পালা শুরুর আগেই মঞ্চের পেছনের দিকে কাপড়ের ঘের দেওয়া সাজঘরে বসে মহিষাসুরবধ পালা পরিবেশনের জন্যে নেত্রকোণার দুর্গাপুর-বগাউড়া থেকে আগত রাধাকৃষ্ণ সম্প্রদায়ের হাজং শিল্পীরা একে একে যার যার চরিত্রানুযায়ী সাজ গ্রহণ করতে থাকেন। আমি তাদের সাজ গ্রহনের মাঝে তাদের পাশে দাঁড়িয়ে ও বসে দেখতে থাকি এক একজন দিনমজুর সামান্য সাজে কেমন করে হয়ে ওঠেন অসামান্য দেব-দেবী। দেখি সাজ গ্রহনে পুরুষ দিনমজুর দ্রোণদেব হাজং (৪৪)-এর দেবী কালী হয়ে ওঠা, চায়ের দোকানদার বিনয় হাজং (৩৭)-এর দুর্গা বা মহামায়া হয়ে ওঠা। এছাড়া, আরো দেখি রাজমিস্ত্রি সুবল হাজং (৪৫) হয়ে উঠলেন নিশুম্ভ, হৃদয় হাজং (১২) ডাকিনী, জয়ন্ত হাজং (১১) যোগিনী, বায়ু হাজং (২২) চণ্ডা, চেঙ্গিস হাজং (৩২) মহিষাসুর, সাধন হাজং (২৫) মণ্ডা, নারায়ণ হাজং (১৮) কুড়াল, রুবেল হাজং (১৯) লক্ষ্মী, সুধানন্দ হাজং (১৭) সরস্বতি, বাপ্পী হাজং (১০) কার্তিক, হেমল (১২) গণেশ, রপেন্দ্র হাজং (২০) শিব, বিচিত্র হাজং (৩৬) দুর্গাসুর, শলিল হাজং (২৭) ইন্দ্ররাজ প্রভৃতি।
মহিষাসুরবধ পালার শুরুতেই থাকে বন্দনাগীত। মঞ্চের উত্তর-পশ্চিম ভাগে বসা বাদ্যযন্ত্রী ও সঙ্গীতশিল্পী দল বাদ্যের তালে তালে বন্দনাগীত শুরু করে- “নমঃ নমঃ নারায়ণী জগত তারিণী/দুর্গাসুর বিনাশিনী দুর্গতী হারিণী ॥/সর্বলোক নিস্তারিণী পতিত উদ্ধারিণী/কালী তারা তাপহারা সন্তোষ কারিণী ॥/কালী তারা মহাবিদ্যা রাজা রাজ্যশ্বরী/শ্রীমতী ভুবনশ্বরী ভৈরব শঙ্করী ॥চন্দ্র রূপ রগণ রকতারিণী/অতি চণ্ডী রা কর অশুভ হারিণী ॥” এই বন্দনাগীতের মধ্যে একে একে সকল কুশীলব চরিত্রানুযায়ী বিভিন্ন অভিনয় উপকরণ ঢাল, তরবারী, ত্রিশূল, তীর-ধনুক, মুখোশ সহযোগে নৃত্যের তালে তালে মঞ্চে এসে নৃত্য পরিবেশন করেন এবং বন্দনাগীত সমাপ্ত হলে তারা মঞ্চ থেকে প্রস্থান করেন।
মূল নাট্যপালার শুরুতেই এক হাতে তরবারি আর অন্য হাতে ফলা অস্ত্র নিয়ে নৃত্যের তালে তালে মহামায়া বা দুর্গা মঞ্চে প্রবেশ করেন। একই সঙ্গে তাকে অনুসরণ করে ঢাল-তরবারি হাতে একজন কুশীলব অসুর রূপে নৃত্য যোগে মঞ্চে আগমন করেন। এক সময় তিনি তাঁর নৃত্যের মধ্যে নানা রকম অঙ্গ ভঙ্গি করে অট্টহাসিতে ফেটে পড়েন এবং বলেন-
অসুর : হু হা হা হা। কে? কে তুমি নারী? আমায় সত্য পরিচয় দাও।
মহামায়া : সমরের প্রাঙ্গণে দেবতার আলয়ে কেন তুমি আসিলে হেথায়?
অসুর : এই তো আমি অসুর। তুমি আমাকে সত্য পরিচয় দেবে, না হলে তোমাকে আমি করতে পারি জানো?
মহামায়া : হ্যাঁ জানি। তোমার মতো তোমার মত কত সহস্র অসুর আমার পায়ের তলায় রেখে দিয়েছি। সেই পাপিষ্ট অসুর আমার পরিচয় জানতে চায়ছো! জানো, আমি মহামায়া।
অসুর : মহামায়া! আজ তুমি কী চাও।
মহামায়া : চাই শুধু রাজ্য।
অসুর : রাজ্য! হু হা হা হা। তবে আয়- আয়রে মৃত্যুকামিনী নারী, তোকে রাজ্যের সাধ মিটিয়ে দেই ॥
বেজে ওঠে যুদ্ধের দামামা। আর অসুর সেই বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে মহামায়ার সঙ্গে যুদ্ধ করতে থাকেন। বেশ কিছুণ ধরে যুদ্ধ চলার পর মহামায়ার কাছে অসুর পরাস্ত হয়। কিন্তু পরণেই আবার অসুর যুদ্ধে মেতে ওঠেন। এ পর্যায়ে মহামায়া প্রায় পরাস্ত হয়ে যান এবং বলেন-
মহামায়া : ওরে পাপিষ্ট অসুর আমি যে আর পারছি না।
অসুর : পাপীয়সী নারী- তুমি এখনই আমার দুটি পাও ধরো। আর রাজ্যের ইচ্ছা পরিত্যাগ করো।
মহামায়া : না না না।
আবার যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে। মহামায়া পূর্ণ শক্তিতে অসুরের সাথে যুদ্ধে মেতে ওঠেন। এবারের যুদ্ধে অসুর পরাস্ত হয়ে বলেন-
অসুর : জগৎতারিনী মা, আমায় মা করো। আমি জেনে বুঝে করেছি অপরাধ। আমায় তুমি মা করো।
যুদ্ধে পরাস্ত হয়ে অসুর এভাবে মহামায়ার পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়তেই মঞ্চে নতুন করে আরেক অসুরের আবির্ভাব ঘটে। তিনি হাতের এক হাতের তরবারি দিয়ে অন্য হাতের ঢালে আঘাত করে শব্দ করে নৃত্য যোগে মঞ্চে এসে বলেন-
মহিষাসুর : হা হা হা।
মহামায়া : তুমি আবার কেন এলে মহিষাসুর! আর কোনো মহাপাপ করো না তুমি।
মহিষাসুর : বড় দুষ্ট নারী তুমি, লজ্জা নাহি তোর মুখে। পুরুষের সাথে রণ কর মন সুখে। ধিক ধিক নারী জাতি, নাহি গুরু জ্ঞান। ত্যাজ্য পথে আসিয়াছ হারাইতে প্রাণ। নারী জাতি বলে মা করেছি এতোণ। কিন্তু এখনি হইবে তোর সম্মুখে মরণ।
মহামায়া : তবে আয়- আয়রে মোরই গর্বে গর্বিত দানব। তোরে মেরে ঘোচাইব দেবেরই ভয় সব। নারীর অপার মায়া দৈত্য কেমনে জানিবে। ষোলকলা পাপ তোর হইলো পূরণ। অনিবার্য হলো তোর নিকটে মরণ ॥
যুদ্ধ শুরু হয় বাদ্যের তালে তালে। মহামায়া আর মহিষাসুরের সেই যুদ্ধের মধ্যে একসময় একে একে দুর্গা-কার্তিক-গণেশ-লক্ষ্মী-সরস্বতী মঞ্চে প্রবেশ করে। বাদ্যের তালে তালে তাদের প্রত্যেকের সাথেই মহিষাসুরের যুদ্ধ হয়। সে যুদ্ধে মহিষাসুর পরাস্ত হয়। আর তখনই সকল দেব-দেবী পরিবেষ্টিত আসনে মহামায়া বা দুর্গার অধিষ্ঠান ঘটে। এ সময় সঙ্গীতশিল্পীগণ গেয়ে ওঠেন-
ভালো ভালো সকল দেবতা পরাস্ত হয়ে গেল।
আর নাহি কো দেরী জানাই পূর্ণ সালাম ॥
মন্দিরে দুর্গা পুজার অধিষ্ঠানের মতো মঞ্চে দুর্গার অধিষ্ঠান ঘটে। এ সময় পেছন দিকে একটি চিত্রিত কাপড়ের প্রোপট তুলে ধরা হয় এবং দুর্গা বন্দনার গান গীত হয়- ‘জগৎতারিণী...॥’ ধুপ-ধোঁয়া সহযোগে দুর্গার অধিষ্ঠানে পূজা প্রদান করা হয়। এভাবেই প্রথম পর্বের সমাপ্তি হয়। একই ভাবে দ্বিতীয় পর্বের সূচনা এবং সমাপ্তি হয়। তবে, দ্বিতীয় পর্বে মহামায়া বা দুর্গা রূপের পরিবর্তে কালী রূপে আবির্ভূতা হয়ে থাকেন।
এমন একটি নাট্যপালা শেষে কুশীলবদের সাথে আলাপে জানতে বাংলাদেশের হাজংরা আসলে এ ধরনের একটি কৃত্যমূলক নাট্যপালার মাধ্যমে পৃথিবীতে সত্য-সুন্দরের বিজয় গাঁথা রচনা করেন।
আলোকচিত্র : সাহাদাত পারভেজ
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই মে, ২০০৮ রাত ১১:৩৭