somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ছোটগল্পঃ সন্তাপ

২৮ শে জুন, ২০১৩ বিকাল ৪:৫৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



ভালমন্দ দোষগুণ মিলিয়ে মানুষ। কোন মানুষের কাজের পরিধিতে যদি ভালর পরিমাণ বেশী ঢুকে যায়, সেই সাথে চারিত্রিক দিক দিয়ে গুণের পরিমাণ বেশী হয় তাকে ভাল মানুষ বলে আখ্যা দেয়া যায়। আমি মানুষ হিসেবে কেমনতর সেটা বিচার বিশ্লেষণের ভার আমার পারিপার্শ্বিকতার উপর। তবে যতটুকু পারি কাজে কামে আচার আচরণে সৎ থাকার চেষ্ঠা করি। তবে ইদানীং কালের একটি ঘটনার কারণে গত কিছুদিন যাবত আমি ফেরারী আসামী। পুলিশ আমার পিছে লেগেছে। ধরতে পারলে হয়ত ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিবে। কিন্তু আর কতদিন পালিয়ে থাকা যায়। স্বাধীনভাবে ঘোরাফেরার মধ্যে এক ধরনের অহমিকা কাজ করে। একদম মুক্ত বিহঙ্গের মত পাখনা মেলো যেখানে খুশী। কোথাও বদ্ধ হয়ে থাকলে একটা সংকীর্ণতা জেকে বসে। মনটা তেলাপোকার মত হয়ে যায়। হয় মৃত্যুদূত নয়ত কোন আজব দৈত্য এসে পিসে দেবে এখনি।

আমি বাইরে বেশ জাকালো স্বভাবের। বন্ধু বান্ধবদের সাথে আড্ডায় ইয়ত্তা নেই। ঘন্টার পর ঘন্টা ব্যয় হয়। তখন বেশ উৎফুল চিত্তে সময় কাটাই। এ ওর গায়ে হাসতে হাসতে ঢলে পড়ি। কেবল ঘরে ফিরলেই আমি মিইয়ে যাই। জগতের যাবতীয় জরা, ক্লিষ্ট, গ্লাণিময় বিষয় বস্তু আমার কাঁধে ভর করে। বেড়ালের মত ঘরের এক কোণায় সিধে যাই। এখন সেই ঘর ছেড়ে আর এক বদ্ধ বাড়িতে।

বাড়িটা অনেক পুরনো। যুদ্ধের সময় কোন এক হিন্দু সম্প্রদায় রেখে চলে গেছে। হয়ত প্রত্যন্ত গ্রাম বলে কেউ আর দখল করেনি। শহর বা ঢাকা শহর হলে এতদিনে হাতিয়ে নিতো ভূমিদস্যুরা। দিব্যি নিজের অথবা নিজের বাপ দাদার বলে চালিয়ে দিতো। এটা ভেঙ্গে বড় কোন অট্টালিকা তুলে কোটি টাকার পসার সাজাতো। যেখানে জীবন্ত মানুষ হটিয়ে দখল করছে বাড়িঘর সেখানে এ জায়গা জমিটা মহামূল্য বস্তু। ভূমি আগ্রাসনের মত মানুষের মনের আগ্রাসনও চলছে দিব্যি। আজকালকার প্রেমিক প্রেমিকাদের হালহকিকত দেখলেই বুঝা যায় কিরকম মহামারি চলছে এই যুগে এসে। আমি ছোট মানুষ। আমার সংসারটা আরও ছোট ছিল। মানুষটা ছোট হলেও এসব অনাচার আমার সহ্য হয় না। মাঝে মাঝে প্রতিবাদ করতে ইচ্ছে করে। আমিও তো প্রেমিক ছিলাম। আমার প্রেম করার জন্য কোন বাড়ি গাড়ী বা দামী কোন বাইকের দরকার হয়নি। আমরা বোধয় প্রকৃতিগতভাবে পরস্পর এগিয়ে এসেছিলাম। আমাদের প্রেমটা বার বছর অর্থাৎ এক যুগ দীর্ঘস্থায়ী ছিল। একটা ঝড় এসে আমাদের দুটি মন দুটি দিকে উড়ে গেছে। সেই দুর্বিপাকে পড়ে আমার বুকে যে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে সেটা কখনো সারাবার মত নয়। যাই হোক ধান ভানতে শিবের গীত বন্ধ করি। আজ আর সেই প্রেমিকার নামটাও বলতে চাই না। একটা চুম্বন। শুধুমাত্র একটা চুম্বনই আমাদের সেই অমর প্রেমের সাক্ষ্যি। এখন জীবন বাঁচানো ফরজ। অতীত এবং ভবিষ্যত নিয়ে কথা বলার সময় নেই। পুরনো প্রেমিকা দূরে যাও। কাছে আসো নিঠুর বাস্তবতা।

বাড়ীটা দোতলা। প্রায় ভগ্নস্তুপ। নিচে তিনটে ঘর আছে। একটাতে একটা চৌকি আছে। সম্ভবত এলাকার লোকজন গরমের সময় এখানে এসে বসে। পুবে-পশ্চিমে জানালা আছে, একদম উন্মুক্ত। কোন দরজা বা আড়ালের বালাই নেই। দিনে চর্তুদিক দেখা যায়। রাত হলে কিছুটা অন্ধকার গ্রাস করে। বিল্ডিং লাগোয়া বিশালাকার বাঁশঝাড়ের কারণে অন্ধকার কিছুটা বেশী হয়। মেইন রাস্তা বাড়ি থেকে প্রায় একশ কদম দূরে। তাই রাত হলে এদিকটায় কেউ আসে না। বাড়িটা নিয়ে এলাকায় অনেক কল্পকাহিনী বিদ্যমান। কলেজ বন্ধু রাশেদের হাত ধরে এই বাড়ির খোঁজ পাই। সেই মূলত সাহায্য করেছে এই বাড়িতে থাকার জন্য। দিনের বেলা অন্য কোথাও ঘুরে বেরালেও রাতের বেলা চৌকিটাতে গা এলিয়ে শুয়ে থাকি। ঘুমতো আসেই না। উল্টো রাজ্যের সব চিন্তা আমার কাঁধে ভর করে। বাড়ির উত্তর দিকের যে ঘরটা আছে তার প্রাচীর ঘেঁষে একটা বটগাছ। মূলত এই বটগাছটাকে নিয়েই যতসব কল্পকাহিনীর ডালপালা প্রসারিত। গ্রামের ছেলে তাই এসব কল্পকাহিনীকে তেমন একটা পাত্তা দেইনি।

আজকে আমার পালানোর সপ্তম দিন। এই সাতটা দিন জীবনের সবচেয়ে নিঠুরতম দিন। ছিলাম উন্মুক্ত আকাশের বিহঙ্গ। এখন খাঁচায় বন্দী ঘুঘু। ভাল লাগছে না আর এই অস্থিরতা। একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে শুয়ে পড়েছিলাম। ঘুম আসছে না। মোমবাতি প্রায় শেষের দিকে। শেষের কয়েক দিন রাশেদের কাছে ছিলাম। রাশেদও মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে। তাই বললাম, দোস্ত আমাকে কোন পরিত্যক্ত জায়গায় রেখে আয়। যেখানে রাতের বেলা কেউ যায় না। সে প্রথমে রাজী না হলেও। পড়ে আমতা আমতা করে রাজী হয়। সেদিন দিনের বেলা জায়গাটা দেখে গিয়েছি। সন্ধ্যার পর এখানে এসেছি। রাশেদ চলে যাওয়ার আগে জায়গাটার অলৌকিক কান্ডকীর্তি সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়ে গেছে। সেটাই এখন মাথার মধ্যে ঘুরঘুর করছে। ঘুম কিছুতেই আসছে না।

একটু পর কি মনে করে দোতলার ছাদে উঠে এলাম। বটগাছটা ঝুকে আছে ছাদের বুকে। পূর্বতন গল্পগুলো এলোমেলো করে দেয় শরীর মন। তারপরও সাহস করে সামনে অগ্রসর হই। দুটো চেয়ার মুখোমুখি করে বসানো। আজ দিনের বেলা একবার এদিকে এসেছিলাম। তখন চেয়ার দুটি দেখিনি। ভয়ের রেশ আরও বেড়ে গেল। প্রতিটি রোমকূপ জানান দিচ্ছে ভৌতিক বার্তা। আর একটু অগ্রসর হয়ে সাহস করে একটা চেয়ারে বসে পড়লাম। বসার পর কিছুটা স্বস্তি ফিরে পেলাম যেন। এখন সেই আগের ভৌতিক অনুভূতি আমার মধ্যে নেই।

মাঝে মাঝে ডায়েরীতে লেখার অভ্যেস ছিল। এখন ডায়েরী নেই। মুঠোফোনে লিখতে ইচ্ছে করছে:

মুখোমুখি দুটি চেয়ার। আবছা অন্ধকার। সন্ধ্যার পর লালচে চাঁদ পাঠে বসেছে। একটু একটু করে জোছনা প্রসারিত হচ্ছে। এই মূহুর্তে চেয়ারে একজন বসে থাকার কথা। সে আজ আসেনি। অনতিদূরে ছাদের দেয়াল ঘেঁষে একটা বটগাছ। কয়েকটা বাদুর বটফল খেতে ব্যস্ত। চাঁদটা এতক্ষণে সান্ধ্যকালীন তপস্যা শেষে চলা শুরু করেছে। হঠাৎ একটা কালো মেঘের সাথে দেখা। তাই চুপসে গিয়ে সংকীর্ণ পথে পৃথিবীর দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে। এখন মৃদু আলোটা ঝাপসা হয়ে গেছে। একটা ঝাপসা অবয়ব চোখের সীমানার কিছুটা বাইরে দোদুল্যমান।
এ পর্যন্ত লিখেছি...
এই সময় চারিদিক কাঁপিয়ে একটা হাসির রোল পড়ে গেল। এরকম হাসি জীবনে কখনো শুনিনি। হাসিটা ফুরিয়ে যেতে যেতে বিভিন্ন জায়গায় প্রতিধ্বনি সৃষ্টি করলো। সেটা শেষ হলো আমার কাঁধের কাছে এসে।
'তুমি ভালই লিখতে পারো' এই বলে মেয়েলী কন্ঠটা আমার দু'কানে ফিসফিস করতে থাকে।
'কি লিখতে পারোনা?' তার কন্ঠে ধমকের সুর।
হ্যা লিখতে পারি। তবে বহুদিন হয় লিখি না। আমার ডায়েরী অযত্নে পড়ে আছে।
সেটা তোমার ভুল। কন্ঠটা আরও বাজখাই হয়ে কানে বাজে।
আমি! আমি!
'হ্যা তোমার ভুল। তুমি ভাল মানুষ সেটা যেমন তোমার গুণ। তেমনি তুমি অনেক দিন পালিয়ে বেড়াচ্ছো সেটা তোমার ভুলেই।' কন্ঠটা আস্তে আস্তে মোলায়েমের দিকে যায়।

এতক্ষণে নিজেকে সম্বরণ করি। কেন জানি মনে হয় এই মূহুর্তে তার সাথে খোলামেলা আলাপ করা জরুরী। সে আমার সম্পর্কে অনেক কিছু জেনে গেছে। তার সাথে বিস্তারিত আলাপ করলে বাকীটা খোলাসা হয়ে যাবে। তারপর সে আমার ঘাড় মটকাক। মরার আগে অন্তত আমার ভুলভ্রান্তিটুকু জেনে যাবো।

আচ্ছা তোমার সম্পর্কে যে সব কল্পকথা শুনি সেটা কি সত্যি? কিছুটা ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
কিরকম কল্পকথা। একটু আইডিয়া দাও তো।
এই যেমন এই এলাকায় তোমাকে নিয়ে একটা গল্প প্রচলিত আছে।
না তো আমি সেই গল্পটা সম্পর্কে জানি না! তার চোখে মুখে বিস্ময়।
কিন্তু তুমি আমার সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য জেনে গেছো। সেটা কেমন করে সম্ভব হলো?
'আমার জানার পরিধি খুব সীমিত। যারা এই বটগাছ থেকে একশ কদমের মধ্যে থাকে কেবল তাদের সম্পর্কে ইচ্ছে করলে আমি জানতে পারি। তুমি তাড়াতাড়ি আমার গল্পটা বলো।'

সে তার সম্পর্কে গল্প শোনার জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। বিনিময়ে যদি আমার এই ছুটে চলার অবসান হয় তো মন্দ কি। আর জীবন যদি এখানেই যায় তো প্রকৃত সত্যটা উৎঘাটন হয়ে তারপর না হয় যাক।

আমি শুরু করলাম...
এই এলাকায় একটা গল্প প্রচলিত আছে। এই মনসাপুর গ্রামে নাকি এক সুন্দরী মহিলা ছিল। সে পেশায় শিক্ষকতা করতো। শিক্ষকতা করলেও সে এলাকায় বিভিন্ন বেহায়াপনা কাজ করে বেড়াতো। সে বিবাহিত হলেও তার সাথে স্কুলের সব পুরুষ শিক্ষকের অনৈতিক সম্পর্ক ছিল। সেই সাথে গ্রামের সব শিক্ষিত যুবক সম্প্রদায়ের সাথে ফষ্টিনষ্টি করে বেড়াতো।

এই পর্যন্ত বলার পর একটা বড় দীর্ঘশ্বাস নিলাম। সে দেখি চুপচাপ অধীর আগ্রহে বাকীটা শোনার জন্য অপর পাশের চেয়ারে বসে আছে। তার চেহারায় অদ্ভূত লাবণ্য ফুটে উঠেছে। আমার দেখা যেকোন সুন্দরীকে সৌন্দর্যগুণে এক নিমিষেই হারাতে পারবে। গল্পটা এ পর্যন্ত শুনে তার চোখ উদগ্রীব হয়ে আছে। আমি আমতা আমতা করলেও তার চোখের ইশারায় বাকীটুকু বলতে বাধ্য হলাম।

একবার কয়েক যুবক অতি উত্তেজিত হয়ে পড়লে ঐ শিক্ষিকাকে পাটখেতে নিয়ে গিয়ে গণধর্ষণ করে। পরের দিন ঐ মহিলাকে পাটখেতের পাশে একটা বটগাছে ঝুলে মরতে দেখা যায়। এরপর ঐ মহিলা ভূত হয়ে গ্রামের যত যুবক আছে তাদের ঘাড় মটকানো শুরু করে।

এই পর্যন্ত শোনার পর সে উদভ্রান্ত হয়ে পড়ে। আরও কিছুটা উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চায়, আচ্ছা তারপর সেই মহিলার স্বামী সম্পর্কে কিছু জাননা।

তেমন কিছু জানি না। শুধু শুনেছি সেই লোক এখানকার এক কলেজে শিক্ষক ছিল। এই ঘটনার পর পাগল হয়ে এলাকা ছেড়ে চলে গেছে।

'হুম সেটা বিশ বছর আগের ঘটনা।' এই বলে সে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। সেই দীর্ঘশ্বাসে যেন চারিদিক শীতল হয়ে যায়। বলা শুরু করে, মানুষের ইতিহাস সব সময় সঠিকভাবে লিপিবদ্ধ হয় না। ইতিহাসের মধ্যে বিরাট কোন ভুল মানুষ সচেতনভাবে বা কখনো সখনো অবচেতন মনে ঢুকিয়ে ফেলে। আমি এখন সেই পার্থিবতার উর্ধ্বে। তাই ওসব লোকগল্প আমাকে সেরকম ব্যথিত করবে না। তবু এখনকার এই প্রজন্ম যাতে মিথ্যের মধ্যে না থাকে সেজন্য তোমাকে ছোট্ট একটা কাজ করতে হবে। বলো সেটা পারবে?।'
আমি আমতা আমতা করতে করতে বললাম, পারবো।
শোনো তোমার মধ্যে অনেকটা দ্বিধা কাজ করছে। সেই সাথে তোমার মন সন্দেহপ্রবণ। তুমি পারবে কিনা আমি চিন্তিত।
তার এই অকাট সত্যের কাছে আমি লজ্জিত হয়ে পড়লাম।
সে বলা শুরু করলো, লোকজন যে ধরণের ঘৃণা নিয়ে আমার গল্প বলে তাতে করে আমার নামটাও তারা মনে রাখেনি। মনে রাখার প্রয়োজনও বোধ করেনি।
এতক্ষণে মনে পড়লো সেই সত্যটা। আমি সেই নামটাও শুনিনি। এমনকি সেই ঘর পালানো পাগল স্বামীটিরও না।
তুমি বলো দেখি আমি কিছু করতে পারি কিনা।
সে বললো তুমি পারবে। তোমার বন্ধু রাশেদ এই এলাকার কৃতি সন্তান। সে ইচ্ছে করলে তার সাথে যুক্ত হয়ে সহজেই পারবে। আমার কাঁধে তার শীতল হাত রেখে অভয় দান করলো।
তাহলে বলো আমাকে কি করতে হবে।
আমার জীবনের গল্পটা বলি...
"আমি ছিলাম এই গ্রামের সোবহান মাস্টারের মেয়ে। আমার বাবা মনসাপুর স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। তিনি ছাত্র-ছাত্রীদের অংক পড়াতেন। গ্রামের কৃতি শিক্ষক ছিলেন। এই গ্রাম এবং এর আশেপাশের যত গ্রাম আছে সোবহান মাস্টার বলতে পাগল ছিল। মা আমার শৈশবেই মারা গেছেন। মা মারা যাওয়ার পর বাবা আমাকে নিয়ে দুর্বিপাকে পড়েন। সকালে উঠে তার পাশে বসে পড়াশুনা করতাম। স্কুলে যাওয়ার সময় এক সাথে স্কুলে যেতাম। মোটামুটি তিনি কোলেপীঠে করে আমাকে মানুষ করেন। স্কুলের পাঠ চুকিয়ে আমি কলেজে ভর্তি হই। ততদিনে কিছুটা বড় হয়ে যাই। তাই বাবা আমাকে একাই ছেড়ে দেন। আমি সাংসারিক টুকিটাকি কাজ সারি। সময়মত কলেজে যাতায়াত করি। গ্রামের চেয়ারম্যানের ছেলে আজগর। আন্ডারমেট্রিক। কয়েকবার চেষ্ঠা করেও মেট্রিক পাশ করতে পারেনি। সে আমার পিছে লাগে। তার নারী লিপ্সার কারণে গ্রামে ইতোমধ্যে অনেক মেয়ে পড়াশুনা বাদ দিয়ে বাড়িতে বসে আছে। আমি আমার মত করে বুক ফুলিয়ে কলেজ যেতাম। আসতাম। সে তার সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে আমার পিছু অনুসরণ করতো। একদিন সরাসরি প্রেমের প্রস্তাব দেয়। আমি অমত করি। এরপর আর তাকে কখনো আমার পিছে দেখা যায় নি।

আমি উৎকীর্ণ হয়ে তার কথা শুনতে থাকি। এই পর্যায়ে সে লম্বা একটা শ্বাস নেয়।

আমার নামটা বলা হয়নি। সালেহা নামে সবাই চিনতো। বাড়িতে বাবা মণি বলে ডাকতো। কখনো চোখের মণি বলে কখনো নয়নের মণি বলে ডাকতো। কলেজ ছেড়ে একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। বাবার এবং আমার পছন্দের বিষয় গণিত নিয়ে। বেশ সাফল্যের সাথে পড়াশুনা শেষ হলো। আমি বাইরে চাকরীর জন্য চেষ্ঠা করতে থাকলাম। বাবা বললো মণি সবাই তো পড়াশুনা করে গ্রাম ছেড়ে চলে যায়। তুইও কি আর সবার মত চলে যাবি। আমার শরীরটাও ভাল না। তোর বিয়ে দেয়া দরকার। জিজ্ঞেস করলেন, তোর পছন্দের কোন পাত্র থাকলে বল। আমি নত মুখে জানালাম কোন পছন্দের পাত্র নেই। তিনি বললেন, হরিহরপুর কলেজে নতুন এক শিক্ষক এসেছে জাহেদ নামের। ছেলেটা সুদর্শন আর ভদ্র। তুই কি চিনিস? এলাকার কলেজ। তাছাড়া বাড়ির কাছেই। তাই এখানকার শিক্ষদের নারী নক্ষত্র সব জানা হয়ে যায়। আমি হ্যা সূচক মাথা দোলাই। -আমি যদি তার সাথে বিয়ের বন্দোবস্ত করি তুই কি তাতে রাজী থাকবি?
সারাজীবন বাবার বাধ্যগত মেয়ে হয়ে ছিলাম। আর সম্পর্কটা মন্দ নয়। তাই রাজী হয়ে গেলাম। আমাদের বিয়ে হয়ে গেল। আমাদের সংসারটা সুন্দরভাবে চলছিল। জাহেদের শিক্ষকতা এবং আমার শিক্ষকতায় এলাকায় যাতে জ্ঞানের আলো বিকশিত হয় এজন্য আমরা যথেষ্ঠ মনোযোগ দিয়ে শিক্ষকতা করছিলাম। আমার বিয়ের দু'মাসের মাথায় বাবা হঠাৎ করে ওপাড়ে চলে যায়। বাবা চলে যাওয়ার পর আমি অভিভাবকশূন্য হয়ে পড়ি। হাজার হোক বাবার মত নামী শিক্ষকের ভয়ে বা সম্মানে সুন্দরী হওয়ার পরও এলাকার ছেলেপেলে চোখ তুলে চাওয়ার সাহস পেত না।

বিয়ের পর জানতে পারি বিয়ের আগে চেয়ারম্যানের ছেলে বাবাকে প্রস্তাব দিয়েছিল। বাবা সে কথা আমাকে বলেননি। বাবার সুহৃদ আর এক শিক্ষক মালেক চাচার কাছে এ কথা জানতে পারি। বাবা মারা যাওয়ার পর কলেজে যাতায়াতের সময় আজগরের উৎপাত বেড়ে যায়। মাঝে মাঝে অতিষ্ঠ হয়ে উঠি। এরকম একদিন পায়ের স্যান্ডেল খুলে তার দু'গালে দু'ঘা মেরে দেই। সে লাজ শরমের ভয়ে তখন আর কিছু বলেনি। গালে হাত দিয়ে হনহন করে হেঁটে যায়।

এর সপ্তাহখানেক পরের ঘটনা। আমি তখন পাঁচ মাসের অন্ত:সত্তা। এক মধ্যরাতে চোখে মুখে মুখোশ দিয়ে ঢেকে আজগর তার সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে হাজির হয়। জাহেদের মুখে ত্যানা প্যাঁচিয়ে ঘরের খাটের সাথে বেঁধে রাখে। আমাকে নিয়ে আসে বাড়ি থেকে বেশ কিছু দূরে। পাশের ঐ খেতটায়। ওটাতে তখন বড় পাটগাছ ছিল।" এই বলে সে থেমে যায়।

এরপর আর তার মুখে কোন শব্দ নেই। তার শীতল দীর্ঘশ্বাসে আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠলো। তার ধারে কাছে বসে থাকা আমার জন্য দায় হয়ে যায়।

আমার দু'চোখের কোণা বেয়ে অনবরত অশ্রু ঝরে। এখন কি করা উচিত আমি জানি না। তাকে কি সান্তনা দেয়া যায়। কিংবা তার কাঁধে হাত রেখে অভয় দান। এসব করে আর কি হবে। সেতো এসব কিছুর উর্ধ্বে।
এক সময় নীরবতা ভঙ্গ করার জন্য বলি। তারপর...
তারপর আর কিছু শুনতে চাও!
আমি মনে মনে আজগরের প্রতি বজ্রমুষ্ঠি তুলি। বলি না থাক আর বলতে হবে।
তুমি এখানে না আসলে তো আমার সম্পর্কে নেগেটিভ আলোচনার কথা জানাও হতো না। তাই আমি আমার জীবনের করুণ সত্য গল্পটা বললাম। তুমি তোমার মত করে সবাইকে জানাইও।

তার এই জীবন কাহিনীর ভারে আমার কোন কথাই আর মনে আসে না। আমি যে পুলিশের খাতায় দাগী আসামী। পুলিশকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছি...

আমার ভাবনা তার কন্ঠস্বরে থেমে যায়। সে বলতে থাকে। 'শোনো তুমি যে সমস্যায় পড়েছো এটা তোমার নিজেরই সৃষ্টি। তোমার সন্দেহবাতিকগ্রস্থ মন। তার কথা শুনে আমার মাথা আবারও নত হয়ে যায়। বলে,'তুমি তোমার স্ত্রী'র সাথে যে কাজটা করেছো সেটা তোমার খেয়ালী মনের উদ্ভট ভাবনা। তোমার স্ত্রীর বুকের বামপাশে একটা নখের আঁচড় দেখে মনোকষ্টে ভুগছো। বিয়ের প্রথম রাত থেকে সেই আঁচরটা যেন তোমার মনে গেঁথে আছে।
সে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়, ঠিক না?
আমি হ্যা সূচক মাথা নাড়ি।
এই মনোকষ্ট তোমার কোন দিন দূর হবে না। যতদিন পর্যন্ত না তুমি উদার মনের অধিকারী হও।
শোনো তোমার বউ ছোটকালে খুব দূরন্ত ছিল। নিজের বাড়ির সব আম জাম চুরি করে বান্ধবীদের সাথে ভাগ বাটোয়ারা করে খেত। একবার সব বান্ধবীরা মিলে পাশের বাড়ির জাম্বুরা চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে যায়। তাড়াহুড়ো করে নামতে গিয়ে জাম্বুরা গাছের একটা কাঁটা তার বুকের বামপাশে বিঁধে। এতে করে জায়গাটা ছিলে যায়। সে বাবা-মার ভয়ে বাড়িতে আর সেকথা বলেনি। এক সময় সেই ক্ষতের দাগটা স্থায়ী হয়ে যায়। আর তুমি কিনা!
আমি বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে যাই।
আর শোনো তোমার বউ আত্মহত্যা করেনি। তোমার পিছে কোন পুলিশও ঘুরছে না। গত কিছুদিনের টানা ঘুমের ঔষধের ফল এটা। তোমার বউ এখন তার প্রিয় বান্ধবী শারমিনের বাড়িতে আছে। এখান থেকে নামার আগে সামনে একটা বাগান দেখতে পাবে। ঐ বাগানের গেটে একটা শিশু বসে আছে।
আমি অভিসন্ধিৎসু মনে জিজ্ঞেস করি, শিশুটা কি তোমার?
সে মাথা নাড়ে। ওর নাম আখলাক। নামার আগে ওর কাছ থেকে একগোছা রজনীগন্ধা নিবে। সেটা নিয়ে তোমার বউয়ের কাছে যাবে।

সামনে এগিয়ে গেলে শিশুটির দেখা পাই। একদম দেবশিশুর মত দেখতে। সে হাসিমুখে আমার দিকে রজনীগন্ধার ডাটা এগিয়ে দেয়। আমি তার মাথায় হাত বুলাতে গেলে তার হাসি আরও বেড়ে যায়। এরপর সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে না নামতেই দেখি সকাল হয়ে গেছে। তখন চারিদিক উজ্জ্বল করে একটা লাল সূর্য পশ্চিমাকাশে উঠছে।


ছবিঃ নিজস্ব এ্যালবাম।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে জানুয়ারি, ২০১৫ সকাল ১১:৩৪
২৭টি মন্তব্য ২৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ব্লগে বিরোধী মতের কাউকে নীতি মালায় নিলে কি সত্যি আনন্দ পাওয়া যায়।

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৮

ব্লগ এমন এক স্থান, যেখানে মতের অমিলের কারণে, চকলেটের কারণে, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে অনেক তর্কাতর্কি বিতর্ক কাটা কাটি মারামারি মন্তব্যে প্রতিমন্তব্যে আঘাত এগুলো যেনো নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। ব্লগটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

সিকান্দার রাজার চেয়ে একজন পতিতাও ভালো।

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ৮:০৭

সিকান্দার রাজা কোকের বোতল সামনে থেকে সরিয়ে রাতারাতি হিরো বনে গেছেন! কিন্তু তাকে যারা হিরো বানিয়েছেন, তারা কেউ দেখছেন না তিনি কত বড় নেমকহারামি করেছেন। তারা নিজেদেরকে ধার্মিক বলে দাবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগার'স ইন্টারভিউঃ আজকের অতিথি ব্লগার শায়মা

লিখেছেন অপু তানভীর, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১১:০৫



সামুতে ব্লগারদের ইন্টারভিউ নেওয়াটা নতুন না । অনেক ব্লগারই সিরিজ আকারে এই ধরণের পোস্ট করেছেন । যদিও সেগুলো বেশ আগের ঘটনা । ইন্টারভিউ মূলক পোস্ট অনেক দিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

...এবং উচ্চতায় তুমি কখনই পর্বত প্রমাণ হতে পারবে না

লিখেছেন নতুন নকিব, ০৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৫৬

...এবং উচ্চতায় তুমি কখনই পর্বত প্রমাণ হতে পারবে না

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ অন্তর্জাল।

ছোটবেলায় মুরব্বিদের মুখে শোনা গুরুত্বপূর্ণ অনেক ছড়া কবিতার মত নিচের এই লাইন দুইটাকে আজও অনেক প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪১


প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×