somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হুমায়ূন আহমেদের ছোটগল্পে অব্যাখ্যাত ঘটনা

৩১ শে ডিসেম্বর, ২০১২ রাত ১১:২৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

হুমায়ূন আহমেদের ছোটগল্পে অব্যাখ্যাত ঘটনা

[সারসংক্ষেপ: গল্পসমগ্র হুমায়ূন আহমেদ, অষ্টম মুদ্রন ২০০৬, কাকলী প্রকাশনী বইটির ৮৫টি ছোটগল্পে অব্যাখ্যাত ঘটনার উপস্থাপন যথেষ্ট পরিমানে রয়েছে। এসব গল্পগুলোর এক সাদামাটা শ্রেণিকরণ করা যেতে পারে: অস্বভাবী মানুষের জগত, ভূতের জগত, প্রাণিজগতের অব্যাখ্যাত ঘটনা এবং বিজ্ঞান কল্পকাহিনী হিসেবে। মিসির আলির গল্পগুলোকে সরাসরি শ্রেণিকরণ করা না হলেও কোনক্রমেই উপেক্ষা করা হয়নি। ৮৫টি গল্পের প্রায় অর্ধেক গল্পের মূল বিষয় এমন সব অব্যাখ্যাত ঘটনা যা হুমায়ূন আহমেদ এর এক বিশেষত্বকে তুলে ধরে। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই অব্যাখ্যাত ঘটনার সঙ্গে তীব্র মানবিক বোধের সংমিশ্রন ঘটিয়ে গল্পকে কালোত্তীর্ণ করার প্র্য়াস লক্ষ্য করা গেছে এবং দু-একটি গল্প যে বিশ্ব সাহিত্যের ক্লাসিক ছোটগল্পের সংকলনে স্থান করে নিবে তা বলতে দ্বিধা নেই।]


শুরুর কথা

হুমায়ূন আহমেদ এ পর্যন্ত ঠিক কতটি ছোটগল্প আমাদেরকে দান করেছেন তা হয়ত এখনি ঠিকঠাক বলা সম্ভব নয়। বিভিন্ন সংকলন থেকে সবকটির হিসাব বের করা ছোটখাট একটি গবেষণার দাবী রাখে বলে আমার মনে হয়। কিছু অপ্রকাশিত গল্প যে কোথাও থাকতে পারে সে সম্ভাবনাও ফেলনা নয়। আর তাই আমি হাতের কাছে পাওয়া একটি গল্পসমগ্র নিয়ে বসে পড়ি, উদ্দেশ্য হলো হুমায়ূনের গল্পের কিছু বিশেষত্বের স্বাদ নেয়া। ২০০৬ সালে মুদ্রিত অষ্টম মুদ্রন এর ৭৩৬ পৃষ্ঠার বিশালবপু গল্পসমগ্র হুমায়ূন আহমেদ বইটি কাকলী প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত। এই গল্পসমগ্রে মোট ৮৫টি গল্প স্থান পেয়েছে। এখানে যেমন ৩-৪ পৃষ্ঠার বেশ কিছু গল্প আছে, এর চেয়ে বড় দেহের গল্প আছে আরো বেশী সংখ্যায়, তেমনি ৪৮ পৃষ্ঠার একটি গল্পও এখানে স্থান করে নিয়েছে। ৮৫টি গল্পের আয়তন নিয়ে কোন প্রশ্ন করতে চাই না। এক নাগাড়ে পড়তে শুরু করলে পাঠক প্রতিটি গল্পেই হুমায়ুনের বিশেষ হিউমার এর উপস্থিতির স্বাদ পান। তবে এ বিষয়েও আমাদের আলাপ নয়। যে বিষয়টির বিশালবপু অস্তিত্ব আমাকে ভাবালো সেটি হলো ভুত, টুত, অলৌকিকতা, প্রাণীকূলের অব্যাখ্যাত ঘটনাপ্রবাহ, সেই বহু পরিচিত মিসির আলি, বিজ্ঞান কল্পকাহিনী আর আরো বহু ধরনের যুক্তিহীন ঘটনা-অনুভূতির উপস্থাপন। এসব যে পুরোপুরি যুক্তিহীন তা আর বলা যায় না হুমায়ূন আহমেদ যখন অকস্মাৎ গল্পের ছেদ টেনে পাঠকের মুখে তার বিশেষ কায়দায় কুলুপ এটে দেন। তিনি কিভাবে পাঠকের সব প্রশ্নের উত্তর দেয়ার পথ বন্ধ করে দেন সে নাহয় অন্য আরেক আলাপে আনা যেতে পারে। আজ আমরা দেখতে যাচ্ছি আমাদের হাতে থাকা গল্পগ্রন্থের ৮৫টি গল্পে কিছু অব্যাখ্যাত ঘটনার উপস্থিতি।

হুমায়ূন আহমেদের প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার জগতের সঙ্গে মিলিয়ে যদি তার ছোটগল্পগুলোকে পড়ার চেষ্টা করে কোন পাঠক, তাহলে হয়ত থমকে দাঁড়াতে হবে। পাঠক ভাবতে পারেন, রসায়নে উচ্চতর ডিগ্রিধারী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক আধি-ভৌতিক বা অবৈজ্ঞানিক বিষয়কে যুক্তির সীমানায় নিয়ে আসবেন কিনা। পাঠক যদি লেখকের স্বাধীনতায় পুরোপুরি বিশ্বাস না করেন, তাহলে হুমায়ূন আহমেদের লেখায় এমন বিষয়ের উপস্থাপনকে খারাপ চোখে না দেখলেও সেসবকে যুক্তিগ্রাহ্য করার যে কোন চেষ্টাকে মানতে কষ্ট পাবেন। আমরা তো অবশ্যই লেখকের কল্পনা আর সৃষ্টিশীলতার স্বাধীনতায় বিশ্বাস রাখি। আর তাই হুমায়ূন আহমেদের ছোটগল্পে যেসব অব্যাখ্যাত ঘটনার উপস্থিতি পাবো তার একটি শ্রেণিবিন্যাস ও মূল্যায়নের চেষ্টা করতে পারি। লেখক সেসব ঘটনাকে নিজ উদ্যোগে যুক্তিগ্রাহ্য করছেন কি না তাও দেখার চেষ্টা করতে পারি।

তাহলে প্রথমেই দেখতে পারি তার ছোটগল্পে উপস্থিত অব্যাখ্যাত ঘটনার এক সাদামাটা শ্রেণিকরণ। আমরা যদি আমাদের জীবনের সাধারণ উপলব্ধির বাইরের যত ঘটনা তার গল্পে উপস্থাপিত হতে দেখি তার খোঁজ করি তবে আমরা নিম্নোক্ত শ্রেণিবিন্যাসের আভাস পাই যদিও ব্যাখ্যার সুবিধার জন্য কোন একটি শ্রেণিতে আলোচনা করা একটি গল্পে আরেকটি শ্রেণির বৈশিষ্ট্য একবারে অনুপস্থিত থাকবে তা ভাবা যাবে না:
১. অস্বভাবী মানুষের জগত
২. ভূতের জগত
৩. প্রাণিজগতের অব্যাখ্যাত ঘটনা
৪. বিজ্ঞান কল্পকাহিনী


এক. অস্বভাবী মানুষের গল্প

অস্বভাবী মন পুরোপুরি অব্যাখ্যাত না হলেও এর জটিলতা একে ব্যাখ্যাতীত সীমানায় ঠেলে দেয়। আমরা দেখেছি কালজয়ী সব ছোটগল্পকারকে মানুষের অস্বভাবী স্বত্ত্বা নিয়ে গল্প লিখতে। হুমায়ূন আহমেদও সে চেষ্টা করেছেন এবং আমি মনে করি তিনি একাজে একাধারে সাহিত্যিক ও মনোবিশ্লেষক এর মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। বেশ কিছু গল্পের ভেতর আমরা দুটি গল্প চেখে দেখতে পারি এখন: ‘খাদক’ ও ‘জিন কফিল’।

‘খাদক’ (১২০-১২৬) গল্পটি প্রকৃত অর্থে ব্যক্তি অস্বভাবী মনোবিশ্লেষণের আওতায় পড়ে বলে মনে করি না। এটি যেন সমাজ মনস্তত্বের অস্বভাবী রূপ তুলে ধরেছে। এটি মতি মিয়ার গল্প যে মতি মিয়া একবার বসে অস্বাভাবিক পরিমান খেতে পারে। দূরদূরান্ত থেকে খাদক মতিকে লোকজন ‘হায়ার’ করে নিয়ে যায় বরযাত্রির সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার জন্য যেন ‘মেয়ের বাড়িতে খাবার শর্ট পড়ে।’ সে কখনো খাওয়ার বাজিতে হারে না। এই গল্পের ভাষ্যকারের সম্মানে এলাকার বিশিষ্ট ব্যক্তি খোন্দকার সাহেব খাদক মতির খাবারের ব্যবস্থা করে। একটি গরু খাবার বাজি। রাত দশটায় শুরু হয়, শেষ হতে প্রায় সকাল দশটা লাগবে বলে লোকজন বলে। মতি মিয়ার ভাষ্যে তার ছেলেরা হলো ‘দেখক’। ছেলেগুলো খেতে না পেয়ে হার জিরজিরে, তারা কেবল বসে থেকে বাবার খাওয়া দেখে। রাত বেশী হলে গল্পের ভাষ্যকারকে লোকজন বিছানায় পাঠিয়ে দেয় আর তিনি মতি মিয়ার চরিত্রে একটু মানবিকতা যোগ করার কল্পনা করেন। তিনি ভাবেন, শেষ মুহুর্তে মতি মিয়া মাংসের টুকরোটা তার ছেলের মুখে তুলে দিবে। কিন্তু তারপরই তিনি মন্তব্য করেন, তা হবে না, মতি মিয়া জিতবেই। এমন মন্তব্যে মতি মিয়ার অস্বাভাবিকতা যেন আর একক অস্বভাবী ব্যক্তির অস্বাভাকিতা হয়ে থাকে না। আমাদের পুরো সমাজের মুখোশ খুলে পড়ে। আর তাই এই গল্পটিতে অস্বভাবী আচরণ উপস্খাপিত হলেও পাঠকের মন ব্যক্তি থেকে সমাজ চিন্তায় ঘুরে যায়। হুমায়ূন আহমেদ এর অন্যতম সেরা গল্পের একটি হতে পারে এই ‘খাদক’, পাঠক হিসেবে এমনই বোধ করি।

‘জিন-কফিল’ (১৯৭-২৩১) হয়ত কোন সত্য ঘটনার কাছাকাছি পাঠের গল্প রূপ। ৩৫ পৃষ্ঠার এই গল্পটি মিসির আলির গল্পও বটে। গল্পের ভাষ্যকার মিসির আলির বন্ধু মানুষ। গল্পের শুরু হয় এক সাধুর খোঁজে বেড়িয়ে পড়ার বিলাস দিয়ে। ঘটনাক্রমে তাদেরকে এক ইমামের আতিথ্য নিতে হয়। গল্পের শুরু মূলত এখানেই, কারণ ইমাম সাহেবের মতে, তার স্ত্রী লতিফা জীনে ধরা রোগী। দেখা যায়, তার স্ত্রী ‘চোখে পড়ার মত রুপবতী’ কিন্তু তার দুটি সন্তানকে তার সঙ্গে থাকা কফিল নামের জীন হত্যা করেছে। একটি শিশুকে হত্যা করে কুয়ায় ফেলে। গল্পটি শেষমেষ মিসির আলির কাছে পৌঁছলে তিনি যুক্তি প্রয়োগ করেন। মিসির আলি দেখায় যে, বাচ্চা হারানোর পর সেই মহিলাই সবার আগে কুয়ার দিকে দৌড়ায়। যদিও এখানেও কিছু অব্যাখ্যাত ঘটনা রেখে দেওয়া হয়। কুয়ার টিন কেন ঝনঝন করে উঠেছিল তার পরিপূর্ণ ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। তৃতীয় সন্তান হলে মিসির আলির পরামর্শে লতিফা তার সন্তানকে কিছুদিনের জন্য অন্য মহিলার কাছে রাখতে রাজি হয়। এভাবে তৃতীয় সন্তানটি বেঁচে যায় যার নামকরণ হয় মিসির আলি বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে যে মেয়ের প্রেমে পড়েছিলেন তার নামে। এই গল্পে মিসির আলি যেভাবে পুরো অস্বাভাবিকতার ব্যাখ্যা দেন তা অস্বভাবী মনোবিজ্ঞানের ওপর হুমায়ূন আহমেদের দখলকে তুলে ধরে। একই সঙ্গে এই গল্প যুক্তির প্রয়োগকে স্থায়ী আসন দেয়। অস্বভাবী মনোবিজ্ঞানের অসাধারণ কেস স্টাডি হিসেবে এই গল্পকে মনোবিজ্ঞানের বইয়েও স্থান দেয়া যেতে পারে।

‘অঙ্ক শ্লোক’ (২৬৮-২৭৩) গল্পে মনোবিকারগ্রস্ত এক বাবার দেখা পাওয়া যায় যিনি তার মেয়েকে অঙ্ক শেখানোর জন্য বেশ পীড়ন করতেন। অঙ্কভীতি নিয়ে মেয়েটি মারা যায় আর এই বাবা অঙ্কভীতি দূর করতে প্রচলিত সব অঙ্ককে শ্লোকে রূপ দেয়ার প্রচেষ্টায় রত হয়। কতটাই মানবিক উপস্থাপন। ‘পিশাচ’ (৬৭০-৬৭৬) গল্পে দেখতে পাই প্রেমে ব্যর্থ এক পুরুষকে যে পিশাচ সাধনার জন্য পাঁচটি কাক পানিতে মারার প্রয়োজন হলেও প্রথমটাকেই মারতে পারেনি। তবু সেই মেয়েকে পাওয়ার জন্য সে পিশাচ সাধনায় জীবন কাটিয়ে দেবে। এখানেও মানবিক বিপর্যয়ের এক করুন উপস্থাপন। মূল চরিত্রের অস্বভাবী আচরণ পাঠককে তার প্রতি বিতশ্রদ্ধ করে না, বরং মমতায় বুকে টেনে নিতে প্রলুব্ধ করে। এভাবে ‘অয়োময়’ (২৪১-২৫৫), ‘ভয়’ (৩০৫-৩২১) এবং অন্তরার ‘অন্তরার বাবা’ (৬৩০-৬৩৮) গল্পে আমরা বিভিন্ন ধরনের অস্বভাবী চরিত্রের দেখা পাই। প্রতিটি চরিত্রই নিজ নিজ অস্বভাবী বৈশিষ্টে ভাস্বর। বেশীরভাগ গল্পেই আমরা পাঠককূল শেষমেষ মানবিকতার ফাঁদে ধরা পড়ি। এখানেই হুমায়ূন আহমেদের অসাধারণ কৃতিত্ব।

দুই. ভূতের জগত

অব্যাখ্যাত বিষয়বস্তুর মধ্যে সবচে বেশী ব্যবহৃত বিষয় ভূত-প্রেত এর জগত। স্বাভাবিকভাবেই প্রচন্ড রসবোধ সম্পন্ন লেখক হিসেবে এই বিষয়টি নিয়ে যথেষ্ট লেখালেখি করেছেন। এখানে যেমন আমরা প্রচলিত ভূতের গল্প দেখতে পায় তেমনি অশরীরি জগতের অস্তিত্বও দেখি যেখানে আমাদের প্রচলিত ভূতের দেখা নাই।

‘মিরখাইয়ের অটোগ্রাফ’ (৪৬৭-৪৭৫) স্রেফ ভূতের গল্প। নীতুর বানানো গল্প শুনতে ইচ্ছে করে না। গল্প শোনার আগেই সে বলে নেয় যেন তাকে সত্যি গল্প বলা হয়। ক্লাস থ্রীর এই মেয়েকে তার মামা এমন এক ভূতের গল্প বলে যে ভুতটি মামার কড়ে আঙুল ধরে হাঁটতে থাকে। মজার ব্যাপার হলো, মামা ভয় পেয়ে ভূত ভূত বলে চেঁচিয়ে উঠলে ভূত জানায় সে তো ভূত না, সে টুত। এখানেই হুমায়ূন আহমেদের গল্প কৌশল। এই টুত এর নাম মিরখাই। সে বিশ্ববিদ্যালয়ের এসোসিয়েট প্রফেসর, বেশ কটি বইয়ের লেখক। তার গবেষণার বিষয়, মানুষকে কিভাবে ভয় দেখানো যায়। গল্প শেষ হয় নীতুর খাতায় অদৃশ্য মিরখাইয়ের অদৃশ্য অটোগ্রাফ দিয়ে। এই গল্পটি ছোটদের জন্য, এটি বোঝা যায়। তবে বড়দের জন্যও, কারণ বানানো গল্পকে সত্য গল্পে রূপান্তর কৌশল এমন করে খুব গল্পকারের কাছেই শেখা যায়।

‘নিজাম সাহেবের ভূত’ (৫৫৯-৫৬৭) গল্পটি শুরু হয় বাস্তব জগতে, তারপর ভূতের জগতে, শেষে আবার বাস্তব জগতে। এটি কি আসলে ভূতের গল্প না কি মৃত্যু-প্রায় অভিজ্ঞতা সে বিষয়ে প্রশ্ন হতে পারে। নিজাম সাহেব গিন্নির কথামত সবকিছু কিনেছেন কিনা তা ভাবতে ভাবতে খেয়াল করেন, ঝিনুকের চুন নেয়া হয়নি। তখন চুন কেনার জন্য রাস্তা পার হতেই এক্সিডেন্ট। এরপরই তিনি ভূত হয়ে গেলেন। মাছের ব্যাগ থেকে মাছগুলো বেরিয়ে পড়লে তিনি হাত দিয়ে ধরার চেষ্টা করে বুঝলেন তার হাত আর শরীরি হাত নেয়। এর মাঝে আরো ভূতের সঙ্গে দেখা হলো। মোতালেব নামের এক ভালো ভূত শিখিয়ে দিল কোন কোন এলাকায় খারাপ সন্ত্রাসী ভূত আছে। একসময় মোতালেব বলে নিজাম সাহেব এখনো পুরোপুরি মরেনি, ডাক্তাররা তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে। মোতালেব তাকে বলে, হসপিটালের বেডে থাকা তার দেহে চোখ দিয়ে ঢুকে পড়তে। নিজাম সাহেব ঢুকেও পড়ে। তখন ডাক্তাররা বলে, “রিফ্লেক্স একশন ভালো। চোখের মনি ছোট হচ্ছে। … ট্রাকের নিচে পড়েও বেঁচে যায়- এই প্রথম দেখলাম।” এভাবে একটি ভূতের গল্প শেষমেষ ডাক্তারি গবেষণার বিষয় হয়ে দাঁড়ায় মৃত্যু-প্রায় অভিজ্ঞতার উপস্থাপনের মাধ্যমে। এখানে হুমায়ূন আহমেদ এক চমৎকার মোচড় দিয়ে সমাপ্তি টেনেছেন।

ভূতের জগতের গল্পগুলোর বৈচিত্র বেশ। গল্প সংখ্যাও কম নয়। ‘বীনার অসুখ’ ২৩৯-২৪৯), ‘শবযাত্রা ১’ (৩৬০-৩৭৭), ‘ওইজা বোর্ড’ (৩৮৯-৪০৩), ‘বেয়ারিং’ (৪১০-৪১৫), ‘রুঁরুঁর গল্প’ (৪৭৬-৪৮৫), ‘গুণীন’ (৫১৩-৫২৪), ‘ছায়াসঙ্গী’ (৩৪৩-৩৫২), ‘মোবারক হোসেনের মহাবিপদ’ (৪৮৬-৪৯২) এবং ‘পরেশের হইলদা বড়ি’ (৬৫৯-৬৬৪) গল্পগুলিতে ভিন্ন ভিন্ন ঢঙের ভূতের গল্প কিংবা এক অশরীরি জগতের গল্প বলা হয়েছে। যার বেশীরভাগই ঠিক ছোটদের জন্য লেখা না বলে পাঠক বোধ করে।

তিন. প্রাণিজগতের অব্যাখ্যাত ঘটনা

হুমায়ূন আহমেদের গল্পে পরিবেশ সচেতনতা কেমন তা ভিন্ন আলোচনার বিষয় হতে পারে, তবে তার গল্পে সাধারণ প্রাণী আর কীটপতঙ্গের প্রভাববিস্তারী অস্তিত্ব আছে। সাধারন পিঁপড়া যে কতটা প্রভাববিস্তারী গল্প সৃষ্টি করতে পারে তার প্রমান আমরা পাই। এমনিভাবে কুকুরের বা সাপের অস্তিত্বও পাঠকের মনে স্পষ্ট রেখাপাত করে গল্পে সেই প্রানীর উপস্থাপনের কৌশলে।

‘পিঁপড়া’ (২৬-৩৫) গল্পটি হতে পারে মানুষের অপরাধী মনের উপস্থাপনের এক বিশ্বসেরা কাহিনী। মোহাম্মদ মকবুল হোসেন ভুঁইয়ার গল্প এটি। সে এসেছে ডাক্তারের কাছে চিকিৎসার জন্য। রোগ বড় অদ্ভূত। পিঁপড়ার হাত থেকে সে কোথাও বেঁচে থাকতে পারে না। তার কথায় জানতে পারি, “বছর পাঁচেক আগে দূর সম্পর্কর এক বোনের মেয়ের ওপর আমার চোখ পড়ল, চইদ্দ-পনর বছর বয়স। … খুবই বজ্জাত মা, মেয়েকে নিয়ে আমার মা’র ঘরে মেঝেতে ঘুমায়। এত কিছু কইরাও লাভ হইল না। এক রাতে ঘটনা ঘটে গেল।” ঘটনার পর সেই মা মেয়েকে ইঁদুর মারা বিষ খাইয়ে দিল আর নিজে আমগাছে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়ল। গ্রাম থেকে থানা পনর মাইল দূরে। পাঁচ হাজার টাকা নজরানা নিয়ে সেখানে গেলে জানা গেল, দারোগা দলবল নিয়ে গেছে এক ডাকাতি মামালায়। আসতে তিনদিন সময়। বর্ষাকাল। লাশ পচে বিকট গন্ধ। লাশ যখন দারোগা দেখল তখন “লাখ লাখ লাল পিঁপড়া লাশের শরীরে। মনে হইতেছে মাগীর শইলে লাল চাদর।” মকবুল হোসেন বলে, “আমি একটা সিগারেট ধরাইলাম। সিগারেটের আগুন ফেলার সাথে সাথে মেয়েটার শরীরের সবগুলি পিঁপড়া নড়ল।” সবগুলি পিঁপড়া একসঙ্গে আমার দিকে আসতেছে। তখন থেকে শুরু। আগে কাশি ছিল না। পিঁপড়া ঢুকে গেছে ফুসফুসে। কাশির সাথে আসে মরা পিঁপড়া। ডাক্তারকে সে ২ লাখ টাকা দেবে যদি তার অসুখ ভাল করতে পারে। এদিকে ডাক্তার যখন মকবুল হোসেনের দিকে এগোনো পিঁপড়ার সারি দেখলেন, তখন “ডাক্তার সাহেব ভেবে পেলেন না, মুখে ডিম নিয়ে পিঁপড়াগুলি যাচ্ছে কেন? এরা চায় কী? কে তাদের পরিচালিত করছে। কে সেই সূত্রধর?” পাঠকের মুখ যেন এই এক কথাতেই কুলুপ মেরে বন্ধ করে দেয়া হয়। এটি হুমায়ূন আহমেদের একটি গল্প কৌশল। সমাপ্তি মন্তব্যটি এমন হবে যেন পাঠক আর কোন প্রশ্ন করার সুযোগ না পায়।

‘কুকুর’ (৪২-৪৯) গল্পটি সাদামাটা ভনিতা দিয়ে শুরু। কোইন্সিডেন্স এর ঘটনা শোনোতে চায় গল্প কথক। গল্পটা প্রফেসর আলীমুজ্জামান সাহেব এর। তার বাসায় ষোল হাজার বই। কথক বলে, “কোনো রকম ব্যাখ্যা বা টীকা টিপ্পনিও দিচ্ছি না। পুরোটা পাঠকদের উপর ছেড়ে দিচ্ছি।” পাড়ার কয়েকটি ছেলে একটা কুকরছানাকে কম্বল পড়িয়ে তার গায়ে কেরোসিন দিয়ে আগুনের মাঝে ছেড়ে দিবে। গলায় ঘুংঘুর বাজবে। ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র থাকার সময় এর ঘটনা। প্রফেসর কুকুরটাকে বাচানোর চেষ্টা করে কিন্তু, না, তার “থার্ড ডিগ্রী বার্ণ” হয়। কুকুরছানা মারা যায়। এরপর থেকে মাঝে মাঝে একদল কুকুর রাতের বেলা তার বাসার বাইরে এস বসে। তার মাঝে থাকে সেই ঘুংঘুর ওয়ালা পুড়ে কালো হওয়া কুকুর। তবে ঘটনাটা শুধু সেই প্রফেসরই দেখেন। প্রফেসর নিজে অতিপ্রাকৃত ঘটনার বিরুদ্ধে সারাজীবন অবস্থাবন নিয়েছেন “অথচ সেই [প্রফেসরকেই] কিনা সারাজীবন একটি অতিপ্রাকৃত বিষয় হজম করে যেতে হচ্ছে।” এদিকে গল্পের কথককে যখন তিনি ফোন করে জানান যে ওরা এসেছে, কথক আর শ্রাবণ মাসের রাতে বের হয় না। তার ভাষায়, “আমি টেলিফোন নামিয়ে বিছানায় চাদরের নিচে ঢুকে পড়লাম।” হুমায়ূন আহমেদও যেন এই সমাপ্তি মন্তব্যের মাধ্যমে পাঠকের বিশ্বাস-অবিশ্বাস এর দোলাচলকে চাদরের নিচে ঢেকে দিলেন।

‘একটি ভয়ংকর অভিযানের গল্প’ (৪২৯-৪৩৯) মশাদের কাহিনী। তাদের মানবিকতার গল্প। ‘পানি-রহস্য’ (৫০৪-৫২৩), ‘শবযাত্রা ২’ (৬০০-৬১১) এবং ‘বেবী রুথ’ (১৬৪-১৬৯) গল্পে আরো ভিন্ন স্বাদের গল্পের উপস্থাপন পাই।

চার. বিজ্ঞান কল্পকাহিনী

হুমায়ূন আহমেদ যে বিজ্ঞান কল্পকাহিনী কতটা ভালবাসতেন, পড়তে ও লিখতে, তা আমার হাতে থাকা গল্পগ্রন্থের ৪৫৯ পৃষ্ঠায় লেখকের নিজের জবানিতে পাই। জবানিটি এই প্রবন্ধের শেষে উল্লেখ করব বলে আশা রাখি। কোন গল্প পুরোপুরি বিজ্ঞান কল্পকাহিনী যেখানে বিজ্ঞানের সুত্র নিয়ে খেলা করা হয়েছে, অথবা বিজ্ঞাননির্ভর ব্যাখ্যা উপস্থাপন করা হয়েছে। আবার কোনটিতে আছে এক দ্বিতীয় জগতের উপস্থিতি যা হয়ত উন্নত প্রাণ প্রজাতির পক্ষে কথা বলে।

‘সে’ (৬৯-৮০) গল্পটি মানব প্রজাতির বিশেষ বিবর্তনের কথা বলে। গল্পের কথকের ছোট মেয়ের গলার কাটা বের করে দেয় স্ত্রীরোগবিশেষজ্ঞ হাসনা বেগম যিনি একসময় জন হপকিন্সে চলে যান গবেষণার জন্য। গল্পটি সেই মহিলার। কথক বলছেন, “যেভাবে শুনেছি অবিকল সেইভাবে বলার চেষ্টা করছি।” হাসনা বেগম এর এক প্রসূতি রোগী বলে যে তার সন্তানকে মেরে ফেলা হবে। রোগীর কথা, তার সন্তানই একথা বলেছে। ডাক্তার হিসেবে একথা বিশ্বাস করেন না হাসনা বেগম। জন্ম নেয় যেন একতাল মাংসপিন্ড যার আছে হাতির শুঁড়ের মত আট-দশটি শুঁড়। হাসনা বেগম বলেন, “প্রথম আঘাতটি করলাম আমি।” মারা যাওয়ার সময় বাচ্চাটি অবিকল মানুষের মত গলায় ডাকল- মা, মা। এ ঘটনার সাত বছর পর আমেরিকান জার্নাল অব মেডিক্যাল সোসাইটিতে এমন আরেক শিশুর কথা পাওয়া যায়। শিশুটি বলিবভিয়ান ভাষায় মা, মা বলে ডেকেছিল। ডাক্তার বলে, “কিছূ কিছু সময় আসে যখন আমরা বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের সীমারেখায় বাস করি।” কিন্তু পাঠক কি আর দোলাচলে থাকে? বোধহয় না। পাঠক এমন ঘটনা পুরোপুরি অবিম্বাস করলেও লেখকের সৃষ্টির চমৎকারিত্বে মুগ্ধ হয়।

‘নিমধ্যমা’ (৯৬-১১০) শুরু হয় এভাবে- মতিনউদ্দিন সাহেব মনে করছেন তাকে কেউ পছন্দ করেন না। তার ইচ্ছা হয় বিভিন্ন জনকে জিজ্ঞেস করে জানবে কি সেই কারণ যে কারণে তাকে কেউ পছন্দ করে না। মতিন সাহেবের এমন মানবিক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে গল্প শুরু। কিন্তু গল্পের হঠাৎ প্রায় মাঝপথে মতিন সাহেব চলে যান অন্যজগতে। চৈত্র মাসের এক রোববারে রমনা পার্কে বসে থাকার সময় তার নাড়িভুড়ি পাক দিয়ে উঠল। তারপর তার চারপাশে দেখা দিল অন্যজগতের বসিন্দা। এক কোটি আলোক বর্ষ দূরের উন্নত প্রযুক্তির বাসিন্দা। তারা মতিন সাহেবকে অনুরোধ করে তাদের অস্তিত্বের কথা বিজ্ঞানীদের জানানোর জন্য, ক্যানসারের চিকিৎসাও শিখিয়ে দিতে চায়। কিন্তু মতিন সাহেব বলেন, কেউ তার কথা বিশ্বাস করবে না। এ সময়ে পাঠকের মনে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের এক দোলাচল কাজ করলেও সন্ধ্যায় মতিন সাহেব ঘরে ফিরলে ওজু করার সময় যা দেখা যায় তাতে পাঠক স্তম্ভিত হয়। মতিন সাহেবের হাত-পায়ে এখন চারটি করে আঙুল। প্রশ্ন হলো এখানে কি হুমায়ূন আহমেদ পাঠককে ঘটনাটি বিশ্বাস করতে বাধ্য করছেন? সমাপ্তিটি এতটা একমুখি না হওয়াটাই বোধহয় ভাল ছিল। তারপরও এ এক সফল বিজ্ঞান কল্পকাহিনী।

‘দ্বিতীয় মানব’ (৬৮৯-৭৩৬) গল্পটি ৪৮ পৃষ্ঠার হওয়ায় উপন্যাস আকৃতির। এটি যেমন অন্য জগতের, আরেক উন্নত জগতের মানব সম্প্রদায়ের কথা বলে তেমনি মানবিকতার ঠাসা বুননে বুকের খাঁচায় কাঁপন তোলে। নেত্রেকোনা থেকে পায়ে হেটে মাটিকাটা শ্রমিক খলিলুল্লাহ আসে ঢাকায় বিত্তশালী যুক্তিবাদী মাহতাব উদ্দিন এর বাসায়। তার সঙ্গে অবসরপ্রাপ্ত হেডমাস্টার হাবীবুর রহমান এর চিঠি। খলিলুল্লাহর এক বিশেষ দক্ষতায় বিস্মিত হয়ে হেডমাস্টার তাকে মাহতাব উদ্দিন এর কাছে পাঠিয়েছে। এই খলিলুল্লাহ পানির নীচে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দিতে পারে কোন কৌশল ছাড়াই। এটি এক বিস্ময়। এছাড়াও সে ‘কলের জিনিস ফইর করতে’ পারে অর্থাৎ ইলেকট্রনিক জিনিসপত্র মেরামত করতে পারে। তবে বিস্ময় হলো তার কোন লেখাপড়া বা প্রশিক্ষণ নেই, এমনকি তার কাছে কোন যন্ত্রপাতিও নেই। মাহতাব উদ্দিন তার বন্ধু জালাল খাঁ-কে ডেকে পাঠায় খলিলুল্লাহকে পরীক্ষা করার জন্য। জালাল খাঁ একটি ডিজিটাল ভয়েস রেকর্ডার দেয় ঠিক করার জন্য। আসলে সেটি ঠিকই আছে, কিন্তু ব্যাটারী বিহীন। খলিলুল্লাহ যখন ব্যাটারীর স্থানটি দেখিয়ে বলে যে সেখানে একটা জিনিস লাগবে, তখন জালাল খাঁ তাকে ভুল ব্যাটারি দেয়- ১২ভোল্টোর ব্যাটারির জায়গায় ৬ ভোল্টের ব্যাটারি দিলেও খলিলুল্লাহ তার নখ দিয়ে এটা ওলা খুলে কিছু মেরামত করে সেই ব্যাটারি দিয়েই যন্ত্রটা চালিয়ে দেয় যা এককথায় ওভাবে খালি হাতে মেরামত করা বিজ্ঞানের যুক্তিতে অসম্ভব। স্বাভাবিকভাবেই পাঠকের কাছে কেমন গাঁজাখুরি গল্প মনে হতে পারে কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ পাকা গল্পস্রষ্টার মত এর ভেতরে এক ভয়াবহ মানবিক সংকট প্রবেশ করেন। মাহতাব উদ্দিন এর মেয়ে টুনটুনি খলিলুল্লাহর সাদামাটা জীবনে কৌতুহলী হয়। এদিকে খলিলুল্লাহ তাকে এক যন্ত্র বানিয়ে দেয় যে যন্ত্র দিয়ে টুনটুনি তার ২০ বছর আগের মাকে দেখতে পায়। টুনটুনি জেনে যায় তার নীল চোখওয়ালা মাকে ঘরে বন্দী করে রাখা হয়েছিল। তার বাবা জানায়, তার মার মানসিক অসুস্থতার কথা। এসময় মাহতাব উদ্দিন তার লোকজন দিয়ে খলিলুল্লাহকে ইটের ভাটায় পুড়িয়ে মারে কারণ তাকে পানিতে ডুবিয়ে মারা যাবে না। এর পাঁচ মিনিটের মধ্যে টুনটুনির ভীষণ জ্বর এলে মাহতাব উদ্দিন তাকে বাথটাবে শুইয়ে ডাক্তার ডাকতে যায়। টুনটুনি পানিতে ডুবে যায় এবং সে শুনতে পায় তাকে দ্বিতীয় মানব প্রজন্মে স্বাগত জানানো হচ্ছে। ৪৮ প্রষ্ঠার গল্পের প্রথম অর্ধেক অংশে পাঠকের মনে যুক্তি প্রবলভাবে কাজ করলেও শেষের দিকে টুনটুনির সঙ্গে একাকার হয়ে পাঠক যেন এমন এক অসম্ভব জগতকেও আর প্রশ্ন করবে না বলে পাঠের সমাপ্তি ঘটায়। এখানেই লেখকের মুন্সিয়ানা।

‘নিউটনের ভুল সূত্র’ (২৮০-২৯৯) গল্পটিতে মানুষের ভেসে থাকার ক্ষমতাকে প্রশ্নাতীত করা হয়েছে। ‘অঁহক’ (৬৫২-৬৫৯) পুরোটাই অন্য জগতের বাসিন্দাদের গল্প যেখানে আবার আরো উন্নত প্রাণের প্রমাণ মেলে। এভাবে ‘যন্ত্র’ (৪৫৯-৪৫৬), ‘ভাইরাস’ (৫৫৩-৫৪৯), ‘সম্পর্ক’ (৫৮৯-৬০০), ’তাহারা’ (৬৩৯-৬৫১) এবং ‘জাদুকর’ (৬৬৪-৬৭০) গল্পগুলোর একেকটায় একেক ধরনের জগত ও বিজ্ঞাননির্ভর প্রশ্ন কিংবা হেঁয়ালির উপস্থাপন ঘটেছে। প্রতিটি গল্পই হুমায়ূন আহমেদ এর সৃষ্টিশীলতার পরম ছোঁয়া পেয়েছে বলে পাঠক অনুভব করবে।

শেষ কথা

বিষয়টি বোধহয় উপেক্ষা করার মত নয়- ৭২৮ পৃষ্ঠার ভেতর যে ৮৫টি গল্পের বাস তার মাঝে অন্তত ৩৮টি গল্প আমাদের উল্লিখিত শ্রেণিকরণের ছাঁকনিতে আটকা পড়ে। আমরা যদি মিসির আলির চারটি গল্পও এর সঙ্গে যোগ করি তাহলে সংখ্যাটি আরো বড় হয়। প্রকৃতপক্ষে প্রবন্ধের আকার কিছুটা কমানোর চিন্তায় মিসির আলির গল্প কটি আর উল্লেখ করা হলো না। সময় নিয়ে গল্পগুলো আবার পড়লে আরো কিছু গল্প যে আটকা পড়বে না তা বলা যাবে না। আর এসব গল্পগুলোই তুলনামূ্লকভাবে অন্যান্য গল্পের চেয়ে দীর্ঘাকৃতির, কখনো বেশ দীর্ঘাকৃতির। অর্থাৎ অব্যাখ্যাত সব ঘটনার উপস্থাপন যেসব গল্পে স্থান পেয়েছে সেগুলো সংখ্যায় প্রায় পুরোপুরি আধাআধি, আর আকারে গল্পগ্রন্থটির প্রায় দুই তৃতীয়াংশ দখল করে নিয়েছে। এমন সাদামাটা তথ্য আমাদেরকে যেন বলতে চায়, হুমায়ূন আহমেদ জগতের অব্যাখ্যাত ঘটনার প্রতি বেশ আকর্ষণ বোধ করেছেন, প্রচন্ড ভালবেসেছেন গল্পের এসব বিষয়কে, যেমন বলেছেন ‘যন্ত্র’ গল্পের শুরুতে: “সাহিত্যের ছাত্রছাত্রীরা বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীকে মোটেই গুরুত্ব দেন না। কেন যে দেন না তা সাহিত্যের ছাত্র নয় বলেই হয়তো বুঝি না। আমি নিজে এই জাতীয় রচনা আগ্রহ নিয়ে পড়ি। লেখার সময়ও আগ্রহ নিয়ে লিখি- পাঠকদের এই তথ্যটি খুব বিনয়ের সঙ্গে জানিয়ে গল্প শুরু করছি।” জানতে আগ্রহ হয়, কি এমন দরকার পড়েছিল যে লেখককে এমন জবানবন্দী করতে হলো। মিসির আলি বিষয়ক ব্যাখ্যাও আমরা অন্যত্র লেখকের কাছ থেকে জেনেছি, লজিক আর এন্টি-লজিকের উপস্থাপন কিভাবে এমন চরিত্রকে স্থায়ী রূপ দিয়েছে তা পাঠকের জানা। বাঙলার মাটির কাছাকাছি থাকা মানুষের, শহুরে মধ্যবিত্তের বা বছরে দুবছরে একবার গ্রামে বেড়াতে যাওয়া বিত্তশালীর কুসংস্কার বলি বা আধি-ভৌতিক অভিজ্ঞতা বলি সেসবও হুমায়ূন আহমেদের লেখনীতে আবহমান সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়ায়। মানুষের অস্বভাবী মনস্তত্বের ব্যাখ্যায় হুমায়ূন আহমেদ অতি সিদ্ধহস্ত, মা নিজে কিভাবে সন্তানকে হত্যা করতে পারে তার যুক্তিগ্রাহ্য উপস্থাপন একথা পাঠককে মনে করিয়ে দেয়। শেষ কথা হলো, কোন গবেষক নিশ্চয় এগিয়ে আসবেন যাতে করে হুমায়ূন আহমেদের সকল ছোটগল্পে অব্যাখ্যাত ঘটনার পুঙ্খানাপুঙ্খ বিশ্লেষণ সম্ভব হয়।


হাসিনুল ইসলাম
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা জানুয়ারি, ২০১৩ রাত ১০:৫৮
১০টি মন্তব্য ৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

নারী একা কেন হবে চরিত্রহীন।পুরুষ তুমি কেন নিবি না এই বোজার ঋন।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১২:৫৪



আমাদের সমাজে সারাজীবন ধরে মেয়েদেরকেই কেনও ভালো মেয়ে হিসাবে প্রমান করতে হবে! মেয়ে বোলে কি ? নাকি মেয়েরা এই সমাজে অন্য কোন গ্রহ থেকে ভাড়া এসেছে । সব... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুসলিম কি সাহাবায়ে কেরামের (রা.) অনুরূপ মতভেদে লিপ্ত হয়ে পরস্পর যুদ্ধ করবে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৯




সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ১০৫ নং আয়াতের অনুবাদ-
১০৫। তোমরা তাদের মত হবে না যারা তাদের নিকট সুস্পষ্ট প্রমাণ আসার পর বিচ্ছিন্ন হয়েছে ও নিজেদের মাঝে মতভেদ সৃষ্টি করেছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদে মসজিদে মোল্লা,ও কমিটি নতুন আইনে চালাচ্ছে সমাজ.

লিখেছেন এম ডি মুসা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৩

গত সপ্তাহে ভোলার জাহানপুর ইউনিয়নের চরফ্যাশন ওমরাবাজ গ্রামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। লোকটি নিয়মিত মসজিদে যেত না, মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েনি, জানা গেল সে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী ছিল, স্বীকারোক্তিতে সে... ...বাকিটুকু পড়ুন

=সকল বিষাদ পিছনে রেখে হাঁটো পথ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৮



©কাজী ফাতেমা ছবি

বিতৃষ্ণায় যদি মন ছেয়ে যায় তোমার কখনো
অথবা রোদ্দুর পুড়া সময়ের আক্রমণে তুমি নাজেহাল
বিষাদ মনে পুষো কখনো অথবা,
বাস্তবতার পেরেশানী মাথায় নিয়ে কখনো পথ চলো,
কিংবা বিরহ ব্যথায় কাতর তুমি, চুপসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগে বিরোধী মতের কাউকে নীতি মালায় নিলে কি সত্যি আনন্দ পাওয়া যায়।

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৮

ব্লগ এমন এক স্থান, যেখানে মতের অমিলের কারণে, চকলেটের কারণে, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে অনেক তর্কাতর্কি বিতর্ক কাটা কাটি মারামারি মন্তব্যে প্রতিমন্তব্যে আঘাত এগুলো যেনো নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। ব্লগটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×