somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

থ্রিলার: আঁধার ব্যথা

২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১১:২৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ফাস্ট ফুডের দোকানদারসহ দুই পুলিশকে খুন করে পালিয়েছে খুনি। ঝুম-বৃষ্টির মাঝে লাশগুলো পড়ে আছে, পুলিশের গাড়ি চলে এসেছে। খুনি আশেপাশে কোথাও থাকতে পারে, কিংবা পালিয়ে গেছে অনেক আগে। অন্য কোথাও।

রাত এখন দশটা। সকাল থেকে বৃষ্টি হচ্ছে। থেমেছিল গত রাতে, বৃষ্টি হচ্ছে গত তিন দিন থেকে এমন থেমে থেমে। খুব সাবধানে গাড়ি চালাতে হচ্ছে। মাঝে মাঝেই নিয়ন্ত্রণ রাখা কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। নাবিদের এ জীবনের প্রতি মায়া বলতে চলে গিয়েছে, তবুও অদ্ভুত কোনো কারণে গাড়ির নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাস্তার পাশের নদীতে পড়ে মরে যাবার কোনো ইচ্ছে নেই, মরে যাবার আরও অনেক পথ আছে। সিন্থিয়ার সাথে ঝগড়া করে চলে আসলো, উত্তরা থেকে আশুলিয়ার পথের দিকে যাচ্ছে।


সিন্থিয়া সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছে, বন্ধু বান্ধব ছাড়া সিন্থিয়ার পক্ষে থাকা সম্ভব না।
নাবিদ রাগ দেখিয়ে বলেছিল, “তাই যদি হবে, তবে তোমার বিয়ে করার কী দরকার ছিল?”
“তুমি বার বার কেন ওদের সাথে নিজেকে তুলনা করো বুঝতে পারি না। শুধু শুধু নিজেকে নিচে নামাও, নিজের ওয়েট নিজে কমাও। তুমি আর ওরা এক না।”
“তোমার এত বন্ধু কেন থাকতে হবে? আমার তো কোনো মেয়ে বান্ধবী নেই।”
“তোমার নেই, সেটা তোমার ব্যাপার। আমি না করছি না তোমার বান্ধবী থাকার ব্যাপারে। তোমার বান্ধবী থাকা মানেই এই না যে, তুমি ওদের সাথে গিয়ে এক বিছানায় গড়াগড়ি খাচ্ছ। স্বাভাবিকভাবে দেখো সব।”
“আমি স্বাভাবিকভাবে দেখতে পারি না সব। তোমার কোনো ছেলে বন্ধু থাকবে না, এটা আমার শেষ কথা।”
“আমার পক্ষে সম্ভব না তোমার কথা মানা।”


গাড়িটা কষে ব্রেক করল নাবিদ। একটা লোক সামনেই হাত উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে, রাস্তার মোটামুটি মাঝখানে বলা যায়। খেয়াল করেনি নাবিদ। আরেকটু হলে, লোকটার উপর দিয়েই গাড়ি উঠিয়ে দিচ্ছিল। লোকটা এগিয়ে আসলো, সাইড গ্লাস নামিয়ে লোকটার দিকে তাকাল নাবিদ। লোকটা রেইন কোট পরা। একটু সূক্ষ্ম চোখে দেখলে দেখা যাচ্ছে রেইন কোট কনুইয়ের কাছ দিয়ে ছেড়া। রাস্তার মাঝে আছাড় খেয়ে পড়ে গিয়ে ছিঁড়ে যাবার মতন দেখতে। নাবিদ জানতে চাইল, “কিছু বলবেন?”
লোকটা একটু নিচু হয়ে মুখমণ্ডলের পানি মুছতে মুছতে বলল, “একটু সাহায্য করতে পারবেন? আমার মোটর সাইকেলটা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পাশের নদীতে পড়ে দিয়েছে। আমি কোনোমতে লাফ দিয়ে বেঁচে গিয়েছি। আপনার গাড়িটায় একটু সামনে নামিয়ে দিলে উপকার হতো। মোটরসাইকেলের আশা করে আর লাভ নাই।”
নাবিদ লোকটার দিকে ভালো করে তাকাল। কয়েক বার করে দেখল। অন্ধকারে ভালো মত চেহারা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। কী যেন ভাবল নাবিদ। ভেবে বলল, “জ্বি উঠুন।”
লোকটা গাড়িতে পিছনে না বসে, উঠে নাবিদের পাশে বসল। সাধারণ ভদ্রতাসূচক ধন্যবাদটা পর্যন্ত দিলো না। অদ্ভুত লোক! গাড়ি চলতে লাগল। নাবিদ চালাতে চালাতেই বলল, “আপনি কোথায় যাবেন?”
লোকটা কোনো উত্তর করল না। এখনও রেইন কোট খোলেনি। ভেজা অবস্থায় সিটে বসে আছে। প্রতিবাদ করেনি নাবিদও। খানিক পর মাথার হুডিটা নামিয়ে নিল। চেহারাটা এখন স্পষ্ট। শরীরের তুলনায় মুখটা অনেক ছোটো, দুই পাশের গালে মাংস অনেক কম, সোজা বাংলায় বললে চাপা ভাঙ্গা। চোখের নিচে কালি পড়ে আছে, চোখে মুখে স্পষ্ট ক্লান্তির ছাপ। মুখ জুড়ে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি ক্লান্তি ভাব আরও ভালো করে ফুটিয়ে তুলছে। লম্বায় যেমন খাটো, হাত গুলোও তেমন ছোটো ছোটো। নাবিদ বেশ ভালো পর্যবেক্ষণ করল অল্প সময়ের মধ্যে। সৃজনশীল মানুষদের সবচেয়ে বড় গুণ হচ্ছে মানুষকে খুব মনোযোগ নিয়ে লক্ষ্য করা। এই ব্যাপারটা ভিতর থেকেই আসে। আপনি যখন আপনার আশেপাশের মানুষ গুলোকে বেশ সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করবেন, তাদের চলাফেরা, কথা বলার ধরণ, মুখের ভাব সাব খুব মনোযোগ নিয়ে দেখা শুরু করবেন, বুঝতে হবে আপনি গোয়েন্দা ধাঁচের কেউ কিংবা আপনার মাঝে সৃজনশীল কিছু আছে, আপনি কবি, লেখক, অভিনেতা কিংবা চিত্রশিল্পী।


নাবিদ চিত্রশিল্পী। সিন্থিয়ার চেয়েও বেশি নাবিদ ওর আঁকাআঁকি ভালোবাসে, আপন ভাবে। নাবিদের আঁকাআঁকিকে ভালো লেগেই, ভালোবেসেছিল সিন্থিয়া নাবিদকে। আঁকাআকির ব্যাপার নিয়ে কখনও সিন্থিয়া প্রতিবাদ করেনি বিয়ের পর, নাবিদ যখন আঁকত পাশের ঘরে বসে সিন্থিয়া ফোনে কথা বলত। নাবিদ বেশিক্ষণ মনোযোগ ধরে রাখতে পারত না, আঁকার চেয়ে মনোযোগের মাত্রা বেশি থাকত এ বিষয়টা খোঁজাতে, আসলে কার সাথে কথা বলছে সিন্থিয়া। মাঝে মাঝে আঁকা ছেড়ে চুপচাপ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকত লুকিয়ে, শুনতে চেষ্টা করত সিন্থিয়া কী বলে, কার সাথে কথা বলে। হুট করেই ঘরে ঢুঁকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকত সিন্থিয়ার দিকে। সিন্থিয়ার মাঝে তেমন কোনো ভাবান্তর হতো না, শুধু হাসি মুখে বলত, “আচ্ছা রাখি রে। নাবিদ চলে এসেছে, পরে কথা বলব তোর সাথে।”
এরপরের সময়টা গতানুগতিক তর্ক-বিতর্ক দুজনের মাঝে। নাবিদের অভিযোগ, “তোমার কেন ছেলে বন্ধুদের সাথে এত কথা বলতে হবে?”
সিন্থিয়ার স্বভাব সুলভ জবাব, “আমি কথা না বলে থাকতে পারব না। বিয়ে করেছি মানেই এই না, আমি অসামাজিক হয়ে যাব, সব বন্ধুদের ছেড়ে দিয়ে তোমার কোলের মধ্যে বসে থাকব।”


“সামনে একটা পুলিশ চেক পোস্ট আছে। সিগন্যাল দিলে থামাবেন না।”
থমথমে গলায়, নাবিদের পাশে বসা লোকটা বলল। নাবিদ আবার একটু চোখ ছোটো করে, ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে দেখল লোকটাকে। লোকটার মাঝে কিছু একটা সমস্যা আছে। সে সমস্যায় ফেঁসে যাচ্ছে না তো নাবিদ? নাবিদ একটু জোরের উপর জানতে চাইল, “কেন থামাব না?”
লোকটা ভাবলেশহীন ভাবে বলল, “বললাম তাই থামাবেন না। থামালে আপনারই বিপদ।”

নাবিদের বুকটা হুট করেই থক করে উঠল, একটা হৃদস্পন্দন বিরতি নিলো বলে মনে হলো। নাবিদ চুপ করে লোকটার দিকে আড়চোখে তাকাল। লোকটা রেইন কোটের পকেট থেকে একটা চকচকে চাকু বের করে বলল, “আশা করি এখন কথাগুলো বুঝতে সমস্যা হচ্ছে না, সমস্যা হলে আমিও সমস্যা করব, ঠিক আছে?”
নাবিদ একটা ঢোঁক গিলল, ভয় পেল কিনা নিজেই বুঝতে পারল না। বেড়িবাঁধের মোড়ে সত্যি একটা পুলিশ চেকপোস্ট পড়ল, লোকটার কথা মতন, গাড়িটার গতি বাড়িয়ে দিলো। টহল পুলিশদের এই বর্ষার মাঝে বৃষ্টি ভিজে গাড়ি চেক করার মতন ইচ্ছা হলো না। তারা রেইন কোট পরে ছাতা মাথায় দিব্বি দাঁড়িয়ে আছে। কোনো রকম নির্দেশ প্রদান করল না গাড়ি থামাবার জন্য। নাবিদও সাঁই করে গাড়িটা চেক পোস্ট পেরিয়ে নিয়ে গেল। পাশ থেকে লোকটা বলল, “ভয় পেয়েছেন আপনি?”
নাবিদ চমকে আবার লোকটার দিকে আড়চোখে চেয়ে বলল, “ভয় পাব কেন? ভয় পাবার কী আছে?”
লোকটা একটা শুকনো হাসি মুখে এনে বলল, “আমি জানতাম পুলিশ এই বৃষ্টির মাঝে চেক করার ঝামেলায় যাবে না। তবুও সতর্কতা আর কী! আর আপনাকে আমার ভয় দেখাবার কোনো ইচ্ছা ছিল না। আপনিই একটু তর্ক জুড়ে দিলেন, তাই আমিও জিনিসটার একটু ঝলক দেখালাম। আর কিছুই না।”
“আপনি যাবেনটা কোথায় বলেন তো?”, কিছুটা বিরক্ত গলায় জিজ্ঞেস করল নাবিদ।
লোকটা আবার সেই শুকনো হাসি হেসে, একটু আড়মোড়া ভেঙে বলল, “এই বৃষ্টি বাদলার দিনে আর কই যাব? আপনি যেখানে যান, আমিও সেখানে যাই। সকালে বৃষ্টি থামলে না হয় দেখা যাবে।”

নাবিদ একটু কড়া ভাষায় কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু কল্পনায় চকচকে চাকুটার ছবি ভেসে উঠতেই নিজেকে সামলে নিলো। নয়ত বলেই দিত, “আপনি আমার গাড়ি থেকে নামেন, এই মুহূর্তে নামেন। ফাজলামি না-কি? আপনি আমার সাথে যাবেন কেন?”
নাবিদের তা বলা হলো না। বরং ভয় কাটিয়ে একটু স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে বলল, “আমি তো যাব আশুলিয়াতে। আমার বাসা ওখানে।”
লোকটা স্বাভাবিক গলায় বলল, “কে কে থাকে ওখানে?”
“আমি একাই। উত্তরাতে আরেকটা বাসা আছে, ওখানে বউ থাকে।”
“আচ্ছা তাহলে আর কী! আমি গেলে কোনো সমস্যা নেই। গাড়ি চালান।”

এরপরের সময়টা, চুপচাপ দুজনেই। নাবিদ নীরবে গাড়ি চালাতে লাগল, একজন অস্বাভাবিক মানুষকে পাশে করে নিয়ে।
নাবিদের পাশের লোকটা থমথমে বলায় হুট করেই বলল, “আমি আসার সময় দেখলাম এক ফাস্ট ফুডের দোকানদার আর দুজন পুলিশকে কে যেন খুন করে রেখে এসেছে।”
পকেট থেকে ছুরিটা বের করে বলে গেল, “হয়ত এমন একটা ছুরি দিয়েই, হাহাহা।”
নাবিদ এক দৃষ্টিতে লোকটার দিকে তাকিয়ে রইল। ভয়ের একটা শিহরণ মেরুদন্ড বেয়ে নেমে গেল। হাত পা কাঁপছে নাবিদের। গাড়ির সামনের উইন্ডশিল্ড ওয়াইপারটা তুমুল বৃষ্টির পানি সরিয়ে নেবার প্রাণপণ চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছে, নাবিদও তেমন খুব করে মন থেকে ভয়টাকে তাড়াবার চেষ্টায় ব্যর্থ। লোকটা আবার শব্দ ছাড়া সে হাসি হেসে, রেইন কোটের হাতা দিয়ে ঠোঁটের উপর দিকটা মুখে বলল, “ভয় পেয়েছেন?”
নাবিদ গাড়ির গতি বাড়িয়ে বলল, “কই না তো।”
“আপনার সাথে এমন কিছু হবে না, ভয় পাবেন না।”
বলে লোকটা চুপ হয়ে গেল, এরপর আর একটা শব্দও উচ্চারণ করলো না, বাকি পথটুকুতে। নাবিদও চুপচাপ গাড়ি চালিয়ে পাশের একটা রাস্তা দিয়ে ঢুকিয়ে দিলো। এ রাস্তা ধরে খানিক দূর গেলেই নাবিদের বাসা। এখানেই বেড়ে উঠেছে ছেলেবেলা থেকে। বাবা মা মারা যাবার পর থেকে এ বাড়িটা খালিই পড়ে আছে। প্রায় বছর খানেক পরে বাড়িটায় আসা। বাড়িটার সামনে এসে গাড়ি থামাল নাবিদ। বৃষ্টি থামেনি তখনও। লোকটাকে বলল নাবিদ, “চলে এসেছি আমরা, এটাই আমার বাড়ি।”
লোকটা কিছু না বলে নেমে আসলো। নাবিদ গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে লোকটাকে, মতিগতি বোঝবার চেষ্টা করছে। এমন কি হতে পারে, লোকটা খুব ভয়ংকর কোনো খুনি? বা এমনও হতে পারে, লোকটা মিছে মিছে ভয় দেখাচ্ছে নাবিদকে। বলা যায় না, কোন মানুষের মনে কী চলে। কে খুব ঠান্ডা মাথার খুনি, কে ভয়ংকর রাগের পিছনে বেশ নিরীহ গোছের এক ব্যক্তি?



ফাস্ট ফুডের দোকানটার নাম, আলিম স্ন্যাঙ্কস। ছোটোখাটো একটা দোকান। তাতে বার্গার, স্যান্ডুইচ জাতীয় খাবারের সাথে কফি বিক্রি হয়। এ দোকানের দোকানদার আলিমুজ্জামানসহ রাস্তায় টহল দেয়া দুই পুলিশ খুন হয়েছে। খুন হবার পর আগে আগে, ওয়াকি টকিতে একজন পুলিশ শেষবারের মত বলার চেষ্টা করছিল খুনির ব্যাপারে। কথা শেষ করতে পারেনি পুলিশটা। খুনের পর পুলিশ সেখানে এসে খুনির কোনো চিহ্ন খুঁজে পায়নি। তবে আশার ব্যাপার হলো, ফাস্ট ফুডের দোকানে একটা ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা ছিল। ক্যামেরার ক্ষমতা অতি জঘন্য, তার উপর টানা তিন দিনের বৃষ্টি, খুনের ঘটনার সব স্পষ্ট দেখা গেলেও, খুনির চেহারা বোঝা যাচ্ছে না। তবে যা পেয়েছে তাতেই কাজ চলবে। খুনের ধরণ দেখে মনে হচ্ছে, লোকটার মাথায় কোনো গণ্ডগোল আছে। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, কারণ ছাড়াই খুন করছে তিন জনকে। আশেপাশে তিনজন ছিল, তিনজনকেই খুন করল। আরও কেউ থাকলে তাদেরও করত।


“আমি প্রায় বছর খানেক পরে এখানে আসলাম। খাবার কিন্তু নেই কিছু। রাতে আপনার না খেয়ে থাকতে অসুবিধা হবে?”
নাবিদের কথা লোকটার মাঝে কোনো প্রভাব ফেলল না। হাতে চকচকে চাকুটা নিয়ে সোফায় বসে আছে লোকটা। নাবিদ খানিকটা সামনে একটা চেয়ারে। নাবিদ একটু পর পর এটা ওটা বলছে। মানুষকে তার উদ্দেশ্য থেকে, চিন্তা থেকে সরিয়ে নেবার সবচেয়ে বড় উপায় হলো, তার সাথে অনবরত কথা বলা। কিন্তু লোকটার সাথে কথা ঠিক জমে উঠছে না, লোকটা এদিক ওদিক দেখছে। মনোযোগ দিয়ে এপাশ ওপাশ পর্যবেক্ষণ করছে ঘরের ভিতর। নাবিদ একটু সামনে ঝুঁকে বলল, “ভাই, আপনি তো আজ আমার সাথে থাকছেন। দুজন মানুষ একসাথে থাকছি, একটু আধটু পরিচিত না হলে হয় বলেন?”
লোকটা চাকুটা নাবিদের মুখের সামনে এনে বলল, “পিছনে যান। যা বলার দূর থেকে বলেন।”
নাবিদ দূরে সরে গেল।
“আচ্ছা সরে এলাম। চলেন দুজন একটু পরিচিত হই।”
“আপনি এত কথা বলছেন কেন? প্রথম দিকে আপনাকে দেখে মনে হয়নি এত কথা বলতে পারেন।”
“যাই হোক না হোক, আপনি তো থাকছেন এখানে। তাই ভাবলাম একটু কথা বলি।”
“কথা নাই কোনো। চুপচাপ বসে থাকেন। কথা বললে, জিব কেটে দিব।”

শান্ত গলার কথাটায় নাবিদের বুকের ভিতর আবার ধক করে উঠল। নাবিদ চুপ করে রইল। কেমন একটা অস্বস্তিকর থমথমে পরিবেশ। যেকোনো সময় যেকোনো কিছু ঘটে যেতে পারে। খানিক পরে লোকটাই বলা শুরু করল, “আমার নাম মারুফ। আপনার?”
“নাবিদ।”
“আজ বিকালে চাকুটা কিনলাম। কয়েকটা খুন হবে এই চাকু দিয়ে। রাগ উঠলেই খুন। আপনার কি আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে?”
“জি হচ্ছে।”
“রাগ উঠলেই খুন, আর কোনো কিছু ভাববার সময় নাই।”
নাবিদ কী বলবে ভেবে পায় না। একটু থেমে থেমে বলল, “আমার উপর কি আপনার রাগ উঠেছে? “
মারুফ হেসে বলল, “মাঝে মাঝে উঠছে আবার কমেও যাচ্ছে।”

নাবিদের চোখ জুড়ে ঘুম এসে ভর করেছে। বড় ক্লান্ত নাবিদ। কিন্তু এমন ভয়ংকর কাউকে ঘরে রেখে ঘুমিয়ে পড়াটা বুদ্দিমানের কোনো কাজ হবে না। যেকোনো সময় নাবিদ খুন হয়ে যেতে পারে। লোকটা নিজে থেকেই নানা কথা বলল। নাবিদ যখন জানতে চাইল, “আপনি কি কাউকে খুন করেছেন আজ পর্যন্ত?”
মারুফ শান্ত গলায় একটু রহস্য করে বলে, “করতেও পারি আবার নাও পারি। আগে খুন করলেও এখন খুন করতে পারব, না করলেও পারব।”
নাবিদ প্রসঙ্গ অন্য দিকে নিতে চায়। বলে যায়, “আপনি বলছিলেন যে আপনি আসার সময় দেখেছেন তিনজন মানুষ খুন হয়ে পড়ে আছে, ওটা কোথায় আসলে?”
মারুফ আবার হেসে বলল, “মিরপুরের দিকে, আর আপনার কি মনে হচ্ছে খুন গুলো আমিই করেছি, এই চাকুটা দিয়ে?”
নাবিদ সামলে নিয়ে বলে, “না না, আমি বলছি না যে আপনি খুন করেছেন। কী ভয়ঙ্কর খুনি, একবার ভেবে দেখেছেন?”
“অত ভাবার সময় নেই।”
“আচ্ছা তিনজনকে কে খুন করেছে, সেটা কি আপনি......।”
কথাটা শেষ করতে পারল না নাবিদ। মারুফের ভয়ংকর চাহুনিতে কথা থেমে গেল। বাহিরে তাকাল, এখনও বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির রেষ বেড়ে চলছে, ক্রমাগত। এই পরিবেশে কেউ খুন করে চলে গেলেও টের পাবে না, আশেপাশের কেউ। টের পাবার প্রশ্নও ওঠে না। আশেপাশে যে বাড়িঘর, তা অনেক দূরে। অত দূর থেকে চিৎকার কিংবা আর্তনাদ কিছুই শুনতে পাবার কথা না।

মারুফ বলে, “আমার মাঝে একটা পশু বাস করছে। গত চার রাত ধরে না ঘুমানোও মাথাও কাজ করছে না ঠিক মতন। আমি কি করছি না করছি, তার সম্পর্কে আমার নিজেরই কোনো ধারণা নেই।”
মারুফ সোফা ছেড়ে উঠে গেল। দাঁড়াল গিয়ে দরজা খুলে, বৃষ্টির আঁচ এসে লাগছে চোখে মুখে। নাবিদ পিছনে অমন ঠায় বসে রইল। বড় তৃষ্ণা পাচ্ছে। উঠে গিয়ে ব্যাগ থেকে পানি বের করে খেতেও কেমন যেন ভয় লাগছে। মনে হচ্ছে, এই বুঝি মারুফের মাঝের পশুটা জেগে ওঠে। খুন করে বসে নাবিদকে।
রাত এখন আড়াইটা, মারুফের মাঝে ঘুমের কোনো নাম-গন্ধ নেই। নাবিদের প্রচণ্ড ঘুম চোখে।

মারুফ মুখ ঘুরিয়ে জানতে চায়, “আমি যদি এখন আপনাকে খুন করি, তার আগে যদি বলি আপনার শেষ ইচ্ছেটা কী? আপনার উত্তর কী হবে?”
নাবিদ যেন উত্তর ঠিক করেই রেখেছিল, “একটা ছবি আঁকতে চাইব।”
মারুফ একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, “বউয়ের সাথে কথা বলতে চাইবেন না?”
“আমি আমার আঁকাআঁকিকে আমার বউয়ের চেয়েও বেশি ভালোবাসি।”
মারুফের মেজাজ কেন যেন বিগড়ে গেল কথাটা শুনে। ছুটে এসে সোফার সামনের টেবিলে সজোরে একটা চাপড় দিয়ে বলল, “কীসের আঁকাআঁকিরে বাইন**”
বলেই নাবিদের নাকের মধ্যে একটা সজোরে আঘাত করল হাত দিয়ে মারুফ। গলগলিয়ে রক্ত পড়ছে নাক দিয়ে নাবিদের। নাবিদ ভাবনাহীনভাবে নাক চেপে ধরে কোঁকাতে লাগল। মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছে না। মারুফ চিৎকার করে বলে, “মেয়েদের সম্মান করতে জানিস না, বিয়ে করছিস কেন? তোর ঐ বালের আঁকাআঁকি নিয়াই থাকতি। মরার আগে বউয়ের সাথে কথা বলবি না কেন তুই? তোর কথা বলতে হবে। ফোন দে তুই। এই মুহূর্তে ফোন দে। নয়ত কল্লা কাইটা ফেলব এখনি।”

নাবিদ উঠে দাঁড়াল। মারুফ আবার চিৎকার করে ওঠে, “দাঁড়াইলি কেন তুই? ঐ বাইন** দাঁড়াইলি কেন তুই?”
নাবিদ থেমে থেমে বলল, “আমার মোবাইলটা ব্যাগের মধ্যে, নিয়ে আসি। কল করব সিন্থিয়াকে।”
“সিন্থিয়া কে?”
“আমার বউ।”
“চুপচাপ বসে থাক। কোথাও যাবি না। কাউকে কল করতে হবে না।”
নাবিদ বসে পড়ল। মারুফ আবার খিটমিটিয়ে নাবিদের দিকে এসে মুখের মধ্যে আর একটা ঘুষি বসিয়ে দিলো।
“কাঁচা চিবিয়ে খেতে ইচ্ছা করছে তোকে। মাথায় রক্ত উঠে গেছে আমার।”
নাবিদ বুঝে উঠতে পারছে না, কী অপরাধ করল নাবিদ। বুকের ভিতর ধুকপুক করছে ভয়ে যতবার চাকুটা চোখে পড়ছে।
মারুফ বারবার চাকুটা সামনে ঘুরাচ্ছে। রাগে রাগে বলছে, “এই যেগুলা মানুষ আঁকে আর লেখে এদের আমার দেখলেই খুন করতে ইচ্ছা করে। আঁকতে পারলেই মানুষ ভালো হলো, লিখতে পারলেই ভালো হলো? মেয়েগুলা এগুলার পিছনেই ছুটবে। আমার নিশিটাও একটা লেখককে পেয়ে, বাহ কী সুন্দর পটে গেল, আমাকে রেখে। বাহ।”
বলে নাবিদের চুল ধরে ছিটকে মেঝের উপর ফেলে দিলো। নাবিদ কোনোমতে সামলে উঠে দাঁড়াল।
মারুফ অন্য দিকে তাকিয়ে বলল, “যা ফোন নিয়ে আয়, কল কর।”
নাবিদ চুপচাপ হেঁটে গিয়ে, খানিকটা দূরে থাকা ব্যাগ থেকে, মোবাইলটা বের করল। শেষ কল করবে সিন্থিয়াকে।



ভোর পাঁচটা বেজে দশ মিনিট। নাবিদের আশুলিয়ার বাসার সামনে পুলিশের গাড়ি এসে থামল। বৃষ্টি ভেজা রাস্তায় আসতে কম বেগ পেতে হয়নি। অতি সাবধানে পুলিশের বাড়িটার মধ্যে প্রবেশ করতে হবে।
নাবিদ রঙ তুলি নিয়ে ছবি আঁকছে। প্রায় শেষের দিকে ছবি আঁকা। রক্তাক্ত মৃত মানুষের ছবি। মাত্র একটা গুলি খরচ করতে হয়েছে মারুফের জন্য। এক গুলিতেই শেষ। আরও একটা গুলি বাকি আছে বন্দুকে। এক দিনে পাঁচটা খুন করা কম কথা নয়। মারুফের জন্য লাগল একটা গুলি, দুই পুলিশ আর ফাস্ট ফুডের দোকানদারের জন্য লেগেছে চারটা গুলি, একটা গুলি হয়েছিল লক্ষ্যভ্রষ্ট। এখনকার টহলদার পুলিশদের এই এক সমস্যা। অ্যাকশনের জন্য প্রস্তুত থাকে না। দুই পুলিশে দুই গুলি খেয়ে মরে গেল। ফাস্ট ফুডের দোকানদার এক গুলি থেকে বেঁচে গেলেও, পরের গুলিতে কাজ সাবাড়। এই তিন জনকে খুন করার কোনো কারণ ছিল না নাবিদের। একটু থ্রিল আনল জীবনে। এই তিনজনের আগের জনকে খুনে কোন থ্রিলই ছিল না। সিন্থিয়া কথা কাটাকাটি করল, সিন্থিয়ার বন্ধু ছাড়া চলবে না, কোনোভাবেই না। নাবিদও ওর বন্ধুদের মেনে নিবে না। হাতের কাছে একটা চাকু পেয়ে তেড়ে গেল সিন্থিয়ার দিকে। সিন্থিয়া বলে, “খুন করবে আমাকে? করো, করো। করলেই তো তোমার ঝামেলা শেষ।”
সত্যি সত্যি ঝামেলা শেষ করে দিলো। এখন ঘুরে বেড়াক, কথা বলুক, যত খুশি বন্ধুদের সাথে। লাশটা ফেলে বাসায় আসার সময়, রাস্তায় ফাস্ট ফুডের দোকানের কাছে বৃষ্টির দিনে দুই টহলদার পুলিশ, ফাস্ট ফুডের দোকানদার তিন জনকে মেরে দিলো। আশেপাশে কেউ ছিল না বৃষ্টির রাতে। ভেবেছিল একটা যুদ্ধ হোক, মরে যাক নাবিদ। তেমন কিছুই হলো না। শেষটায় ভেবেছিল মারুফ বোধহয় মেরে দিবে, তাও হলো না। নাকে মুখে দুইটা ঘুষি, আর মোবাইল আনার কথা বলে পিস্তল বের করে গুলি করার পর নাবিদের পায়ের কাছে একটু আঘাত চাকু দিয়ে, এই পর্যন্তই। নাবিদ এখন নিশ্চিন্তে ছবি আঁকছে। বাগড়া বাধাচ্ছে পুলিশ।

পুলিশ ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা থেকে নাবিদের ছবিটা দেখে, নাবিদের বাসায় যায়। নাবিদ পরিচিত মুখ মোটামুটি অঙ্কনশিল্পী হিসাবে। ঠিকানা খুঁজে বের করাটা কঠিন ছিল না। বাসায় গিয়ে পাওয়া যায় সিন্থিয়ার লাশ। শেষ কাজটা বোধহয় ছিল এটাই, খুঁজে দেখা নাবিদের এই বাসাটায়। সেটায় পুলিশ সফল। নাবিদের আঁকা প্রায় শেষ। আর একটা গুলি জমে আছে পিস্তলে। আর একটা ছবি আঁকার উপলক্ষ হোক। সজোরে একটা পিস্তলের গুলির শব্দ হলো। মারুফের পাশে আর একটা লাশ পড়ল। আর একটা ছবি আঁকা হবে, রক্তের রঙে, খুব অন্ধকারে, ব্যথা ব্যথা তুলিতে।

১৭-০৪-২০১৭
রিয়াদুল রিয়াদ

সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১১:২৩
৫টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বিপ্লবের নিঃশব্দ মূল্য: অর্থনৈতিক বৈষম্য ও বাংলাদেশি ছাত্র আন্দোলন

লিখেছেন মুনতাসির, ১২ ই অক্টোবর, ২০২৪ সকাল ৯:২৫

এ লেখাটি বেশ বড়ো। এখানে ছোট করে দেয়া হল। পুরো লেখাটি যদি কেও পড়তে চান, তবে নীচের লিঙ্ক থেকে পড়তে পারবেন।


সাম্প্রতিক ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে হতাহতের সংখ্যা নিয়ে বিভিন্ন পর্যালোচনা চলছে। জাতিসংঘের... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিরহ

লিখেছেন গোধুলী বেলা, ১২ ই অক্টোবর, ২০২৪ সকাল ৯:৪৪

একটি কবিতা লিখা হবে বাদে কিছুক্ষণ
মেঘমালারা বারি পাত করিছে ক্ষণে ক্ষণ।
গগনভেদি কামান গোলা পরিছে মুহুর্মুহু
দুরুদুরু ভয়েতে কাপিছে বুক বাদ যায়নি কেহ।

জানালার পাশে  প্রেমিকার ছলছল চোখ
বৃষ্টিরো সাথে সে কেঁদে  ভাসাইছে বুক।
হাজারো... ...বাকিটুকু পড়ুন

কিছু কিছু মানুষ বলার শুরু করেছে, "আমরা আগেই ভালো ছিলাম"।

লিখেছেন সোনাগাজী, ১২ ই অক্টোবর, ২০২৪ দুপুর ২:০২



একাধিক কারণে মানুষ ইহা বলার শুরু করেছেন: (১) সাধারণ মানুষ কোমলমতিদের ক্রমেই চিনতে পারছেন, ইহা ভীতি ও অনিশ্চয়তার সৃষ্টি করছে; কোমলমতিরা সরকারের গুরুত্বপুর্ণ অনেক পদে আছে ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি - একাল সেকাল

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ১২ ই অক্টোবর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৮



টানা বৃষ্টির মধ্যে মরিচের দাম বেড়ে হয়েছে ৪০০ টাকা কেজি । অন্যদিকে ফার্মের মুরগির এক পিছ ডিমের দাম বেড়ে হয়েছে ১৫ টাকা।শুধু মরিচ নয়,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কমলা যদি পরাজিত হয়, "দ্রব্যমুল্য"ই হবে ১ নম্বর কারণ

লিখেছেন সোনাগাজী, ১২ ই অক্টোবর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৩৭



দ্রব্যমুল্য হচ্ছে অর্থনৈতিক সুচকগুলোর ১ টি বড় প্যারামিটার; ইহা দেশের অর্থনীতি ও চলমান ফাইন্যান্সের সাথে সামন্জস্য রেখে চলে; টাস্কফোর্স, মাস্কফোর্স ইহার মুল সমাধান নয়; ইহার মুল সমাধন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×