অফিস থেকে বাসায় ফেরার প্রতিদিনের রাস্তাটা সেদিন অনেকটাই বেশি বড় মনে হচ্ছিল । অপেক্ষায় যেন দূরত্বকে বাড়িয়ে দিয়েছিল কয়েকগুন ।পৃথিবীর কষ্টদায়ক ব্যাপারগুলো মধ্যে 'অপেক্ষা' আমার কাছে মনে হয় অন্যতম একটি ।
অপেক্ষাটা ছিল বাসায় ফিরে বাংলাদেশ - ইংল্যান্ড ম্যাচের হাইলাইটস্ দেখা ।ম্যাচের রেজাল্ট জানার পরও এই হাইলাইটস্ না দেখা পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছিলাম না । সকালে অফিসে থাকার কারণে বাংলাদেশের ইনিংসের সময় কম্পিউটারে বল-টু- বল স্কোরবোর্ড নিয়েই থাকতে হয়েছিল । স্কোরবোর্ড দেখেই টেনশনে হাত পা হিম হয়ে গিয়েছিলো । ৮ উইকেট পরার পর বুকের ভেতর যে পাথরটা ভর করেছিল তার ওজন ওয়েষ্ট ইন্ডিজের সাথে ৫৮ রানে আউট হবার পর যে কষ্টদায়ক পাথর বসেছিল তার চেয়ে কয়েকগুন বেশি মনে হচ্ছিল । পেয়ে হারনোর কষ্ট যে না পাওয়ার চেয়ে ও অনেক বেশি । মনে হচ্ছিল নিশ্চিত একটা জয় হাত ছাড়া হয়ে গেল যেন ।তারপরের সময়গুলো ছিল একটা কঠিন পরীক্ষা ।স্কোরবোর্ড নিয়মিত আপডেট হচ্ছে .তারপর ও বার বার পেইজ রিফ্রেশ দিচ্ছি ; আবার কখনো কখনো ভয়ে স্কোরবোর্ডের দিকে তাকাচ্ছিনা । চাপ সহ্য করতে না পেরে একবার বমি ও করলাম; হাইপার টেনশন যাকে বলে ;জীবনে এরচেয়েও অনেক ক্লোজ ম্যাচ দেখেছি কিন্তু এর উপলব্ধি যেন পুরোটাই অন্যরকম ।হয়ত নিজের দেশ বলেই এই অনুভুতি । ম্যাচ শেষে কোনোমতে চোখের জল সংবরণ করলাম |এই জল আনন্দের --এই জল চরম এক প্রাপ্তির ; যেন আবারও আবিষ্কার করলাম দেশকে কতটা ভালবাসি ।
ক্রিকেট উন্মাদনা আমাদের দেশে ,আমাদের মধ্যে প্রকটভাবে ঝেঁকে ধরেছে । এই উন্মাদনা সত্যিকার অর্থে ক্রিকেট উন্মাদনা নয় ..দেশকে ভালোবাসার উন্মাদনা । ক্রিকেটের জায়গাতে হকি বা ফুটবল হলেও আমাদের অবস্থা এই রকমই হত । দেশপ্রেম প্রকাশের মাধ্যম ;যাইহোক , এই একটা জায়গাতেইআজ জাতিগত ভাবে আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ । সবাই এক সুরে কথা বলি ,একসাথে হাসি ,একসাথে কাঁদি ,একই সাথে সবাই প্রার্থণা করি । আমাদের দেশের জন্য এটা একটা বিশাল ব্যাপার যেখানে নোংরা রাজনীতিতে দেশ জিম্মি ; দেশের জন- মানুষের আশা আকাঙ্খাকে পিষে রাজনীতিবিদরা নিজেদের সার্থ সিদ্ধি নিয়ে ব্যস্ত । সেই আলোচনাতে এখন নাইবা গেলাম । যারা এমন একটা বিশাল উপলক্ষ্য জাতির জন্য তৈরী করে দিয়েছে , তাদের ব্যর্থতায় যেন আমরা হিংস্র হয়ে না উঠি । জয় পরাজয় খেলারই অংশ এটা যেন ভুলে না যাই ।ওয়েষ্ট ইন্ডিজের সাথে বাজেভাবে হারের পর সপ্তাহব্যপি যা চললো তা খুবই দুঃখজনক । কে জানে এগুলো হয়তবা ভালোবাসারই বহিঃর্প্রকাশ (যেমন সাকিবের বাড়িতে ঢিল ),কিন্তু এই ব্যাপারগুলোতে আরো বেশী সচেতন হবার প্রয়োজন আছে । সবচেয়ে অবাক করার মত যে বিষয়টি হল এরই মাঝে একটি মহল পরিকল্পিতভাবে এই সুযোগ অন্যদিকে নেবার চেষ্টা চালিয়েছে ;কেউ কেউ আবার এই নিয়ে হলুদ সাংবাদিকতায়ও নেমেছে । জাতি হিসাবে আমাদের বড় একটা সমস্যা হচ্ছে আমরা যেমন খুব দ্রুত সব বিশ্বাস করি আবার তেমনি খুব তাড়াতাড়ি সব ভুলে যাই --দুটোই খুব বিপদ্জনক |
অবশেষে বিশ্বকাপের আগামী দিনগুলিতে আমাদের দলের জন্য রইলো অনেক অনেক শুভ কামনা আর নিজ দেশের সমর্থক হিসেবে একটাই বিশেষ অনুরোধ রইলো । পরাজয়ের গ্লানিতে যেন আমরা অতীত প্রাপ্তিগুলোকে ভুলে না যাই । আমরা ধীরলয়ে হলেও এগুচ্ছি । সামনের পথ চলাকে মসৃন রাখতে হলে কিছুটা ধৈর্য্য ধরারও দরকার আছে । দল খারাপ খেললে সমর্থক হিসেবে সমালোচলনা করার অধিকার আমাদের অবশ্যই আছে ; কিন্তু সমালোচলনা যেন আমাদের গর্ব করার ভিতকেই নষ্ট করে না ফেলে সেইদিকেও খেয়াল রাখতে হবে ।।