কলম্বো এয়ারপোর্টে নেমে আপনি যদি ১০০ রুপী মূল্যে Explore Sri Lanka নামের একটি ম্যাগাজিন যা এয়ারপোর্টে পর্যটকদেরকে বিনামূ্ল্যে দেয়া হয়; হাতে তুলে নেন তাহলে দেখতে পাবেন দেশে পর্যটকদের প্রতি আহ্বান বাণী: “Explore Sri Lanka -once discovered, you must explore”। আবার দেখবেন দেশের প্রতি তাদের মমতাপূর্ণ বাণী : Sri Lanka- A land like no other.
২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারির কোন এক নিষুতি রাতে এসে নেমেছিলাম রাবণের দেশে: শ্রীলংকার রাজাধানী কলম্বোতে।
Bandaranayake International Airport -এ। মুল কলম্বো শহর থেকে এটি ৩৫ কি.মি. দূরে। টার্মিনাল বিল্ডিং থেকে বের হয়েই বুঝা গেল বাইরের গরমের সে কি দাপট।পরে শুনলাম এখানে সারা বছরই গরম। কোন শীতকাল এখানে নেই। দুইটই ঋতু- গ্রীষ্ম আর বর্ষা।
বাইরে এসেই ঢাকার সাথে পার্থক্যটা প্রথম উপলব্ধি করলাম। গাড়ীওয়ালাদের কোন টানাটানি নেই। কাউন্টার থেকে যে কোন ধরনের গাড়ী পাওয়া যায়। ভাড়াও নির্ধারিত। গাড়ীগুলো ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করেনা। আমি দেখেছি, রাত ৩ টায় লাল বাতি জ্বললেও গাড়ি থেমে যায়। যদিও তখন ইচ্ছে করলেই গাড়ী টান মেরে যে কোন দিকে চলে যাওয়া যায়। তা না করে চালকেরা সবুজ বাতির জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। আইনকে এরা অনেক মানে। আইন না মানলে যে বি:শৃঙ্ক্ষলা সৃষ্টি হবে এটা জানে।
এদেশের মানুষের সাথে বাংলাদেশের মানুষের অনেক মিল রয়েছে। কি গায়ের রং কি উচ্চতায় সব কিছুই বাংলাদেশের মতো। কেবল মিল নেই ভাষায়। তবে দুরত্বে ব্যবধান না থাকলে ভাষার অমিল খুব থাকত বলে মনে হয় না। কারণ সিনহালা ভাষার অনেক শব্দের সাথে বাংলা শব্দের বেশ মিল দেখা যায়। যেমন-গাছ,হাত,কান ইত্যাদি অনেক শব্দই বাংলার কাছাকাছি।
প্রথমে সংক্ষেপে দেশটির পরিচয় দিতে চাই।
দক্ষিণ এশিয়ার বৃত্তম দ্বীপ রাষ্ট্র শ্রীলংকা। আয়তন ২৫,৩৩২ বর্গমাইল বা ৬৫,৬১০ কিমি । আয়তনের দিক দিয়ে এটি বিশ্বের ১২১ তম দেশ। আযতনে ছোট হলও দেশটিতে ৯ টি প্রদেশ রযেছে। প্রদেশগুলোর আবার রয়েছে আলাদা সরকার। জেলা মাত্র ২৫ টি। ১৯৪৮ সালে বৃটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে সিলন (Ceylon) নাম নিয়ে। ১৯৭২ সালে এর নতুন নামকরণ করা হয় শ্রীলংকা (Democratic Socialist Republic of Sri Lanka )। বর্তমান লোক সংখ্যা ২০.২ মিলিয়ন (ইউএন, ২০০৯). প্রধান ভাষা সিনহালা, তামিল ও ইংরেজি। প্রধান ধর্মীয় জনগোষ্ঠী হচ্ছে’ বৌদ্ধ ৬৯.১%, হিন্দু, ৭.১%মুসলিম ৭.৬%ও খৃস্টান ৬.২% অন্যান্য ১০% । শিক্ষার হার ৯০.৭%।
দেশটির উন্নয়নের অনেক সম্ভাবনা থাকলেও ৩০ বছরের গৃহ যুদ্ধের কারণে অনেক পিছিয়ে পড়েছে। তবে আশার কথা গত বছর সমাপ্তি ঘটেছে রক্তাক্ত সেই গৃহযুদ্ধের। ফলে এই দেশটি এখন তরতরিয়ে উঠে যাবে উন্নতির দিকে। কেননা, এদের জন সংখ্যা একটি সহনীয় মাত্রায় রয়েছে। সাধারণ মানুষের মাঝে যথেষ্ট সততা রয়েছে। সততার বড় অভাব আমাদের দেশে। এখানে অত অভাব নয।
অনেক ভাল এখানকার আইন-শৃঙ্খলা অবস্থা। মেয়েরা অবাধে পথে চলতে পারছে। কোন ছেলে তাদেরকে টিজ করছেনা। এখানকার মেয়েরা অনেক ফাস্ট। জিন্স-টি শার্ট আর সংক্ষিপ্ত ড্রেস পড়ে এরা অবাধে চলাচল করতে পারছে। ঘরে-বাইরে কাজ করছে সর্বত্র। বিভিন্ন সরকারী বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে নারী কর্মীর সংখ্যা চোখে পড়ার মতো। বিশেষ করে টেলিকম ও ব্যাংকিং সেক্টরে নারী কর্মীর সংখ্যা পুরুষ কর্মীর চেয়ে অনেক বেশীই বলে মনে হয়েছে আমার কাছে। সবধরনের বাসে নারী-পুরুষ এক সাথে দাড়িয়ে- সে যাচ্ছে। কোন হাঙ্গামা নাই। ভাড়া নিয়ে নেই কোন ক্যাচাল। যা ঢাকার বাসগুলোতে নিত্যদিনের ঘটনা। বাসগুলোতে অবশ্য কয়েকটি সিট সংরক্ষিত থাকে। ২টি ধর্মীয় গুরু, ২টি গর্ভবতী আর ২টি অক্ষমদের জন্য। এধরনের যাত্রী এলে সবাই সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে যাবে। এটা আমাদের দেশে কি আমি আশা করতে পারব?
কলম্বোতে শপিং মলের সংখ্যা কম নয়। বেশ কটি বিখ্যাত শপিং মলের নাম: হাউজ অব ফ্যাশনস, নোলিমিট, কেন্দ্রা, ফ্যাশন বাগ, আরপিকো সুপার সেন্টার, কিল্স সুপার,কারগিলস ফুট সিটি ইত্যাদি। অনেক পণ্যের দামই এই সব মলে যা বাইরের সাধারণ দোকানেও তা। বাংলাদেশে এটা আশাই করা যায় না। ওজন নেবার যান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং ইলেক্ট্রনিক ক্যাশ রেজিস্টার এর ব্যবহারের কারণে ভ্যাট সহ যে কোন ধরনের ট্যাক্স ফাকি দেবার কোন সুযোগ নেই।
কলম্বো শহরের লোক সংখ্যা প্রায় ১০ লাখ । এর মাঝে ৪ লাখ আবার ভাসমান। এর দিনে শহরে আসে আবার সন্ধ্যায় চলে যায়। ফলে শহরের পরিবেশ রাতের হয়ে যায় নীরব। ব্যয়বহুল শহরে কেউ থাকতে চায় না। নারী-পুরুষ সবাই কাজ করে বলে সংসারে তেমন অভাব নেই কারোরই। তবে নিজ নিজ এলাকা থেকে কর্মক্ষেত্রে আসতে হয় বলে যাদের আবাস কলম্বো শহরের বাইরে তারা ভোর রাত ৪টার পরে ঘুম থেকে উঠে কর্মক্ষেত্রে যাবার প্রস্তুতি নিতে থাকে। বাসে –ট্রেনে চড়ে যাত্রা শুরু হয় খুব ভোরেই। শহরেরই বাইরের শিশুরা কলম্বোর ভাল স্কুলে পড়তে আসে। সকাল হলেই দেখা যায়, মাইক্রোবাসে ( ভ্যান) করে অসংখ্যা শিশু কলম্বোর দিকে ছুটে চলেছে। সকাল ৯টার পর প্রতিদিনই তাই কলম্বোর লোক সংখ্যা বেড়ে যায়। সন্ধ্যার পর আবার সুনসান নীরবতা।
শ্রীলঙ্কাতে দুটি জাতীয় ও একটি প্রাদেশিক নির্বাচন হতে দেখেছি। একটি প্রাদেশিক নির্বাচন আর আরেকটি ২০১০ সালের আলোচিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। অনেক আধুনিক তাদের নির্বাচন। বাংলাদেশের মতো অমন নির্বাচন এখানে হয়না। প্রচারণা চলে নীরবে। মিছিল নই। ভাংচুর নেই। ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া নেই। যে যার পছন্দ মতো ভোট দিয়ে আসে। এখানে মানুষ অনেক সচেতন। ভোটের ফলাফলের পর অহেতুক বিজয় মিছিলও হয়না । মানুষ অত গোড়াভাবে কোন দলকে সাপোর্টও করে না।
তবে জিনিসপত্রের দাম বাংলাদেশের তুলনায় অনেক বেশী। দাম দেখলে মনেই হয় না যে এটা দক্ষিণ এশিয়ার একটি দেশ। আমি ২০০৭ সালে এসে জিনিসপত্রের যে দেখেছিলাম তা এখন ৩ গুণ হয়ে গেছে। তবে এনিয়ে এখানে কোন মাতামাতি নেই। এখানে আজ পর্যন্ত এই নিয়ে একটা মিছিল পর্যন্ত হয়নি। তার মানে এই নয় যে এখানে অনেক প্রাচুর্য। তবে এখানে কেউ বসে থাকে না। সবাই কাজ করে । ফলে যে কোন পরিবার চলে অনায়াসে। যদি কোন পরিবারে একটি মুদির দোকা ন থাকে তাহলে ঐ পরিবারের সবাই দোকানে কাজ করে। যাদের তা নেই তারা কোন একটা দোকানে বা প্রতিষ্ঠানে কাজ খুজে নেয়। কোন কাজইকেই এরা ছোট করে দেখে না। আমাদের দেশে তো সবাই কাজ করতে চায়না। গায়ে ফু দিয়ে বেড়াতে বড় ভালবাসে তারা।
একটি কথা না বললেই নয়। এখানে যতগুলো টিভি আছে তার সবগুলোই ডিশ ছাড়া দেখা যায়। অর্থাৎ সব গুলো টিভিই টেরেসট্রিয়াল সম্প্রচারের ব্যবস্থা আছে। ৩/৪টি চ্যানেল আছে যেগুলো সব সময়ই ইংরে জি অনষ্ঠান প্রচার করছে। হিন্দি গান, হিন্দি ছবি টিভিগুলো হরহামেশাই প্রচার করছে। সিনেমা হলেগুলোতে প্রায়ই চলে হিন্দি সিনেমা। ইংরেজি ও স্থানীয় ভাষার ছবিও চলে অনেক। আশ্চর্য জনক ব্যাপার হল সিনেমা হলগুলোতে পরিবেশ খুবই ভাল। সপরিবারে ছবি দেখার মতো পরিবেশ থাকায় এখনো মানুষ আগ্রহভরে সিনেমা হলে ছবি দেখতে যায়।
টিভিগুলো যখন ইংরেজি বা হিন্দি ছবি প্রচার করে তখন সাবটাইটেল বা সংলাপগুলো স্থানীয় ভাষায় পর্দাও নীচে দেখানো হয়। ফলে দর্শকরা সহজেই ছবি বুঝতে পারে। টিভিতে কোন ধুমপান কিংবা মদ্যপানের দৃশ্য এলে তা সাথে ঢেকে দেয়া হয়। যদিও এদেশে মদ্যপান খুব প্রচলিত। এরা অন্য খাবার না খেয়ে থাকতে পারে কিন্তু মদ না খেযে থাকতে পারবে না। তাই দেশের অলিতে গলিতে গড়ে উঠেছে মদের দোকান। সব ধরনের ক্রেতারা ভিড় করে কিনছে মদ।
পুরো শ্রীলংকা দেশটাই ঘুরে দেখার মতো। সাধারণ নিরাপত্তা থাকায় অবাধে আসছে পর্যটকরা। একেবারে অজপাড়া গাঁয়েও ক্রেডিট কার্ডে কেনাকাটা করা যায়। অধিকাংশ মানুষ মোটামুটি ইংরেজি বলতে পারে বলে পর্যটকরা সহজেই ঘুরে বেড়াতে পারে, কেনা-কাটা করতে পারে।
৩০ বছরের গৃহ যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। আর পেছনে থাকা নয়। উন্নয়নের বাধভাঙ্গা জোয়ার আসছে সামনে। শ্রীলংকানরা এখন আশায় বুক বাধছেন। অদুর ভবিষ্যতে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম উন্নত দেশে পরিণত হবে শ্রীলংকা। তাদের সেই আশা যে অমূলক নয় তা শ্রীলংকা একবার ঘুরে দেখলেই বুঝা যায়।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই আগস্ট, ২০১০ রাত ১০:১৬