জায়গাটা আমার কাছে অপরিচিত মনে হচ্ছে। মনে হওয়াটা স্বাভাবিক; কারণ এই জায়গাটায় আমার আগে কখনো আসা হয়নি অথবা আসার চিন্তাও করিনি। আশেপাশের মানুষগুলো আমাকে একনজর দেখে যাচ্ছে। তাদের নজর দেখে মনে হচ্ছে যেনো চিড়িয়াখানায় প্রথম বানরের মুখচ্ছবি দেখছে। এমনটা হওয়াও স্বাভাবিক, কারণ আজ আমি পশু আর তারা মানুষ, তাদেরই একজনের ইশারায় তাদেরই কারো একজনের হাতে আমার মৃত্যু হবে। আজ আমি অস্বাভাবিক, তারা স্বাভাবিক।
শুনেছি, মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামীদের নাকি প্রাণনাশের আগে এখানে আনা হয়। বলে ফেলা ভালো, আজ আমি তাদেরই একজন। তবে আমাকে কোন অপরাধের ফলে এমন শাস্তি দেওয়া হলো তা আমার কাছে এখনো পরিষ্কার নয়। আমি তো কোন গুরুতর অপরাধ করিনি...........................
হ্যাঁ, কিছু অপরাধ আছে আমার, কিন্তু সেটা ছোটবেলার। রক্ষণশীল পরিবারে জন্মগ্রহন করে উচ্চবিত্ত স্বপ্ন দেখেছিলাম, চাহিদা দেখিয়েছিলাম। স্বাভাবিকভাবেই প্রত্যাশামতো সেগুলো না পেয়ে তান্ডবলীলা চালিয়েছি, এমনকি নিজের অনেক আপনজনের গায়ে হাত তুলেছি। আমার স্পষ্ট মনে আছে, যেদিন আমার এসব অত্যাচারের পরিমান খুব অসহনীয় পর্যায়ে যায়, তখন থেকে বাবা আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেন। তার দুইরুমের বাসাটা হঠাৎ একরুম হয়ে যায়। তার পরিবারের সদস্যসংখ্যা তিনজন থেকে দুইজন হয়ে যায়, তার সন্তান সংখ্যা দুইজন থেকে একজন হয়ে যায়। আমার পুরো নামের শেষ অংশ তথা আমাদের বংশের নাম টা মুছে যায়। বাবা থেকেও এতিম জীবনযাপন শুরু হয়।
আমি এখনো বুঝে উঠছিনা আমার অপরাধটা কী ছিলো। সামনের পাহাড়াদার দুইজন গার্ড হঠাৎ তিনজন হলো। পরে বুঝলাম গার্ড আসলে দুইজনই, আরেকজন সুপারভাইজার গোছের কিছু। গার্ড গেট খুলে দেওয়ার পর তিনি আমার সামনে আসলেন। কোনরকম ভূমিকা না করেই তিনি জিজ্ঞাসা করলেন,
- আপনার জীবনের শেষ ইচ্ছা আছে কোন? থাকলে বলতে পারেন।
আমি উল্টা অবাক হলাম। আসলেই তিনি ভূমিকা দিয়ে কথা শুরু করেছেন। ব্যাপারটা আমার খুব অপছন্দ। মৃত্যুপথযাত্রী কে মৃত্যুর ভয় মনে করিয়ে দেওয়ার কোন মানে হয়না। এরকম ভূমিকা আমি আসলেই প্রত্যাশা করিনি।
সামিহা যখন আমাকে প্রথম তার মনের কথা গুলো খুলে বলে, তখন সে ঠিক এভাবেই ভূমিকা করে কথা শুরু করেছিলো। আসলে সে পুরো একটা রচনা লিখে এনেছিলো, যেটার একদম শেষ লাইন বলার জন্যও তার এতো সাধনা। তো সে তার সাধনার ফল পাঠ শুরু করলে আমার ঘুম ধরে যায়। আস্তে আস্তে ঘুমে পুরোপুরি আচ্ছন্ন হইয়ে যখন আমি গভীর ঘুমে অচেতন হই, তখন সে তার অনূভুতির কথা চূড়ান্তভাবে একটি লাইনে প্রকাশ করে তার রচনা পাঠ শেষ করে।
- কিছু বলছেন না যে আপনি?? আপনি ঠিক আছেন তো??
সুপারভাইজার গোছের সেই লোকটার কথায় পরম বাস্তবে ফিরে আসলাম। আমি বুঝতে পারলাম লোকটা অনেক নার্ভাস হয়ে আছে, তাই সে মৃত্যদন্ডপ্রাপ্ত আসামী কে ঠিক থাকার কথা জিজ্ঞাসা করছে। কিন্তু আমি তো জেনে আসছি এরা অনেক শক্ত মনের মানুষ হয়। তাহলে এদের এই অবস্থা কেনো? আমি কিঞ্চিত বিরক্ত হয়ে তার কথার জবাব দিলাম।
- ইয়ে, মানে আমার শেষ ইচ্ছা হলো, আমাকে মুক্তি দিয়ে দিন। আজকের রাতটা আপনার বাসায় থাকবো। কারণ আমার নিজের বাসায় যাওয়ার ভাড়া আমার কাছে নেই
সামিহাও ঠিক এভাবে একদিন আমার কাছে মুক্তি চায়, আর সেদিন আমি ঠিক ওই সুপারভাইজার গোছের লোকটার ভূমিকায় ছিলাম। আমি তাকে বাধা দেইনি। দশটা বছরের সম্পর্ক, দশটা বছর ধরে করে আসা প্রতিজ্ঞা, সারাজীবন সাথে থাকার কথা যে এক মূহুর্তেই শেষ করে দিতে চায়, তবে সেখানে অবশ্যই কোন বিশেষ কারণ বিদ্যমান। হয়তো তার নিজের কোন কারণ, যেটা সে অনেক ভূমিকা করে অনেক পরে বলবে, আর আমি ততোক্ষণে ঘুমিয়ে যাবো। অথবা এটাও হতে পারে, আমি বুনো প্রাণীকে পোষ মানানোর চেষ্টা করেছি এতোগুলো দিন। ভুলেই গিয়েছিলাম যে বন্যেরা বনে সুন্দর , শিশুরা মাতৃক্রোড়ে।
আচ্ছা, জল্লাদের সাথে মৃতুদন্ডপ্রাপ্ত আসামীর দেখাটা কীভাবে হয়? তারা কী একে অপরকে সালাম দেয়?? তাদের সম্পর্কটা ওই অল্প সময়টুকুতে কিরকম হয়?? আসলেই কি তাদের মধ্যে কোন কথোপকথন হয়? নাকি জল্লাদের চেহারা আসামী কে দেখতে দেওয়া হয়না। আচ্ছা জল্লাদ যখন মৃত্যুদণ্ড দেয়, তখন কি তার হাত কাঁপেনা? তার মনটা বেঁকে বসে না?? তার কষ্ট লাগেনা? উত্তরটা অবশ্যই না হবে, কারণ উত্তরটা হ্যাঁ হইলে তাদের আসল নামের পরিবর্তে তাদের জল্লাদ ডাকা হতোনা। এই মূহুর্তে বিষয়গুলো খুব জানতে ইচ্ছে করছে, কারণ জল্লাদের সাথে আমাকে পরিচয় করে দেওয়ার পর যদি আমি তাকে জিজ্ঞাসা করি, আপনি কি আমার জান কবজ করবেন ? তখন সে অক্কা পেলে আমার উপর আবার কেস মোকদ্দমা চলবে। কিন্তু আমার এখনো জানা হলোনা আমার অপরাধটা আসলে কি ছিলো, আমাকে কেন এতো বড় শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। এই একটা রহস্য নিয়ে মনে হয় আমার মরতে হবে।
জল্লাদের সাথে আসামীর সম্পর্কটা নিয়ে কিঞ্চিত অবহিত না হলেও একটা খুনির সাথে ভিকটিমের সম্পর্কটা কিরূপ হয়, তা আমার খুব ভালো করেই জানা আছে। ব্যাপারটা যদিও ওরকম না। সামিহা যখন আরেকজনের হাত ধরে সারাজীবনের জন্য এক অটুট বন্ধনে আবদ্ধ হয়, ঠিক তখন আমার মধ্যে একটা অদ্ভুত সত্তার জাগরণ ঘটে। সেই অদ্ভুত সত্তার অসাধারণ বুদ্ধিমত্তায় আমি প্রতিশোধের আগুনে মত্ত হয়ে তাদের সামনে একদিন এসে যাই। আমার টার্গেট ছিলো সামিহা, তাই স্বভাবতই নাইন এমএম পিস্তলের ম্যাগাজিনে থাকা শেষ গুলিটা আমি তাকেই করেছিলাম। ঠিক যেভাবে বাকী গুলিগুলো আমার জীবনের কিছু বিশেষ দিনে সময়ের প্রয়োজনে ব্যবহার করেছিলাম। আজো সময়ের প্রয়োজনে ভালোবাসার মানুষটিকে বিদায় জানিয়ে দিলাম। আমি খুন করিনি, কারণ ভালোবাসার মানুষটাকে মেরে ফেলা কোন অপরাধের মধ্যে পড়েনা, এটা ভালোবাসার প্রয়োজন।
আমাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ভাবতেই খুব অবাক লাগছে, এতদিন আদর-যত্ন-আরাম ভোগের পর আজ এভাবে জামাই আদর পাওয়া লাগবে। মঞ্চে আমাকে উপস্থিত করার পর সবাই চলে যাওয়ায় আমি কিঞ্চিত অবাক হলাম। এখানে কোন জল্লাদ নেই, নেই কোন মানুষ। শুধু একজন শিকারি আর একটা শিকার। শিকারি আর কেউ নয়, খোদ সামিহা। স্বামী হত্যার প্রতিশোধ নিতে আজ সে প্রতিশ্রুতি বদ্ধ। তার হাতে সেই নাইন এমএম পিস্তলটা।
আমি ছোটবেলা থেকেই ছিলাম অভিশপ্ত, আমাকে জন্ম দেওয়ার সময় আমার মা মারা যান, আর বাবা তো আমি প্রাপ্তবয়স্ক হবার আগেই আমাকে ত্যাজ্য করে দেন। একমাত্র বড়ভাইটাও বাবার ভয়ে আমার সঙ্গ ত্যাগ করে। আমি পরনির্ভরশীলতা তখন থেকেই চর্চা শুরু করি। যার ফলে জীবনে কোন কাজ নিজে থেকে ঠিকমতন করতে পারিনি, উল্টা আরেকজনের উপর নির্ভর করেছি। জীবনের প্রয়োজনে, বেঁচে থাকার প্রয়োজনে অনেক পদ্ধতি অবলম্বন করেছি। মানুষ চিনেছি, কখনো ভালো, কখনো খারাপের চরিত্রে নিজেকে দেখেছি। সামিহার সাথের দশটা বছরও আমি ওর উপর নির্ভরশীল ছিলাম। কিন্তু সামিহার বিয়ের পর হঠাৎ সময়ের প্রয়োজনে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার প্রয়োজন অনুভব করলাম। তাই তখনই ভেবে নিলাম হাতেখড়ি তাকে দিয়েই হয়ে যাক। কিন্তু, সেই অভিশপ্ত কপালের জন্য হাতেখড়ির বারোটা বেজে যায়, যখন ভালোবাসার প্রয়োজনে সামিহার স্বামী তার জীবন দিয়ে সামিহাকে বাঁচায়।
সামিহা আমার কপালে পিস্তলটা তাক করে শুধু একটা কথাই বললো,
- ভালোবাসার মানুষের জীবন নেওয়া না, ভালোবাসার মানুষের জন্য জীবন দেওয়াটা অপরাধের কিছুনা।
এরপর একটা নাইন এমএম বুলেট আমার মাথা ভেদ করে বের হয়ে গেলো, আমি একটুও ব্যথা অনুভব করলাম না। এক স্বর্গীয় অনুভূতি আমার পুরো শরীর জুড়ে খেলে গেলো, আর আমি মাটিতে লুটিয়ে পড়লাম। আমার চোখ দুটো নিজে থেকে বন্ধ হবার আগেই আমার প্রাণ আমার দেহ ত্যাগ করলো, আর সব কিছু কেমন অন্ধকার হয়ে গেলো।
চোখ মেলার পর দেখলাম আমি আমার বালিশে শুয়ে আছি, বালিশ আর বিছানা জুড়ে রক্তের বদলে ঘাম। পরিস্থিতি বুঝতে বেশী সময় নিলাম না। স্বপ্ন দেখছিলাম এতক্ষণ আমি। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। এই প্রথম মনে হয় কোন কিছু আমাকে ভয় পাইয়ে দিলো। আসলে সবার জীবনে দ্বিতীয় সুযোগ আসেনা........................... বালিশের পাশে থাকা নাইন এমএমের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে সেটাই বললাম...........................