সাত বছর বন্ধ থাকার পর খুলে গেল সৌদি আরবের শ্রমবাজার। বর্তমানে প্রায় ২৫ লাখ বাংলাদেশি সৌদি আরবে বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত। সৌদি আরবই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার। ২০০৮ সালে নিষেধাজ্ঞা আরোপের আগে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে প্রায় দেড় লাখ শ্রমিক নিত সৌদি আরব। দেশটির শ্রমবাজার খুলে যাওয়ার পর আবার আগের মতোই শ্রমিক পাঠানো যাবে। এখন থেকে নামমাত্র খরচে চাকরি নিয়ে সৌদি যেতে পারবে বাংলাদেশি শ্রমিকরা। ভিসা, মেডিক্যাল ফি, বিমান ভাড়াসহ সব খরচ বহন করবে নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠান। তবে বিদেশ যাওয়ার পূর্বপ্রস্তুতির জন্য খরচ হতে পারে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা।
সৌদিতে কম খরচে কর্মী পাঠানো শুরু হলে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশও একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করবে বলে আশা করছে সরকার। তখন মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে নামমাত্র খরচে যেতে পারবে বাংলাদেশি শ্রমিকরা।
বেতন ১২০০ থেকে ১৫০০ রিয়ালঃ
৯ ফেব্রুয়ারি প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে সৌদি আরবের ১৯ সদস্যের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠক করেন বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খোন্দকার মোশাররফ হোসেন। সৌদি প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন দেশটির শ্রম ও আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপমন্ত্রী ড. আহমেদ আল ফাহাইদ। বৈঠক শেষে খোন্দকার মোশাররফ হোসেন জানান, ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা খরচ করে প্রতি মাসে সৌদি আরবে ১০ হাজার বাংলাদেশি শ্রমিক যেতে পারবে। মাসিক বেতন ১২০০ থেকে ১৫০০ রিয়াল। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় ৩১ হাজার টাকা। কর্মীদের আবাসনের ব্যবস্থাও করবে সৌদি নিয়োগকর্তা প্রতিষ্ঠান। পাওয়া যাবে বীমা সুবিধাও।
লোক নেওয়া হবে ১০টি ক্যাটাগরিতেঃ
দেশটির শ্রম ও আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপমন্ত্রী ড. আহমেদ আল ফাহাইদ জানান, গত বছর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে সৌদি আরবে প্রায় ১৩ লাখ শ্রমিক গেছেন। এবারও ব্যাপক হারে শ্রমিকের চাহিদা আছে। বাংলাদেশ থেকে কনস্ট্রাকশন ও বিভিন্ন খাতে লোক নেওয়া হবে।
জানা গেছে, নারী গৃহকর্মী, নির্মাণকর্মী, গাড়িচালকসহ ১০টি ক্যাটাগরিতে পাঁচ-ছয় লাখ কর্মী নেওয়া হবে। এসব ক্যাটাগরিতে প্রতি মাসে ১০ হাজার বাংলাদেশি শ্রমিক সৌদি আরবে পাঠানো হবে। এরই মধ্যে নিবন্ধনকৃত বিদেশ যেতে ইচ্ছুক সব শ্রমিককে বিষয়টি জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। নিবন্ধন ছাড়া বাংলাদেশ থেকে এখন আর কোনো দেশে কর্মী পাঠানো যাবে না। তাই নিবন্ধিত না হলে এখনই নিবন্ধন করতে হবে।
নিবন্ধন যেভাবেঃ
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিমেট) ডাটাবেইসে বিদেশে চাকরিপ্রার্থীদের নাম নিবন্ধন করতে হয়। সৌদি আরবসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যেতে ইচ্ছুক বাংলাদেশি কর্মীদের (পুরুষ ও নারী) নাম নিবন্ধনপ্রক্রিয়া সারা দেশে একযোগে শুরু হয়েছে। রাজধানীর ইস্কাটনে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়সহ সারা দেশের প্রতিটি জেলায় জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে জনশক্তি ও প্রশিক্ষণ বিভাগে নিবন্ধন করা যাবে। নির্দিষ্ট ফি দিয়ে সেখান থেকে নিবন্ধন করতে হবে।
বৃহস্পতিবার (১২/০২/২০১৫) মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, বিদেশ গমনেচ্ছুরা ইউনিয়ন ডিজিটাল কেন্দ্রগুলোর মাধ্যমে অনলাইনেও নিবন্ধন করতে পারবেন।
“বিদেশ গমনেচ্ছু ব্যক্তিগণ অফিস চলাকালীন সৌদি আরবসহ বিশ্বের যে কোনো দেশে গমনের জন্য বিএমইটির অধীনস্থ সকল জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিস এবং দেশের প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদে অবস্থিত ইউনিয়ন ডিজিটাল কেন্দ্রের মাধ্যমে রেজিস্ট্রেশন করতে পারবেন।”
এছাড়াও আগ্রহীরা বিএমইটির ওয়েবসাইটের (http://www.bmet.gov.bd) মাধ্যমেও অনলাইন নিবন্ধন করতে পারবেন বলে জানানো হয় বিজ্ঞপ্তিতে।
এতে আরও বলা হয়, আগে যারা নিবন্ধন করেছেন তাদের দ্বিতীয়বার তা করার প্রয়োজন নেই।
নিবন্ধন করতে গিয়ে তাড়াহুড়ো করতেও নিরুৎসাহিত করা হয় বিজ্ঞপ্তিতে
ডাটাবেইসে নাম অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর প্রার্থীর ছবিসহ একটি আইডি কার্ড দেবে। এই কার্ডে একটি সিরিয়াল নম্বর থাকবে, এর মাধ্যমে প্রার্থীর তথ্য শনাক্ত করা যাবে। নিবন্ধন করতে নির্ধারিত আবেদনপত্রের সঙ্গে দুই কপি পাসপোর্ট সাইজের ছবি, নাগরিকত্ব সনদপত্র, ব্যাংক ড্রাফট/পে-অর্ডারের মাধ্যমে নির্ধারিত ফি, অন্যান্য সনদের (প্রযোজ্য হলে) সত্যায়িত কপি (শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদপত্র, কারিগরি প্রশিক্ষণ, ভাষা শিক্ষা ইত্যাদি) জমা দিতে হয়।
পাঠানো হবে রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমেঃ
রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে শ্রমিক পাঠানো হবে। এ ক্ষেত্রে এজেন্সিগুলো কত টাকা করে সার্ভিস ফি নেবে সে বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। তবে শ্রমিকের কাছ থেকে যাতে অতিরিক্ত অর্থ আদায় না করা হয় সেটি নজরদারি করবে সরকার। সরকারের ছাড়পত্র ছাড়া কোনো কর্মী বিদেশে পাঠাতে পারবে না রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো।
রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে যাওয়ার সময় প্রতারণার শিকারও হয় অনেকে। একটু সতর্ক হলে এসব প্রতারণা এড়ানো যায়। প্রতারণা এড়ানোর প্রথম উপায়ই হলো সরকার অনুমোদিত বৈধ এজেন্সির সঙ্গে যোগাযোগ করা। সরকার অনুমোদিত বৈধ এজেন্সির তালিকা পাওয়া যাবে বিমেটের ওয়েবসাইটের এই লিংকে-www.bmet.org.bd/BMET/raHomeAction
কর্মী বাছাই করা হবে যেভাবেঃ
সৌদি আরবের নিয়োগকর্তা কম্পানি বাংলাদেশের রিক্রুটিং এজেন্সির কাছে তাদের চাহিদাপত্র দেবে। নিবন্ধিত কর্মী ছাড়া কেউ বিদেশে যেতে পারবে না। রিক্রুটিং এজেন্সি প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে চাহিদাপত্র দিলে ডাটাবেইস থেকে লটারির মাধ্যমে কর্মী বাছাই করা হবে। কর্মীরা বিএমইটির ছাড়পত্র নিয়ে বিদেশে যেতে পারবে। এ ক্ষেত্রে নিবন্ধনের বাইরে রিক্রুটিং এজেন্সি ইচ্ছা করলেই খেয়ালখুশি মতো লোক পাঠাতে পারবে না। পরবর্তী সময়ে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন বা ছাড়পত্র নিয়ে সৌদিতে কর্মী পাঠানো হবে।
প্রশিক্ষণঃ
প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব খন্দকার ইফতেখার হায়দার জানান, কাজ নিয়ে সৌদি আরবে যাওয়ার আগে আগ্রহীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে। ডাটাবেইসে নিবন্ধিতদের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার তথ্য ডাটাবেইসে সংরক্ষণ করা হয়। দক্ষ শ্রমিকদেরই সৌদি আরবে কাজে যাওয়ার সুযোগ থাকবে। ৫০০ শ্রমিকের চাহিদাপত্র দেওয়া হলে ডাটাবেইস লটারির মাধ্যমে এক হাজার ৫০০ শ্রমিকের তালিকা দেওয়া হবে। প্রতি তিনজন থেকে নিয়োগকর্তা প্রতিষ্ঠান একজন বাছাই করবে। দক্ষ শ্রমিক হিসেবে গড়ে তুলতে সারা দেশে ৩৮টি প্রশিক্ষণ সেন্টারের মাধ্যমে কর্মীদের নানা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের তালিকা, ঠিকানা ও ফোন নম্বর পাওয়া যাবে http://www.bmet.gov.bd/BMET/trainingHomeAction লিংকে।
লোক পাঠানোর প্রক্রিয়াঃ
যারা সৌদি যেতে চায়, তাদের পাসপোর্ট করা ছাড়া তেমন কোনো চিন্তা করতে হবে না। ভিসাপ্রক্রিয়া থেকে শুরু করে সব কিছু দেখবে নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠান। সৌদিতে যেতে ইচ্ছুকরা ডাটাবেইসের অন্তর্ভুক্ত না থাকলে প্রথমে নিবন্ধন করতে হবে। তৈরি করতে হবে পাসপোর্ট। লটারিতে নির্বাচিত হলে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে মোবাইলে এসএমএসের মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হবে। পরবর্তী করণীয় জেনে নিতে হবে সংশ্লিষ্ট জেলার জনশক্তি ও প্রশিক্ষণ কার্যালয়ে।
পাসপোর্ট করার আগে জেনে নিনঃ
অনেকেই পাসপোর্ট করার সময় কিছু ছোট ভুল করে, যা পরবর্তী সময়ে তাদের বড় সমস্যায় ফেলে। যেমন- নামের বানানে হেরফের, পেশা নির্ধারণে ভুল সিদ্ধান্ত, জন্মতারিখে অমিল।
পাসপোর্টের জন্য আবেদন করার সময় ফরমে ‘পেশা’ কী লিখবে, তা নিয়ে বিভ্রান্তিতে থাকে অনেকেই। তখন অনেক চাকরিপ্রার্থীই জানে না- কোন পেশায় চাকরি নিয়ে বিদেশে যাবে। কোনো নির্দিষ্ট কাজে প্রশিক্ষিত বা দক্ষ হলে বিভ্রান্তির সুযোগ থাকে না। সরকারের পাসপোর্টসংক্রান্ত ওয়েবসাইটে (http://www.passport.gov.bd) পাসপোর্টের জন্য আবেদনের নির্দেশনা আছে। চাইলে অনলাইনেও আবেদন করা যাবে। তবে সরাসরি পাসপোর্ট অফিসে গিয়ে আবেদন করাই ভালো।
বিভাগীয় ও আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের তালিকা ও মেশিন রিডেবল পাসপোর্টের (এমআরপি) আবেদন ফরম পাওয়া যাবে বহির্গমন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে (http://www.dip.gov.bd)।
ভাষা শেখা জরুরিঃ
সৌদি আরবে বসবাসের সময় কিংবা কাজের জায়গায় দেশটির ভাষা জানারও প্রয়োজন হবে। কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শব্দ, কথোপকথন বা যোগাযোগের প্রাথমিক ধারণা নিয়ে গেলে সুবিধা হয়। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের অনেক ভাষা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আরবি ভাষা প্রশিক্ষণ কোর্স চালু আছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাব, গ্লোবাল, একুশেসহ বিভিন্ন ভাষা শিক্ষার প্রতিষ্ঠানে আরবি শেখানো হয়। বই পড়েও শেখা যায় আরবি ভাষা। সরকারিভাবে ভাষা শেখানোর জন্য সম্প্রতি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রতিটি উপজেলায় চালু করা হচ্ছে আরবিসহ বিভিন্ন ভাষা শিক্ষা কোর্স।
-দৈনিক কালের কালের কণ্ঠের সৌজন্যে
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ রাত ১১:১৭

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




