প্রথমে নতুন জাতীয় শিক্ষাক্রমের সমালোচনা করার মত বিষয়গুলি দেখি। আমার দৃষ্টিতে নীচের বিষয়গুলি সমস্যা তৈরি করতে পারে।
নেতিবাচক দিকঃ
১। এই শিক্ষা পদ্ধতি ব্যয়বহুল হয়ে যাবে অনেকের জন্য। বিভিন্ন উপকরণ কিনতে অনেক অভিভাবকের কষ্ট হবে। মোবাইল, অন্তরজাল বা কম্পিউটার সুবিধা দরিদ্র বা অনেক মধ্যবিত্ত পরিবার দিতে পারবে না। সরকারকে এই ব্যাপারে চিন্তা করে বিকল্প ব্যবস্থা নিতে হবে।
২। ক্লাস সিক্স বা সেভেনের বাচ্চাদের মোবাইল দেয়াটা ঠিক হবে না। একটা কারণ হলও চোখের উপর চাপ পড়বে। মোবাইল সুবিধা বৈধভাবে পাওয়ার কারণে মোবাইল আসক্তি আরও বাড়বে। ১৬ বছরের আগে মোবাইল না দেয়াই ভালো।
৩। বিজ্ঞান এবং গণিতের বইগুলিতে অনেক অধ্যায় কমিয়ে দিয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে। যদি সত্যি হয় তাহলে এই ব্যাপারটা একটা সমস্যা তৈরি করতে পারে যারা বিজ্ঞান নিয়ে ভবিষ্যতে পড়বে। আন্তর্জাতিকভাবে আমরা মোটামুটি জানি এসএসসি বা এইচএসসি পর্যায়ে বিজ্ঞান এবং গণিতের কি কি বিষয় অবশ্যই জানা উচিত। এসএসসি এবং এইচএসসির বই পড়ে যারা পাস করবে তারা যেন বিশ্বের ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার মত যোগ্যতা অর্জন করতে পারে সেটা নিশ্চিত করা দরকার।
ইতিবাচক দিকঃ
১। মুখস্ত করার একটা বাজে প্রথা যুগের পর যুগ আমাদের দেশে চলে এসেছে। এই প্রথা বন্ধ হওয়া দরকার। ছাত্র জীবনে দেখেছি যে এসএসসি বা এইচএসসির অংক পর্যন্ত অনেকে মুখস্ত করতো। এক অংক ১৪ বার করলে এমনিই অনেকের মুখস্ত হয়ে যেত। অনেকে অংক বুঝতো না কিন্তু বারবার প্র্যাকটিস করার কারণে না বুঝেই অংক মিলিয়ে দিতে পারতো। অংক একটু ঘুরিয়ে দিলে তারা আর পারতো না। অনেক অভিভাবককে দেখেছি যে উচ্চস্বরে না পড়লে বকা দিত বাচ্চাকে। উচ্চস্বরে পড়া মানে সে পড়ছে। নীরবে পড়লে ফাঁকি দিচ্ছে। মুখস্ত অনেক বিষয় করতে হয়। কিন্তু কিছু বিষয় আছে নিজে বুঝে নিজের মত করে লিখতে হয়। আমাদের দেশে এই প্রথা ছিল না। যার কারণে যারা মুখস্ত কম করতে পারতো তারা পরীক্ষায় মার্ক কম পেত।
২। এই পদ্ধতিতে খারাপ ছাত্ররাও লেখাপড়ায় আগ্রহী হয়ে উঠবে। কারণ বইয়ের লেখার চেয়ে দল বেঁধে বা এককভাবে মাথা খাটিয়ে কাজ করার ও বইয়ের পড়াটা বোঝার সুযোগ তারা পাবে। ছাত্র জীবনে দেখেছি যে ক্লাসের অনেক ছাত্র বা ছাত্রী প্রচলিত লেখাপড়ায় ভালো না কিন্তু তাদের সাথে মিশলেই বোঝা যেত যে তাদের মেধা ঠিকই আছে কিন্তু সেটা আমরা বুঝতে পাড়ছি না আমাদের প্রচলিত শিক্ষার মাপ কাঠির কারণে। এই ধরণের খারাপ ছাত্র বা ছাত্রীকে শিক্ষকরা পশুর মত জালি বেত দিয়ে পিটাতো। এটা যে ঐ বাচ্চার জন্য কত ক্ষতিকর সেটা আমরা বুঝি না। পরবর্তী জীবনে দেখেছি যারা ক্লাসে শেষের দিকে থাকতো তারা এখন জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফল। তাই শুধু পরীক্ষার হলের পরীক্ষার মার্ক দিয়ে একজন মানুষের মেধার প্রকৃত মূল্যায়ন হয় না।
৩। আমাদের আগের শিক্ষা পদ্ধতিগুলিতে বাচ্চাদের মানসিক চাপের দিকগুলি খেয়াল করা হয় নাই। এই নতুন শিক্ষাক্রমে বাচ্চারা আনন্দ করতে করতে শিখবে। তাদের মধ্যে টিম ওয়ার্ক করার মন মানসিকতা গড়ে উঠবে। একসাথে ছেলে মেয়ে মিলেমিশে বইয়ের পড়াটাও আনন্দের সাথে শিখবে। শিক্ষকদের চোখ রাঙ্গানির ভয়ে অনেক ছেলে মেয়ে ঝরে পড়ে। সেটা আশা করি কমে যাবে।
৪। ফার্স্ট সেকেন্ড হওয়ার এবং জিপিএ ৫ পাওয়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতা ছোটবেলা থেকেই বাচ্চার মাথায় ঢুকে যায়। এক ধরণের স্ট্রেস বাচ্চার মধ্যে ছোট থেকেই তৈরি হয়। তবে এইট বা নাইন থেকে তাদের মধ্যে ধীরে ধীরে পড়ার চাপ নেয়ার মন মানসিকতা তৈরি করতে হবে। তার আগের ক্লাসগুলিতে এতো বেশী পড়ার চাপ দেয়া ঠিক না।
৫। আগে এসএসসিতে নাইনে যা পড়ানো হয়েছে সেটার উপরও পরীক্ষা দিতে হতো। একইভাবে এইচএসসি প্রথম বর্ষের বই থেকেও এইচএসসি পরীক্ষায় প্রশ্ন আসতো। এখন নাইনের পড়া নাইনে শেষ। কলেজের ফার্স্ট ইয়ারের পড়া ফার্স্ট ইয়ারেই শেষ।
৬। ক্লাস ফাইভ এবং এইটের বোর্ড পরীক্ষা বন্ধ করে ভালো হয়েছে বলে আমার মনে হয়। এতো কম বয়সে বোর্ড পরীক্ষা না হলেও চলে।
আমাদের দেশে ক্যাডেট কলেজ বা ভারতেশ্বরী হোমসের মত আরও কিছু প্রতিষ্ঠানের অনেক সুনাম। এই প্রতিষ্ঠানগুলিতে ক্লাসের পড়াশুনার পাশাপাশি শরীর চর্চা, ফুলের বাগান সবজি বাগান করা, রান্না করা, মাঠের ঘাস কাটা, ময়লা পরিষ্কার করা, শখের কাজ করা, ঘর ঝাড়ু দেয়া, ঘর মোছা, বিছানা তৈরি করা, নিজের কাপড় ধোয়া সেলাই করা ইত্যাদি ছোট বয়স থেকেই শেখানো হয়। কোন অভিভাবক এগুলির বিরুদ্ধে কিছু বলেছে বলে শুনি নাই। আমাদের জাতীয় শিক্ষাক্রমে এগুলি পুরোপুরি আনতে পারবে না সেটা ঠিক। কারণ আবাসিক ব্যবস্থা না হলে সব কিছুর ব্যবস্থা করা সম্ভব না। তারপরও কিছু চেষ্টা করা হয়েছে নতুন শিক্ষাক্রমে। মূল লেখাপড়ার পাশাপাশি খুব সামান্য সময়েই এই কাজগুলিতে ব্যয় করতে হবে। কিন্তু বিভিন্ন মিডিয়া দেখলে মনে হচ্ছে এরা লেখাপড়াই করছে না। সঠিক তথ্য মিডিয়াতে আসা উচিত। নতুন শিক্ষাক্রমের সাথে সম্পর্ক নেই এমন অনেক অপ্রাসঙ্গিক ভিডিও ইউটিউবে দেখা যাচ্ছে। জাতীয় শিক্ষাক্রম বোর্ডের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেছেন হাসের ডাক অনুকরণের ভিডিওটা গণিত অলিম্পিয়াডের, ব্যাঙের লাফের ভিডিওটা স্কাউটিং ট্রেনিংয়ের এবং কিরিং কিরিং সাইকেলের ভিডিওটা আসামের এক শিক্ষকের। এই শিক্ষাক্রমে পরীক্ষা নেই এই কথাও ভুল। পরীক্ষাও আছে।
এই শিক্ষাক্রমের ভালো খারাপ দুইটাই আছে। খারাপগুলি সংশোধনেরও সুযোগ আছে। কিন্ত আমরা কোন বড় পরিবর্তন আসলে মানতে চাই না। আশা করি সরকার এই শিক্ষাক্রমের ত্রুটিগুলি সংশোধন করবে, মানুষের আর্থিক সামর্থ্যের ব্যাপারটা নিয়ে ভাববে এবং মূল লেখাপড়ার মান যেন কমে না যায় সেটা নিশ্চিত করবে।