী নাই আর হৈমও ইদানিং একুশকে বকা দেয়, অভিমান করে গাল ফুলিয়ে বসে থাকে । তবে সব কিছুর মধ্যে লুকিয়ে আছে এক অকৃত্রিম ভালোবাসা । ও বলতে ভুলে গেছি, একুশ এবং হৈমের
রিলেশনশীপ স্ট্যাটাসটা সিঙ্গেল থেকে ইন এ রিলেশনশীপ হয়ে গেছে ।