somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাংলাদেশের হাজংদের ঐতিহ্যবাহী নাট্যধারা মহিষাসুরবধ

০৫ ই মে, ২০০৮ রাত ১১:০৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আনুমানিক দ্বাদশ শতাব্দী থেকে বাংলাদেশের বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার নেত্রকোণা, সুসংদুর্গাপুর, ধোবাউরা, কলমাকান্দা, হালুয়াঘাট, নালিতাবাড়ী এবং বৃহত্তর সিলেট জেলার সুনামগঞ্জে হাজং জনগোষ্ঠী বসবাস করে আসছে। এদেশে বসবাসরত অন্যান্য জনগোষ্ঠীর মত হাজংরা নিজেদের বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসব, কৃত্যাচার ও ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে বিভিন্ন ধরনের গীতি, নৃত্য, বাদ্য এবং নাট্যপালা পরিবেশন করে থাকে। প্রতি বছর বাংলা আশ্বিন-কার্তিক মাসে চরমাগা বা নবান্ন উৎসবে এদেশের হাজংরা শ্যামাপূজার আয়োজন করে। এ সময় হাজং যুবকরা একটানা সাতদিন ধরে গ্রামের বিভিন্ন বাড়ি ঘুরে মুখোশ নৃত্যসহ দেবতার বন্দনামূলক গীত পরিবেশন করে থাকে। শুধু তাই নয়, হাজং জনগোষ্ঠীর কিছু গীতিনৃত্যের দল এ ধরনের চরমাগা বা নবান্ন উৎসবে একবাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে পরিভ্রমণের কালে ধর্মীয় আখ্যানমূলক/কাহিনীভিত্তিক নৃত্যগীত বা নাট্যপালা পরিবেশন করে থাকে। এেেত্র বাংলাদেশের হাজং সমাজে মহিষাসুরবধ ও দেবাসুরবধ নাট্যপালার জনপ্রিয়তায় অধিক। স্থানীয় পর্যায়ে জনপ্রিয় এই দুটি ঐতিহ্যবাহী হাজং নাট্যপালা সম্প্রতি বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পরিবেশন করে আসছে নেত্রকোণা জেলার রাসমনি হাজং সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর নেত্রীত্বে দুর্গাপুর-বগাউড়ার রাধাকৃষ্ণ সম্প্রদায় এবং লাঙ্গলজোড়া হাজং সাংস্কৃতিক দল। এ বছর ঢাকার সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানট আয়োজিত দেশ ঘরের গানের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিল বগাউড়ার রাধাকৃষ্ণ সম্প্রদায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের লিচু তলায় রাধাকৃষ্ণ সম্প্রদায়ের হাজং শিল্পীরা ২৯ মার্চ ২০০৮ খ্রিস্টাব্দে রাতের প্রথম প্রহরে মহিষাসুরবধ পালা পরিবেশন করে। অত্র নিবন্ধে সেদিনের আসরের বর্ণনা প্রদান করা হলো।
পালা শুরুর আগেই মঞ্চের পেছনের দিকে কাপড়ের ঘের দেওয়া সাজঘরে বসে মহিষাসুরবধ পালা পরিবেশনের জন্যে নেত্রকোণার দুর্গাপুর-বগাউড়া থেকে আগত রাধাকৃষ্ণ সম্প্রদায়ের হাজং শিল্পীরা একে একে যার যার চরিত্রানুযায়ী সাজ গ্রহণ করতে থাকেন। আমি তাদের সাজ গ্রহনের মাঝে তাদের পাশে দাঁড়িয়ে ও বসে দেখতে থাকি এক একজন দিনমজুর সামান্য সাজে কেমন করে হয়ে ওঠেন অসামান্য দেব-দেবী। দেখি সাজ গ্রহনে পুরুষ দিনমজুর দ্রোণদেব হাজং (৪৪)-এর দেবী কালী হয়ে ওঠা, চায়ের দোকানদার বিনয় হাজং (৩৭)-এর দুর্গা বা মহামায়া হয়ে ওঠা। এছাড়া, আরো দেখি রাজমিস্ত্রি সুবল হাজং (৪৫) হয়ে উঠলেন নিশুম্ভ, হৃদয় হাজং (১২) ডাকিনী, জয়ন্ত হাজং (১১) যোগিনী, বায়ু হাজং (২২) চণ্ডা, চেঙ্গিস হাজং (৩২) মহিষাসুর, সাধন হাজং (২৫) মণ্ডা, নারায়ণ হাজং (১৮) কুড়াল, রুবেল হাজং (১৯) লক্ষ্মী, সুধানন্দ হাজং (১৭) সরস্বতি, বাপ্পী হাজং (১০) কার্তিক, হেমল (১২) গণেশ, রপেন্দ্র হাজং (২০) শিব, বিচিত্র হাজং (৩৬) দুর্গাসুর, শলিল হাজং (২৭) ইন্দ্ররাজ প্রভৃতি।
মহিষাসুরবধ পালার শুরুতেই থাকে বন্দনাগীত। মঞ্চের উত্তর-পশ্চিম ভাগে বসা বাদ্যযন্ত্রী ও সঙ্গীতশিল্পী দল বাদ্যের তালে তালে বন্দনাগীত শুরু করে- “নমঃ নমঃ নারায়ণী জগত তারিণী/দুর্গাসুর বিনাশিনী দুর্গতী হারিণী ॥/সর্বলোক নিস্তারিণী পতিত উদ্ধারিণী/কালী তারা তাপহারা সন্তোষ কারিণী ॥/কালী তারা মহাবিদ্যা রাজা রাজ্যশ্বরী/শ্রীমতী ভুবনশ্বরী ভৈরব শঙ্করী ॥চন্দ্র রূপ রগণ রকতারিণী/অতি চণ্ডী রা কর অশুভ হারিণী ॥” এই বন্দনাগীতের মধ্যে একে একে সকল কুশীলব চরিত্রানুযায়ী বিভিন্ন অভিনয় উপকরণ ঢাল, তরবারী, ত্রিশূল, তীর-ধনুক, মুখোশ সহযোগে নৃত্যের তালে তালে মঞ্চে এসে নৃত্য পরিবেশন করেন এবং বন্দনাগীত সমাপ্ত হলে তারা মঞ্চ থেকে প্রস্থান করেন।
মূল নাট্যপালার শুরুতেই এক হাতে তরবারি আর অন্য হাতে ফলা অস্ত্র নিয়ে নৃত্যের তালে তালে মহামায়া বা দুর্গা মঞ্চে প্রবেশ করেন। একই সঙ্গে তাকে অনুসরণ করে ঢাল-তরবারি হাতে একজন কুশীলব অসুর রূপে নৃত্য যোগে মঞ্চে আগমন করেন। এক সময় তিনি তাঁর নৃত্যের মধ্যে নানা রকম অঙ্গ ভঙ্গি করে অট্টহাসিতে ফেটে পড়েন এবং বলেন-

অসুর : হু হা হা হা। কে? কে তুমি নারী? আমায় সত্য পরিচয় দাও।
মহামায়া : সমরের প্রাঙ্গণে দেবতার আলয়ে কেন তুমি আসিলে হেথায়?
অসুর : এই তো আমি অসুর। তুমি আমাকে সত্য পরিচয় দেবে, না হলে তোমাকে আমি করতে পারি জানো?
মহামায়া : হ্যাঁ জানি। তোমার মতো তোমার মত কত সহস্র অসুর আমার পায়ের তলায় রেখে দিয়েছি। সেই পাপিষ্ট অসুর আমার পরিচয় জানতে চায়ছো! জানো, আমি মহামায়া।
অসুর : মহামায়া! আজ তুমি কী চাও।
মহামায়া : চাই শুধু রাজ্য।
অসুর : রাজ্য! হু হা হা হা। তবে আয়- আয়রে মৃত্যুকামিনী নারী, তোকে রাজ্যের সাধ মিটিয়ে দেই ॥
বেজে ওঠে যুদ্ধের দামামা। আর অসুর সেই বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে মহামায়ার সঙ্গে যুদ্ধ করতে থাকেন। বেশ কিছুণ ধরে যুদ্ধ চলার পর মহামায়ার কাছে অসুর পরাস্ত হয়। কিন্তু পরণেই আবার অসুর যুদ্ধে মেতে ওঠেন। এ পর্যায়ে মহামায়া প্রায় পরাস্ত হয়ে যান এবং বলেন-

মহামায়া : ওরে পাপিষ্ট অসুর আমি যে আর পারছি না।
অসুর : পাপীয়সী নারী- তুমি এখনই আমার দুটি পাও ধরো। আর রাজ্যের ইচ্ছা পরিত্যাগ করো।
মহামায়া : না না না।

আবার যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে। মহামায়া পূর্ণ শক্তিতে অসুরের সাথে যুদ্ধে মেতে ওঠেন। এবারের যুদ্ধে অসুর পরাস্ত হয়ে বলেন-

অসুর : জগৎতারিনী মা, আমায় মা করো। আমি জেনে বুঝে করেছি অপরাধ। আমায় তুমি মা করো।

যুদ্ধে পরাস্ত হয়ে অসুর এভাবে মহামায়ার পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়তেই মঞ্চে নতুন করে আরেক অসুরের আবির্ভাব ঘটে। তিনি হাতের এক হাতের তরবারি দিয়ে অন্য হাতের ঢালে আঘাত করে শব্দ করে নৃত্য যোগে মঞ্চে এসে বলেন-

মহিষাসুর : হা হা হা।
মহামায়া : তুমি আবার কেন এলে মহিষাসুর! আর কোনো মহাপাপ করো না তুমি।
মহিষাসুর : বড় দুষ্ট নারী তুমি, লজ্জা নাহি তোর মুখে। পুরুষের সাথে রণ কর মন সুখে। ধিক ধিক নারী জাতি, নাহি গুরু জ্ঞান। ত্যাজ্য পথে আসিয়াছ হারাইতে প্রাণ। নারী জাতি বলে মা করেছি এতোণ। কিন্তু এখনি হইবে তোর সম্মুখে মরণ।
মহামায়া : তবে আয়- আয়রে মোরই গর্বে গর্বিত দানব। তোরে মেরে ঘোচাইব দেবেরই ভয় সব। নারীর অপার মায়া দৈত্য কেমনে জানিবে। ষোলকলা পাপ তোর হইলো পূরণ। অনিবার্য হলো তোর নিকটে মরণ ॥

যুদ্ধ শুরু হয় বাদ্যের তালে তালে। মহামায়া আর মহিষাসুরের সেই যুদ্ধের মধ্যে একসময় একে একে দুর্গা-কার্তিক-গণেশ-লক্ষ্মী-সরস্বতী মঞ্চে প্রবেশ করে। বাদ্যের তালে তালে তাদের প্রত্যেকের সাথেই মহিষাসুরের যুদ্ধ হয়। সে যুদ্ধে মহিষাসুর পরাস্ত হয়। আর তখনই সকল দেব-দেবী পরিবেষ্টিত আসনে মহামায়া বা দুর্গার অধিষ্ঠান ঘটে। এ সময় সঙ্গীতশিল্পীগণ গেয়ে ওঠেন-

ভালো ভালো সকল দেবতা পরাস্ত হয়ে গেল।
আর নাহি কো দেরী জানাই পূর্ণ সালাম ॥

মন্দিরে দুর্গা পুজার অধিষ্ঠানের মতো মঞ্চে দুর্গার অধিষ্ঠান ঘটে। এ সময় পেছন দিকে একটি চিত্রিত কাপড়ের প্রোপট তুলে ধরা হয় এবং দুর্গা বন্দনার গান গীত হয়- ‘জগৎতারিণী...॥’ ধুপ-ধোঁয়া সহযোগে দুর্গার অধিষ্ঠানে পূজা প্রদান করা হয়। এভাবেই প্রথম পর্বের সমাপ্তি হয়। একই ভাবে দ্বিতীয় পর্বের সূচনা এবং সমাপ্তি হয়। তবে, দ্বিতীয় পর্বে মহামায়া বা দুর্গা রূপের পরিবর্তে কালী রূপে আবির্ভূতা হয়ে থাকেন।
এমন একটি নাট্যপালা শেষে কুশীলবদের সাথে আলাপে জানতে বাংলাদেশের হাজংরা আসলে এ ধরনের একটি কৃত্যমূলক নাট্যপালার মাধ্যমে পৃথিবীতে সত্য-সুন্দরের বিজয় গাঁথা রচনা করেন।

আলোকচিত্র : সাহাদাত পারভেজ
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই মে, ২০০৮ রাত ১১:৩৭
৪টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আজ রমনায় ঘুড়ির 'কৃষ্ণচূড়া আড্ডা'

লিখেছেন নীলসাধু, ১৮ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:২৬




আজ বিকাল ৪টার পর হতে আমরা ঘুড়ি রা আছি রমনায়, ঢাকা ক্লাবের পর যে রমনার গেট সেটা দিয়ে প্রবেশ করলেই আমাদের পাওয়া যাবে।
নিমন্ত্রণ রইলো সবার।
এলে দেখা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আকুতি

লিখেছেন অধীতি, ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০

দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক- এর নুডুলস

লিখেছেন করুণাধারা, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫২



অনেকেই জানেন, তবু ক এর গল্পটা দিয়ে শুরু করলাম, কারণ আমার আজকের পোস্ট পুরোটাই ক বিষয়ক।


একজন পরীক্ষক এসএসসি পরীক্ষার অংক খাতা দেখতে গিয়ে একটা মোটাসোটা খাতা পেলেন । খুলে দেখলেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কারবারটা যেমন তেমন : ব্যাপারটা হইলো কি ???

লিখেছেন স্বপ্নের শঙ্খচিল, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০২

কারবারটা যেমন তেমন : ব্যাপারটা হইলো কি ???



আপনারা যারা আখাউড়ার কাছাকাছি বসবাস করে থাকেন
তবে এই কথাটা শুনেও থাকতে পারেন ।
আজকে তেমন একটি বাস্তব ঘটনা বলব !
আমরা সবাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×