অনেক অনেক দিন আগে এক দেশে এক গরীব কিষাণ ছিল। কিষাণ আর কিষাণির ঘরে তেমন কিছু না থাকলেও তাদের ঘরকে আলোকিত করে রেখেছিল তাদের একমাত্র মেয়ে ঊর্মিমালা। তরুণী ঊর্মিমালার যেমন ছিল রূপ তেমন তার গুণ। ঊর্মিমালার রূপ আর গুণে মুগ্ধ হয়ে দেশের কত ধনীর দুলাল যে পাগল হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু ঊর্মিমালা গরীব ঘরের মেয়ে হলে কি হবে টাকা-পয়সা, সম্পদের প্রতি তার কোনই লোভ নেই। তার কথা হোল জীবন সঙ্গি হিসাবে আমি শুধু একটা ভালো ছেলে চাই, আর কিছু চাই না। কিন্তু ঊর্মিমালার বাবার কাছে যে প্রস্তাব আসত সেগুলির বেশীর ভাগই ছিল ধনীর বখে যাওয়া দুলাল।
এক কান দুই কান করে ঊর্মিমালার রূপ-গুনের খবর সেই দেশের রাজার কান পর্যন্ত চলে গেল। রাজাটা ছিল খুবই অসৎ চরিত্রের। নিরীহ প্রজাদের সে নির্যাতন আর শোষণ করতো। একজন সুন্দরী রানী থাকা সত্ত্বেও সুন্দরী মেয়ের খবর পেলেই জোর করে তুলে এনে বিয়ে করতো। কয়েকদিন ভোগ বিলাস করার পর ঐ মেয়েগুলিকে সে মেরে ফেলত। ঊর্মিমালার কথা রাজার কানে গেলে সে তৎক্ষণাৎ তার পাইক পেয়াদা পাঠিয়ে দিল ঊর্মিমালার বাবার বাড়িতে। তারা গিয়ে বলল যে রাজা মশাই আপনার মেয়েকে বিয়ে করবেন। দুই দিনের মধ্যে বিয়ের সব বন্দোবস্ত করেন। সব খরচ রাজা মশাই দেবেন।
এই কথা শুনে ঊর্মিমালা আর তার বাবা-মার তো দিশেহারা অবস্থা। ঊর্মিমালা অনেক বুদ্ধিমতি মেয়ে ছিল তাই প্রথমে ঘাবড়ে গেলেও সে পণ করলো যে, যেভাবেই হোক তাকে এই দেশ থেকে পালিয়ে যেতে হবে। বাবা-মাকে না জানিয়েই সে কিছু কাপড় চোপড় সাথে নিয়ে তাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। তাদের বাড়ির কাছেই ছিল একটা গহীন অরণ্য। ঊর্মিমালা মনে মনে ভাবলো এই অত্যাচারী, লম্পট রাজার সাথে বিয়ে হওয়ার চেয়ে জঙ্গলের বাঘের পেটে যাওয়াও অনেক ভালো।
ঊর্মিমালা হাটতে হাটতে ধীরে ধীরে গহীন অরণ্যের মধ্যে ঢুকে গেলো। এদিকে বেলা ডোবার সময় হোল। জঙ্গলে আঁধার নেমে এলো। ঊর্মিমালা ক্লান্তিতে আর ভয়ে একেবারে জড়সড় হয়ে একটা উঁচু গাছের ডালে গিয়ে উঠলো। কোন রকমে সে রাতটা কাটালো অনেকটা জেগে জেগে। ভোর হলে ঊর্মিমালা আবার বনের পথে নিরুদ্দেশভাবে চলা শুরু করলো।
হঠাৎ সে দেখে একটা সুদর্শন ছেলে বনের মধ্য দিয়ে ঘোড়ায় চড়ে যাচ্ছে। ছেলেটা বেশ লম্বা এবং সুঠাম দেহের অধিকারী। ছেলেটা ঊর্মিমালাকে দেখে ঘোড়া থামাল। ছেলেটা ঘোড়া থেকে নেমে ঊর্মিমালাকে বলল যে তুমি এই গহীন জঙ্গলের মধ্যে একা একা কি করছ। ঊর্মিমালা মনে মনে ভাবলো যে এই প্রশ্ন তো আমিও তোমাকে করতে পারি। কিন্তু সে মনের কথা প্রকাশ না করে বলল যে আসলে আমি একটা বিপদে পড়ে এই জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছি।
তখন ছেলেটা বলল যে, তোমাকে দেখে অনেক ক্লান্ত এবং ক্ষুধার্ত দেখাচ্ছে। আমার কাছে কিছু হরিণের মাংসের কাবাব আছে। তুমি এই গাছের নীচে বসে আগে কিছু খাও তারপরে তোমার গল্প শুনবো আবার আমার গল্পোও তোমাকে বলবো। ঊর্মিলার সত্যিই ভীষণ খিদে পেয়েছিল। তাই কোন প্রশ্ন না করে ছেলেটার সাথে একটা বড় গাছের নীচে বসলো। ছেলেটা খুব যত্ন করে ঊর্মিমালাকে খাবার পরিবেশন করলো এবং কাছের একটা ঝর্না থেকে ঊর্মিমালার জন্য পানি নিয়ে এলো।
ঊর্মিমালা খাচ্ছে আর ছেলেটা বলছে যে আমার নাম সাগর। আমি একজন রাজপুত্র। আমি আমার লোকদের নিয়ে বনে এসেছিলাম শিকার করতে। কিন্তু একদল ডাকাত আমার সাথের লোকদের হত্যা করে এবং আমাকে বন্দি করে। আমি অনেক কষ্টে তাদের কাছ থেকে পালিয়ে এসেছি। কিন্তু এখন এই গহীন অরণ্যে দিক ঠিক করতে না পেরে আমার দেশের পথ খুঁজে পাচ্ছি না।
ঊর্মিমালা বলল যে তাহলে তো আমাদের এই জঙ্গলের মধ্যেই মনে হয় বাকি জীবন কাটিয়ে দিতে হবে। এরপর ঊর্মিমালা তার নিজের জীবনের কাহিনী রাজপুত্র সাগরকে খুলে বলল। সাগর বলল যে চিন্তা করো না আমরা যদি চেষ্টা করি তাহলে নিশ্চয়ই এই জঙ্গল থেকে বের হওয়ার একটা পথ আমরা পাবো। তুমি তো আর তোমার দেশে যেতে পারবে না বরং এক কাজ করো তুমিও আমার সাথে আমার দেশে চল। আমি আমার বাবা মার সাথে তোমার পরিচয় করিয়ে দেবো।
ঊর্মিমালা বলল তুমি আমাকে মাফ কর। আমি এক রাজার হাত থেকে পালিয়ে এসেছি। এখন আবার আরেক রাজার হাতে পড়তে চাই না। তখন সাগর বলল
- ঊর্মিলা, রাজা মানেই কি খারাপ? তুমি আমার বাবা মাকে দেখলে তোমার ভুল ভাঙ্গবে।
- আমি বলছি না সব রাজাই খারাপ। কিন্তু আমি তো একজন গরীব কিষানের মেয়ে।
- তোমাকে দেখেই আমি বুঝেছি, তুমি একটা ভালো মেয়ে। তোমার বাবা কিসান হয়েছে তো কি হয়েছে।
- ঠিক আছে সবই বুঝলাম। আগে বন থেকে বের হবার পথ তো খোঁজো। তারপর দেখা যাবে।
ঊর্মিমালা বলল আমরা কতদিন এই বনে থাকবো তা তো কেউই আমরা জানি না। আসো আমরা আগে থাকার জন্য একটা ছোট ঘর বানাই। রাজপুত্র বলল যে এটা তুমি একটা ভালো কথা বলেছো। আমি এখনই কাঠ কাটতে যাচ্ছি। ঊর্মিমালা বলল যে তুমি একা যাবে, আমিও তোমাকে সাহায্য করতে চাই। রাজপুত্র বলল যে ঠিক আছে তবে দুজনে মিলেই আমরা একটা ছোট ঘর বানাবো।
অনেক কষ্ট করে ঊর্মিমালা আর সাগর বনের কাঠ, পাতা, লতা এইসব দিয়ে একটা ঘরের মতো বানাল। একটা গাছের উপরে তারা এই ছোট ঘরটা বানালো যেন বাঘ, ভাল্লুক থেকে বাঁচা যায়। দুইজনে এই ছোট ঘরটা বানাতে পেড়েই মহাখুশি। ওদের দুইজনেই তখন ভীষণ ক্লান্ত ছিল। তাই কখন যে তারা ঘুমের কোলে ঢলে পড়েছে নিজেরাও জানে না।
বেলা পড়লে ওদের ঘুম ভাংলো। রাজপুত্র বলল যে আমি কিছু শিকার করে নিয়ে আসি। তারপর আমরা আগুনে পুড়িয়ে কাবাব বানিয়ে খাব। ঊর্মিমালা বলল যে ঠিক আছে যাও কিন্তু সাবধানে থেকো। সাগর বলল যে তুমিও কিন্তু সাবধানে থেকো। আর আমি না আসা পর্যন্ত নীচে নেম না। রাজপুত্র একটা হরিণ শিকার করে নিয়ে আসল। চকমকি পাথর জ্বেলে ওরা আগুন জ্বালাল। এদিকে রাত হয়ে গেছে। হরিণের মাংসের কাবাব খেয়ে নিলো ওরা। খেয়ে দেয়ে ওরা কিছুক্ষন গল্পগুজব করে ছোট ঘরটার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়লো।
হঠাৎ কাদের কথায় যেন মাঝরাতে ঊর্মিমালার ঘুম ভেঙ্গে গেলো। সে কানপেতে শোনার চেষ্টা করলো। আসলে ঐ গাছে এক জোড়া ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমি বাস করতো। ওরাই কথা বলছিল। ঊর্মিমালা রাজপুত্রকে জাগাল। ওরা দুইজনে কানপেতে ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমীর কথা শুনতে লাগলো। পাখি দুটি বলছে ;
ব্যাঙ্গমা - দেখেছ রাজপুত্র আর ঊর্মিমালাকে কেমন মানিয়েছে।
ব্যাঙ্গমি – তা তো ঠিক। কিন্তু ওরা তো পথ খুঁজে পাচ্ছে না।
ব্যাঙ্গমা – বন থেকে বের হওয়ার পথ হোল প্রথম উত্তরে গেলে একটা পাহাড় পড়বে। পাহাড় পার হওয়ার পর একটা ঝর্না পড়বে। ঝর্না পার হলেই একটা লাল রঙের মাটির রাস্তা আছে। এই আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে ওরা যদি সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত চলে তাহলেই রাজপুত্রের দেশে পৌঁছে যাবে।
ব্যাঙ্গমি – যাক! ওরা নিশ্চয়ই পথ খুঁজে পাবে।
ঊর্মিমালা আর রাজপুত্র সাগর পাখি দুটির কথা শুনে খুব আনন্দিত হোল। মনের আনন্দে গল্প করতে করতে ওরা বাকি রাত পার করে দিল।
ভোরে উঠেই ওরা কোন রকমে কিছু খেয়ে নিয়ে ওদের পথ খুজতে বের হোল। ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমীর কথা মতো দুই দিনের পথ পার হয়ে ওরা বনের একেবারে প্রান্তে চলে এলো। বনের কাছে কিছু ঘর বাড়ি ছিল। সাগরদের প্রজা ওরা। রাজপুত্রকে চিনতে পেরে ওরা ঊর্মিমালা এবং রাজপুত্রকে নিয়ে রাজবাড়িতে পৌঁছে দিল। সাগরকে পেয়ে রাজা আর রানী তো মহা খুশি। ওদেরকে প্রথমে ভালো মতো খাওয়ানো হোল। তারপর বিশ্রামের ব্যবস্থা করা হোল।
কিন্তু ওদের সুখ অল্প সময় পরেই দুঃখতে রুপান্তরিত হোল। পরের দিন সকালে রাজপুত্র তার বাবা আর মাকে বলল যে সে ঊর্মিমালাকে ভালোবাসে এবং তাকে বিয়ে করে রাজবাড়িতে বউ হিসাবে রাখতে চায়। এই কথা শোনা মাত্র রাজা আর রানীর মুখ কালো হয়ে গেলো। কারণ সাগর তার আগেই ঊর্মিমালার বাবা, মা আর পরিবার সম্পর্কে তাদেরকে বলেছিল।
রাজা মশাই বললেন ;
রাজা - এই বিয়ে কখনই হতে পারে না। আমার ছেলের বিয়ে কি না হবে এক চাষার মেয়ের সাথে। অসম্ভব!
রানী – সাগর, আমাদের রাজকীয় খান্দানে শুধু রাজ পরিবারের মেয়েরাই কনে হিসাবে আসতে পারে।
রাজপুত্র – বাবা এবং মা তোমরা কেন বুঝতে চাচ্ছ না যে ঊর্মিমালা একটা ভালো মেয়ে। ওরা গরীব হতে পারে কিন্তু তাই বলে ওদের এভাবে অবজ্ঞা করা তোমাদের ঠিক হচ্ছে না।
এইভাবে অনেক সময় পর্যন্ত বাক বিতণ্ডা চলার পর রাজপুত্র বলল যে ঠিক আছে তোমরা যেনে রাখ ঊর্মিমালাকে যদি আমি বিয়ে না করতে পারি তাহলে আমি এই দেশে আর থাকবো না। রাজ সিংহাসনেরও আমার দরকার নাই। আমি এখনই ঊর্মিমালাকে নিয়ে চলে যাচ্ছি। ঊর্মিমালা আড়ালে দাড়িয়ে এতক্ষন ওদের কথা শুনছিল। সে আড়াল থেকে বের হয়ে রাজপুত্রকে বলল যে, হে মহামান্য রাজপুত্র আপনি আবেগ প্রবণ না হয়ে আপনার বাবা ও মার কথা মেনে নেন। আমি এখনই এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছি। আমার কারণে আপনাদের মধ্যে ঝগড়া- বিবাদ হোক এটা আমি চাই না।
ঊর্মিমালা অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে রাজবাড়ি থেকে বের হয়ে গেলো। রাজপুত্রও দেরী না করে ঊর্মিমালার পিছু পিছু গেল এবং এক সময় তাকে ধরে ফেলল।
রাজপুত্র – ঊর্মিমালা, তুমি যদি এখন চলে যাও তাহলে কিন্তু আমি আমার তরবারি দিয়ে আঘাত করে নিজেকে শেষ করে দেবো।
ঊর্মিমালা – রাজপুত্র আপনি এভাবে করবেন না। আমি চলে যাচ্ছি। আপনি আপনার বাবা মার পছন্দ মতো একটা রাজকুমারীকে বিয়ে করে নিবেন। জীবন ছেলেখেলা না।
রাজপুত্র – ঊর্মিমালা, তুমি আমাকে এ কি বলছ। তুমি কি মনে কর তোমাকে ছেড়ে আমি অন্য কোন মেয়েকে বিয়ে করে সুখী হতে পারবো?
ঊর্মিমালা – রাজপুত্র, আমি আপনাদের যোগ্য নই। আমি আপনার ভালোর জন্যই বলছি।
রাজপুত্র – যে জীবনে ঊর্মিমালা থাকবে না সেই জীবন কখনই ভালো হতে পারে না। আমি এখনই নিজেকে শেষ করে দিচ্ছি।
ঊর্মিমালা দ্রুত রাজপুত্রের হাত থেকে তরবারি কেড়ে নিল আর বলল;
- রাজপুত্র আমার মত একটা কিষাণির মেয়ের জন্য আপনি কেন জীবন দিবেন। আমিই বরং জীবন দিয়ে দিচ্ছি।
এই বলে তলোয়ার দিয়ে সে নিজেকে আঘাত করতে উদ্যত হোল। কিন্তু রাজপুত্র নিমিষেই তলোয়ার তার হাত থেকে কেড়ে নিল।
রাজপুত্র বলল – ঊর্মিমালা চল না আমরা আবার আমাদের বনের ঘরটাতে চলে যাই।
ঊর্মিমালা – রাজপুত্র তুমি কি পারবে সেই ছোট্ট ঘরে থাকতে আমার সাথে। তোমার কষ্ট হবে না তো। আমি তো কিষাণির মেয়ে আমার কোন কষ্ট হবে না।
রাজপুত্র – ঊর্মিমালা, তোমাকে পেলে পৃথিবীতে কোন কষ্টই আমার কাছে কষ্ট না।
তাদের দুজনের চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগলো। রাজপুত্র ঊর্মিমালাকে বাহুডোরে আবদ্ধ করলো। রাজবাড়ির দিকে শেষ বারের মত একবার তাকিয়ে ওরা দুজনে দুজনার কাঁধে হাত রেখে বনের পথ ধরলো।
দুজনে যখন একসাথে আছে কোন কষ্টই তাদের কাছে আর কষ্ট না। সুখে থাকুক ওরা।
ছবি - cydaru.wordpress.com