আজকাল অনিদ্রাটা একটু বেশীই জেঁকে বসেছে আমার চোখে । এপাশ ওপাশ করতে করতেই রাতটা পার হয়ে যায় । তবে তার বিনিময়ে প্রতিনিয়ত একটা সুন্দর সকাল উপভোগ করতে পারি ।
আজ সকালটাতেও তেমনি ভাবে সূর্যোদয় হয়েছে আমার নির্ঘুম রাত কাটানোর পর.. সকালের বাইরের পরিবেশটা অদ্ভুত শান্ত। জানালার ফাঁক গলে এক টুকরা লালচে সোনালী রং ধারণ করা নীল আকাশটা উঁকি দেয়, যেন 'শুভ সকাল' জানায় আমাকে।
আগে ঘুম ভেঙেই এককাপ চা, দুটো টোস্ট বিস্কিট, পাউরুটি আর কলা খেয়ে কলেজে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতাম । এখন অবশ্য কলেজে যেতে পারি না । অনেকদিন নটরডেম ক্যাম্পাসের সবুজ ঘাস দিয়ে হাঁটি না । তাই চুপ করে বিছানায় শুয়ে থেকেই পাখিদের চঞ্চল কিচিরমিচির শুনি।
এখনো ঘুম থেকে উঠেনি কেউ। ওই তো, পাশের বিছানাতেই মা ঘুমিয়ে আছে। জানো মা, সারারাত না ঘুমিয়ে না ঘুমিয়ে তোমার চোখে কাজলকালো দাগ পড়েছে। কিছুদিন পর তো একদম ঘুমাবে না, শুধু কাঁদবে। তাই এখনি তোমার ঘুমানো উচিত। থাক, তোমায় জাগাবো না। বরং আমি আমার ভাবনার ঝুলিটা খুলে বসি।
সেই ছোট্টবেলায় বাবা মায়ের একমাত্র আদরের পুতুল ছিলাম আমি। তাই আদরের কমতি ছিলো না আমার। এখন একটা ছোট বোনও আছে। তাও আদরের কমতি নেই আমার। বাবা, মা, বোন, বন্ধু বান্ধব সবাই ভীষণ ভালোবাসে আমায়। আর আমি কী স্বার্থপরের মতো সব ভালোবাসা ছেড়ে পালিয়ে যাবার প্ল্যান করেছি!
' মা ', ও মা, যখন এটা সেটা খেতে আবদার করবো, তখন মুখে 'না' বলে, লুকিয়ে লুকিয়ে সেটা বানাবার আয়োজন করবেনা? খেতে ডাকলে একটু দেরী করলে তুমি আর কান ধরে নিয়ে গিয়ে খাবার টেবিলে বসাবে না ? যখন আমি চলে যাবো, তখন এভাবেই ভালোবাসবে তো?
একদম কাঁদবে না কিন্তু! জানো তো, কান্না সহ্য হয় না আমার।
বাবা, তুমি কিন্তু অভিনয় একদম পারো না। চোখের জলটা লুকিয়ে রাখতে প্রাণপণ চেষ্টা করো, কিন্তু চশমার ফাঁকে তোমার ছলছল করে ওঠা চোখ দুটো আমি ঠিকই দেখি। বাবা, তুমি এত্তো ভুলোমনা কেন? সেই কবে বলেছিলাম আমাকে একটা গীটার কিনে দিতে, আর এখনো আনোনি? তাড়াতাড়ি না আনলে আমার যে আর গীটার বাজানো হবে না !
ছোট্র পিচ্চি বোনটা, তোর দুষ্টুমি কবে কমবে? দুষ্টুমি করে এখনো আমার মন ভালো রাখতে চাস, তোর এই চেষ্টায় আমার সত্যি হাসি পায়। আমি চলে গেলে কার সাথে এমন করবি রে? আর কার মানিব্যাগ থেকে টাকা চুরি করবি ?? তুই টেনশন করিস না, আমি যেদিন চলে যাব সবাইকে ছেড়ে, সেদিন আমার জমানো টিউশনির টাকা গুলো মানিব্যাগে রেখে যাব.. তুই সেখান থেকে ইচ্ছেমতো নিয়ে নিস..
প্রিয় বন্ধুরা, রাফি, রিফাত, আবির, নীল, শাহরিয়ার, সাফী, অনি কেমন আছিস তোরা ?? শুনলাম তোরা নাকি আমার চিকিত্সার জন্য নাকি নটরডেম ক্যাম্পাস থেকে ফান্ড গড়ে তুলেছিস ? টিচার সুডেন্ট সবার কাছ থেকে নাকি টাকা তুলছিস ? মাঝে মাঝে নাকি ভিএনসি, হলিক্রস, আইডিয়াল এর ক্যাম্পাসে যাস ? সেইখানে কী টাকা তুলতে যাস নাকি সুন্দরী অষ্টাদশী তরুণীর দর্শন পেতে ?? তবে তোরা যাই কর না কেন, তোদের সাথে চায়ের টংয়ের আড্ডায় আর থাকব না রে.. চলে যাবার আগে একদিন অফিশিয়ালী তোদের সাথে আড়ি করে নেব.. জানিস আমি এখন ক্যান্সারের সাথে বন্ধুত্ব করে নিয়েছি..
আর টিয়া পাখি, তোমার সাথে আমার অনেক রাগ। এমন করে কেউ কাঁদে? এত্ত এত্ত ভালোবাসো কেন আমায়? তোমার দেয়া নীল শার্টটা, সাদা রিজব্যান্ড আর কালো ঘড়িটা পরতে পারিনা । হাসপাতালে আমায় সবসময় সবুজ এপ্রন পরিয়ে রাখে। তোমার এতো ভালোবাসা হৃদয়ে আর ধরে রাখতে পারবো না । হৃদয় যে ছিদ্র হয়ে গেছে!
হাসছো? হাস! তোমার হাসিটা যে আমার ভীষণ প্রিয়।
বেঁচে থাকতে খুব ইচ্ছে হয়, জানো? ইচ্ছে হয়, আবার আগের মতো সবাইকে জ্বালাতে, তোমার সাথে পার্কে বসে আড্ডা দিতে,
ফুচকা খেতে, তোমার হাত ধরে
বৃষ্টিতে ভিজতে, রাত জেগে মুঠোফোনে তোমার মিষ্টি বকা শুনতে, কিন্তু কিছুই যে আর হবার নয়।
এই নিষ্ঠুর পৃথিবীটা আমাকে মায়ের স্নেহ, বাবার ভালোবাসা, বোনের আবদার, বন্ধুদের আড্ড়া, প্রিয়তমার মিষ্টি অভিমান, খুনসুটি সব থেকে বঞ্চিত করে তাড়িয়ে দিচ্ছে অনেক অনেক দূরের এক দেশে..
বিদায় নিষ্ঠুর পৃথিবী !! বিদায় !!