আমার তুর্কি জীবনের একদম শুরুতে যাদের সাথে হায়/হ্যালো হয় তাদের মধ্যে ছিল এক ড্যাম স্মার্ট, চলনে-বলনে ‘আধুনিক’ ইরানি সুন্দরী।
পরে দেখা গেল আমরা একই বিভাগের (সাংবাদিকতা) শিক্ষার্থী। তারপর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যুক্ত হই, এখনো আছি।
ছোটবেলা থেকে যে কয়েকটা রাষ্ট্রের প্রতি আমার মমত্ববোধ, মায়া, মোহ কাজ করত তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ইরান-তুরান (তুরস্ক) ও কাতার। মুসলিম প্রধান নয় এমন দেশগুলোর মধ্যে কোরিয়া, জাপান, ব্রাজিল, জার্মানি, কানাডা প্রভৃতি। তবে ধীরে ধীরে অন্যসব মুসলিম দেশগুলোর প্রতি মোহ কমেছে বলতে হয়। এটা বোধহয় সে সব দেশ বা দেশের মানুষের সংস্পর্শ পাওয়া বা রাষ্ট্র হিসেবে তাদের অন্যায্য অবস্থানের কারণে। ব্যক্তিজীবনে কথিত ধার্মিক মুসলমান, শাসক বা ইসলামী বক্তাদের বিলাস জীবন এবেলা নিয়ামক ভূমিকা পালন করতে পারে।
একটা লম্বা সময় পর্যন্ত তুরস্ক ও ইরান নিয়ে এক ধরনের ফ্যান্টাসি ছিল। তবে ইরানের প্রতি প্রথম মোহভঙ্গ হয় সিরিয়া ইস্যুতে। একসময় ইরানের অনেক কিছুই অপছন্দ করতে শুরু করি বা করতে হয়। একজন সংবাদ কর্মী বা সাংবাদিকতার ছাত্র হিসেবে এ লেখায় আমি প্রথমত ইরান ও ইরানি মিডিয়া নিয়ে আমার পর্যবেক্ষণই তুলে ধরার চেষ্টা করব। সাথে রসদ হিসেবে থাকবে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি, হামাস, সিরিয়া যুদ্ধ, ইরানের ভূমিকা ইত্যাদি প্রসঙ্গ।
পশ্চিমা নানা অবরোধের সময় বিশ্বস্ত বন্ধুর মতো ইরানের পাশে ছিল তুরস্ক। অবরোধ মোকাবেলায় তেলের বিকিকিনি, আমেরিকার রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে তুর্কি ব্যাংকের মাধ্যমে ইরানকে লেনদেনে সাহায্য করা, তুরস্কে ইরানের সাথে বহুপক্ষের বৈঠকের আয়োজন, আমেরিকার নিষেধ না শুনে তুর্কি-ইরান সীমান্ত খোলা রাখা, এ ছাড়া বেশ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ইরানিকে তুরস্কের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়ার সুযোগ ও ইরানিদের তুরস্কে থেকে ব্যবসা পরিচালনাসহ নানা কাজের সুযোগ প্রদান। সম্মিলিত পশ্চিমা শক্তির চাপের মুখে থাকা একটি দেশের পক্ষে যতটা থাকা যায় ইরানের পাশে ততটাই ছিল তুরস্ক। এখনো দেশটি নানা ইস্যুতে ইরানের পাশে দাঁড়ায়।
তুর্কিরা বৈশ্বিক সম্পর্কের বেলায় ইসলামী ভাতৃত্বকে বেশ বড় করে দেখে। তারা বিশ্বাস করে, কখনো তুরস্ক আক্রান্ত হলে তা হবে পশ্চিমা বা খ্রিস্টান কোনো শক্তির দ্বারা আর কোনো দেশ, প্রতিষ্ঠান, বা ব্যক্তি যদি তুরস্কের পক্ষে দাঁড়ায় তা হবে মুসলিম বিশ্ব থেকে। পশ্চিমাদের সাথে সদ ভাব থাকলেও তুর্কিরা পশ্চিমাদের বিশ্বাস করে না।
তুরস্কের সব ধরনের মানুষের সাথে কথা বলে একটা বিষয় বুঝেছি। তাদের কাছে শিয়া-সুন্নী, হানাফী-লা’মাজহাবী এসব বড় কোনো বিষয় না। তারা শুধু ইসলাম বা মুসলিম শব্দটাকেই বিবেচনায় নেয়। বাকিসব পরিচয় বা ভাগকে গুরুত্বহীন মনে করে। ফলে কসোভার, বা আজারবাইজানের (শিয়া শাসক ও জনগণ) শাসকদের সাথে তুর্কিদের ভাই-ভাই সম্পর্ক বজায় রাখতে বেগ পেতে হয় না (আজারবাইজানিরা তুরস্কে থাকার, পড়ার ও কাজ করার সুযোগ পায়। হাজার হাজার বলকানও তুরস্কে থাকে।) তুর্কিরা হানাফি-শাফেয়ি বিভেদ দূরে থাক, শিয়া-সুন্নি নিয়ে কেউ কথা বলতে চাইলে তাকে নিরুৎসাহিত করে (বিশ্ববিদ্যালয় বা বিভিন্ন ইসলামী এনজিও ও তুর্কি সরকারের পদস্থ কর্মকর্তা, সাংবাদিক বিভিন্ন পেশার মানুষের সাথে কথা বলে আমার এমনটাই মনে হয়েছে।)
তুরস্কের এমন ভূমিকার জন্য ইরানি মিডিয়াগুলোত একসময় ব্যক্তি এরদোয়ান, তার দেশ ও সরকারের বেশ প্রশংসা ছাপা হতো (সম্প্রতি এরদোয়ানের প্রশংসা বা এরদোয়ান ও তুরস্ক সম্পর্কে ইতিবাচক খবর আবার ইরানি মিডিয়ায় দেখা যাচ্ছে।) কিন্তু পাশার দান উল্টে যায় সিরিয়া যুদ্ধে তুরস্কের যুক্ত হওয়ার পর।
বিভিন্ন আরব দেশ ও তাদের নেতাদের বিরুদ্ধে ইরানি মিডিয়ায় চলা অপপ্রচারে যুক্ত করা হয় তুরস্ক ও এরদোয়ানকে। ইরানি মিডিয়াগুলোর এ আচরণকে আমার কাছে মনে হয়েছে কমিউনিস্ট রাষ্ট্রসূহের সম্মিলিত প্রেপাগান্ডা কার্যক্রমের মতো। তার পক্ষে যা যায় তা অন্ধের মতো তুলে ধরা। আর বিপক্ষে গেলে যাচ্ছেতাইভাবে চরিত্রহরণ করা। ফলে আমরা দেখি একই দিনে ইরানি মিডিয়ায় তুরস্ক বা এরদোয়ান নিয়ে বিপরীতধর্মী নিউজ। যার একটাতে এরদোয়ান ভিলেন, তাকে কথিত নেতা বলা হচ্ছে আরকেটাতে নায়ক।
আমি ইরানি মিডিয়া ও বৈশ্বিক মিডিয়াকে অনুসরণ করি ও মূল্যায়ন করি সাংবাদিকতায় অক্ষর জ্ঞান সম্পন্ন হিসেবেই। ফলে তখন থেকেই ইরানি মিডিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতা আমার কাছে কমতে শুরু করে। পার্স টুডে বা প্রেস টিভি কি বলছে আমি হয়তো পড়ি, দেখি। কিন্তু সেটা কেবল পড়ার জন্য। কখনোই রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহারের জন্য না। (এই মিডিয়াগুলোর একটা প্রধান লক্ষ্যই হচ্ছে-মুসলিম আরব রাষ্ট্রসমূহকে নানাভাবে হেয়পতিপন্ন করা।)
যারা ইরানি মিডিয়াগুলোকে সচেতনভাবে অনুসরণ করে বিষয়টি তাদের চোখ এড়িয়ে যাওয়ার কথা না। আমি সবেচেয়ে বেশি আশাহত হই, ২০১৫ সালে তুর্কি-রাশিয়া বিবাদের সময়। রাশিয়ার পক্ষ নিয়ে ইরানি মিডিয়ার যে তুর্কি বিরোধী প্রচারণা চালায় তা আমাকে আহত করে। সে সময় ইরানি নেতাদের বক্তব্য ও ছিল লাগামহীন তুর্কি বিরোধী। তারা এমনভাবে এরদোয়ানকে উপস্থান করতে শুরু করে যেন সে পাড়া ছিঁচকে কানো মাস্তান, সিঁদেল চোর।
কিন্তু বিপরীতে তুর্কি নেতারা ও গণমাধ্যমগুলো দায়িত্বশীল আচরণ করেছে। তারা শত্রুতার বদলে শত্রুতাকে গ্রহণ করেনি। তুরস্কের এমন ভূমিকা আমার ভালো লেগেছে। এখনো মুসলিম বিশ্বের নানা ইস্যুতে দেশটির মধ্যমপন্থা ভালো লাগে।
কিন্তু রাষ্ট্রের পক্ষে অন্ধভাবে কাজ করতে গিয়ে বা কাজ করতে বাধ্য হয় বলে এই মিডিয়াগুলোই ইরান নামক রাষ্ট্রটিকে নৈতিকভাবে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। একটি রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি সবসময় এক থাকে না, অন্য দেশের সাথে সম্পর্কও উঠানামা করে। সিরিয়া ইস্যুতে, রাশিয়ার পক্ষ হয়ে যে ইরান একসময় তুরস্কের চরম শত্রুতা শুরু করেছিল, তারা একদিন দর্শক সারিতে বসে দেখল, তুর্কি-রাশিয়া সমঝোতা হয়ে গেছে। মাঝখান দিয়ে ইরান রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় মিডিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতা ও ভাবমূর্তি শূন্যের কোঠায় গিয়ে ঠেকেছে!
(চলবে)