মা বাবার কথা মনে পরে না হুসনেয়ারার।
ছোটবেলা থেকেই ফুপুর কাছে থাকে সে।
বয়স মাত্র তের হলেও বুঝতে শিখেছে অনেক কিছু।
কে তাকে কিভাবে দেখে সেটা সে খুব ভালো করেই বুঝতে পারে।
এইতো সেদিন তার ফুপার ছোট ভাই তাহের তার মুখ চেপে ধরেছিল, বড় ঘরের পিছনে নিয়ে গিয়ে মাটিতে ফেলে চেপে বসেছিল উপরে।
হুসনেয়ারার দম প্রায় বন্ধ হয়ে আসছিল কিন্তু হঠাৎ করে তাহের তাকে ছেড়ে দিয়ে লাফিয়ে সরে যায় সাথে বলে উঠে 'মাগো'।
হুসনেয়ারা জানে না সেদিন তাহেরের কি হয়েছিল।
সে ওমন করে লাফিয়ে উঠে মাগো বলে চিৎকার দিয়েছিল কেন।
তবে ভালই হয়েছে, তার পর থেকে তাহের তার আসেপাশেই আর আসে না।
পাড়ার অনেক ছেলেই তার দিকে কেমন কেমন করে যেন তাকায়।
হুসনেয়ারা আগে জানতো না তারা কেন ওভাবে তাকায় কিন্তু এখন জানে।
পাশের বাড়ির মিলি আপুর কাছে থেকে সে শুনেছে।
হুসনেয়ারা দেখতে অনেক সুন্দরি তো তাই নাকি ছেলেরা ওভাবে তাকায়।
হুসনেয়ারা স্কুলে যায় না তবে বাড়ির কাজের ফাঁকে মিলি আপুর কাছ থেকে একটু আদটু করে লেখাপড়া শিখেছে।
মিলি আপু বলেছে 'হুসনেয়ারা, তোর মাথাটা পরিষ্কার,খুব সহজেই সব শিখে ফেলতে পারবি।
মিলি আপুর বয়স পনেরো বছর।
সে দশম শ্রেণীতে পড়ে।
এখন মিলি আপুর বই এর অঙ্কগুলোকে হুসনেয়ারার কাছে ডালভাতের মত মনেহয় কিন্তু সে মিলি আপুকে বলেনি।
কেউ একজন তার ভিতর থেকে বাঁধা দিয়েছে বলতে।
হুসনেয়ারাকে ফুপুর বাড়িতে নানা কাজ করতে হয়।
সকালে উঠে উঠোন ঝাড়ু দেয়া তারপর থালা বাসন ধোয়া, রান্নার জন্য পানি নিয়ে দেয়া, ফুপুর নির্দেশ মত
তরকারি কেটে দেয়া আরো কত কি।
তবে রান্নাটা ফুপু নিজে করেন কেননা ফুপুর হাতের রান্না আবার ফুপার অনেক পছন্দের।
হুসনেয়ারার দিন স্বাভাবিক ভাবেই চলছিল কিন্তু একদিন সঁন্ধ্যার পরে পাশের ঘর থেকে ফুপা ফুপুর কথা শুনে তার মনের ভিতর ওলোট পালোট হয়ে গেলো।
হুসনেয়ারা শুনতে পেলো তার ফুপা ফুপু তর্ক করছেন তাকে নিয়ে।
ফুপু বলছেন,
- এই ছোট্ট মেয়েটিকে তুমি বিয়ে দিতে চাও তা আবার ওই বুড়ো লোকটার সাথে? ছিঃ টাকার জন্য তুমি এত নিচে নামতে পারো
আমার জানা ছিল না।
ফুপা বললেন,
- আমি বারেক মিয়াকে কথা দিয়েছি।
কালকেই বিয়ে হবে, বেচারার বৌ মারা গেছে, ওইখানে হুসনেয়ারা সুখেই থাকবে। আর বুড়ো বলছো কেন?
কতই আর বয়স হবে বারেক মিয়ার চল্লিশ কি পয়্তাল্লিশ।
ফুপু বললেন,
- বুড়ো বলব না তো কি জোয়ান বলব?
বারেক মিয়ার মেয়ের বয়স ও তো হুসনেয়ারার চেয়ে বেশি।এতই যদি ভাল হয় তাহলে নিজের মেয়ে জরিনাকে দাও না বিয়ে।
ফুপা রেগে গিয়ে বললেন,
- বেশি কথা বলবা না।
তাহলে তোমার কপালেও খারাবি আছে।
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে হুসনেয়ারা দেখলো তার ফুপু উঠোন ঝাড়ু দিচ্ছেন।
সে এগিয়ে গেলে ফুপু বললেন তাকে ঘরে যেতে।
এভাবেই সারাদিন তাকে কোন কাজ করতে দেয়া হলো না।
সঁন্ধ্যায় আসেপাশের বাড়ি থেকে কিছু মহিলা আসল।
মিলি আপুও আসল
বলল,
- তুই বড় দুঃখীরে।
তারপর কানে কানে বলল,
- পালাবি?
হুসনেয়ারা মাথা ডানে বামে নাড়ালো,
সে পালাবে না।
মিলি আপু আর কিছু বলল না শুধু হুসনেয়ারার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো।
হুসনেয়ারার চেহারায় দুঃখের কোন ছাপ নেই,
হাসি হাসি মুখ।
হাসি মুখ থাকবেই তো,
জীবনের প্রথম ফুপা ফুপু সহ বাড়ির সব মানুষ তাকে এত আদর করছে আর তখন কি গোমড়া মুখে থাকা যায়?
রাতে যখন বিয়ের জন্য তার মতামত নিতে আসলেন কাজী সাহেব আর তাকে কবুল বলতে বললেন কিছু বলতে পারলো না ও, শুধু অবাক হয়ে কাজীর দিকে তাকিয়ে রইল।
এর মাঝেই কানে তিনবার কবুলের শব্দ আসল পিছন থেকে।
কে যেন তার মাথার পিছনে মুখ নিয়ে গিয়ে কবুল বলল।
বিয়ের সব কাজ শেষে বিদায় দেয়ার সময় হুসনেয়ারার ফুপু অনেক কান্নাকাটি করলেন।
কিন্তু হুসনেয়ারা স্বাভাবিক রইল কারণ, সে জানে তার কিছুই হবে না আর এই কথাটি গতরাতে তাকে কেউ একজন বলেছে।
সেই কেউ একজন টা কে সেটা হুসনেয়ারা জানে না।
বারেক মিয়ার বাড়ি আর তার ফুপার বাড়ি পাশাপাশি গ্রামে।হুসনেয়ারাকে বারেক মিয়ার বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হলো।
কিছু বয়ষ্ক পুরুষ মহিলাকে সালাম করতে হলো তার।
তারপর তাকে একটি ঘরে ফুল দিয়ে সাঁজানো বিছানায় বসিয়ে দেয়া হলো।
কিছুক্ষণ বসে থাকার পর একটি মেয়ে ঢুকলো ঘরে।
মেয়েটি কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থেকে তাকে ছোট মা বলে ডাকলো।
সব কিছুই অবাক লাগছে হুসনেয়ারার কাছে কারণ, মেয়েটি তার পরিচিত।
মেয়েটির নাম কুলসুম, হুসনেয়ারা তাকে কুলসুম বু বলে ডাকতো।
কুলসুম এক বছর আগেও মাঝে মাঝেই তাদের গ্রামে গোল্লাছুট খেলতে যেত,
এখন আর যায় না।
কিন্তু, কুলসুম বু তাকে ছোট মা বলে ডাকছে কেন সেটাই সে বুঝতে পারছে না।
কুলসুম কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থেকে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
আর তার কিছুক্ষণ পর ঘরে ঢুকলো এক লোক।
লোকটা মোটাসোটা, গায়ের রং শ্যামা আর মুখের উপর মোটা একখানা গোঁফ।
এই লোকটার নামই কি বারেক মিয়া?
আর এর মেয়েই কি কুলসুম বু?
সেজন্যই কি তাকে কুলসুম বু ছোট মা ডেকেছিল, আচ্ছা এখানে আমার বদলে যদি কুলসুম বু বসে থাকতো তাহলে এই গোঁফ ওয়ালা লোকটা কি করতো?
এসবই ভাবছে হুসনেয়ারা।
হঠাৎ তার ভাবনা বন্ধ হল বারেক মিয়ার চিৎকারে।
বারেক মিয়া রাহেলা রাহেলা বলে চিৎকার করছে।
ঘরে ঢুকলো এক মহিলা।
বারেক মিয়া চিৎকার করেই বললো,
- রাহেলা, এটা ফাজলামি করার কোন বিষয়?
বাসর ঘরে বৌ না রেখে আমার মেয়েরে রাখছস ক্যান?
রাহেলা একবার খাটের দিকে তাকালো তারপর বলল,
- কি বলছো ভাইজান, ঐ তো তোমার নতুন বৌ হুসনেয়ারা।
বারেক মিয়া চিৎকার করে ধমক দিল রাহেলাকে।
তারপর গরম চোকে হুসনেয়ারার দিকে তাকিয়ে বলল,
- এই মাইয়া এইখানে বইসা রইছস ক্যান? যা বাইরে যা।
একেবারে মূল গেটের বাইরে দাড়ায়া থাকবি।
ঐ রাহেলা ওরে নিয়া গেটের বাইরে রাইখা আয় আর শোন, কেউ যাতে ওর পাশে না থাকে।
ওরে আইজ আমি ভূত দিয়া খাওয়ামু।
ওরে রাইখা আইসা আমার বৌ রে ঘরে দিয়া যাবি।
মেলা ট্যাকা দিয়া বিয়া করছি।
রাহেলা ভাইকে জমের মত ভয় পায়। তাই সে ভবিষ্যৎ না ভেবে হুসনেয়ারাকে গেটের বাইরে রেখে গেল।
কেউ নেই এখানে, এখন কি করতে হবে জানে হুসনেয়ারা।
নদীর পাড়ে যেতে হবে, নদীতে নৌকা থাকলে ভাল আর না থাকলে সাঁতরে পার হতে হবে।
তারপর স্টেশনে গিয়ে ভোরের ট্রেন ধরতে হবে।
শহরে গিয়ে কি হবে সেটা জানে না হুসনেয়ারা,
তবে তাকে যেতেই হবে এখান থেকে।
সে দৌড়াচ্ছে, দৌড়াতে দৌড়াতে শুনতে পেলো বারেক মিয়া চিৎকার করে গালি দিচ্ছে তার বোনকে।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ রাত ৮:৩২