খ্রিষ্টান ধর্মের বাইবেল গ্রন্থ ঈশ্বরের কথা কি না এটা নিয়ে মুসলমান ও খ্রিস্টান পণ্ডিতদের মধ্যে অনেকবার আনুষ্ঠানিক বিতর্ক হয়েছে। এই বিষয়ের উপর প্রখ্যাত ইসলামি পণ্ডিত আহমেদ দিদাদ অনেক খ্রিস্টান পণ্ডিতের সাথে একাধিকবার বিতর্ক করেছেন। ১৯৮৬ সালে খ্রিস্টান প্যাসটর Stanley Sjoberg এবং আহমাদ দিদাদের মধ্যে অনুষ্ঠিত একটি বিতর্কে আহমেদ দিদাদ বাইবেলের লেখা থেকেই দেখিয়ে দিয়েছেন যে বাইবেল আল্লাহর কথা না। বিতর্কটি এই লিঙ্কে পাবেন। Is The Bible The Word of God? - Debate - Sheikh Ahmed Deedat VS Pastor Stanley Sjoberg
আহমেদ দিদাদের এই বিষয়ের উপর আরেকটা লেখা আছে। যেটার নাম ইজ দা বাইবেল গডস ওয়ার্ড? IS THE BIBLE GODS WORD? এই বইয়ে উনি যথারীতি প্রমাণ করেছেন যে আসলে বাইবেল আল্লাহর কথা না বরং এটি কয়েকজন খ্রিস্টান পণ্ডিতের জিশু, ঈশ্বর ও খ্রিস্টধর্ম সংক্রান্ত বর্ণনার সমষ্টি। এটা অনেকটা মুসলমানদের হাদিসের মত। মুসলমানরা শুধু সহি হাদিসকে মেনে চলে এবং দুর্বল ও জাল হাদিস পরিহার করে। কিন্তু খ্রিস্টানদের বাইবেলের কোন বর্ণনাগুলি সঠিক এটা নিয়ে খ্রিস্টানদের মধ্যেই বিতর্ক আছে। কারণ এখন পর্যন্ত ইন্টারনেটেই বাইবেলের প্রায় ৬২ রকমের ভারশন পাওয়া যায়। এক ভারশনের সাথে অন্য ভারশনের অনেক ক্ষেত্রে শব্দ ও বাক্যে অমিল পাওয়া যায়।
এছাড়া ব্যাপ্টিস্ট মিনিস্টার এবং লেখক উইলিয়াম গ্রাহাম স্ক্রগির একটা বই আছে যেটার নাম 'ইস দা বাইবেল ওয়ার্ড অব গড'? Solid Christian Books তার বইয়ের ১৭ পৃষ্ঠায় এই ব্যাপ্টিস্ট মিনিস্টার বলেছেন যে
It is Human, yet Divine ( এটি মানুষের রচনা, তারপরও স্বর্গীয়)-
"Yes, the Bible is human, though some, out of zeal which is not according to knowledge, have denied this. Those books have passed through the minds of men, are written in the language of men, were penned by the hands of men, and bear in their style the characteristics of men." অর্থ (“হ্যাঁ, বাইবেল মানুষের রচনা, যদিও অনেকেই জ্ঞান বিবর্জিত আবেগের কারণে এই কথা অস্বীকার করেছেন। বাইবেলের এই বইগুলি মানুষের মনে বিচরণ করেছে, মানুষের ভাষায় লেখা হয়েছে, মানুষের হাতে লেখা হয়েছে এবং এটার স্টাইল মানুষের বৈশিষ্ট্য বহন করে।“)
বাইবেলের ৬২ রকমের ভারশন ইন্টারনেটেই খুঁজে পাওয়া যায় biblegateway। এক ভারশনের সাথে অন্য ভারশনের অনেক ক্ষেত্রেই শব্দ ও বাক্যের ক্ষেত্রে অমিল আছে। একজন খ্রিস্টানের পক্ষে বলা সম্ভব না কোন ভারশনটা সঠিক।
কয়েক ধরণের বাইবেল সম্পর্কে একটু আলোচনা করা যাক।
১। ক্যাথলিক বাইবেল-Roman Catholic Version (RCV)
১৫৮২ সালে ফ্রান্সের শহর রেইমসে ক্যাথলিক বাইবেল প্রথম ছাপা হয়। এটি মোট ৭৩ টি বইয়ের সমষ্টি। কিন্তু প্রটেস্টান্টরা বলে থাকে যে এই বাইবেলে ৭ টা অতিরিক্ত বই (অধ্যায়) আছে, যা তারা মানে না। যেমন দা বুক অব জুডিথ, দা বুক অব তবিয়াস ইত্যাদি।
২। প্রটেস্টান্ট বাইবেল Authorized Version (AV) or King James Version (KJV)
এটাকে কিং জেমস ভারশনও বলে। এটা ১৬১১ সালে প্রকাশিত হয়। ক্যাথলিকরা মনে করে যে প্রটেস্টান্টরা এটাকে বিকৃত করেছে। এই বাইবেলে মোট ৬৬ টি বই (অধ্যায়) আছে। এই বাইবেল অনেকবার রিভাইজ করা হয়। যেমন ১৮৮১ সালে এটার নাম হয় Revised Version (RV), ১৯৫২ সালে নাম হয় Revised Standard Version (RSV), ১৯৭১ সালে আবার রিভাইজ করা হয় নাম যদিও থাকে Revised Standard Version.
এছাড়াও বাইবেলের অন্তরজালে পাওয়া ৬২ রকমের ভারশনের মধ্যে আরও কিছু ভারশনের নাম হোল;
১। নিউ ইন্টারন্যাশনাল ভারশন
২। অ্যামেরিকান ষ্ট্যাণ্ডার্ড ভারশন
৩। খ্রিস্টান ষ্ট্যাণ্ডার্ড বাইবেল
৪। ইজি টু রিড ভারশন ইত্যাদি
১৯৭১ সালের Revised Version এর ভুমিকার দুই জায়গাতে আগের ‘কিং জেমস ভারশন’ এর ত্রুটি এভাবে তুলে ধরা হয়েছে।
"YET THE KING JAMES VERSION HAS GRAVE DEFECTS." এবং
"THAT THESE DEFECTS ARE SO MANY AND SO SERIOUS AS TO CALL FOR REVISION . . ."
অর্থঃ “তথাপি কিং জেমস ভারশনে বড় ত্রুটি আছে।“ এবং
“ এই ত্রুটিগুলির সংখ্যা এত বেশী এবং সেগুলি এত গুরুতর যে কারণে রেভিশন প্রয়োজন হয় ….. “
আহমাদ দিদাদ উপরে উল্লেখিত তার বইয়ে ( ইজ দা বাইবেল ওয়ার্ড অব গড?) লিখেছেন যে খ্রিস্টানদের একটি শাখা ‘জেহোভাস উইটনেস’ রা মনে করে যে কিং জেমস ভারশনে ৫০,০০০ ভুল আছে। প্রমাণ হিসাবে এই সাইটটি দেখতে পারেন। 50,000 Errors and Biblical contradictions
এই সাইটে এই ব্যাপারে অনেক উদাহরণ তুলে ধরা হয়েছে। কিছু উদাহরণ আমি উল্লেখ করছি;
তাদের দাবি অনুযায়ী,
১। জেনেসিস ১:৩১ এ বলা হয়েছে God is satisfied with his works।
কিন্তু জেনেসিস ৬:৬ এ বলা হয়েছে God is dissatisfied with his works।
২। Chron 7:12, 16 – God dwells in chosen temples
Act 7:48 – God dwells not in temples
এভাবে আরও অজস্র উদাহরণ তারা দিয়েছে উপরে উল্লেখিত সাইটে।
বাইবেলের ৬২ রকমের ভারশন বর্তমানে অন্তরজালে সহজে পাওয়া যায় (হয়তো আরও আছে)। বিভিন্ন সংস্করণের মধ্যে অনেক ক্ষেত্রে শব্দের ও বাক্যের পার্থক্য দেখা যায়। যেমন -
জন ৫:৭ এর শ্লোকের উদাহরণ যদি দেখি, তাহলে পাই;
King James Bible
For there are three that bear record in heaven, the Father, the Word, and the Holy Ghost: and these three are one.
একই শ্লোক আরেক জায়গায় আছে;
Revised Standard Version
And the Spirit is the witness, because the Spirit is the truth.
উপরে উল্লেখিত শ্লোকগুলিতে আগের ভারশনে ট্রিনিটির ( পিতা, পুত্র এবং পবিত্র আত্মা) কথা থাকলেও পরের ভারশনে ট্রিনিটির উল্লেখ নেই, শুধু পবিত্র আত্মার কথা বলা হয়েছে। আমাদের কোরআন শরিফে পরিষ্কারভাবে এই ট্রিনিটির উপর আপত্তি স্থাপন করা হয়েছে।
"আর একথা বলো না যে, আল্লাহ্ তিনের এক, একথা পরিহার কর; তোমাদের মঙ্গল হবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ এক ও অদ্বিতীয়।" ( সুরা নিসা, আয়াত ১৭১)
খ্রিস্টানরা তাদের আগের ভারশনের ভুল কথা/ দাবি তাদের পরবর্তী ভারশনে সংশোধন করেছে সমালোচনার কারণে। প্রকারান্তরে কোরআনের কথাই যে সত্যি তা মেনে নিয়ে তারা তাদের নতুন ভারশনে ট্রিনিটিকে বাদ দিয়ে দিয়েছে। এই ভুল কথা বা মিথ্যা দাবি আল্লাহ ১৪০০ বছরে আগেই বলে দিয়েছেন সুরা নিসার ১৭১ নং আয়াতে ( উপরে উল্লেখ করা হয়েছে)।
জন ৩:৬ শ্লোকটির ক্ষেত্রে আগের সংস্করণে begotten ( বাইওলজিকালি জন্ম হওয়া)শব্দটি থাকলেও পরের ভারশনে এই শব্দটি বাদ দেয়া হয়। কারণ এটা নিয়ে অনেক বিতর্ক হয়েছিল। আল্লাহ বায়লজিকালি পুত্রের পিতা এটা অনেকের পক্ষেই আপত্তিকর ছিল।
জন ৩:৬ শ্লোকটি আগের ভারশনে আছে এভাবে ;
For God so loved the world, that he gave his only begotten Son, that whosoever believeth in him should not perish, but have everlasting life.
Begotten son মানে এখানে বুঝানো হয়েছে যে আল্লাহ বায়লজিকালি সন্তানের পিতা হয়েছেন। এই কথার প্রতিবাদ স্বরূপ কোরআনের আয়াতে বলা হয়েছে যে আর তারা বলে, "পরম করুণাময় সন্তান গ্রহণ করেছেন। তোমরা তো এমন এক বীভৎস বিষয়ের অবতারণা করছ" ( সুরা মারিয়াম, আয়াত ৮৮-৮৯)
এইসব কারণে বাইবেলের নতুন অনেক ভারশনে জন ৩:৬ শ্লোকটিকে অন্যভাবে বর্ণনা করা হয়েছে;
For God so loved the world that he gave his one and only Son, that whoever believes in him shall not perish but have eternal life. (New International Version)
এখানে begotten son বলা হয় নাই। অর্থাৎ জিশুকে আল্লাহর বায়োলজিক্যাল পুত্র বলা হয় নাই। মেরিয়াম ওয়েবেসটার অভিধান অনুযায়ী Son of God বলতে বুঝায়;
১। a superhuman or divine being (such as an angel)
২। MESSIAH (the promised deliverer of the Jewish nation prophesied in the Hebrew Bible)
৩। a person established in the love of God by divine promise
অর্থাৎ আগের ভারশনে জিশুকে আল্লাহর বায়োলজিক্যাল পুত্র বলা হলেও বর্তমান ভারশনে সংশোধন করে বলা হচ্ছে যে জিশু একজন super human বা মেসিয়া। এই ভুলের কথা বা মিথ্যা দাবির কথা আল্লাহতালা ১৪০০ বছর আগেই কোরআনে সুরা মরিয়মে (উপরে দেয়া হয়েছে) উল্লেখ করেছেন। যে ভুল বা মিথ্যা দাবি খ্রিস্টানরা আবিষ্কার করেছে অনেক পরে। তারা এখন সমালোচনা এড়ানোর জন্য তাদের গ্রন্থকে সংশোধন করেছে।
খ্রিস্টান বাইবেলের অসঙ্গতির সংখ্যা অনেক। আমি কিছু উদাহরণ দিয়েছি মাত্র। আল্লাহর কিতাব হোলে একটি অসঙ্গতিও থাকার কথা না। সর্বোপরি বলা যায় যে বর্তমান বাইবেল আসলে আল্লাহর নাজিলকৃৎ ইঞ্জিল কিতাব না। বর্তমান খ্রিস্টান বাইবেল হোল কয়েকজন লেখক কর্তৃক লিখিত খ্রিস্টান ধর্ম, জিশু ও ঈশ্বর সংক্রান্ত বয়ান। অনেকেই মনে করে যে কোরআনে যে ইঞ্জিল কিতাবের কথা বলা হয়েছে সেই কিতাব আর বর্তমান বাইবেল একই কিতাব। আসলে তাদের ধারণা ভুল। যদিও খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারকরা মুসলমানদের আকৃষ্ট করার জন্য তাদের বাইবেলের বাংলা অনুবাদে বাইবেলকে ইঞ্জিল কিতাব বলে থাকে।
সুত্র -
https://d1.islamhouse.com/data/en/i
https://www.ghanaweb.com/GhanaHomePage/NewsArchive/50-000-Errors-and-Biblical-contradictions-190303h_books/single/en_Is_The_Bible_Gods_Word.pdf
https://en.wikipedia.org/wiki/Ellen_G._White
https://d1.islamhouse.com/data/en/ih_books/single/en_Is_The_Bible_Gods_Word.pdf
https://www.biblicaltraining.org/library/william-graham-scroggie?__cf_chl_captcha_tk__=pmd_3f706a541bc98fceb5ee9e7f8f308d2d44b5ecc8-1628135955-0-gqNtZGzNAuKjcnBszQii
https://solidchristianbooks.com/shop/bible-study-books/w-graham-scroggie/
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই আগস্ট, ২০২১ রাত ১০:১০