somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আলোর গতির চেয়েও দ্রুত গতিতে মহাশূন্য প্রসারিত হচ্ছে

২৪ শে আগস্ট, ২০২১ দুপুর ১:৫৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


আলবার্ট আইনস্টাইন ১৯০৫ সালে তার বিশেষ আপেক্ষিকতা থিউরিতে উল্লেখ করেন যে আলোর গতির চেয়ে অধিক গতিশীল কোন বস্তু, শক্তি বা তথ্যবাহী সঙ্কেতের কোন অস্তিত্ব থাকা সম্ভব না। বিজ্ঞানীদের পরিমাপকৃত আলোর গতি হোল প্রায় সেকেন্ডে ৩ লক্ষ কিলোমিটার। অর্থাৎ এই মহাবিশ্বে এই গতির চেয়ে অধিক গতিশীল কোন কিছু নাই।

কিন্তু আমরা জানি যে ১৩.৮ বিলিয়ন বছর আগে ঘটা বিগ ব্যাঙের পর থেকে এই মহাবিশ্ব ক্রমাগত প্রসারিত হচ্ছে। ফলে গালাক্সিগুলি একে অন্যের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। বিজ্ঞানীরা হিসাব করে দেখেছেন যে গ্যালাক্সিগুলি আলোর গতির চেয়েও দ্রুত গতিতে একে অন্যের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। কিন্তু আমি আগেই উল্লেখ করেছি যে আলোর গতির চেয়ে অধিক গতিশীল কোন কিছু নাই। তাহলে গ্যালাক্সিগুলির এই দূরে সরে যাওয়াকে কিভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে? বিজ্ঞানীরা অনেক গবেষণা করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে আসলে গ্যালাক্সিগুলির নিজস্ব গতি আলোর গতির ২% এর বেশী না। তাহলে কেন এরা আলোর গতির চেয়ে অধিক গতিতে দূরে সরে যাচ্ছে?

বিজ্ঞানীরা পর্যবেক্ষণ ও বিভিন্ন গবেষণা থেকে প্রমাণ পেয়েছেন যে আসলে এই মহাশূন্যের যে ফাঁকা জায়গা, সেই ফাঁকা জায়গাটাই অনেকটা বেলুনের মতো প্রসারিত হচ্ছে এবং মহাশূন্যের আকার বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই ফাঁকা জায়গা (space) এতো দ্রুত প্রসারিত হচ্ছে যে এর মধ্যে অবস্থিত গ্যালাক্সিগুলিকে মনে হচ্ছে যেন এরা আলোর গতির চেয়ে দ্রুত গতিতে একে অন্য থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। মহাবিশ্বকে যদি একটা বিশাল বেলুনের সাথে তুলনা করা যায় তাহলে বলা যায় যে এই বেলুনটা মুলত বড় হচ্ছে। বেলুনের মধ্যে অবস্থিত গ্যালাক্সিগুলির মধ্যে দূরত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে এই প্রসারনের কারণে। বেলুনের ভিতরে ফাঁকা জায়গার পরিমান বৃদ্ধি পাচ্ছে। গ্যালাক্সিগুলির গতির কারণে কিছুটা দূরত্ব বৃদ্ধি হচ্ছে বটে তবে মূল কারণ বেলুনের সম্প্রসারণ যার দ্বারা বেলুনের ভিতর নতুন স্পেস তৈরি হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে গ্যালাক্সিগুলি আলোর গতির চেয়ে অনেক কম গতিতে দূরে সরে যাচ্ছে কিন্তু গ্যালাক্সিগুলির মধ্যে এতো দ্রুত নতুন স্পেস তৈরি হচ্ছে যে আমাদের কাছে মনে হচ্ছে যে গ্যালাক্সিগুলি আলোর গতির চেয়ে দ্রুত গতিতে চলছে। এই স্পেসের গতি আলোর গতির চেয়ে বেশী। এই আবিষ্কারটার ছিল যুগান্তকারী। নচেৎ আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিকতার থিউরির সাথে এই ঘটনা ( গ্যালাক্সিগুলির দূরে সরে যাওয়ার গতি) সংঘর্ষ তৈরি করতো।


বিগ ব্যাঙের পর থেকেই স্পেসের এই সম্প্রসারণ শুরু হয়েছে এবং এই সম্প্রসারনের গতিও ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে এখন অনেক দূরবর্তী গ্যালাক্সির আলো কখনও পৃথিবীতে পৌঁছাবে না। কারণ গ্যালাক্সি থেকে আলো পৃথিবীর দিকে আসছে আলোর গতিতে কিন্ত আমাদের গ্যালাক্সি আলোর চেয়েও অধিক গতিতে অন্য দিকে সরে যাচ্ছে। যদিও ঐ গ্যালাক্সির আলো আগে পৃথিবীতে পৌঁছত। কারণ তখন মহাশূন্যের সম্প্রসারণের গতি কম ছিল।

১৩.৮ বিলিয়ন বছর আগে ঘটা বিগ ব্যাঙের পর এক সেকেন্ডের একটি অতি ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ সময় ( একের পরে ৩২ টা শুন্য বসালে যে সংখ্যা পাওয়া যায় সেই সংখ্যা দিয়ে সংখ্যা ১ কে ভাগ করলে যে ভগ্নাংশ সেকেন্ড পাওয়া যায় তার সমান) অতিবাহিত হলে হঠাৎ এই মহাবিশ্ব ক্ষুদ্র অবস্থা থেকে কল্পনাতীত আকৃতিতে প্রসারিত হয়। এই সম্প্রসারণের তুলনা করা যায় এক ন্যানো মিটার ( একের পরে ৯ টা শুন্য দিলে যে সংখ্যা পাওয়া যায় সেই সংখ্যা দিয়ে সংখ্যা ১ মিটারকে ভাগ করলে যে ভাগফল পাওয়া যায়) দৈর্ঘ্যের একটি লাঠিকে ১০.৬ আলোক বর্ষের (১০.৬ বছরে আলো যে দূরত্ব অতিক্রম করে) সমান লম্বা করার সাথে। এই সম্প্রসারণের সময় থেকে শুরু করে পরবর্তী ৯.৮ বিলিয়ন বছর পর্যন্ত মহাবিশ্ব অপেক্ষাকৃত ধীর গতিতে প্রসারিত হয়েছে। বিগত ৪ বিলিয়ন বছর ধরে এই সম্প্রসারণের গতি ছিল পূর্বের চেয়ে বেশী এবং ক্রমাগতভাবে সম্প্রসারণের এই গতি বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই সম্প্রসারণের গতি আলোর গতির চেয়েও বেশী।

মহাবিশ্বের দূরবর্তী গ্যালাক্সিগুলি নিকটবর্তী গ্যালাক্সির চেয়ে অধিক দ্রুত দূরে সরে যাচ্ছে। আইনস্টাইন ১৯১৫ সালে যখন তার সাধারণ আপেক্ষিকতার থিউরি প্রকাশ করেন তখন কেউ জানত না যে মহাবিশ্ব ক্রমাগত প্রসারিত হচ্ছে। আইনস্টাইনও তার এই থিউরিতে ধরে নেন যে মহাবিশ্ব স্থির অবস্থায় আছে। তৎকালীন এই ভুল ধারনার কারণে তিনি একটা ধ্রুবক তার থিউরিতে ব্যবহার করেন, যার নাম কসমোলজিক্যাল ধ্রুবক। পরবর্তীতে ১৯২৯ সালের দিকে হাবল এবং অন্যান্য বিজ্ঞানীরা যখন নিশ্চিত হন যে মহাবিশ্ব আসলে প্রসারিত হচ্ছে তখন আইনস্টাইন বলেন যে তার এই কসমোলজিক্যাল ধ্রুবকটা তার জীবনের সব চেয়ে বড় ভুল ছিল। কারণ এই সম্প্রসারণশীল মহাবিশ্বের ধারণা আবিষ্কারের কারণে ঐ ধ্রুবকের আর প্রয়োজন ছিল না। এই অজানা তথ্যের কারণেই তাকে এই ধ্রুবকটি আনতে হয় যেন তার হিসাবের সাথে পর্যবেক্ষণ লব্ধ তথ্যের মিল হয়।

মহাবিশ্বের এই সম্প্রসারণের ধারণা প্রথম যার মাথায় আসে তার নাম ভেসটো স্লিফার। ১৯১২ সালে সর্পিল গ্যালাক্সি নিয়ে কাজ করতে গিয়ে তার কাছে মনে হয় যে এই গ্যালাক্সিগুলি পৃথিবী থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। কিন্তু তখন তার হাতে কোন প্রমাণ ছিল না। এরপর অ্যালেক্সান্ডার ফ্রিডম্যান ১৯২২ সালে আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা থিউরি নিয়ে কাজ করার সময় ধারনা করেন যে এই মহাবিশ্ব সম্ভবত প্রসারিত হচ্ছে। তিনি কিছু সমীকরণ প্রকাশ করেন যার নাম ‘ফ্রিডম্যান সমীকরন’। ১৯২৭ সালে জর্জ লেমাইত্রিও অনুমান করেন যে মহাবিশ্ব সম্ভবত প্রসারিত হচ্ছে। অবশেষে ১৯২৯ সালে এডউইন হাবল চূড়ান্তভাবে প্রমাণ করেন যে এই মহাবিশ্ব প্রচণ্ড গতিতে প্রসারিত হচ্ছে এবং এই প্রসারনের গতি ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। তিনি একটি ল আবিষ্কার করেন যার নাম ‘হাবল’স ল’। এই ল কে ‘হাবল-লেমাইত্রি ল’ ও বলা হয়ে থাকে। এই ‘ল’ তে হাবল ধ্রুবক বলে একটা সংখ্যা আছে। মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের গতি নির্ণয়ের জন্য এই ‘ল’ এবং ধ্রুবক ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন যে ‘ডার্ক এনার্জি’ নামে এক ধরণের রহস্যময় এনার্জি মহাবিশ্বে আছে যার কারণে মহাবিশ্বের এই প্রসারন ঘটছে। ডার্ক এনার্জি সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা এখনও আরও জ্ঞান অর্জনের চেষ্টা করে যাচ্ছেন। মহাকর্ষের কারণে গ্যালাক্সিগুলির এক অন্যের কাছে আসার কথা কিন্তু এই ডার্ক এনার্জি মহাকর্ষের বিপরীতে কাজ করে এবং মহাবিশ্বের এই প্রসারনের জন্য যে প্রচণ্ড শক্তির প্রয়োজন হয় তার জোগান দিয়ে থাকে বলে ধারণা করা হয়। এই ডার্ক এনার্জি এবং মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ নিয়ে এখনও গবেষণা চলমান এবং নতুন নতুন তথ্য বিজ্ঞানীরা পাচ্ছেন গবেষণা ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে।

ছবি - theexplanation.com, en.wikipedia.org
সুত্র-
forbes.com
Expansion of the universe
Inflation (cosmology)
Hubble's law
Big Bang
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে আগস্ট, ২০২১ রাত ৮:১৬
২০টি মন্তব্য ২০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ডালাসবাসীর নিউ ইয়র্ক ভ্রমণ

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:৪৪

গত পাঁচ ছয় বছর ধরেই নানান কারণে প্রতিবছর আমার নিউইয়র্ক যাওয়া হয়। বিশ্ব অর্থনীতির রাজধানী, ব্রডওয়ে থিয়েটারের রাজধানী ইত্যাদি নানান পরিচয় থাকলেও আমার কাছে নিউইয়র্ককে আমার মত করেই ভাল ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×