ভার্সিটির বটতলায় দাঁড়িয়ে যে মেয়েটাকে বলেছিলাম “ভালোবাসি”, সে মেয়েটা অবাক হওয়া চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে কিছুক্ষণ, পাশে বসে থাকা ছেলেটার হাত শক্ত করে ধরে, বুঝিয়ে দিয়েছিলো, সে আমাকে প্রত্যাখ্যান করেছে। পাশে বসা লম্বা চওড়া ছেলেটা আমার ভার্সিটির দুই ব্যাচ সিনিয়র। একবার আমার অবচেতন মন জানান দিয়েছিলো, আমার প্রতিবাদ করা দরকার। এই মেয়েটার সাথে আমার ভার্সিটি জীবনের দুই বছরের সখ্যতা। তাকে ভালোবাসার অধিকার অতি অবশ্যই আমার আছে। আমি অধিকার ভুলে, প্রতিবাদ করলে, যে শক্তি ক্ষয় হবে, তা অভিমান করে জমিয়ে রেখে বিবর্ণ মুখে সে স্থান হতে চলে এসেছিলাম। আর কখনও আমি শাহরিনের সামনে যাইনি, কোনো অধিকারের কথা মুখ ফুটে বলিনি, বন্ধুত্ব যে সখ্যতা আমাদের মাঝে তৈরি করেছিলো, সে স্মৃতি টেনে এনে ওকে আর বিব্রত করিনি। ভেবেছিলাম শাহরিন ভার্সিটির ঐ বড় ভাইয়ের সাথে বেশ মানিয়ে নিবে। মানিয়ে নিতে পারেনি ও। সে বছরই ভার্সিটি ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়া বড় ভাইয়ের সাথে ঠিক কবে, কী কারণে শাহরিনের মনোমালিন্য থেকে বিচ্ছেদ ঘটেছে, আমি সে খবর রাখিনি।
আমার মাসে পনেরো হাজার টাকা বেতনে প্রথম চাকরিতে জয়েনের পর পরই আবিষ্কার করলাম, আমার অফিসের সিনিয়র কলিগ প্রান্ত ভাই। সেই সিনিয়র যার জন্য শাহরিনের সাথে আমার প্রেম হবার সম্ভাবনাটুকুনও নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল। প্রান্ত ভাই অতি প্রাঞ্জল মানুষ, নতুবা যে পরিস্থিতে আমি তার সামনে শাহরিনকে ভালোবাসার কথা বলেছিলাম, তিনি আমাকে ভার্সিটির সিনিয়র হিসাবে শাসন ত্রাসন করতেই পারতেন। তিনি তা কখনও করেননি। বরং অফিসে প্রথম তার সাথে দেখা হবার পর তিনি বেশ উচ্ছল আচরণে আমাকে বুকে টেনে নিয়েছেন, খবরাদি জিজ্ঞেস করেছেন, অফিসের কোথায় কোন ইন্টারনাল পলিটিক্স আছে তা বুঝিয়ে দিয়েছেন, কাজের ব্যাপারে সবাই যখন ফ্রেশার হিসাবে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেছে, তিনি আমাকে আমার কাজের প্রতিটা ধাপ বেশ যত্ন সহকারে বুঝিয়ে দিয়েছেন। সর্বোপরি ম্যানেজার স্যারের সাথে আলাপ করে, আমাকে কাজ শেখাবার সমস্ত দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন।
কীভাবে এক্সেল ফাইলে কাজ করতে হবে, মেইলের শুরুতে শেষে কী লিখতে হবে, বাংলাদেশিদের স্যার ম্যাডাম ছাড়া মেইল পাঠানো যাবে না, বিদেশিদের নাম ধরে মেইল পাঠালেও কোনো অসুবিধা নেই এসব বিষয় বুঝিয়ে দিয়েছেন।
দুজন একসাথে লাঞ্চ শেষে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে অফিসের কে কোথায় কীভাবে কার পিছনে লাগার চেষ্টা করছে, সে বিষয়ে অবগত করতেন। আমি আমার চাকরি জীবনের সমস্ত সমস্যার সমাধান পেতে থাকলাম, প্রান্ত ভাইয়ের কাছ থেকে। যেকোনো জটিল সমস্যায় তিনি আমাকে সমাধান দিতেন। আমি একবার তাকে বলেই ফেললাম, “ভাই আপনি যেখানে যান না কেনো, আমাকে নিয়ে যাবেন। আমি একা কাজ করতে পারব না।”
তিনি হেসে বলতেন, “সবই পারবি, কারও জন্য কারও জীবন থেমে থাকে না।”
বেশ সহজ সরল একটা কথা, তবু আমি মানতে পারতাম না। প্রান্ত ভাই অফিস ছেড়ে চলে গেলে আমার পক্ষে টিকে থাকা সম্ভব হবে না।
আমি জানি, প্রান্ত ভাই আরও ভালো বেতনে চাকরির চেষ্টা তদবির চালাচ্ছেন। আমার বাড়তি বেতনের দরকার নেই। আমার প্রান্ত ভাইয়ের সাথে থাকা প্রয়োজন।
প্রান্ত ভাই থাকলেন না, হুট করে এক মাসের পাঁচ তারিখ রিজাইন লেটার জমা দিলেন। বসকে মানিয়েছেন, আর মাত্র পঁচিশ দিন এ অফিসে আছেন। আমাকে তড়িঘড়ি করে সমস্ত কাজ বুঝিয়ে দিতে লাগলেন, বিভিন্ন কাস্টমারের সাথে মিটিং এ আমাকে নিয়ে যেতে লাগলেন। আগে মেইল লেখার সময় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব পরীক্ষা করা প্রান্ত ভাই, আমার উপর সব ছেড়ে দিলেন। নিজে থেকে সব মেইলের উত্তর দেয়ার তাগিদ দিলেন। আমি তাকে যখন বলি, “ভাই আমিও চাকরি ছেড়ে দেই, আপনার ওখানে পোস্ট খালি হলে, আমাকে নিয়েন।”
তিনি হাসিমুখে উত্তর করেন, “বোকামি করিস না, কাজ শিখে নে। আমি সুযোগ বুঝে তোকে নিয়ে নিব।”
প্রান্ত ভাই আমাকে একা ফেলে অফিস ছেড়ে দিলেন। প্রথম দিকে প্রতিদিন তার সাথে আমার কথা হতো, সময় সুযোগ বুঝে দেখা সাক্ষাত হতো। এতোদিনের আলাপচারিতায় আমাদের মধ্যে শাহরিন নামটা কখনও আসে নি। হয়ত দুজনেই এড়িয়ে যেতে চাইতাম। ধীরে ধীরে সময়ের স্রোতে আমাদের যোগাযোগ ফিকে হতে লাগলো। আমি আমার কাজ নিজের মত গুছিয়ে নিতে লাগলাম, অফিসে প্রমোশন, বেতন বৃদ্ধি সব ঘটল। আমার আন্ডারে অনেকে আসতে লাগলো। এর মধ্যে এক জুনিয়র কলিগকে দারুণ মনে ধরল।
শান্ত নামের ছেলেটা নামের মতনই ভীষণ চুপচাপ, কিন্তু কাজ শেখার ব্যাপারে দারুণ উদগ্র। ঠিক যেমন প্রান্ত ভাই আমাকে সকল কিছু ধরে ধরে শিখাতেন, আমার জানা সকল কিছু আমি শান্তকে শেখাতে শুরু করলাম। শান্ত আমার কাছে জানতে চায়, “ভাই, বিদেশিদের নাম ধরে ডাকলে সমস্যা নেই। আমাদের দেশের মানুষজনকে কেনো স্যার ম্যাডাম ডাকতে হবে?”
আমি প্রান্ত ভাইয়ের কাছ থেকে শেখা বুলি আওড়ে বলেছিলাম, “আমরা স্যার ম্যাডাম শুনতে ভালোবাসি। আমাদের প্রচণ্ড আত্মসম্মানবোধ। ভালোবাসার মানুষ ছাড়া বয়সে বড় মানুষকে তুমি ডাকা এখানে চরম মাত্রায় পাপ।”
শান্ত মুগ্ধ হয়, হাসি মুখে আমার সকল যুক্তি মেনে নেয়। কিন্তু একটা সময় পর, আমি অফিসের প্রেসার গুলো মেনে নিতে পারি না। বেতন বাড়ে, প্রমোশন হয়, সাথে সাথে মাথার উপর একটা পর একটা ঝামেলার বোঝা এসে জমাট হয়।
নতুন বিয়ে করে বউকে নিয়ে কোথাও ঘুরতে যেতে পারি না। শুক্রবার দিনেও হুটহাট মিটিংয়ে ডাক পড়ে, বউ আমার অভিমান জমিয়ে বসে থাকে। আমি অনর্থক নানা যুক্তিতে তাকে কীসব বুঝাই, সে তা লক্ষ্মী মেয়ের মতন বুঝে নেয়ার মিথ্যে অভিনয় করে। বিয়ে উপলক্ষ্যে আমাকে তিনদিন ছুটি দেয়া অফিস ডিসেম্বর মাসে আমার প্রাপ্য বাকি নয় দিন ছুটি না দেয়াতে রাগ করে চাকরি ছেড়ে দেই। সিদ্ধান্ত নিয়ে নেই, জমানো টাকায় নিজে ব্যবসা করবো। চাকরি করা আমাকে দিয়ে সম্ভব নয়।
অফিস থেকে চলে আসার দিন, প্রায় সবাই কাঁদো কাঁদো চোখে বিদায় দিলেও, শান্ত ছেলেটা চুপচাপ ডেস্কে মুখ গোমড়া করে বসে থাকে। আমি পাশে গিয়ে মাথায় হাত বুলাতেই, আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ কান্না শুরু করে। “আপনাকে ছাড়া আমি কিছু পারব না ভাই। আমি যাইয়েন না,” বলে চোখের জল ফেলে যায়।
আমি প্রান্ত ভাইয়ের শেখানো বুলিতেই বুঝিয়ে যাই, “জীবন কারও জন্য থেমে থাকে না।”
শূন্য বুকে অফিস ছেড়ে নিজের ব্যবসা টুকটাক করে বাড়াতে থাকি। শান্ত আমার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখে। সে যোগাযোগও যথারীতি একসময় কমে যায়। শান্তও হয়ত নিজের মতন সব গুছিয়ে নিতে পেরেছে।
এখন সময় গুলো ভিন্ন, আমার পাশের-কাছের মানুষগুলোর তালিকা ভিন্ন। আমার শাহরিনের সাথে আর কখনও দেখা হয় নি। কোথায়, কেমন আছে জানি না। প্রান্ত ভাইকে আমার ফোন দেয়া হয় না। মোবাইল হারিয়ে তার নাম্বারটাও হারিয়ে ফেলেছিলাম। এর মাঝে হুট করে একদিন আমাকে ফোন করে বলেছিলেন, “আমার এখানে একটা পোস্ট খালি আছে, জয়েন করবি?”
তত দিনে তো আমি ওসব ছেড়ে বহু দূরে। আমার জয়েন করা হয় না। শান্তও নিজের কাজ, জীবন নিয়ে হয়ত ব্যস্ত। আমাকে আর প্রয়োজন পড়ে না। ফোন দেয় না।
জীবন গুলো এভাবেই চলে, সময়ের সাথে চারপাশ বদলে যায়। একটা সময় যাকে ছাড়া থাকা অসম্ভব মনে হয়, কথা গল্প আড্ডায় যার সাথে জীবনের অনেকটা সময় কাটানো হয়, মানুষ একটা সময় পর তাকে ছাড়াই থাকতে শিখে যায়। অন্ধকার রাতে আকাশের তারাদের দিকে তাকালে যেমন, মিটিমিটি তারাদের অনেক চেনা তবু বহুদূরের অপরিচিত কিছু মনে হয়, ঠিক তেমনি সম্পর্কগুলোও আলো আঁধারের খেলায় পাশ কাটিয়ে বিবর্ণ হয়ে যায়। তবু ঐ সম্পর্কে জড়িয়ে থাকা মানুষ গুলোর সাথে দেখা হলে, কথা হলে, মনের কোণে যে ভালোলাগা কিংবা ব্যথার সূক্ষ্ম অনুভূতি নাড়া দেয়, তাই জানান দিয়ে যায়, এই মানুষটার সাথে আবেগ অনুভূতির অনেক কিছু মিশে ছিলো। সে মিশে যাওয়া অনুভবেরা মিহি কোমল স্মৃতি হয়ে সারা জীবন বুকের কোণে জমাট বেধে রয়।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ বিকাল ৪:১৩